উৎসর্গ করা (sacrifice) ইবাদতের একটি সর্বজনীন প্রকাশ। জীব জানোয়ার উৎসর্গ করা হলে আমরা সাধারণত কুরবাণী দেওয়া, বলি দেওয়া বা জবাই করা বলি। খাদ্য, ফসল, ফুল ইত্যাদী উৎসর্গ করা হলে সাধারণ ভাবে বাংলাদেশের মুসলিম পরিভাষায় মান্নত, সদকা ইত্যাদি বলা হয়। যুগে যুগে বিভিন্ন সমাজের মানুষেরা আল্লাহকে বা তাদের অন্যান্য উপাস্যকে খুশী করার জন্য, তাদের বর, আশীর্বাদ বা করুণা পাওয়ার জন্য বা তাদের প্রতি অন্তরের ভক্তি প্রকাশের জন্য জীব জানোয়ার, ফল-ফসল, ফুল-ফল খাদ্য ইত্যাদী উৎসর্গ করেছেন, বলি দিয়েছেন বা ভেট দিয়েছেন এবং এখনো দেন। উৎসর্গ কখনোও সাধারণভাবে করা হয, কোন রকম শর্ত (precondition) ছাড়াই একজন ভক্ত তার ভক্তির প্রকাশ হিসাবে উৎসর্গ দান করেন। কখনো বা তা মানত হিসাবে পেশ করা হয়, অর্থাৎ একজন ভক্ত উপাসক সিদ্ধান্ত নেন যে তার নির্দিষ্টমনোবাসনাপূর্ণ হলে তিনি তার উপাস্যর জন্য কিছু উৎসর্গ করবেন।
সর্ব যুগের মুশরিকদের মত আরবের মুশরিকরাও জীব জানোয়ার, ফসল খাদ্য ইত্যাদি আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করতো এবং তাদের অন্য সকল উপাস্যের জন্যও উৎসর্গ করত। এ শিরকের বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেছেন:
وَجَعَلُوا لِلَّهِ مِمَّا ذَرَأَ مِنَ الْحَرْثِ وَالأَنْعَامِ نَصِيبًا فَقَالُوا هَذَا لِلَّهِ بِزَعْمِهِمْ وَهَذَا لِشُرَكَائِنَا فَمَا كَانَ لِشُرَكَائِهِمْ فَلا يَصِلُ إِلَى اللَّهِ وَمَا كَانَ لِلَّهِ فَهُوَ يَصِلُ إِلَى شُرَكَائِهِمْ سَاءَ مَا يَحْكُمُونَ
‘‘আল্লাহ যে শস্য ও গবাদি পশু সৃষ্টি করেছেন তন্মধ্য হতে তারা আল্লাহর জন্য এক অংশ নির্দিষ্ট করে এবং নিজেদের ধারণা অনুযায়ী বলে, ‘এটি আল্লাহর জন্য এবং এটি আমাদের অন্যান্য উপাস্যের জন্য। যা তাদের দেবতাদের অংশ তা আল্লাহর কাছে পৌঁছে না এবং যা আল্লাহর অংশ তা তাদের দেবতাদের কাছে পেঁছে; তারা যা মিমাংসা করে তা নিকৃষ্ট।’’[1]
উৎসর্গ বিষয়ক শিরকের বিষয়ে অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন:
وَيَجْعَلُونَ لِمَا لا يَعْلَمُونَ نَصِيبًا مِمَّا رَزَقْنَاهُمْ تَاللَّهِ لَتُسْأَلُنَّ عَمَّا كُنْتُمْ تَفْتَرُونَ
‘‘আমি তাদেরকে যে রিয্ক দান করি তারা তার এক অংশ নির্ধারিত করে তাদের জন্য যাদের সম্পর্কে তারা কিছুই জানে না। শপথ আল্লাহর, তোমরা যে মিথ্যা উদ্ভাবন কর সে সম্বন্ধে তোমাদেরকে প্রশ্ন করা হবেই।’’[2]
কুরবানী বা উৎসর্গ একমাত্র আল্লাহর জন্যই করার নির্দেশনা দিয়ে অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন:
قُلْ إِنَّ صَلاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ، لا شَرِيكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ
‘‘বল, নিশ্চয় আমার সালাত, আমার উৎসর্গ বা কুরবাণী, আমার জীবন, আমার মৃত্যু আল্লাহরই নিমিত্ত, যিনি জগৎসমূহের প্রতিপালক,তার কোন শরীক নেই। এজন্যই আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং আমি সর্বাগ্রে আত্মসমর্পণ করছি।’’[3]
মহান আল্লাহ তাঁর রাসূল (ﷺ)-কে সম্বোধন করে বলেন:
فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ
‘‘তোমার প্রতিপালকের জন্য সালাত আদায় কর এবং জবাই-কুরবানী কর।’’[4]
এ জাতীয় শিরক আালোচনা প্রসঙ্গে শাহ ওয়ালি উল্লাহ বলেন: মুশরিকগণ মুর্তি, প্রতিমা ও গ্রহ-নক্ষত্রের করুণা ও নৈকট্য লাভের জন্য তাদের উদ্দেশ্যে জবাই করত। এজন্য তারা জবাইদের সময় তাদের নাম নিয়ে জবাই করত। অথবা তাদের উদ্দেশ্যে বানানো বিশেষ বেদি বা স্মৃতি বিজড়িত স্থানে নিয়ে পশু জবাই করত। কুরআনে তাদের এরূপ করতে নিষেধ করা হয়েছে। এছাড়া তারা তাদের উপাস্যদের করুণা লাভের উদ্দেশ্যে তাদের নামে পশু ছেড়ে দিত। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন[5]:
مَا جَعَلَ اللَّهُ مِنْ بَحِيرَةٍ وَلا سَائِبَةٍ وَلا وَصِيلَةٍ وَلا حَامٍ وَلَكِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا يَفْتَرُونَ عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ وَأَكْثَرُهُمْ لا يَعْقِلُونَ
‘‘বাহীরাহ, সায়িবা, ওয়সীলাহ ও হাম (উপাস্যদের নামে বিভিন্ন প্রকারের উৎসর্গকৃত পশু) আল্লাহ স্থির করেন নি; কিন্তু কাফিরগণ আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে এবং তাদের অধিকাংশ উপলব্ধি করে না।’’[6]
[2] সূরা (১৬) নাহল: ৫৬ আয়াত।
[3] সূরা (৬) আনআমঃ ১৬২-১৬৩ আয়াত।
[4] সূরা (১০৮) কাওসার: ২ আয়াত।
[5] সূরা (৫) মায়িদা: ১০৩ আয়াত।
[6] শাহ ওয়ালি উল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ ১/১৮৭।