আমরা দেখেছি যে, সত্য ও মিথ্যার সংঘাতের সবচেয়ে বড় বিষয় তাওহীদ ও শিরকের সংঘাত। যুগে যুগে নবী-রাসূলগণ মানুষদেরকে তাওহীদের পথ দেখিয়েছেন। শয়তান ও তার অনুসারিগণ সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়েছে আবার তাদেরকে শিরকের মধ্যে নিপতিত করতে। মানবীয় দুর্বলতা, তাওহীদ সম্পর্কে অজ্ঞতা, ওহীর জ্ঞান সম্পর্কে অজ্ঞতা ইত্যাদি বিষয় মুমিনকে শয়তানের ক্ষপ্পরে পড়তে সাহায্য করেছে।
তাওহীদের বিশ্বজনীন, সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ দাওয়াত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দাও‘আত। কুরআন ও সুন্নাহে তাওহীদকে সমুন্নত রাখার ও শিরক-কুফর প্রতিরোধ করার সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে আমরা দেখেছি। কিন্তু শয়তানের প্রচেষ্টা তাতে থেমে যায় নি। শয়তান তার অনুসারীদের নিয়ে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে শিরক-কুফর প্রবেশ করাতে। বিশেষ করে যখনই কোনো মুসলিম ব্যক্তি বা সমাজ কুরআন ও সহীহ হাদীসের জ্ঞান থেকে দূরে সরে গিয়েছে তখনই শয়তানের প্রচেষ্টা তাদের মধ্যে কিছুটা হলেও সফলতা লাভ করেছে।
বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর উম্মাতকে সতর্ক করেছেন যে, পূর্ববর্তী উম্মাতগুলি যেমন বিভ্রান্ত হয়েছে, তাঁর উম্মাতের মধ্যেও অনুরূপভাবে একই প্রকৃতির বিভ্রান্তি প্রবেশ করবে। এ বিষয়ক কিছু হাদীস আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি। এ বিষয়ক অনেক হাদীস আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে দেখতে পাব, ইনশা আল্লাহ। এ সকল হাদীস থেকে সুনিশ্চিতভাবে জানা যায় যে, ইহূদী, খৃস্টান, পারস্যের অগ্নি-উপাসক ও অন্যান্য বিভ্রান্ত জাতি যেভাবে আসমানী হেদায়াত পাওয়ার পরেও শিরক-কুফর ও বিভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত হয়েছিল অবিকল সেভাবে মুসলিম উম্মাহর অনেকে শিরক-কুফর ও বিভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত হবে। পার্থক্য এই যে, মুসলিম উম্মাহর মূল দীন বিনষ্ট হবে না, মহান আল্লাহ এর মূল উৎস কুরআন ও সুন্নাহকে বিশুদ্ধভাবে হেফাযত করবেন এবং উম্মাতের মধ্যে কিছু মানুষ সর্বদা হক্কের উপর থাকবেন, যারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবীগণের সুন্নাত হুবহু অনুসরণ করবেন।
আমরা দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর উম্মাতকে শিরক থেকে সতর্ক থাকতে বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। পিপিলিকার পদচারণার মত সন্তর্পনে তা মুমিনের হৃদয়ে প্রবেশ করতে পারে বলে তিনি সতর্ক করেছেন। এমনকি মুর্তিপূজার মত বিষয়ও তাঁর উম্মাতের মধ্যে ঘটবে বলে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
لا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى تَضْطَرِبَ أَلَيَاتُ نِسَاءِ دَوْسٍ حَوْلَ ذِي الْخَلَصَةِ وَكَانَتْ صَنَمًا تَعْبُدُهَا دَوْسٌ فِي الْجَاهِلِيَّةِ بِتَبَالَةَ
‘‘কিয়ামতের পূর্বেই দাওস গোত্রের নারীদের নিতম্ব ‘যুল খালাসাহ’-র আশেপাশে আন্দোলিত হবে’’, যুল খালাসাহ ছিল তাবালায় অবস্থিত দাওস গোত্রের একটি প্রতিমা যা তারা জাহিলী যুগে ইবাদত করত।[1]
সাওবান (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
وَلا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى تَلْحَقَ قَبَائِلُ مِنْ أُمَّتِي بِالْمُشْرِكِينَ وَحَتَّى تَعْبُدَ قَبَائِلُ مِنْ أُمَّتِي الأَوْثَانَ
‘‘কিয়ামতের পূর্বেই আমার উম্মাতের কিছু সম্প্রদায় মুশরিকদের সাথে মিশে যাবে এবং আমার উম্মাতের কিছু সম্প্রদায় ‘ওয়াসান’ ‘পূজিত দ্রব্যের’ ইবাদত করবে।’’[2]
ওয়াসান (الوثن) বলতে মুর্তি, প্রতিমা ও যে কোনো প্রকার পূজিত দ্রব্য বা বস্ত্ত বুঝানো হয়। আদী ইবনু হাতিম (রাঃ) বলেন:
أَتَيْتُ النَّبِيَّ (ﷺ) وَفِي عُنُقِي صَلِيبٌ مِنْ ذَهَبٍ فَقَالَ يَا عَدِيُّ اطْرَحْ عَنْكَ هَذَا الْوَثَنَ
‘‘আমি যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট আগমন করলাম তখন আমার গলায় ছিল একটি স্বর্ণের ক্রুশ। তিনি আমাকে বলেন, তোমার গলা থেকে এ ‘ওয়াসান’ বা পূজিত বস্ত্তটি ফেলে দাও।’’[3]
এ সকল হাদীস থেকে বুঝা যায় যে, মুর্তিপূজা, দ্রব্য পূজা, স্মৃতি-বিজড়িত স্থান বা বস্ত্ত পূজার মত শিরকও মুসলিম উম্মাতের কারো কারো মধ্যে প্রবেশ করবে। বাস্তব অবস্থাও তাই সাক্ষ্য দেয়।
[2] আবূ দাউদ, আস-সুনান ৪/৯৭; ইবনু মাজাহ ২/১৩০৪; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৪/৪৯৬। হাকিম ও যাহাবী হাদীসটিকে বুখারী ও মুসলিমের শর্ত অনুসারে সহীহ বলে উল্লেখ করেছেন।
[3] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/২৭৮। তিরমিযী হাদীসটিকে গরীব বলেছেন।