মুশরিকদের শিরকের অন্যতম একটি প্রকাশ ছিল মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কারো ‘ইলমুল গাইব’ অর্থাৎ অদৃশ্য জগতের বা ভবিষ্যতের জ্ঞান আছে বলে বিশ্বাস করা।
এখানে লক্ষণীয় যে, মহান আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের অন্যতম দিক তাঁর অনন্ত-অসীম অতুলনীয় ও সামগ্রিক ইলম বা জ্ঞান। তাঁর অন্যতম সিফাত হলো ‘আলিমুল গাইব’ বা ‘অদৃশ্যের জ্ঞানের অধিকারী’ এবং ‘আলিমুল গাইব ওয়াশ শাহাদাহ’ বা ‘দৃশ্য ও অদৃশ্যের জ্ঞানের অধিকারী’। কুরআন কারীমে একথা বলা হয় নি যে, মহান আল্লাহর মত গাইবী ইলম কারো নেই, বরং বারংবার উল্লেখ করা হয়েছে যে, গাইবের জ্ঞানই আল্লাহ ছাড়া কারো নেই। পাশাপাশি উল্লেখ করা হয়েছে যে, মহান আল্লাহ ওহীর মাধ্যমে গাইবের জ্ঞান তার নবী-রাসূলদের প্রদান করেন। এছাড়া উল্লেখ করা হয়েছে যে, নবী-রাসূলসহ সমগ্র সৃষ্টিকে অতি সামান্য জ্ঞানই দান করা হয়েছে।
বান্দার জ্ঞান উপকরণের অধীন। জাগতিক বা আত্মীক উপকরণের মাধ্যমে, অর্থাৎ ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি, যুক্তি, ওহী ইত্যাদির মাধ্যমে বান্দা জ্ঞান লাভ করে। ইন্দ্রিয় ও অন্যান্য জাগতিক উপকরণ সকল মানুষের জন্য সমান। আর ওহী, ইলহাম ইত্যাদি মহান আল্লাহ দয়া ও পছন্দ করে কোনো বান্দাকে দিতে পারেন। এগুলি একান্তই মহান আল্লাহর ইচ্ছাধীন, বান্দার ইচ্ছাধীন নয়।
ইলমুল গাইবে শিরক করার বিভিন্ন দিক রয়েছে:
(১) আল্লাহ ছাড়া কারো উপকরন ছাড়া কোনো বিশেষ বা সকল গাইবেরর জ্ঞান আছে বলে বিশ্বাস করা।
(২) ওহী বা আল্লাহর পক্ষ থেকে জানানো ছাড়া কোনো ব্যক্তি কোনোভাবে কোনো গাইব বা অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যতের অদৃশ্য কোনো জ্ঞান অর্জন করতে পারে বলে বিশ্বাস করা। জ্যোতিষী, গণক, যাদুকর ও জিন্নদের বিষয়ে আরবের মুশরিকগণ এরূপ বিশ্বাস পোষণ করত।
(৩) আল্লাহর সকল ইলমু গাইব তিনি তাঁর কোনো বান্দাকে জানিয়েছেন বলে বিশ্বাস করা। এতে কুরআন ও হাদীসের স্পষ্ট নির্দেশনা অস্বীকার করা হয়। কুরআন ও হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সকল সৃষ্টির সকল জ্ঞান আল্লাহর জ্ঞানের তুলনায় অতি সামান্য এবং আল্লাহ ছাড়া কেউ গাইব জানে না। অত্যন্ত সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বারংবার বলা হয়েছে যে, কিয়ামতের সময়, আগামীকাল মানুষ কি করবে, কোথায় মরবে ইত্যাদি কিছু বিষয় মহান আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। এজন্য কাউকে আল্লাহ এরূপ সকল ও সামগ্রিক গাইব জানিয়েছেন বলে দাবি করাও কুরআনের নির্দেশনা অস্বীকার করা বলে গণ্য। খৃস্টানগণ ঈসার (আঃ) বিষয়ে এরূপ বিশ্বাস পোষণ করে।
খৃস্টানগণ বিশ্বাস করে যে, ঈসা মাসীহ (আঃ) মহান আল্লাহর মতই সকল গাইবী জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন, কারণ তিনি মহান আল্লাহর যাতেরই অংশ। প্রচলিত ও বিকৃত বাইবেলের মধ্যেও যীশুর সুস্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে যে, তিনি গাইব জানতেন না। কিন্তু খৃস্টানগণ বিভিন্ন ব্যাখ্যা করে এ সকল আয়াত বাতিল করে দেয়। প্রচলিত বাইবেলের মথির সুসমাচারের ২৪ অধ্যায়ের ৩৬ আয়াতে কিয়ামতের বিষয়ে যীশু বলেছেন: ‘‘কিন্তু সেই দিনের ও সেই দন্ডের তত্ত্ব কেহই জানে না, স্বর্গের দূতগণও (ফিরিশতাগণ) জানেন না, পুত্রও (যীশু স্বয়ং) জানেন না, কেবল পিতা জানেন।’’ ত্রিত্ববাদী খৃস্টানদের জন্য এ কথাটি কঠিন চপটাঘাত। তারা জালিয়াতির মাধ্যমে বা ব্যাখ্যার মাধ্যমে কথাটি গোপন করতে বা বাতিল করতে চেষ্টা করেছে। জালিয়াতির একটি নমুনা এই যে, তারা ‘পুত্রও জানেন না’ কথাটুকু বাইবেল থেকে মুছে দেয়। বর্তমানে ‘অথোরাইয্ড ভার্সন’ নামে প্রচলিত কিং জেমস ভার্সন-এ উপরের আয়াতটির নিম্নরূপ: ‘‘But of that day and hour knoweth no man, no, not the angels of heaven, but my Father only.’’ এখানে পাঠক দেখছেন যে, ‘পুত্রও জানেন না (neither the Son) কথাটি মুছে দেওয়া হয়েছে। এভাবেই প্রায় হাজার বৎসর যাবত এ কথাটি বাদ দেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে বিভিন্ন প্রাচীন পান্ডুলিপির আলোকে জালিয়াতি ধরা পড়ার কারণে আধুনিক সংস্করণগুলিতে কথাটি সংযোজন করা হয়েছে। এছাড়া বাইবেলের মধ্যে আরো অনেক আয়াত থেকে সুস্পষ্টতই জানা যায় যে, ঈসা মাসীহ কখনোই ওহীর অতিরিক্ত কোনো গাইবের কথা জানতেন না বা জানার দাবি করেন নি। তবে তারা বিভিন্ন ব্যাখ্যা করে এ আয়াতটি এবং এ জাতীয় সকল আয়াতের সুস্পষ্ট অর্থ বাতিল করে দেয় এবং যীশুর জন্য সামগ্রিক ইলমুল গাইব দাবি করে।