রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মাঝারি আকৃতির ছিলেন। তিনি বেঁটে ছিলেন না, আবার অতিরিক্ত লম্বাও ছিলেন ন। তাঁর কাঁধ প্রশস্ত, মাথা বড়, হাত-পায়ের আঙ্গুলগুলো পৌরুষ প্রকাশক ও শক্ত এবং মুখ বড় ছিল। তাঁর চক্ষু ছিল আকর্ষণীয়ভাবে বড় এবং ফাড়া। তাঁর শরীরের রং ছিল ফরসা, সুন্দর কিছুটা লালচে মিশ্রিত সাদা। তাঁর চেহারা মোবারক ছিল পূর্ণিমার চাঁদের মত সুন্দর ও মনেমুগ্ধকর।
তাঁর মাথা ভরা কাল চুল ছিল। তাঁর চুল বেশী কোঁকড়ান বা একবারে সোজা ছিল না, সামান্য কোঁকড়ান ছিল। তাঁর সুবিন্যস্ত চুল সাধারণত তাঁর কান পর্যন্ত লম্বা নেমে আসত। তিনি হজ্জ-ওমরা ছাড়া কখনো মাথা মুন্ডন করতেন না। ইন্তেকালের পূর্বেও তার চুল ও দাড়ি কাল ছিল। সামান্য ১৫/২০টি চুল সাদা হয়েছিল।
তিনি দৃঢ় পায়ে বড় বড় পদক্ষেপে দ্রুত হাঁটতেন, এমনভাবে যে তাকে দেখে মনে হত তিনি ঢালু যমিনের উঁচু থেকে নীচুতে নামছেন এবং পদক্ষেপের সাথে সাথে সামনে ঝুকে পড়ছেন।
তিনি জাগতিক চাকচিক্য ও বিলাসিতা থেকে নিজেকে দূরে রাখতেন। খুব সামান্য খাদ্য খেতেন। কখনো কখনো মাসের পর মাস তাঁর ঘরে কিছুই রান্না হত না। শুধুমাত্র ২/১টি খেজুর ও পানি খেয়েই দিন কাটাতেন। মেহমানদের সাথে তিনি কখনো পেটভরে খান নি। তিনি খাওয়ার সময়ে সাধারণত তিনটি আঙ্গুল ব্যবহার করতেন এবং খাওয়ার পরে আঙ্গুলগুলো চেটে নিতেন। তিনি সাধারণ খেজুরের ছোবড়ার বিছানায় শুতেন। তিনি ডান দিকে কাত হয়ে, ডান হাতের তালু তার ডান গালের নীচে রেখে ঘুমাতেন।
মদীনার জীবনে তিনি ছিলেন মুসলিম রাষ্ট্রের প্রধান। সকল যুদ্ধলব্ধ সম্পদের এক-পঞ্চমাংশ আল্লাহ তাঁর জন্য নির্ধারণ করে দেন। ফলে আল্লাহর নির্দেশ অনুসারেই প্রচুর সম্পদ তাঁর মালিকানায় আসত। কিন্তু তিনি নিজের জন্য টাকা পয়সা নিজের কাছে রাখতেন না। সবই তিনি বিলিয়ে দিতেন। তার ইন্তেকালের আগে তার কাছে মাত্র ৭টি দিরহাম ছিল যা তিনি বিলিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। তার ব্যবহারের বর্মটিও তিনি ইন্তেকালের কিছুদিন পূর্বে এক ইহুদীর কাছে ৩০ সা (প্রায় ৯০ কিলোগ্রাম) গমের বিনিময়ে বন্ধক রাখেন, যা তিনি ইন্তেকালের আগে আর ছাড়িয়ে আনতে পারেন নি। ইন্তেকালের সময় তিনি কোনো নগদ টাকা পয়সা রেখে যান নি। সামান্য কিছু খেজুরের বাগান তার ছিল। তিনি ওসিয়ত করেন যে তার মৃত্যুর পরে তার পরিত্যক্ত সম্পত্তি সাদকাহ বা ওয়াকফ দান বলে হণ্য হবে, তা ওয়ারিশদের মধ্যে বণ্টিত হবে না।
