কুরআন ও হাদীসের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, এ পর্যায়ের তাওহীদের বিষয়ে কাফির-মুশরিকদের মধ্যে তেমন কোনো আপত্তি বা মতভেদ ছিল না। সাধারণভাবে কাফিরগণ বিশ্বাস করত যে, আল্লাহই এ বিশ্বের একমাত্র স্রষ্টা, প্রতিপালক, রিয্কদাতা, জীবনদাতা, একক সার্বভৌমত্ব ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। এ বিশ্বাসের ভিত্তিতে তারা আল্লাহর ইবাদত করত। তারা আল্লাহর ইবাদাত করার সাথে সাথে ফিরিশতাগণ, কোনো কোনো নবী-রাসূল, সত্য বা কল্পিত আল্লাহর প্রিয় বান্দা, তাঁদের মুর্তি, স্মৃতিবিজড়িত স্থান, দ্রব্য বা পাথরের ‘ভক্তি’ করত। ‘ভক্তি’-র প্রকাশ হিসেবে তারা এ সকল দ্রব্য বা স্থানে ‘সাজদা’ করত, মানত করত বা প্রার্থনা করত, যে সকল কর্ম ইসলামের পরিভাষায় ‘ইবাদত’ বলে গণ্য। তারা কখনোই দাবি করত না যে, এ সকল ‘উপাস্য’ এ বিশ্বের কোনো কিছু সৃষ্টি করেছে বা প্রতিপালন করে, বরং তারা আল্লাহকেই একমাত্র স্রষ্টা, রব্ব, প্রতিপালক, সর্বশক্তিমান ও সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক বলে বিশ্বাস করত।
কুরআন কারীমে বিভিন্ন স্থানে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। এক স্থানে মহান আল্লাহ বলেছেন:
قُلْ مَنْ يَرْزُقُكُمْ مِنَ السَّمَاءِ وَالأَرْضِ أَمْ مَنْ يَمْلِكُ السَّمْعَ وَالأَبْصَارَ وَمَنْ يُخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَيُخْرِجُ الْمَيِّتَ مِنَ الْحَيِّ وَمَنْ يُدَبِّرُ الأَمْرَ فَسَيَقُولُونَ اللَّهُ فَقُلْ أَفَلا تَتَّقُونَ
‘‘বল, আসমান এবং জমিন থেকে কে তোমাদেরকে রিয্ক দান করেন? কে দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তির মালিক? কে মৃত থেকে জীবিতকে নির্গত করেন এবং জীবিত থেকে মৃতকে নির্গত করেন? বিশ্ব পরিচালনা করেন কে? তারা উত্তরে বলবে: আল্লাহ। বল: তাহলে কেন তোমরা আল্লাহকে ভয় করছ না।’’[1]
অতঃপর আল্লাহ বলছেন:
قُلْ هَلْ مِنْ شُرَكَائِكُمْ مَنْ يَبْدَأُ الْخَلْقَ ثُمَّ يُعِيدُهُ قُلِ اللَّهُ يَبْدَأُ الْخَلْقَ ثُمَّ يُعِيدُهُ فَأَنَّى تُؤْفَكُونَ
‘‘বল, তোমরা যাদেরকে আল্লাহর সাথে শরীক বানিয়েছ তাদের কেউ কি সৃষ্টি করতে পারে এবং ধ্বংসের পরে পুনরায় সৃষ্টি করতে পারে? একমাত্র আল্লাহই সৃষ্টি করেন এবং পুনরায় সৃষ্টি করেন। তোমরা কোথায় যাচ্ছ?’’[2]
অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন:
قُلْ لِمَنِ الأَرْضُ وَمَنْ فِيهَا إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ. سَيَقُولُونَ لِلَّهِ قُلْ أَفَلا تَذَكَّرُونَ. قُلْ مَنْ رَبُّ السَّمَاوَاتِ السَّبْعِ وَرَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ. سَيَقُولُونَ لِلَّهِ قُلْ أَفَلا تَتَّقُونَ. قُلْ مَنْ بِيَدِهِ مَلَكُوتُ كُلِّ شَيْءٍ وَهُوَ يُجِيرُ وَلا يُجَارُ عَلَيْهِ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ. سَيَقُولُونَ لِلَّهِ قُلْ فَأَنَّى تُسْحَرُونَ.
‘‘(কাফিরদেরকে) বল, তোমাদের যদি জ্ঞান থাকে তবে বল, এই পৃথিবী এবং এর মধ্যে যারা রয়েছে তারা কার? তারা বলবে: আল্লাহর। বল, তবুও কি তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করবে না? বল, সপ্ত আকাশের রব্ব-প্রতিপালন ও মহান আরশের রব্ব-প্রতিপালক কে? তারা বলবে: আল্লাহ। বল, তবুও কি তোমরা সাবধান হবে না? বল, তোমরা যদি জান তবে বল, সকল কিছুর সার্বভৌমত্ব ও কর্তৃত্ব কার হাতে? যিনি ত্রাণের ক্ষমতা রাখেন, যার উপর ত্রাণ দাতা বা রক্ষাকর্তা নেই? তারা বলবে: আল্লাহ। বল, তবুও তোমরা কেমন করে বিভ্রান্ত হচ্ছ?’’[3]
এভাবে আমরা দেখছি যে, কাফিররা মহান আল্লাহকে মহাবিশ্বের একমাত্র স্রষ্টা, প্রতিপালক, সকল ক্ষমতা, রাজত্ব ও সার্বভৌমত্বের অধিকারী ও সর্বশক্তিমান বলে বিশ্বাস করত। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ আরো বলেছেন,
وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ وَسَخَّرَ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ فَأَنَّى يُؤْفَكُونَ. اللَّهُ يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ وَيَقْدِرُ لَهُ إِنَّ اللَّهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ. وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ نَزَّلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَحْيَا بِهِ الأَرْضَ مِنْ بَعْدِ مَوْتِهَا لَيَقُولُنَّ اللَّهُ قُلِ الْحَمْدُ لِلَّهِ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لا يَعْقِلُونَ.
