মুসলিমের দায়িত্ব হলো রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সঠিক মর্যাদা নিরূপনে এবং তাঁকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের ব্যাপারে পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসের উপর নির্ভর করা। আমরা জানি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সম্মান ও মর্যাদা অবগত হওয়া মুমিনের ঈমানের অংশ ও মৌলিক বিষয়। সকল মুমিনের দায়িত্ব এক্ষেত্রে সমান। কাজেই আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে, বিষয়টি আল্লাহ কুরআন কারীমে সহজভাবে সকলের বোধগম্য করেই বর্ণনা করেছেন। এছাড়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিষয়টি তাঁর সাহাবীগণকে জানিয়েছেন। তাঁরাও মুমিনের ঈমানের বিশুদ্ধতার জন্য এভাবেই গুরুত্বের সাথে তা তাবিয়ীগণকে শিখিয়েছেন। এভাবে বিষয়গুলি অবশ্যই কুরআনে বা মুতাওয়াতির-মাশহূর সহীহ হাদীস সমূহে স্পষ্ট ও সর্বজনবোধগম্যভাবে বর্ণিত হয়েছে। কুরআন ও হাদীসে তাঁর সম্মান, মর্যাদা, দায়িত্ব, ক্ষমতা, অধিকার ও আল্লাহর সাথে তাঁর সম্পর্কের কথা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে শেখান হয়েছে। মুসলিমের দায়িত্ব হলো, তাঁর ব্যাপারে কুরআন কারীমে বা সহীহ হাদীসে যা বলা হয়েছে তা সবকিছু পরিপূর্ণভাবে সর্বান্তঃকরণে বিশ্বাস করা। নিজের থেকে কোনো কিছু বাড়িয়ে বলা যাবে না। কারণ আমরা বা উম্মাতের আলিমগণ যা কিছুই বলেন না কেন সবই মানবীয় ইজতিহাদ। আর বিশ্বাস ও আকীদার ভিত্তি ওহী। মানবীয় কথাকে ওহীর সাথে সংমিশ্রণ করলে বা ওহীর মর্যাদা দিলে সীমালঙ্ঘন ঘটতে পারে।
পূর্ববর্তী নবীগণের উম্মাত এরূপ বাড়াবাড়ি বা সীমালঙ্ঘনের কারণে বিভ্রান্ত হয়েছে বলে আমরা কুরআন ও হাদীস থেকে জানতে পারি। নবীগণের প্রতি অবিশ্বাস যেমন মানুষদেরকে ধ্বংস করেছে, তেমনি ধ্বংস করেছে নবীগণের প্রতি ভক্তিতে সীমালঙ্ঘন। এজন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর উম্মাতকে এ বিষয়ে সতর্ক করেছেন।
আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রা) বলেন, উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) মিম্বারের উপরে বক্তৃতায় বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
لا تُطْرُونِي كَمَا أَطْرَتْ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ فَقُولُوا عَبْدُ اللَّهِ وَرَسُولُهُ.
‘‘খৃস্টানগণ যেরূপ ঈসা ইবনু মারিয়ামকে বাড়িয়ে প্রশংসা করেছে তোমরা সেভাবে আমার বাড়িয়ে প্রশংসা করবে না। আমি তো তাঁর বান্দা মাত্র। অতএব তোমরা বলবে: আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল।’’[1]
এখানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর উম্মাতকে প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। বাড়াবাড়ির অর্থ হলো তাঁর বিষয়ে পবিত্র কুরআন ও হাদীসের শিক্ষার অতিরিক্ত কিছু বড়িয়ে বলা যা তিনি আমাদেরকে বলেন নি। তিনি খৃস্টানদের বাড়াবাড়ির দিকে উম্মাতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাদেরকে সতর্ক করেছেন। কুরআন কারীমে মহান আল্লাহ খৃস্টানদের এই বাড়াবাড়ির বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ বলেন:
يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لا تَغْلُوا فِي دِينِكُمْ وَلا تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ إِلا الْحَقَّ إِنَّمَا الْمَسِيحُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ رَسُولُ اللَّهِ وَكَلِمَتُهُ أَلْقَاهَا إِلَى مَرْيَمَ وَرُوحٌ مِنْهُ فَآَمِنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ وَلا تَقُولُوا ثَلاثَةٌ
‘‘হে কিতাবীগণ, দীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না এবং আল্লাহ্ সম্বন্ধে সত্য ব্যতীত বলো না। মরিয়ম তনয় ঈসা মাসীহ আল্লাহর রাসূল, এবং তাঁর বাণী, যা তিনি মরিয়মের নিকট প্রেরণ করেছিলেন এবং তাঁর থেকে (আগত) আত্মা (আদেশ)। সুতরাং তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলে উপর ঈমান আন এবং বলিও না ‘তিন’...।[2]
ঈসা (আঃ)-এর বিষয়ে খৃস্টানদের বাড়াবাড়ির স্বরূপ ছিল তাঁর বিষয়ে আল্লাহর দেওয়া এ সকল বিশেষণকে বাড়িয়ে ব্যাখ্যা করে তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধির অপচেষ্টা করা। আল্লাহ তাঁর বিষয়ে বলেছেন যে, তিনি ‘আল্লাহর কালিমা’ এবং ‘আল্লাহর পক্ষ থেকে রূহ’। ‘কালিমাতুল্লাহ’, ‘রূহুল্লাহ’ ইত্যাদি শব্দ শুনে কিছু ভক্তের মনে যে অতিভক্তির প্লাবন তৈরি হয়, সেগুলিই ক্রমান্বয়ে ভয়ানক শির্কে পরিণত হয়। তারা দাবি করেন যে, আল্লাহর কালিমা আল্লাহর সিফাত বা বিশেষণ যা তাঁর সত্তার অংশ ও তাঁরই মত অনাদি, সেহেতু ‘ঈসা’ (আঃ) আল্লাহর যাত বা সত্তার অংশ। আর আল্লাহর রূহ আল্লাহরই সত্তার অংশ। এভাবে তারা দাবি করে যে, ঈশ্বরের সত্তার তিনটি ব্যক্তিত্ব ‘আল্লাহ বা ‘পিতা’, কালিমাতুল্লাহ বা ইবনুল্লাহ অর্থাৎ পুত্র এবং রূহুল্লাহ বা পবিত্রআত্মা। এ তিন ব্যক্তি সমন্বয়ে এক ঈশ্বর (নাঊযু বিল্লাহ)।
তাদের এ ব্যাখ্যাভিত্তিক আকীদা বাইবেলের কোথাও সুস্পষ্টভাবে বলা হয় নি। বরং বাইবেলের অগণিত নির্দেশনা এর সাথে সুস্পষ্টভাবে সাংঘর্ষিক। তারা তাদের এরূপ ব্যাখ্যাভিত্তিক মতামতকে মূল আ্কীদা হিসেবে গ্রহণ করে এর সাথে সাংঘর্ষিক তাওরাত ও ইঞ্জিলের তাওহীদ বিষয়ক ও ঈসা (আঃ)-এর মনুষ্যত্ব বিষয়ক অগণিত সুস্পষ্ট আয়াতকে অপব্যাখ্যা করে। এ সকল অপব্যাখ্যা গেলানোর জন্য অনেক দার্শনিক যুক্তি পেশ করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এভাবে ঈসা (আঃ)-এর মর্যাদা বৃদ্ধি করা।
এ দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে আল্লাহ বলেন, ঈসার (আঃ) বিষয়ে আল্লাহ যতটুকু বলেছেন তোমরা ততটুকুই বল, কারণ ততটুকুই হক্ক ও সত্য। তার অতিরিক্ত বলো না, কারণ ব্যাখ্যা তাফসীরের নামে তোমরা যা বলছ তা বাতিল ও অসত্য। তোমরা তাঁকে কালিমাতুল্লাহ এবং রূহুল্লাহ বল, তবে কালিমাতুল্লাহ বা রূহুল্লাহর ব্যাখ্যা করে বাড়িয়ে কিছু বলো না। অন্যত্র আল্লাহ উল্লেখ করেছেন যে, এ সকল বাড়াবাড়ির পিছনে রয়েছে কতিপয় ‘পন্ডিতের’ প্রতি পরবর্তীদের অন্ধ ভক্তি ও তাদের অন্ধ অনুকরণ। আল্লাহ বলেন:
قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لا تَغْلُوا فِي دِينِكُمْ غَيْرَ الْحَقِّ وَلا تَتَّبِعُوا أَهْوَاءَ قَوْمٍ قَدْ ضَلُّوا مِنْ قَبْلُ وَأَضَلُّوا كَثِيرًا وَضَلُّوا عَنْ سَوَاءِ السَّبِيلِ
