কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত মুশরিকগণের একটি সুন্দর শ্রেণীভাগ করেছেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী। তিনি ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’ গ্রন্থে তিনি মুশরিকদেরকে তিন শ্রেণীতে এবং ‘আল-বালাগুল মুবীন’ গ্রন্থে মুশরিকদেরকে চার শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। তাঁর শ্রেণীভাগ নিম্নরূপ:
৫. ৩. ১. ১. জ্যোতিষি, প্রকৃতিপূজারী বা নক্ষত্র পূজারিগণ
এরা দাবি করে যে, গ্রহ-নক্ষত্র ইবাদত পাওয়ার যোগ্য। এদের ইবাদত করলে পৃথিবীতে উপকার পাওয়া যায়। মানুষের প্রয়োজন বা হাজত এদের কাছে পেশ করা সঠিক। তারা বলে, আমরা গবেষণা করে উদ্ঘাটন করেছি যে, দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, ব্যক্তির সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্য, সফলতা-ব্যর্থতা, সুস্থতা-অসুস্থতা ইত্যাদির ক্ষেত্রে এদের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। এ সকল গ্রহ-নক্ষত্রের বুদ্ধিমান সত্তা আছে যার ভিত্তিতে তারা যাত্রা ও চলাচল করে। এরা এদের পূজারীদের বিষয়ে অচেতন নয়। এ বিশ্বাসের ভিত্তিতে তারা বিভিন্ন গ্রহ-নক্ষত্রের নামে মন্দির তৈরি করেছে এবং তাদের ইবাদত করে।
৫. ৩. ১. ২. মুশরিকগণ
এরা মুসলিমদের সাথে তাওহীদুর রূবুবিয়্যাতের অধিকাংশ বিষয়ে একমত। তারা বিশ্বাস করে যে, বিশ্বের বৃহৎ বিষয়গুলি পরিচালনার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহরই। এছাড়া যে বিষয়গুলি তিনি নিজেই সিদ্ধান্ত নেন এবং অন্য কাউকে কোনো এখাতিয়ার বা ক্ষমতা প্রদান করেন নি সে সকল বিষয়ও তিনি পরিচালনা করেন। অন্যান্য বিষয়ে তারা মুসলিমদের সাথে একমত নয়। তারা দাবি করে যে, তাদের পূর্ববর্তী নেককার বুজুর্গগণ আল্লাহর ইবাদত করে তাঁর নৈকট্য অর্জন করেছিলেন, ফলে আল্লাহ তাদেরকে ‘উলূহিয়্যাত’ বা ‘উপস্যত্ব’ প্রদান করেন। এভাবে তারা অন্যান্য বান্দাদের ‘ইবাদত’ লাভের যোগ্যতা অর্জন করেছেন। যেমনভাবে রাজাধিরাজ মহারাজের খাদিম বা সেবক তার সেবা ও ভক্তি করে যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় তখন মহারাজ সেই খাদিমকেও রাজত্ব উপঢৌকন প্রদান করেন বা তাকে একটি বিশেষ এলাকার ‘সামন্ত’ রাজা বানিয়ে দেন। তখন সে রাজত্বের পরিচালনার দায়ভার এ সামন্ত রাজার উপরেই বর্তায়। আর উক্ত রাজ্যের প্রজাদের দায়িত্ব হয়ে যায় এ রাজার আনুগত্য করা।
তারা বলে, এ সকল বুজুর্গের ইবাদত না করে শুধু আল্লাহর ইবাদত করলে তা কবুল হবে না। এ ছাড়া আল্লাহ অতি মহান ও অতি ঊর্ধ্বে। তার নৈকট্য লাভের জন্য সরাসরি তাঁর ইবাদত কোনো কাজে আসবে না। বরং এ সকল বুজুর্গের ইবাদত করতে হবে যাতে তারা আল্লাহর নৈকট্য পাইয়ে দিতে পারেন। তারা বলে, এ সকল বুজুর্গ শুনেন, দেখেন, তাদের উপাসকদের জন্য সুপারিশ করেন, তাদের বিষয়াদি পরিচালনা করেন এবং তাদের সাহায্য করেন।