‘‘তুমি যদি তাদেরকে প্রশ্ন কর, কে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং চন্দ্র-সুর্যকে নিয়ন্ত্রিত করেছেন? তারা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ। তাহলে তারা কোথায় চলেছে? আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার জন্য ইচ্ছা তার রিয্ক বর্ধিত করেন আর যার জন্য ইচ্ছা তা সীমিত করেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্ব বিষয়ে মহাজ্ঞানী। আপনি যদি তাদেরকে প্রশ্ন করেন, ভূমি মৃত হওয়ার পর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে কে তাকে সঞ্জীবিত করেন? তারা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ। আপনি বলুন, প্রশংসা আল্লাহরই নিমিত্ত, কিন্তু তাদের অধিকাংশই অনুধাবন করে না।’’[4]
অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন:
وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ قُلِ الْحَمْدُ لِلَّهِ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لا يَعْلَمُونَ
‘‘যদি তাদেরকে প্রশ্ন কর, আকাশমন্ডলী এবং ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছেন? তারা অবশ্যই বলবে: ‘আল্লাহ।’ আপনি বলুন, প্রশংসা আল্লাহর নিমিত্ত, কিন্তু তাদের অধিকাংশই জানে না।’’[5]
মহান আল্লাহ আরো বলেন:
وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ لَيَقُولُنَّ خَلَقَهُنَّ الْعَزِيزُ الْعَلِيمُ
‘‘যদি তাদেরকে জিজ্ঞাসা কর, কে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন? তারা অবশ্যই বলবে এগুলি তো সৃষ্টি করেছেন পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ আল্লাহ।’’[6]
অন্যত্র ইরশাদ করা হয়েছে:
وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَهُمْ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ فَأَنَّى يُؤْفَكُونَ
‘‘যদি জিজ্ঞাসা কর, কে তাদেরকে সৃষ্টি করেছে? তারা অবশ্যই বলবে, ‘আল্লাহ।’ তবুও তারা কোথায় ফিরে যাচ্ছে?’’[7]
অন্যত্র আল্লাহ বলেছেনঃ
وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ قُلْ أَفَرَأَيْتُمْ مَا تَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ إِنْ أَرَادَنِيَ اللَّهُ بِضُرٍّ هَلْ هُنَّ كَاشِفَاتُ ضُرِّهِ أَوْ أَرَادَنِي بِرَحْمَةٍ هَلْ هُنَّ مُمْسِكَاتُ رَحْمَتِهِ قُلْ حَسْبِيَ اللَّهُ عَلَيْهِ يَتَوَكَّلُ الْمُتَوَكِّلُونَ
‘‘যদি তাদেরকে জিজ্ঞাসা কর, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী কে সৃষ্টি করেছেন? তারা অবশ্যই বলবে, ‘আল্লাহ।’ বল, তোমরা ভেবে দেখেছ কি, আল্লাহ আমার অনিষ্ট চাইলে তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাকো তারা কি সে অনিষ্ট দূর করতে পারবে? অথবা তিনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করতে চাইলে তারা কি সে অনুগ্রহ রোধ করতে পারবে? বল, ‘আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।’ নির্ভরকারিগণ আল্লাহর উপরেই নির্ভর করে।’’[8]
এ সকল আয়াত থেকে আমরা জানছি যে, কাফিররা এক বাক্যে স্বীকার করত যে, মহান আল্লাহই বিশ্বের সকল কিছুর একমাত্র স্রষ্টা, পরিচালক, প্রতিপালক, বৃষ্টিদাতা, ফসলদাতা, রিয্কদাতা, সকল ক্ষমতার মালিক, সর্বশক্তিমান, তাঁর উপরে কেউ আশ্রয়দাতা নেই, মানুষের সকল শক্তি তাঁর নিয়ন্ত্রণে, তিনি অনিষ্ট চাইলে কেউ তা দূর করতে পারেনা এবং তিনি কল্যাণ চাইলে কেউ তা রোধ করতে পারেনা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিরোধিতা করা সত্ত্বেও এ কথা তার অকপটে স্বীকার করতো।
পরবর্তী আলোচনা থেকে আমরা দেখব যে, তারা এভাবে মহান আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের একত্বের সুস্পষ্ট ঘোষণা দিলেও অস্পষ্ট একটি ধারণা তাদের মধ্যে ছিল যে, আমাদের উপাস্যগণ আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে কিছু করতে সক্ষম না হলেও, বা আল্লাহ চূড়ান্ত ফয়সালা দিলে তা পরিবর্তনের ক্ষমতা না রাখলেও সাধারণভাবে কিছু অলৌকিক নিষ্ট-অনিষ্টের ক্ষমতা তাদের আছে, যা আল্লাহই তাদের দিয়েছেন।
[2] সূরা (১০) ইউনূস: ৩৪ আয়াত।
[3] সূরা (২৩) মুমিনূন: ৮৪-৮৯ আয়াত।
[4] সুরা (২৯) আনকাবুত: ৬১- ৬৩ আয়াত।
[5] সূরা (৩১) লুকমান: ২৫ আয়াত।
[6] সূরা (৪৩) যুখরূফ: ৯ আয়াত।
[7] সূরা (৪৩) যুখরূফ: ৮৭ আয়াত।
[8] সূরা (৩৯) যুমার: ৩৮ আয়াত।