শিরক প্রতিরোধে কুরআন ও হাদীসের বিশেষ ব্যবস্থার অন্যতম শিরকের উৎসগুলি বন্ধ করা। আমরা দেখেছি যে, শিরক মূলত দুটি বিষয়কে নিয়ে আবর্তিত হয়: (১) মহান আল্লাহর প্রতি অব-ভক্তি বা কু-ধারণা এবং (২) বান্দার প্রতি অতিভক্তি বা অতি-ধারণা। আর এ দুটি বিষয় পরস্পরে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। মহান আল্লাহর মর্যাদা ও ক্ষমতার প্রতি কু-ধারণা না হলে কেউ কোনো বান্দার প্রতি অতি-ধারণা পোষণ করতে পারে না। অনুরূপভাবে কোনো বান্দার প্রতি অতি-ধারণা পোষণের অর্থই হলো মহান আল্লাহর মর্যদা ও ক্ষমতার প্রতি অব-ধারণা পোষণ করা।
কুরআন ও হাদীসে বিশেষভাবে এ বিষয়গুলি রোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য ব্যাপক পরিসরের প্রয়োজন। এখানে অতি-সংক্ষেপে এ বিষয়ে কুরআন-হাদীসের ব্যবস্থাগুলি উল্লেখ করছি।
৫. ৩. ৬. ১. মহান আল্লাহর বিষয়ে অব-ধারণা রোধ করা
কুরআন ও হাদীসের প্রথম, প্রধান ও অন্যতম আলোচ্য বিষয় মহান আল্লাহর মর্যাদা, ক্ষমতা ও তাঁর তাওহীদ। বারংবার বিভিন্নভাবে বলা হয়েছে যে, মহান আল্লাহ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, একমাত্র প্রতিপালক, সর্বশক্তিমান, সকল কর্তৃত্বের অধিকারী, বিশ্ব পরিচালনার অধিকার, ক্ষমতা, কল্যাণ বা অকল্যাণের ক্ষমতা আর কারো নেই। কেউ কিছু করতে পারে না, দিতে পারে না। তিনি দিলে কেউ তা রোধ করতে পারে না। তাঁর ইচ্ছাই চূড়ান্ত। তাঁর ইচ্ছার বিপরীতে অন্য কারো কোনো ইচ্ছার কোনা মূল্য নেই। তিনি তাঁর নিজের ইচ্ছা, অনুমতি ও মর্যির বাইরে কারো সুপারিশ, শাফা‘আত বা দু‘আ গ্রহণ করেন না। একমাত্র তাঁকেই ডাক, তাঁরই সাহায্য চাও, তিনিই তোমার ডাকে সাড়া দিবেন। আর তিনি না দিলে অন্য কেউ কোনোভাবে দিতে পারে না। এভাবে কুরআন ও হাদীসে আল্লাহর মহত্ব, মর্যাদা, ক্ষমতা ও শক্তি সম্পর্কে বারংবার ঘোষণা করা হয়েছে, যেন তাঁর মর্যদা ও মহত্বের প্রতি পরিপূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস মুমিন অর্জন করতে পারেন। এ বিষয়ক অনেক আয়াত ও হাদীস ইতোপূর্বে বিভিন্ন প্রসঙ্গে আলোচনা করেছি।
৫. ৩. ৬. ২. ফিরিশতাগণ সম্পর্কে অতিভক্তি রোধ করা
কুরআন ও হাদীসের বিবরণ থেকে আমরা দেখি যে, মুশরিকগণ যে সকল বান্দার বিষয়ে অতিভক্তির কারণে শিরক করেছে তাদের অন্যতম ফিরিশতাগণ, নবীগণ এবং আল্লাহর প্রিয় নেককার বান্দাগণ। এ ছাড়া মুশরিকগণ অনেক বানোয়াট বা কল্পিত ব্যক্তিত্বকে ‘আল্লাহর প্রিয়’ বা ‘আল্লাহর সন্তান’ নাম দিয়ে শিরক করেছে। আরবের কাফিরগণ ফিরিশতাগণকে আল্লাহর সন্তান বা আল্লাহর কন্যা বলে আখ্যায়িত করত এবং তাদের সুপারিশ-শাফা‘আত লাভের আশায় তাদের ইবাদত করত। কুরআন কারীমে তাদের এ অতিভক্তি রোধ করতে বারংবার উল্লেখ করা হয়েছে যে, তাঁরা মহান আল্লাহর সম্মানিত বান্দা মাত্র। তাঁরা শাফা‘আতের সুযোগ পাবেন বটে, তবে তা তাদের ইচ্চাধীন নয়, বরং মহান আল্লাহর ইচ্ছা ও অনুমতির অধীন। কাজেই শাফা‘আতের আশায় আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের ইবাদত ভয়ঙ্কর পথভ্রষ্টতা ছাড়া কিছুই নয়। এ বিষয়ক বিভিন্ন আয়াত ইতোপূর্বে বিভিন্ন স্থানে আলোচনা করা হয়েছে।
৫. ৩. ৬. ৩. নবী-রাসূলগণের বিষয়ে অতিভক্তি রোধ করা