এ সকল দাবি দাওয়ার ভিত্তিতে তারা এসকল বুজুর্গের নাম পাথরে খোদাই করে রাখে এবং তাদের নাম বিজড়িত পাথর সামনে রেখে তাদের ইবাদত করে। প্রথম যুগের মুশরিকদের তিরোধানের পরে পরবর্তী প্রজন্মের মুশরিকগণ মূল বুজুর্গ উপাস্য ও তাদের স্মৃতিতে বানানো মুর্তি বা স্তম্ভের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। তারা মনে করে এ সকল মুর্তি বা স্তম্ভই বুঝি উপাস্য। এজন্য মহান আল্লাহ এ সকল মুশরিকদের দাবি দাওয়া রদ করে কখনো বলেছেন যে, বিশ্ব পরিচালনা, রাজত্ব ও ক্ষমতা একমাত্র তারই। কখনো তিনি বলেছেন যে, তারা যাদের ইবাদত করে তারা জড় পদার্থ মাত্র।
৫. ৩. ১. ৩. খৃস্টানগণ
খৃস্টানগণ দাবি করে যে, ঈসা মাসীহ (আঃ)-এর সাথে আল্লাহর বিশেষ নৈকট্য আছে এবং তিনি অন্য সকল সৃষ্টির ঊর্ধ্বে। কাজেই তাকে ‘আব্দ’ অর্থাৎ দাস বা ‘বান্দা’ বলা উচিত নয়। কারণ তাকে ‘আব্দ’ বা ‘বান্দা’ বললে তাকে অন্য সকল সৃষ্টির সমান বানিয়ে দেওয়া হয়। এরূপ করা তাঁর মহান মর্যাদার সাথে বেয়াদবী। সর্বোপরি এতে আল্লাহর সাথে তার যে বিশেষ নৈকট্যের সম্পর্ক রয়েছে তা প্রকাশে অবহেলা করা হয়।
এরপর তাদের কেউ কেউ আল্লাহর সাথে তাঁর বিশেষ নৈকট্য বুঝানোর জন্য তাকে ‘আল্লাহর পুত্র’ বলতে পছন্দ করেন। তাদের যুক্তি এই যে, পিতা তার পুত্রকে বিশেষভাবে দয়া করেন এবং নিজের চোখের সামনে তাকে প্রতিপালন করেন। আর সাধারণ দাস বা চাকরদের চেয়ে পুত্র অধিক মর্যাদার অধিকারী হয়। এজন্য ‘পুত্র’ পদটিই তাঁর মর্যাদার সাথে অধিকতর সঙ্গতিপূর্ণ।
এছাড়া তাদের কেউ কেউ তাকে ‘আল্লাহ’ বলতে শুরু করেন। তাদের যুক্তি এই যে, আল্লাহ ঈসা মাসীহের মধ্যে অবতরণ করেছেন এবং তাঁর মধ্যে অবস্থান করছেন। আর এজন্যই তো তিনি মৃতকে জীবিত করা, মাটি থেকে পাখি বানানো ইত্যাদি মানুষের অসাধ্য অলৌকিক কাজ করতে সক্ষম হন। কাজেই তাঁর কথাই আল্লাহর কথা এবং তাঁকে ইবাদত করা অর্থ আল্লাহকে ইবাদত করা।
পরবর্তী প্রজন্মের খৃস্টানগণের মধ্যে ঈসা (আঃ)-কে ‘আল্লাহর পুত্র’ বলার এ সকল দার্শনিক যুক্তি ও চিন্তা সম্পর্কে অজ্ঞতা ও অসচেতনতা বিরাজ করে। ফলে তারা ‘আল্লাহর পুত্রত্ব’ বলতে প্রকৃত পুত্রত্বই বুঝতে থাকে। কেউ মনে করতে থাকে যে, তিনি প্রকৃতই ‘আল্লাহ’। এজন্য আল্লাহ তাদের বিভ্রান্তি অপনোদনে কখনো বলেছেন যে, তাঁর কোনো স্ত্রী নেই, কখনো বলেছেন যে, তিনিই আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর স্রষ্টা।
এ তিন দলেরই মতামত প্রমাণের জন্য অনেক লম্বা চওড়া যুক্তি তর্কের বহর রয়েছে। কুরআন কারীমের শেষের দু দলের শিরকের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে এবং তাদের বিভ্রান্তি, বিভ্রান্তিকর দালিল-প্রমাণাদি বিস্তারিতভাবে খন্ডন করা হয়েছে।’’[1]
অতঃপর তিনি বলেন: ‘‘শির্ক রোগে আক্রান্ত মানুষেরা বিভিন্ন প্রকারের। তাদের মধ্যে কেউ আল্লাহর মহত্ব ও মর্যাদা ভুলে গিয়েছে। সে কেবল শরীকগণেরই ইবাদত করে এবং কেবলমাত্র তাদের কাছেই নিজের হাজত-প্রয়োজন পেশ করে। আল্লাহর কাছে সে নিজের প্রয়োজন জানায় না বা আল্লাহর দিকে সে দৃষ্টিপাতও করে না। যদিও সে নিশ্চিতভাবে জানে ও মানে যে এই মহাবিশ্বের অনাদি-অনন্ত স্রষ্টা আল্লাহই। মুশরিকদের মধ্যে কেউ বিশ্বাস করে যে, আল্লাহই নেতা, প্রভু এবং বিশ্বের পরিচালক। কিন্তু তিনি তাঁর ‘উলূহিয়্যাত’-এর কিছু মর্যাদা তার কোনো কোনো বান্দাকে দিয়ে থাকেন এবং তাদের সুপারিশ কবুল