‘‘বল, হে কিতাবীগণ, তোমরা তোমাদের দীনের বিষয়ে বাড়াবাড়ি করো না এবং সে সম্প্রদায় ইতোপূর্বে পথভ্রষ্ট হয়েছে ও অনেককে পথভ্রষ্ট করেছে এবং সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে তাদের মর্জিমাফিক মতামতের অনুসরণ করো না।’’[3]
তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, খৃস্টানগণের অতিভক্তি ও বাড়াবাড়ির স্বরূপ ছিল ওহীর মধ্যকার কতিপয় দ্ব্যর্থবোধক শব্দের অতিভক্তিমূলক অর্থকে দীনের ও আকীদার ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে ঈসা (আঃ)-এর বিষয়ে ওহীর বাইরে অতিরিক্ত গুণাবলি আরোপ করা এবং সেগুলির বিপরীতে অগণিত দ্ব্যর্থহীন ওহীর বাণীকে ব্যাখ্যা করা।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর উম্মাতকে এ বিষয়ে সতর্ক করে তাঁর বিষয়ে কি বলতে হবে তার নির্দেশনা প্রদান করলেন। তিনি বললেন, আমি আল্লাহর বান্দা। আমাকে আল্লাহ দুটি মূল বিশেষণে বিশেষিত করেছেন: আল্লাহর বান্দা এবং আল্লাহর রাসূল। তোমরা আমার বিষয়ে এরূপই বলবে। অর্থাৎ ওহীর মাধ্যমে কুরআনে বা হাদীসে তাঁর বিষয়ে যা বলা হয়েছে হুবহু তাই আমাদেরকে বলতে হবে। এগুলিকে ব্যাখ্যা করা বা বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে এগুলির সাথে আরো কিছু কথা যোগ করা আমাদেরকে বাড়াবাড়ির পথে নিয়ে যেতে পারে।
উপরের হাদীসের ন্যায় অন্যান্য অনেক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর উম্মাতকে তাঁর প্রশংসা বা ভক্তির ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি পরিহার করতে এবং ওহীর ব্যবহৃত শব্দাবলির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন।
আনাস ইবনু মালিক (রা) বলেন,
إنَّ رَجُلا قَالَ يَا مُحَمَّدُ يَا سَيِّدَنَا وَابْنَ سَيِّدِنَا وَخَيْرَنَا وَابْنَ خَيْرِنَا، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ (ﷺ): يَا أَيُّهَا النَّاسُ عَلَيْكُمْ بِتَقْوَاكُمْ وَلا يَسْتَهْوِيَنَّكُمْ الشَّيْطَانُ، أَنَا مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ، عَبْدُ اللَّهِ وَرَسُولُهُ وَاللَّهِ مَا أُحِبُّ أَنْ تَرْفَعُونِي فَوْقَ مَنْزِلَتِي الَّتِي أَنْزَلَنِي اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ
‘‘এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলে, হে মুহাম্মাদ, হে আমাদের নেতা (সাইয়েদ), আমাদের নেতার পুত্র, আমাদের মধ্যে সর্বত্তোম, আমাদের সর্বোত্তম ব্যক্তির পুত্র। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: হে মানুষেরা, তোমরা আল্লাহকে ভয় করে চল। শয়তান যেন তোমাদেরকে বিভ্রান্ত না করে। আমি আব্দুল্লাহর ছেলে মুহাম্মাদ, আমি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। আল্লাহর কসম, আমি ভালবাসি না যে, আল্লাহ আমাকে যে মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন তোমরা আমাকে তার ঊর্ধ্বে ওঠাবে।’’[4]