কুরআন ও হাদীস থেকে আমরা দেখি যে, ইহূদী, খৃস্টান ও আরবের মুশরিকগণ ইবরাহীম, ইসমাঈল, উযাইর, ঈসা (আলাইহিমুস সালাম) প্রমুখ নবী-রাসূলের বিষয়ে অতিভক্তি ও বাড়াবাড়ি করে শিরকে নিপতিত হয়। এজন্য কুরআন কারীমের বারংবার নবী-রাসূলগণের আবদিয়্যাত বা বান্দাত্ব, বাশারিয়্যাত বা মানবত্ব, আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কোনো অলৌকিক নিদর্শন দেখানোর অক্ষমতা, গাইব সম্পর্কে অজ্ঞতা ইত্যাদি বিষয় বারংবার উল্লেখ করা হয়েছে। যেন তাঁদের অনুসারী ও মুমিনগণ তাঁদের প্রতি অবিচল ভক্তি, ভালবাসা ও আনুগত্যের পাশাপাশি তাঁদের তাদের বিষয়ে অতিভক্তি থেকে আত্মরক্ষা করতে পারেন। এ বিষয়ক অনেক আয়াত ও হাদীস ইতোপূর্বে বিভিন্ন। মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর প্রতি ভক্তি, ভালবাসা, মর্যাদা প্রদান ও পরিপূর্ণ আনুগত্যের পাশাপাশি তাঁর প্রতি ভক্তি ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ওহীর অনুসরণের নির্দেশনাবলিও আমরা বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
৫. ৩. ৬. ৪. ওলীগণ সম্পর্কে অতিভক্তি রোধ করা
আমরা দেখেছি যে, নেককার বা ওলী-আল্লাহগণের বিষয়ে অতিভক্তি ছিল মুশরিকদের শিরকের অন্যতম কারণ। কুরআন ও হাদীসে এ বিষয়ে অতিভক্তির পথ রোধ করা হয়েছে:
প্রথমত, ঈমান ও তাকওয়াকে বেলায়াত বা ওলীত্বের ভিত্তি ধরা হয়েছে। ওলীর পরিচয়ের ক্ষেত্রে অলৌকিকতা, কারামাত ইত্যাদির কোনোরূপ গুরুত্ব প্রদান করা হয় নি। তাকওয়ার অধিকারী কোনো ব্যক্তি থেকে যদি কোনো অলৌকিক কার্য প্রকাশিত হয় তবে তা মহান আল্লাহর দেওয়া সম্মাননা বা কারামত হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। তবে কারো অলৌকিক কার্য দেখে তাকে ওলী বলে মনে করার কোনোরূপ সুযোগ ইসলামে নেই। যেন মুমিন কারো অলৌকিক কর্ম দেখে তাকে নিশ্চিত ওলী বলে ধারণা না করে।
দ্বিতীয়ত, অলৌকিক কার্য দেখে তো কাউকে ওলী বলা যাবে না, এমনকি কুরআন-হাদীসে যাকে বেলায়াতের দলিল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে সেই ঈমান ও তাকওয়া দেখেও কাউকে সুনিশ্চিত ওলী বলে নিশ্চিয়তা দেওয়া যায় না। কারণ, ‘ঈমান’ ও ‘তাকওয়া’ উভয়ই মূলত হৃদয়ের অভ্যন্তরের লূক্কয়িত বিষয়, যা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। মুমিনের কর্ম তার ঈমান ও তাকওয়ার আলামত মাত্র, যা দেখে ঈমান ও তাকওয়ার বিদ্যমানতা সম্পর্কে ধারণা করা যায়, তবে নিশ্চিত হওয়া যায় না। বাহ্যিক ঈমান ও তাকওয়ার ভিত্তিতে সকল মুমিনই আল্লাহর ওলী। যারা তাকওয়া ও নেক-আমল যত বেশি সে তত বেশি আল্লাহর প্রিয়। কিন্তু কোনো ব্যক্তিকে নির্ধারিতভাবে ওলী বলে চিহ্নিত করার সুযোগ দেওয়া হয় নি। নির্ধারিতভাবে কাউকে ‘ওলী’ বলে নিশ্চিত করা তো দূরের কথা, ওহীর নির্দেশানা বাইরে কাউকে নিশ্চিতরূপে জান্নাতী বলতেও আপত্তি করা হয়েছে। এ বিষয়ে উসমান ইবনু মাযঊন (রাঃ) বিষয়ক হাদীসটি ইতোপুর্বে আমরা দেখেছি। অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
لَنْ يُدْخِلَ أَحَدًا عَمَلُهُ الْجَنَّةَ قَالُوا وَلا أَنْتَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ لا وَلا أَنَا إِلا أَنْ يَتَغَمَّدَنِي اللَّهُ بِفَضْلٍ وَرَحْمَةٍ
‘‘কোনো ব্যক্তিকেই তার নিজের আমল জান্নাতে প্রবেশ করাবে না। সাহাবীগণ বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনিও নন? তিনি বলেন, না, আমিও নই, যদি আল্লাহ আমাকে মহানুভবতা ও রহমত দিয়ে আবৃত করে না নেন।’’[1]