করেন। তাদেরকে তিনি কিছু বিশেষ বিষয়ে পরিচালনার বা কার্যনির্বাহের দায়িত্ব প্রদান করেন। যেমন মহারাজ বা রাজাধিরাজ তার রাজ্যের প্রত্যেক প্রদেশে ‘সামন্ত’ রাজা নিয়োগ করেন এবং তাকে উক্ত এলাকার পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করেন। বৃহৎ বিষয়গুলি ছাড়া সাধারণ সকল বিষয় পরিচালনা ও কার্য নির্বাহ করার দায়িত্ব এ সকল ছোট রাজাদের উপর অর্পিত হয়। এরূপ বিশ্বাস পোষণকারী মুশরিক আল্লাহর এ সকল বিশেষ বান্দাদেরকে ‘আল্লাহর বান্দা’, ‘আল্লাহর দাস’ বা আল্লাহর আবদ’ বলতে দ্বিধাবোধ করে; কারণ এতে ‘এ সকল খাস বান্দাকে অন্য সব ‘আম’ বান্দার সমপর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এজন্য সে এরূপ খাস বান্দাদেরকে আল্লাহর বান্দা না বলে ‘আল্লাহর পুত্র’ বা ‘আল্লাহর মাহবূব’ (আল্লাহর প্রিয়) বলে। আর নিজেকে সে এরূপ ‘খাস বান্দাদের’ বান্দা বলে নামকরণ করে। যেমন ‘আব্দুল মাসীহ’, আব্দুল উয্যা, ইত্যাদি। ইহূদী, খৃস্টান, সাধারণ মুশরিক এবং মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর দীনের অনুসারী সীমালঙ্ঘনকারী মুনাফিকদের অধিকাংশই এই রোগে আক্রান্ত।’’[2]
৫. ৩. ১. ৪. কবর পূজারিগণ
শাহ ওয়ালিউল্লাহ তাঁর আল-বালাগুল মুবীন গ্রন্থে বলেন: ‘‘মুশরিকগণের চতুর্থ দলটি হইল কবর পূজারীদের দল। তাহাদের দাবী হইল যখন আল্লাহ তাআলার কোন বান্দা ইবাদত বন্দেগী সাধন-ভজন দ্বারা আল্লাহর দরবারে দোআ কবুল হওয়ার যোগ্য ব্যক্তিরূপে পরিগণিত হইয়াছেন, এইরূপ ব্যক্তির ইনতিকালের পর তাহার আত্মা বিরাট শক্তিশালী এবং ক্ষমতাশালী হইয়া থাকে। সুতরাং যে লোক এমন বুযুর্গের আকৃতি ও চেহারার ধ্যান করে অথবা তাহাদের থাকার স্থান এবং কবরকে খুব বিনয়, নম্রতার এবং ভক্তি সহকারে সিজদাহ করে, তাহার যাবতীয় অবস্থা সম্পর্কে এই বুযুর্গের আত্মা অবহিত হইয়া যায়; দুনিয়া ও পরকালের তাহার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিয়া দিয়া তাহার জন্য সুপারিশকারী হয়। উল্লেখিত শিরক ও বিদআতীদের বাতিল মতবাদ প্রচার করার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তাআলা এরশাদ করিয়াছেন...।
... ইহা আমাদের ভালভাবে বুঝা উচিত যে, উল্লেখিত কুরআনের আয়াতসমূহ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, অদৃশ্য আত্মা ও দেহসমূহের যে ইবাদত বন্দেগী এই পৃথিবীতে করা হয় এবং তাহাদের নিকট যে বস্ত্তর প্রার্থনা করা হয় ঐ সব আত্মা ও দেহসমূহ প্রার্থনাকারীদের প্রার্থনা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। হাশরের ময়দানে যখন আল্লাহ তাআলা তাহাদিগকে প্রার্থনাকারীদের প্রার্থনা করা সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করিবেন তখন তাহারা বলিবে আমরা এই সম্বন্ধে অবগত নহি। পূজারীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা ও আল্লাহর দরবারে তাহাদের জন্য শাফায়াত করা তো দূরের কথা, তাহাদের কাজকে আদৌ স্বীকৃতি দিবে না।’’[3]
[2] শাহ ওয়ালিউল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা ১/১৮২-১৮৩।
[3] শাহ ওয়ালি উল্লাহ দেহলবী, আল-বালাগুল মুবীন (বঙ্গানুবাদ), পৃ. ৫৯-৬১।