মহান আল্লাহ এ বিশ্বের সবকছি একটি নির্ধারিত নিয়মের অন্তর্ভুক্ত করে সৃষ্টি করেছেন, যাকে ‘সুন্নাতুল্লাহ’ বলা হয়। যেমন আগুনে পোড়া, বিষে মৃত্যু হওয়া, রৌদ্রে গরম হওয়া, পানিতে ভিজলে ঠান্ডা লাগা, ঝড়ে বা প্রবল বাতাসে গাছপালা বা বাড়িঘর ভেঙ্গে যাওয়া ইত্যাদি। এরূপ কার্য-কারণ বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী সকলেই জানেন। মুমিন বিশ্বাস করেন যে, সব কিছুর মূল কারণ মহান আল্লাহর ইচ্ছা ও দয়া। জাগতিক এ নিয়ম আল্লাহরই সৃষ্টি এবং তাঁরই নিয়ন্ত্রণে তা কাজ করে। আল্লাহ ইচ্ছা করলে নিয়মের কার্যকারিত স্থগিত বা নষ্ট করতে পারেন। এরূপ বিশ্বাস সহ মুমিন বলতে পারেন, বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা লেগেছে, বৃষ্টির কারণে ফসল ভাল হয়েছে, বিষের প্রভাবে তার মৃত্যু ঘটেছে, ঝড়ের কারণে গাছগুলি ভেঙ্গে গিয়েছে, পচাবাসি খেয়ে পেট নষ্ট হয়েছে, ঔষধ খেয়ে শরীরটা ভাল লাগছে ... ইত্যাদি। এরূপ বলা কোনোরূপ অন্যায় বলে বিবেচিত হয় না, যদিও মুমিন এ সকল ক্ষেত্রেও মহান আল্লাহর ইচ্ছার কথা সুস্পষ্ট বলতে ভালবাসেন। তবে যদি কেউ বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়াই ঔষধ রোগ সারায়, বিষ মানুষ মারে, ঝড় গাছ ভাঙ্গে বা অনুরূপ কোনো বিশ্বাস যদি তিনি পোষণ করেন তবে তা ‘শিরক আকবার’ বলে গণ্য হবে।
আরেক প্রকার উপকরণ-ওসীলা আছে যা জাগতিক নয়, বরং বিশ্বাসের বিষয় মাত্র। বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসের মাধ্যমে বিশ্বাসীদের মধ্যে বিশ্বাস জন্মে যে, বিশ্বের সকল বা বিশেষ কোনো কার্যের পিছনে অমুক কারণটি বিদ্যমান। অমুক কারণটি না হলে কার্যটি হতো না। যেমন একজন খৃস্টান বলতে পারেন, যীশুর ইচ্ছায় কাজটি হয়েছে, একজন হিন্দু বলতে পারেন, অমুক দেবী বা দেবতার করণে অমুক কাজটি হয়েছে। রাশির প্রভাবে বিশ্বাসী বলতে পারেন, অমুক রাশির প্রভাবে এ কাজটি হয়েছে।
জাগতিক উপকরণ এবং বিশ্বাসের উপকরণের মাধ্যমে পার্থক্য খুবই স্পষ্ট। জাগতিক উপকরণাদির ক্ষেত্রে বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী এবং সকল ধর্মের মানুষই একমত। কেউ যদি বলেন, খাদ্যে বিষক্রিয়ায় লোকটির পেট নষ্ট হয়েছে তবে কেউ কথাটিকে অবাস্তব বলে উড়িয়ে দিবেন না, তবে বিশ্বাসী বিশ্বাস করেন যে, মহান আল্লাহর ইচ্ছাতেই তা ঘটেছে। পক্ষান্তরে বিশ্বাস ভিত্তিক উপকরণ-ওসীলাগুলি অন্য বিশ্বাসের মানুষের পাগলামি বলে হেসে উড়িয়ে দিবেন।
একজন মুমিন তার বিশ্বাসভিত্তিক উপকরণাদি জানা ও বলার ক্ষেত্রে অবশ্যই কুরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট শিক্ষার উপর নির্ভর করবেন। জাগতিক ভাবে যা কারণ, উপকরণ বা ওসীলা নয় এবং কুরআন বা হাদীসে যাকে এরূপ উপকরণ বা কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় নি তাকে কোনো কিছুর কারণ বা উপকরণ বলে উল্লেখ করলে তা বিশ্বাসের অবস্থা অনুসারে শির্ক আকবার বা শির্ক আসগার হতে পারে।