এভাবে আমরা দেখছি যে, ইসলামে মানুষের বাহ্যিক নেক কর্মের ভিত্তিতে সম্মান করতে ও ভালবাসতে নির্দেশ দেওয়া হলেও, কোনো বাহ্যিক কর্ম বা কারামাতের ভিত্তিতে কাউকে সুনিশ্চিত ওলী তো দূরের কথা জান্নাতী বলার কোনো সুযোগ রাখা হয় নি। সর্বোপরি কোনো ওলীকে আল্লাহ কোনো অলৌকিক ক্ষমতা দিয়েছেন বা দেন এরূপ কোনো কল্পনা করার সুযোগ ইসলামে নেই। কুরআন বা হাদীসে কোথাও এরূপ কিছু বলা হয় নি। এমনকি সাহাবীগণ নেককার বুজুর্গদের নিকট দু‘আ চাওয়ার বিষয়েও বাড়াড়াড়ি পরিহার করতে পরামর্শ দিতেন। সাধারণভাবে মুমিনদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে অন্যদের জন্য দু‘আ করতে। সাহাবায়ে কেরাম রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর নিকট দু‘আ চাইতেন। তাঁরা একে অপরের কাছেও দোয় চেয়েছেন কখনো কখনো। এমনকি একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে : উমর (রা.) উমরাহ আদায়ের জন্য মক্কা শরীফে গমনের অনুমতি চাইলে রাসূলুল্লহ (ﷺ) অনুমতি প্রদান করেন এবং বলেন : আমাদেরকেও তোমার দু‘আার মধ্যে মনে রেখ, ভুলে যেও না।[2]
তাবেয়ীগণও সাহাবীগণের কাছে মাঝেমধ্যে দু‘আ চাইলে তাঁরা দু‘আ করতেন। এক ব্যক্তি আনাস (রা.) -এর কাছে এসে দু‘আ চায়। তিনি বলেন: ‘‘আল্লাহুম্মা আতিনা ফিদদুনিয়া হাসানাতাও ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানাহ।’’ (অর্থাৎ: হে আল্লাহ, আপনি আমাদেরকে দুনিয়ায় কল্যাণ এবং আখেরাতে কল্যাণ দান করুন।) ঐ ব্যক্তি বার বার দু‘আ চাইলে তিনি শুধু এতটুকুই বলেন।[3]
অপরদিকে তাঁরা এ বিষয়ে বাড়াবাড়ি বা অতিভক্তি নিষেধ করতেন। অনেক সময় অনেক সাহাবী দু‘আ চাইলে দু‘আ করতেন না, কারণ এতে মানুষ দু‘আ চাওয়ার রীতি তৈরি করে নেবে। এক ব্যক্তি খলীফা উমরের (রা.) কাছে চিঠি লিখে দু‘আ চায়। তিনি উত্তরে লিখেন :
إِنِّيْ لَسْتُ بِنَبِيٍّ، ولكن إذا أُقِيْمَتِ الصَّلاَةُ فَاسْتَغْفِرِ اللهَ لِذَنْبِكَ
‘‘আমি নবী নই (যে তোমাদের জন্য দু‘আ করব বা আমার দু‘আ কবুল হবেই), বরং যখন সালাত কায়েম করা হবে, তখন তুমি তোমার গোনাহের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবে।’’[4]
সা’দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রাঃ) সিরিয়ায় গেলে এক ব্যক্তি তাঁর কাছে এসে বলেন: আপনি দু‘আ করুন, যেন আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করেন। তিনি বলেন: আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করুন। এরপর অন্য একজন এসে একইভাবে দু‘আ চান। তখন তিনি বলেন: আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা না করুন, আগের ব্যক্তিকেও ক্ষমা না করুন! আমি কি নবী? (যে সবার জন্য দু‘আ করব বা আমার দু‘আ কবুল হবেই)।[5]
[2] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/৫৫৯; আবূ দাউদ, আস-সুনান ২/৮০; ইবনু মাজাহ, আস- সুনান ২/৯৯৬; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৩/২২১; আলবানী, যায়ীফু সুনানি ইবনু মাজাহ পৃ: ২৩৫। হাদীসটিকে তিরমিযী হাসান সহীহ ও হাইসামী যয়ীফ বলেছেন।
[3] শাতেবী, আল-ইতিসাম ১/৫০০-৫০১।
[4] শাতেবী, আল-ইতিসাম ১/৫০১।
[5] শাতেবী, আল-ইতিসাম ১/৫০১।