অনেক সময় ব্যক্তি মানুষ নিজের বিবেক ও বুদ্ধি দিয়ে সত্যকে উপলব্ধি করতে পারে। কিন্তু সমাজের নেতৃবৃন্দের অনুকরণ-প্রিয়তা বা তাদের বিরোধিতার অনাগ্রহ তাকে সত্য গ্রহণ থেকে বিরত রাখে।
একজন সাধারণ মুশরিক যখন কুরআনের যুক্তিগুলি নিয়ে চিন্তা করে তখন শিরকের অসারতা ও তাওহীদের আবশ্যকতা বুঝতে পারে। মহান আল্লাহই একমাত্র প্রতিপালক ও সর্বশক্তিমান। তাঁর ইচ্ছার বাইরে কারো কিছু করার ক্ষমতা নেই। কাজেই তাকে ছাড়া অন্যকে ডাকার, সাজদা করার, মানত করার, নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করার দরকার টা কি? আমরা দাবি করছি যে, মহান আল্লাহ কোনো কোনো বান্দাকে কিছু ক্ষমতা দিয়েছেন, কিন্তু এ দাবি আমরা ওহীর মাধ্যমে প্রমাণ করতে পারছি না। তিনি কাউকে কোনো ক্ষমতা দিয়েছেন বলে কোথাও বলেন নি। তিনি তার কোনো নবী বা প্রিয় বক্তিত্বকে ডাকতেও নির্দেশ দেন। তিনি কোথাও বলেন নি যে, অমুক নবী, ফিরিশতা বা অমুক ব্যক্তিকে ডাক এবং তার কাছে সাহায্য চাও, মানত কর, ভেট দাও, তাহলে আমি খুশি হব। বরং তিনি বারংবার বলছেন যে, আমাকে ছাড়া কাউকে ডেক না। কেবল আমাকেই ডাক আমিই সব প্রয়োজন মেটাতে পারি। কাজেই আমি কেন আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ডাকব বা তার ইবাদত করব? সকল যুক্তি ও বিবেকের দাবি তো এই যে, আমি শুধু মহান আল্লাহরই ইবাদত করব।
এভাবে একজন সাধারণ তার নিজের বুদ্ধি ও বিবেক দিয়ে শিরকের অসারতা বুঝতে পারে। কিন্তু সে তার এ চিন্তা ধর্মগুরু বা সমাজপতির মতামতের বিরুদ্ধে প্রকাশ করতে দ্বিধা বোধ করে অথবা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। অথবা এরূপ ধর্মগুরু বা সমাজপতিদের কাছে তার চিন্তা প্রকাশ করলে তারা বলে, আরে বাদ দে ওসব কথা! যারা পিতাপিতামহদের ধর্ম পরিত্যাগ করে নতুন কথা বলছে তাদের মত বেয়াদবদের কথায় কান দিবি না। যুগ যুগ ধরে সকলেই করছে, কেউ কিছু বুঝল না আর তুমি বেশি বুঝলে। অমুক, অমুক, তমুক বুজুর্গ, পাদরি, যাজক, ধর্মগুরু এরূপ বলেছেন ও করেছেন, তাদের কথা তোমার ভাল লাগে না! এরূপ করে অমুক এত কিছু পেয়েছেন, বেয়াদবি করে অমুক অমুক শাস্তি পেয়েছে, কাজেই সাবধান!! ... ইত্যাদি বিভিন্ন যুক্তির কাছে দুর্বল চিত্ত মানুষের বিবেক খেই হারিয়ে ফেলে। সে নিজের বিবেকের ডাক প্রত্যাখ্যান করে সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে থাকে।
এদের অবস্থা বর্ণনা করে মহান আল্লাহ বলেন:
إِذْ تَبَرَّأَ الَّذِينَ اتُّبِعُوا مِنَ الَّذِينَ اتَّبَعُوا وَرَأَوُا الْعَذَابَ وَتَقَطَّعَتْ بِهِمُ الأَسْبَابُ وَقَالَ الَّذِينَ اتَّبَعُوا لَوْ أَنَّ لَنَا كَرَّةً فَنَتَبَرَّأَ مِنْهُمْ كَمَا تَبَرَّءُوا مِنَّا
‘‘যখন অনুসৃতগণ অনুসরণকারিগণ সম্বন্ধে দায়িত্ব গ্রহণে অস্বীকার করবে এবং তারা শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে এবং তাদের মধ্যকার সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে। এবং যারা অনুসরণ করেছিল তারা বলবে, ‘হায়! যদি একবার আমাদের প্রত্যাবর্তন ঘটত তবে আমরাও তাদের সম্পর্ক ছিন্ন করতাম যেমন তারা আমাদের সম্পর্ক ছিন্ন করল।’’’[1]
অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন:
وَلَوْ تَرَى إِذِ الظَّالِمُونَ مَوْقُوفُونَ عِنْدَ رَبِّهِمْ يَرْجِعُ بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ الْقَوْلَ يَقُولُ الَّذِينَ اسْتُضْعِفُوا لِلَّذِينَ اسْتَكْبَرُوا لَوْلا أَنْتُمْ لَكُنَّا مُؤْمِنِينَ. قَالَ الَّذِينَ اسْتَكْبَرُوا لِلَّذِينَ اسْتُضْعِفُوا أَنَحْنُ صَدَدْنَاكُمْ عَنِ الْهُدَى بَعْدَ إِذْ جَاءَكُمْ بَلْ كُنْتُمْ مُجْرِمِينَ. وَقَالَ الَّذِينَ اسْتُضْعِفُوا لِلَّذِينَ اسْتَكْبَرُوا بَلْ مَكْرُ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ إِذْ تَأْمُرُونَنَا أَنْ نَكْفُرَ بِاللَّهِ وَنَجْعَلَ لَهُ أَنْدَادًا
‘‘তুমি যদি দেখতে জালিমদেরকে যখন তাদের প্রতিপালকের সম্মুখে তাদেরকে দন্ডায়মান করা হবে, তখন তারা পরস্পর বাদ-প্রতিবাদ করবে। যাদেরকে দুর্বল মনে করা হতো তারা ক্ষমতাদর্পীদেরকে বলবে, তোমরা না থাকলে আমরা অবশ্যই মুমিন হতাম। যারা ক্ষমতাদর্পী ছিল তারা দুর্বলদেরকে বলবে, ‘তোমাদের নিকট সৎপথের দিশা আসার পর কি আমরা তোমাদেরকে তা থেকে বিবৃত্ত করেছিলাম? বস্তুত তোমরাই ছিলে অপরাধী। দুর্বলরা ক্ষমতাদর্পীদেরকে বলবে, ‘প্রকৃতপক্ষে তোমরাই তো দিবারাত্র চক্রান্তে লিপ্ত ছিলে, আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলে যেন আমরা আল্লাহকে অমান্য করি এবং তার শরীক স্থাপন করি।’’[2]
[2] সূরা (৩৪) সাবা: ৩১-৩৩ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা (১৪) ইবরাহীম: ২১ আয়াত।