অর্থাৎ শয়তান বিভিন্নভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা করে। নবী-রাসূলগণকে অস্বীকার করার মাধ্যমে অনেককে সে বিভ্রান্ত করে। আবার তাঁদের ভক্তি ও প্রশংসায় সীমা লঙ্ঘন করিয়েও শয়তান অনেককে বিভ্রান্ত করে। কাজেই সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। শয়তান অনেক সময় কুমন্ত্রণা দিতে পারে যে, নবী-রাসূলকে বেশি প্রশংসা করলে বা ভক্তি করলে তিনি হয়ত খুশি হবেন। এজন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) স্পষ্টভাবে উল্লেখ করলেন যে, এরূপ ভক্তি বা প্রশংসায় তিনি খুশি হন না। বরং ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত বিশেষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেই তিনি খুশি হন।
এখানে লক্ষণীয় যে, উপর্যুক্ত হাদীসে বক্তা সাহাবী রাসূলুললাহ (ﷺ)-এর বিষয়ে যে বিশেষণগুলি ব্যবহার করেছেন সবই সত্য ও সেগুলি বলা ইসলামে কোনোভাবেই আপত্তিকর নয়। তবুও রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আল্লাহ তাঁকে যে বিশেষ দুটি পদমর্যাদা প্রদান করেছেন তার বাইরে কিছু ব্যবহার করা অপছন্দ করছেন। বাহ্যত তিনি বাড়াবড়ির দরজা বন্দ করতে চেয়েছেন।
এ অর্থের অন্য হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবনুশ শিখ্খীর (রা) বলেন,
جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِيِّ (ﷺ) فَقَالَ أَنْتَ سَيِّدُ قُرَيْشٍ فَقَالَ النَّبِيُّ (ﷺ): السَّيِّدُ اللَّهُ قَالَ أَنْتَ أَفْضَلُهَا فِيهَا قَوْلا وَأَعْظَمُهَا فِيهَا طَوْلا فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ (ﷺ): لِيَقُلْ أَحَدُكُمْ بِقَوْلِهِ وَلا يَسْتَجِرُّهُ الشَّيْطَانُ
‘‘একব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট আগমন করে বলে, আপনি কুরাইশদের নেতা বা প্রধান (সাইয়েদ)। তিনি বলেন নেতা বা প্রধান (সাইয়েদ) তো আল্লাহ। লোকটি বলে: আমাদের মধ্যে কথায় আপনিই সর্বোত্তম এবং মহত্বে-মর্যাদায় আপনিই সর্বশ্রেষ্ঠ। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: তোমাদের মধ্যে কেউ কথা বলতে চাইলে বলুক, তবে শয়তান যেন তাকে টেনে নিয়ে না যায়।’’[5]
এখানে লক্ষণীয় যে, কোনো মানুষকে সাইয়েদ (নেতা বা প্রধান) বলা ইসলামে নিষিদ্ধ নয়। সাহাবীগণ একে অপরকে কখনো কখনো ‘সাইয়েদুনা’ (আমাদের নেতা) বলে উল্লেখ করেছেন। এহইয়াউস সুনান গ্রন্থে আমি এ বিষয়ক কিছু হাদীস উল্লেখ করেছি।[6] পঞ্চম অধ্যায়ে শিরক আসগার বিষয়ক আলোচনায় আমরা দেখব যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দাসদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন মনিব বা মালিককে রাবব (প্রভু) না বলে সাইয়েদ (নেতা) বলে ডাকতে। এতদসেত্ত্বও রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর নিজের বিষষে ‘সাইয়েদ’ শব্দ ব্যবহার করতে আপত্তি করছেন। বাহ্যত তিনি এ বিষয়ে বাড়াবাড়ির দরজা বন্ধ করতে চেয়েছেন এবং মহান আল্লাহ তাঁর বিষয়ে যে শব্দ ও উপাধি ব্যবহার করেছেন তার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে উম্মাতকে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। ওহীর ব্যবহৃত শব্দ আর মানবীয় আবেগ-বিবেকের ভিত্তিতে ভাষাজ্ঞানের আলোকে ব্যবহৃত শব্দের মধ্যে ঈমানের জগতে অনেক পার্থক্য।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দৌহিত্র হুসাইন ইবনু আলী (রা) বলেন,
