কুরআন কারীম বারংবার উল্লেখ করেছে যে, নবী-রাসূলগণ সকলেই আল্লাহর বান্দা ও মানুষ ছিলেন। তাঁরা সকলেই পুরুষ ছিলেন। আমরা ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, পূর্ববর্তী নবীগণের নুবুওয়াত অস্বীকার করার ক্ষেত্রে কাফিরগণের বড় ‘দলিল’ ছিল যে, নবীগণ তাদের মতই মানুষ, কাজেই তাঁরা নবী হতে পারেন না। অপরদিকে কোনো কোনো বিভ্রান্ত সম্প্রদায় তাদের নবীদের অলৌকিক কর্মকান্ড, আয়াত বা মুজিযাকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করে তাঁদেরকে আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত বা উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং আল্লাহর বিশেষ বান্দা হওয়ার কারণে তাদেরকে ‘আল্লাহর পুত্র’ বা ‘আল্লাহর সন্তান’ বলে আখ্যায়িত করেছে। কুরআন কারীমে সকল বিভ্রান্তির অপনোদন করে বারংবার উল্লেখ করা হয়েছে যে, নবীগণ মানুষ ছিলেন, তবে তাঁর আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহপ্রাপ্ত ও ওহীপ্রাপ্ত মানুষ ছিলেন। তাঁরা কোনো ‘ঐশ্বরিক ক্ষমতা’ বা কারো কল্যাণ বা অকল্যাণ করার অধিকারী ছিলেন না। তাঁদের মর্যাদা আল্লাহর প্রিয়তম বান্দা ও রাসূল হওয়ায়; আল্লাহর ক্ষমতা, গুণাবলি বা ইবাদত পাওয়ার বিষয়ে আল্লাহর শরীক হওয়ায় নয়।
তাঁদের মানবত্ব প্রমাণের জন্য মহান আল্লাহ মাঝে মাঝে তাঁদের মানবীয় দিকগুলি উল্লেখ করেছেন, যেমন তাঁদের খাদ্যগ্রহণ, বাজার করা, বিবাহ-শাদি, সন্তান গ্রহণ, মৃত্যুবরণ, মানবীয় সীমাবদ্ধতা, কল্যাণ-অকল্যাণে অক্ষমতা, আল্লাহর ইচ্ছা ও নির্দেশের বাইরে কোনো অলৌকিক কর্ম করতে না পারা ইত্যাদি। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন:
قَالُوا إِنْ أَنْتُمْ إِلا بَشَرٌ مِثْلُنَا تُرِيدُونَ أَنْ تَصُدُّونَا عَمَّا كَانَ يَعْبُدُ آَبَاؤُنَا فَأْتُونَا بِسُلْطَانٍ مُبِينٍ. قَالَتْ لَهُمْ رُسُلُهُمْ إِنْ نَحْنُ إِلا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ وَلَكِنَّ اللَّهَ يَمُنُّ عَلَى مَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ وَمَا كَانَ لَنَا أَنْ نَأْتِيَكُمْ بِسُلْطَانٍ إِلا بِإِذْنِ اللَّهِ وَعَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ
‘‘তারা (কাফিরগণ) বলত: ‘তোমরা (নবীগণ) তো আমাদেরই মত মানুষ। আমাদের পিতৃপুরুষগণ যাদের ইবাদত করত তোমরা তাদের ইবাদত থেকে আমাদেরকে বিরত রাখতে চাও। অতএব তোমরা আমাদের নিকট কোনো অকাট্য প্রমাণ (অলৌকিক চিহ্ন বা মুজিযা) উপস্থিত কর। তাদের রাসূলগণ তাদেরকে বলতেন: সত্য বটে আমরা তোমাদের মত মানুষই, কিন্তু আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা অনুগ্রহ করেন। আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত তোমাদের নিকট প্রমাণ (মুজিযা) উপস্থিত করা আমাদের কাজ নয়। মুমিনগণের আল্লাহরই উপর নির্ভর করা উচিত।’’[1]
অন্যত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ إِلا رِجَالًا نُوحِي إِلَيْهِمْ مِنْ أَهْلِ الْقُرَى
‘‘আপনার পূর্বে জনপদবাসীদের মধ্য থেকে পুরুষ মানুষগণকে ছাড়া কাউকে প্রেরণ করি নি (রিসালাত-নুবওয়াতের দায়িত্ব প্রদান করি নি), যাদেরকে আমি ওহী প্রদান করেছিলাম।’’[2]
মহান আল্লাহ আরো বলেন:
وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَسُولٍ إِلا بِلِسَانِ قَوْمِهِ لِيُبَيِّنَ لَهُمْ فَيُضِلُّ اللَّهُ مَنْ يَشَاءُ وَيَهْدِي مَنْ يَشَاءُ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
‘‘আমি প্রত্যেক রাসূলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি, তাদের নিকট পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য; অতঃপর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন এবং যাকে ইচ্ছা সৎপথে পরিচালিত করেন এবং তিনি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।’’[3]
অর্থাৎ নবী-রাসূলগণের দায়িত্ব তাদের সম্প্রদায়ের বোধগম্য ভাষায় দীনের কথা প্রচার ও ব্যাখ্যা করা। হেদায়াত করা বা না করা তাদের দায়িত্ব নয়, বরং তা আল্লাহর দায়িত্ব। আল্লাহ আরো বলেন:
وَمَا أَرْسَلْنَا قَبْلَكَ مِنَ الْمُرْسَلِينَ إِلا إِنَّهُمْ لَيَأْكُلُونَ الطَّعَامَ وَيَمْشُونَ فِي الأَسْوَاقِ
‘‘তোমার পূর্বে আমি যে সব রাসূল প্রেরণ করেছি তার সকলেই তো আহার করত এবং হাটে বাজারে চলাফেরা করত।’’[4]
মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন:
مَا الْمَسِيحُ ابْنُ مَرْيَمَ إِلا رَسُولٌ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ وَأُمُّهُ صِدِّيقَةٌ كَانَا يَأْكُلانِ الطَّعَامَ
‘‘মারইয়াম তনয় মসীহ তো একজন রাসূল মাত্র, তার পূর্বে বহু রাসূল গত হয়েছে, এবং তার মাতা সত্যনিষ্ঠ ছিল। তারা উভয়ে খাদ্যাহার করত।’’[5]
অন্যত্র তিনি বলেন:
وَمَا مُحَمَّدٌ إِلا رَسُولٌ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ أَفَإِنْ مَاتَ أَوْ قُتِلَ انْقَلَبْتُمْ عَلَى أَعْقَابِكُمْ
‘‘মুহাম্মাদ একজন রাসূল মাত্র; তার পূর্বে রাসূলগণ গত হয়েছে। সুতরাং যদি সে মৃত্যু বরণ করে অথবা নিহত হয় তবে কি তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে?’’[6]
মহান আল্লাহ আরো বলেন:
وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلا مِنْ قَبْلِكَ وَجَعَلْنَا لَهُمْ أَزْوَاجًا وَذُرِّيَّةً وَمَا كَانَ لِرَسُولٍ أَنْ يَأْتِيَ بِآَيَةٍ إِلا بِإِذْنِ اللَّهِ لِكُلِّ أَجَلٍ كِتَابٌ
‘‘তোমার পূর্বেও অনেক রাসূল প্রেরণ করেছিলাম এবং তাদের স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দিয়েছিলাম। আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত কোনো নিদর্শন (মুজিযা) উপস্থিত করা কোনো রাসূলের কাজ নয়। প্রক্যেক বিষয়ে নির্ধারিত কাল লিপিবদ্ধ।’’[7]
অন্যত্র বলা হয়েছে:
إِلا قَوْلَ إِبْرَاهِيمَ لأَبِيهِ لأسْتَغْفِرَنَّ لَكَ وَمَا أَمْلِكُ لَكَ مِنَ اللَّهِ مِنْ شَيْءٍ
‘‘তবে ইবরাহীম তার পিতাকে বলেছিল: আমি নিশ্চয় তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব এবং আমি তোমার ব্যাপারে আল্লাহর নিকট কোনো অধিকার রাখি না।’’[8]
ইতোপূর্বে তৃতীয় অধ্যায়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ইলম ও ক্ষমতা বিষয়ক আলোচনায় আমরা এ অর্থে কয়েকটি আয়াত দেখতে পেয়েছি।
[2] সূরা (১২) ইউসূফ: ১০৯ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা (১৬) নাহল: ৪৩ আয়াত; সূরা (২১) আম্বিয়া: ৭ আয়াত।
[3] সূরা (১৪) ইবরাহীম: ৪ আয়াত।
[4] সূরা (২৫) ফুরকান: ২০ আয়াত।
[5] সূরা (৫) মায়িদা: ৭৫ আয়াত।
[6] সূরা (৩) আল-ইমরান: ১৪৪ আয়াত।
[7] সূরা (১৩) রা’দ: ৩৮ আয়াত।
[8] সূরা (৬০) মুমতাহিনা: ৪ আয়াত।