জান্নাতে মহান আল্লাহর দর্শনই হবে মুমিনগণের সর্বোচ্চ ও শ্রেষ্ঠতম নিয়ামত। কুরআন কারীমের এবং অগণিত হাদীসে বারংবার এ নিয়ামতের সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন:
وُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ نَاضِرَةٌ إِلَى رَبِّهَا نَاظِرَةٌ
‘‘সেদিন কোনো কোনো মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হবে, তারা তাদের প্রতিপালকের দিকে তাকিয়ে থাকবে।’’[1]
আখিরাতে মহান আল্লাহর দর্শনের বিষয়ে বর্ণিত হাদীসগুলি বহু-সংখ্যক বা ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ের। এক হাদীসে আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন:
إنَّ أُنَاسًا فِي زَمَنِ النَّبِيِّ (ﷺ) قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ هَلْ نَرَى رَبَّنَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ قَالَ النَّبِيُّ (ﷺ) نَعَمْ هَلْ تُضَارُّونَ فِي رُؤْيَةِ الشَّمْسِ بِالظَّهِيرَةِ ضَوْءٌ لَيْسَ فِيهَا سَحَابٌ قَالُوا لا قَالَ وَهَلْ تُضَارُّونَ فِي رُؤْيَةِ الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ ضَوْءٌ لَيْسَ فِيهَا سَحَابٌ قَالُوا لا
‘‘নবী (ﷺ)-এর যুগে কিছু মানুষ বলে, হে আল্লাহর রাসূল, আমরা কি কিয়ামতের দিন আমাদের প্রতিপালককে দেখব? তখন নবী (ﷺ) বলেন: হ্যাঁ। দ্বিপ্রহরের সময় আলোকোজ্জ্বল আকাশে যদি কোনো মেঘ না থাকে তবে সূর্য দেখতে কি তোমাদের কোনো অসুবিধা হয়? তারা বলেন: না। তিনি বলেন: পুর্ণিমার রাতে আলোকোজ্জ্বল আকাশে যদি কোনো মেঘ না থাকে তাহলে কি চাঁদ দেখতে তোমরা বাধাগ্রস্ত হও? তারা বলেন: না।’’[2]
অন্য হাদীসে আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন,
قُلْنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ هَلْ نَرَى رَبَّنَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ قَالَ هَلْ تُضَارُونَ فِي رُؤْيَةِ الشَّمْسِ وَالْقَمَرِ إِذَا كَانَتْ صَحْوًا قُلْنَا لا قَالَ فَإِنَّكُمْ لا تُضَارُونَ فِي رُؤْيَةِ رَبِّكُمْ يَوْمَئِذٍ إِلا كَمَا تُضَارُونَ فِي رُؤْيَتِهِمَا
‘‘আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমরা কি কিয়ামতের দিন আমাদের প্রতিপালককে দেখব? তিনি বলেন, আকাশ পরিষ্কার থাকলে সূর্য বা চন্দ্র দেখতে কি তোমাদের কোনো কষ্ট হয়? আমরা বললাম: না। তিনি বলেন: সেদিন তোমাদের প্রতিপালককে দেখতে তোমাদের কোনো কষ্ট বা অসুবিধা হবে না, ঠিক যেমন চন্দ্র ও সূর্য দেখতে অসুবিধা হয় না।’’[3]
অন্য হাদীসে জরীর ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন:
كُنَّا عِنْدَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَنَظَرَ إِلَى الْقَمَرِ لَيْلَةً يَعْنِي الْبَدْرَ فَقَالَ إِنَّكُمْ سَتَرَوْنَ رَبَّكُمْ كَمَا تَرَوْنَ هَذَا الْقَمَرَ لا تُضَامُّونَ فِي رُؤْيَتِهِ
‘‘আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট ছিলাম। রাতটি ছিল পূর্ণিমার রাত। তিনি চাঁদের দিকে তাকালেন এবং বললেন: তোমরা যেভাবে এ চাঁদকে দেখছ, কোনোরূপ অসুবিধা হচ্ছে না, সেভাবেই তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে দেখবে।’’[4]
এ সকল আয়াত ও হাদীসের আলোকে সাহাবীগণ ও তাঁদের অনুসারী আহলুস সুন্নাতের অনুসারীগণ প্রত্যয়ের সাথে বিশ্বাস করেন যে, জান্নাতে মুমিনগণ মহান আল্লাহকে দর্শন করবেন। খারিজী, মু’তাযিলী ও সমমনা কোনো কোনো ফিরকা আখিরাতে মহান আল্লাহর দর্শনের কথা অস্বীকার করে। কুরআনের কিছু আয়াত ও কিছু যুক্তি তাদের দলিল। মহান আল্লাহ বলেন:
لا تُدْرِكُهُ الأَبْصَارُ وَهُوَ يُدْرِكُ الأَبْصَارَ وَهُوَ اللَّطِيفُ الْخَبِيرُ
‘‘তিনি দৃষ্টির অধিগম্য নন, কিন্তু দৃষ্টিশক্তি তাঁর অধিগত; এবং তিনিই সূক্ষ্মদর্শী, সম্যক পরিজ্ঞাত’’[5]
অন্যত্র তিনি বলেন:
وَمَا كَانَ لِبَشَرٍ أَنْ يُكَلِّمَهُ اللَّهُ إِلا وَحْيًا أَوْ مِنْ وَرَاءِ حِجَابٍ أَوْ يُرْسِلَ رَسُولا فَيُوحِيَ بِإِذْنِهِ مَا يَشَاءُ إِنَّهُ عَلِيٌّ حَكِيمٌ
‘‘কোনো মানুষের জন্যই সম্ভব নয় যে, আল্লাহ তার সাথে কথা বলবেন ওহীর মাধ্যম ব্যতিরেকে, অথবা পর্দার অন্তরাল ব্যতিরেকে, অথবা এমন দূত প্রেরণ ব্যতিরেকে, যে দূত তার অনুমতিক্রমে তিনি যা চান তা ব্যক্ত করেন, তিনি সমুন্নত, প্রজ্ঞাময়’’[6]
মূসা (আঃ) যখন আল্লাহকে দেখতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন তখন তিনি বলেন:
لَنْ تَرَاني
‘‘তুমি আমাকে দেখবে না।’’[7]
এ সকল আয়াতের ভিত্তিতে তারা দবি করেন যে, মহান আল্লাহকে আখিরাতে দর্শন করা সম্ভব নয়; কারণ তিনি দৃষ্টির অধিগম্য নন। তারা আরো যুক্তি পেশ করেন যে, মহান আল্লাহ স্থান-কাল-পাত্রের ঊর্ধ্বে। তাকে দেখা যাবে বলে বিশ্বাস করার অর্থই হলো তাকে স্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ বলে বিশ্বাস করা। এছাড়া মহান আল্লাহ বলেছেন যে, তিনি কোনো কিছুর সাথে তুলনীয় নন। তাঁকে দেখা যাবে বলে বিশ্বাস করার অর্থই তাকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করা। এ সকল যুক্তির ভিত্তিতে তারা এ বিষয়ক আয়াত ও হাদীস বিভিন্ন ব্যাখ্যা ও আপত্তির মাধ্যমে বাতিল করে দেন।
আমরা ইতোপূর্বে বলেছি যে, বিশ্বাসের বিষয়টি গাইব বা অদৃশ্য জগতের সাথে সংশ্লিষ্ট। এক্ষেত্রে ওহীর কাছে আত্মসমর্পনই মুক্তির একমাত্র পথ। ওহীর মাধ্যমে আমরা জানি যে, পৃথিবীতে আল্লাহ কোনো নবীর সাথেও দেখা দেন না এবং তিনি দৃষ্টির অধিগম্য নন। আবার ওহীর মাধ্যমেই আমরা জানি যে, কিয়ামতে কিছু মানুষ তাদের প্রতিপালকের দিকে তাঁকিয়ে থাকবেন এবং মুমিনগণ তাদের প্রতিপালককে দেখবেন। আর এতদুভয়ের মধ্যে মূলত কোনো বৈপরীত্য নেই। যা কিছু বৈপরীত্য কল্পনা করা হয় তা সবই আখিরাত বা গাইবী জগতকে পার্থিব জগতের মত কল্পনা করার ফল এবং ওহীর নিকট আত্মসমর্পন না করার পরিণতি। মহান আল্লাহর বিশেষণকে মানবীয় বিশেষণের উপর ‘কিয়াস’ করে বা মানবীয় বিশেষণের মত মনে করে দর্শন ও যুক্তি দিয়ে বিচার করতে যেয়ে এরা বিভ্রান্তির মধ্য নিপতিত হয়েছে। আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অনুসারীগণ এ বিষয়ে তাঁদের মূলনীতির অনুসরণে সকল আয়াত ও হাদীস সমানভাবে বিশ্বাস করেন। কারণ উভয় বিষয়ই ওহীর মাধ্যমে আল্লাহ জানিয়েছেন। আর উভয়ের মধ্যে কোনো সংঘর্ষ বা সুস্পষ্ট বৈপরীত্য নেই। মানবীয় জ্ঞান আখিরাতে আল্লাহর দর্শন অসম্ভব বলে গণ্য করে না। কাজেই আখিরাতের দর্শনের খুটিনাটি বিষয় মানবীয় কল্পনা দিয়ে অনুধাবনের চেষ্টা করা বা তা অস্বীকার করা বিভ্রান্তি বৈ কিছুই নয়।
আখিরাতে আল্লাহর দর্শনের বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বলেন:
والله تعالي يُرَي في الآخرة، ويراه المؤمنون وهم في الجنة بأعين رؤوسهم بلا تشبيه ولا كيفية
‘‘আখিরাতে মহান আল্লাহ পরিদৃষ্ট হবেন। জান্নাতের মধ্যে অবস্থানকালে মুমিনগণ তাঁকে দর্শন করবেন তাদের নিজেদের চর্মচক্ষু দ্বারা। এই দর্শন সকল তুলনা ও স্বরূপ-প্রকৃতি নির্ধারণ ব্যতিরেকে।’’[8]