أَحِبُّوْنَا بِحُبِّ الإِسْلاَمِ فَإِنَّ رَسُوْلَ اللهِ (ﷺ) قَالَ: لاَ تَرْفَعُوْنِيْ فَوْقَ حَقِّيْ فَإِنَّ اللهَ تَعَالَى اتَّخَذَنِيْ عَبْداً قَبْلَ أَنْ يَتَّخِذَنِيْ رَسُولاً
‘‘তোমরা আমাদেরকে ইসলামের ভালবাসায় ভালবাসবে; কারণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, আমাকে আমার প্রাপ্যের উপরে উঠাবে না; কারণ আল্লাহ আমাকে রাসূল হিসেবে গ্রহণ করার আগেই আমাকে বান্দা হিসেবে গ্রহণ করেছেন।’’[7]
উপরের হাদীসগুলির আলোকে আমরা বুঝতে পারি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ভক্তি ও মর্যাদা প্রদান আমাদের অন্যতম দায়িত্ব ও ঈমানের অন্যতম দাবি। তবে আমাদের বুঝতে হবে যে, শয়তান বিভিন্ন ভাবে মানুষকে অবিশ্বাসের ন্যায় অতিভক্তির মাধ্যমেও বিভ্রান্ত করতে পারে। এজন্য আমাদেরকে ওহীর হুবহু অনুসরণ করতে হবে।
এছাড়া আরো বুঝতে হবে যে, বিশ্বাসের ভিত্তি ‘গাইবী’ বিষয়ের উপরে। এ সকল বিষয়ে ওহীর নির্দেশনা ছাড়া কোনো ফয়সালা দেওয়া যায় না। কর্ম বিষয়ে কুরআন বা হাদীসে সুস্পষ্ট বিধান নেই এরূপ অনেক নতুন নতুন বিষয় উদ্ভাবিত হয়, এজন্য সেক্ষেত্রে কিয়াস ও ইজতিহাদের প্রয়োজন হয়। যেমন মাইক, ধুমপান ইত্যাদি বিষয়। কিন্তু বিশ্বাস বা আকীদার বিষয় সেরূপ নয়। এগুলিতে নতুন সংযোজন সম্ভব নয়। এজন্য এ বিষয়ে কিয়াস বা ইজতিহাদ অর্থহীন। আল্লাহর গুণাবলি, নবীগণের সংখ্যা, মর্যাদা, ফিরিশতাগণের সংখ্যা, সৃষ্টি, কর্ম, দায়িত্ব ইত্যাদি বিষয়ে ইজতিহাদের কোনো সুযোগ নেই। কুরআন ও হাদীসে যেভাবে যতটুকু বলা হয়েছে তাই বিশ্বাস করতে হবে। এ সকল ক্ষেত্রে আমরা ওহীর কথাকে যুক্তি দিয়ে সমর্থন করতে পারি, কিন্তু যুক্তি দিয়ে কোনো কিছু সংযোজন বা বিয়োজন করতে পারি না।
ষষ্ঠ অধ্যায়ে বিদ‘আত ও বিভক্তির আলোচনায় আমরা দেখব যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, তাঁর উম্মাতের মধ্যেও পূর্ববর্তী উম্মাতদের মত বিভ্রান্তি প্রবেশ করবে। বাস্তবে আমরা দেখতে পাই যে, সাহাবী, তাবিয়ী, তাবি-তাবিয়ীদের যুগ এবং মুসলিম উম্মাহর সোনালী যুগগুলি অতিক্রান্ত হওয়ার পরে, মুসলিম উম্মাহর মধ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মর্যাদা বিষয়ে ওহীর নির্দেশ লঙ্ঘন ও ওহীর সাথে বিভিন্ন ব্যাখ্যা যোগ করে আকীদা তৈরির প্রবণতা সৃষ্টি হয়। কোনো কোনো আলিম মানবীয় বুদ্ধি দিয়ে ওহীর একটি বক্তব্যের নিজের পছন্দমত অর্থকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে অন্যান্য বক্তব্যকে ব্যাখ্যা করে বিকৃত বা বাতিল করেন এবং ওহীর অতিরিক্ত এবং সাহাবীগণের বক্তব্যের ব্যতিক্রম অনেক বিষয়কে আকীদার অন্তর্ভুক্ত করেন। এখানে এ জাতীয় কয়েকটি বিষয় আলোচনা করছি:
[2] সূরা : ৪ নিসা, ১৭১ আয়াত।
[3] সূরা (৫) মায়িদা: ৭৭ আয়াত।
[4] আহমদ, আল-মুসনাদ ৩/১৫৩, ২৪১, ২৪৯। হাদীসটির সনদ সহীহ।
[5] আবূ দাউদ, আস-সুনান ৪/২৫৪; আহমদ, আল-মুসনাদ ৪/২৪-২৫। হাদীসটি সহীহ।
[6] এহইয়াউস সুনান, পৃ. ৪৫৪-৪৫৭।
[7] হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৩/১৯৬; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৯/২১। হাকিম হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। হাইসামী হাদীসটির সনদ হাসান বলে উল্লেখ করেছেন।