যেমন একজন মুমিন বলতে পারেন যে, যাকাত প্রদান না করার কারণে অনাবৃষ্টি হয়েছে, ওযনে, পরিমানে কম বা ভেজাল দেওয়ার কারণে জীবনযাত্রার কাঠিন্য ও অশান্তি ছড়িয়ে পড়েছে, ন্যায় বিচার না থাকাতে দেশের উপর বিদেশী শক্তির প্রাধান্য বেড়েছে... যিক্র-ইসতিগফারের কারণে রিযকে বরকত এসেছে, ঈমান ও তাকওয়ার প্রসারতার কারণে দেশে শান্তি ও বরকত এসেছে....। মুমিন এগুলি বলেন এবং বিশ্বাস করেন যে, এগুলি সত্যিকার কারণ ও উপকরণ-ওসীলা। কুরআন ও হাদীসে সুস্পষ্টত এগুলিকে এ সকল বিষয়ের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
কিন্তু মুমিন বলতে পারেন না যে, অমুক রাশির প্রভাবে বৃষ্টি হয়েছে বা সুনামি হয়েছে বা অমুক রাশিতে চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণের ফলে অমুক বিষয়টি ঘটেছে। কারণ এগুলি কখনোই জাগতিক বৈজ্ঞানিক কার্যকরণের অন্তর্ভুক্ত নয় এবং কুরআন-হাদীস নির্দেশিত কারণও নয়। বিশেষত প্রাচীন যুগের তারকা পূজারী বা গ্রহ-নক্ষত্রের পূজারিগণ রশি বা গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাবে বিশ্বাসী ছিলেন। এ কথাগুলি তাদেরই কথা। যদি কেউ প্রকৃতই বিশ্বাস করেন যে, রাশিচক্র ইত্যাদির নিজস্ব প্রভাব আছে বিশ্ব পরিচালনা ও বিশ্বের বিভিন্ন বিষয় সংঘটনের ক্ষেত্রে তবে তিনি শিরক আকবারে লিপ্ত প্রকৃত মুশরিক বলে গণ্য।
অনুরূপভাবে যদি কেউ মনে করেন আল্লাহর ইচ্ছাতেই এরূপ হয়, তবে আল্লাহ অমুক রাশি উপলক্ষে এরূপ করেন তবে তা শিরক আসগার পর্যায়ের কঠিন কবীরা গোনাহ বলে গণ্য হবে। কারণ তিনি বাহ্যত শিরকী কথা বলেছেন এবং আল্লাহর নেয়ামত অন্য কিছুর প্রতি আরোপ করেছেন। উপরন্তু তা আল্লাহর নামে কঠিন মিথ্যচার বলে গণ্য হবে। কারণ কখনো কোথাও অল্লাহ ওহীর মাধ্যমে জানান নি যে, এগুলি এরূপ বিষয়ের কারণ।
আর যদি কেউ পূর্ববর্তী ধর্মের প্রভাবে কথার মধ্যে এরূপ বলে ফেলেন কিন্তু তিনি বিশ্বাস করেন যে, এগুলির একমাত্র পরিচালক আল্লাহ, রাশিচক্র বা অনুরূপ কোনো কিছু এক্ষেত্রে কোনোরূপ দখল নেই, তবে তা ‘শিরক আসগার’ বলে গণ্য হবে, যা কঠিন কবীরা গোনাহ। কারণ তিনি মহান আল্লাহর দেওয়া একটি নিয়ামতকে এমন বিষয়ের সাথে সংযুক্ত করেছেন যার সাথে এর কোনোরূপ সম্পর্ক নেই। তিনি তার কথায় আল্লাহর নিয়ামত অস্বীকার করেছেন।
যাইদ ইবনু খালিদ আল-জুহানী (রাঃ) বলেন, হুদাইবিয়ায় অবস্থানকালে রাত্রিকালে কিছু বৃষ্টিপাত হয়। প্রত্যুষে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের নিয়ে সালাতুল ফাজর আদায় করেন। সালাত শেষ করে তিনি সমবেত মানুষদের দিকে মুখ করে বলেন, তোমরা কি জান, তোমাদের রবব কি বলেছেন? তাঁরা বলেন, ‘আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল উত্তম জানেন’। তিনি বলেন, মহান আল্লাহ বলেছেন,
قَالَ أَصْبَحَ مِنْ عِبَادِي مُؤْمِنٌ بِي وَكَافِرٌ فَأَمَّا مَنْ قَالَ مُطِرْنَا بِفَضْلِ اللَّهِ وَرَحْمَتِهِ فَذَلِكَ مُؤْمِنٌ بِي كَافِرٌ بِالْكَوْكَبِ وَأَمَّا مَنْ قَالَ مُطِرْنَا بِنَوْءِ كَذَا وَكَذَا فَذَلِكَ كَافِرٌ بِي مُؤْمِنٌ بِالْكَوْكَبِ
‘‘আমার বান্দাদের মধ্যে কেউ সকালে আমার প্রতি ঈমান এনেছে এবং কেউ আমার প্রতি কুফ্রী করেছে। যে ব্যক্তি বলেছে, আমরা আল্লাহর মহানুভবতা ও দয়ার কারণে বৃষ্টি পেয়েছি সে আমার প্রতি ঈমানদার এবং গ্রহনক্ষত্রের প্রতি কাফির। আর যে ব্যক্তি বলেছে, আমরা অমুক অমুক রাশির ফলে বৃষ্টি পেয়েছি তারা আমার প্রতি কুফরী করেছে এবং গ্রহনক্ষত্রে ঈমান এনেছে।’’[1]