তিনি সুগন্ধি খুবই পছন্দ করতেন। তিনি সর্বদা সুগন্ধি ব্যবহার করতেন। কেউ তাঁকে সুগন্ধি উপহার দিলে তা কখনো ফেরত দিতেন না।
তিনি কথা বলতেন ধীরে এবং প্রতিটি শব্দ সুস্পষ্টভাবে উচ্চারণ করতেন। তিনি কখনো উচ্চশব্দে হাসতেন না। সর্বদা তিনি মৃদু হাসতেন। তিনি সবার সাথে হাসিমুখে মিলিত হতেন। কারো সাথে কথা বললে তিনি তাঁর দেহ ও মুখমণ্ডল পুরোপুরি তার দিকে ফিরিয়ে এমনভাবে মনোযোগ ও সম্মানের সাথে কথা বলতেন যে, তাঁর সাথে যেই কথা বলত সেই অনুভব করত যে, সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট অত্যন্ত সম্মানিত ও প্রিয়।
তিনি অনাবিল হাসি তামাশা পছন্দ করতেন। কিন্তু কখনোই তিনি হাসি তামাশার জন্য এমন কথা বলতেন না যার মধ্যে মিথ্যার লেশমাত্র রয়েছে। পারিবারিক জীবনে তিনি তাঁর স্ত্রী-পরিজনদেরকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। পারিবারিক মতভেদে কথা কাটাকাটিতে তাদের প্রতিবাদ, আপত্তি হাসিমুখে নীরবে শুনতেন। তিনি নিজের কাপড় নিজে পরিস্কার করতেন, নিজের ছাগল নিজে দোহন করতেন, নিজের কাজ নিজে করতেন।
তিনি কখনো তার কোনো খাদেম বা স্ত্রীকে ধমক দেন নি। তিনি কখনো চিৎকার করে কথা বলতেন না বা ঝগড়া বা গালিগালাজ করতেন না, কখনো অশ্লীল কথা বলতেন না। একমাত্র ইসলামের বিরোধিতা দেখলেই তিনি রাগান্বিত হতেন। এছাড়া কখনো তাকে রাগতে দেখা যায়নি। ব্যক্তিগত কারণে তিনি কারো উপর রাগ করেন নি, কোনো প্রতিশোধ নেন নি। কেউ তার প্রতি ব্যক্তিগত কোনো অপরাধ করলে বা তাঁকে কেউ কষ্ট দিলে, তিনি তা ক্ষমা করে দিতেন।
তিনি অত্যন্ত বিনয়ী ছিলেন। মদীনায় তিনি ছিলেন একছত্র অধিপতি, শাসক, সামাজিক ও ধর্মীয় প্রধান। কিন্তু কখনো তাঁর আচরণে শক্তি বা প্রতিপত্তির সামান্যতম প্রভাব ছিল না। মদীনার দরিদ্রতম বা নগণ্যতম ব্যক্তিকেও তিনি পরিপূর্ণ সম্মান দান করতেন, ডাকলে তার বাড়ীতে যেতেন, তার কাছে বসে তার কথা শুনতেন। তিনি সর্বদা অতি সাধারণ পোষাক ও বাসস্থান ব্যবহার করতেন। তাঁর বিনয়ের একটি দিক ছিল যে, কেউ তার সম্মানে উঠে দাঁড়াক এটা তিনি পছন্দ করতেন না। তাঁর সাহাবীগণ তাকে প্রাণের চেয়েও ভালবাসতেন, কিন্তু তাঁকে আসতে দেখলে তার সম্মানে উঠে দাঁড়াতেন না, কারণ তাঁরা জানতেন যে, তিনি তা পছন্দ করতেন না। তবে তিনি মাজলিস ছেড়ে প্রস্থান করার সময় যখন উঠে দাঁড়াতেন তখন উপস্থিত সাহাবীগণও তাঁর সাথে উঠে দাঁড়াতেন।[1]