এ বিষয়ে ইমাম তাহাবী বলেন: ‘‘জান্নাতবাসীদের জন্য আল্লাহর দর্শন লাভ সত্য। তা হবে বিনা পরিবেষ্টনে এবং আমাদের বোধগম্য কোনো ধরন বা প্রকৃতি ব্যতীত। আমাদের প্রতিপালকের গ্রন্থে এই সম্পর্কে স্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে: ‘‘সে দিন অনেকের মুখ মন্ডল উজ্জ্বল হবে, তারা তাদের প্রতিপালকের পানে দৃষ্টিমান থাকবে।’’[9] এ বাণীর ব্যাখ্যা আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছা ও তাঁর প্রদত্ত শিক্ষার ভিত্তিতে হবে। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সহীহ হাদীসে যা বর্ণিত আছে তা যেভাবে তিনি বলেছেন সে ভাবেই গ্রহণ করতে হবে এবং এর দ্বারা তিনি যে উদ্দেশ্য করেছেন তা স্বীকার করে নিতে হবে। এতে আমরা নিজেদের মতামত অনুসারে অপব্যাখ্যার মাধ্যমে বা নিজেদের প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে কোনো অর্থের অনুপ্রবেশ ঘটাব না। কারণ, দ্বীনের ব্যা্পারে কেবল সেই ব্যক্তিই ভ্রান্তি ও পদস্খলন থেকে নিরাপদ থাকতে পারে যে মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর নিকট নিজেকে সমর্পন করে এবং তাঁর নিকট সংশয়যুক্ত বিষয়ের সঠিক জ্ঞান এর জ্ঞাতার উপর ছেড়ে দেয়। পূর্ণ আত্মসমর্পণ ও বশ্যতা স্বীকার ব্যতিরেকে কারো ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। সুতরাং যে ব্যক্তি এমন কোনো জ্ঞান অর্জনে সচেষ্ট হবে যা জানা তার জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং যার বুদ্ধি আত্মসমর্পনের মাধ্যমে তুষ্ট হয় না সে খালেস তাওহীদ, পরিচ্ছন্ন জ্ঞান ও বিশুদ্ধ ঈমান থেকে দূরে থাকবে। এমতাবস্থায়, সে কুফরী ও ঈমান, সমর্পন ও অস্বীকৃতি এবং গ্রহণ ও প্রত্যাখ্যানের মাঝামাঝি প্রবঞ্চিত, ওয়াওয়াসাগ্রস্ত, দিশাহারা ও সংশয়ী হয়ে দোটানায় দোদুল্যমান থেকে যায়। সে না হয় পূর্ণ সমর্পক মু‘মিন এবং না হয় দুঢ় অবিশ্বাসী কাফির। জান্নাত বাসীদের সম্পর্কে আল্লাহ পাকের দর্শন লাভ সম্পর্কে এমন লোকের ঈমান বিশুদ্ধ হবে না, যে এটাকে তাদের পক্ষে বিশেষ কল্পনার বিষয় মনে করবে বা স্বীয় জ্ঞানানুসারে এর অপব্যাখ্যা করবে। কারণ, আল্লাহর দর্শন এবং তাঁর রুবুবিয়্যাত সম্পর্কিত প্রতিটি বিষয়ের সঠিক ব্যাখ্যা হলো এর ব্যাখ্যা থেকে বিরত থাকা এবং তা অবিকৃতভাবে গ্রহণ করা। এই নীতির উপরই মুসলিমদের ধর্ম প্রতিষ্ঠিত। আর, যে ব্যক্তি (আল্লাহর গুণাবলীর ক্ষেত্রে) অস্বীকৃতি ও তুলনা করা হতে আত্মরক্ষা না করবে তার অবশ্যই পদস্খলন ঘটবে এবং সঠিকভাবে আল্লাহর পবিত্রতায় বিশ্বাস স্থাপনে ব্যর্থ হবে। কেননা, আমাদের মহামহিম প্রভু অনন্য অতুলনীয় গুণাবলির দ্বারা বিশেষিত এবং একত্বের বিশেষণে বিভূষিত। বিশ্বলোকের কেউ তাঁর গুণে গুণান্বিত নয়।’’[10]
[2] বুখারী, আস-সহীহ ১/২৭৭; ৪/১৬৭১; ৫/২৪০৩; ৬/২৭০৪; মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৬৩-১৬৭, ৪/২২৭৯।
[3] বুখারী, আস-সহীহ ৬/২৭০৬; মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৬৭।
[4] বুখারী, আস-সহীহ ১/২০৩, ২০৯, ৪/১৮৩৬, ৬/২৭০৩; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৪৩৯।
[5] সূরা (৬) আন‘আম: ১০৩ আয়াত।
[6] সূরা (৪২) শূরা: ৫১ আয়াত।
[7] সূরা (৭) আরাফ: ১৪৩ আয়াত।
[8] ইমাম আবূ হানীফা, আল-ফিকহুল আকবার (খামীস-এর শারহ-সহ), পৃ. ৬৭।
[9] সুরা কিয়ামাহ: ২২-২৩ আয়াত।
[10] আবূ জা’ফর তাহাবী, মাতনুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ১০।