২২৪৭৩ নং ফতোয়া
জবাবঃ
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ সুবহানা ওয়া তা’লার, দেওবন্দিরা মুসলিমদের অনেক গুলো দলের একটি। এই দলটি দারুল উলুম দেওবন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের (ভারত) সাথে সম্পৃক্ত এবং সেই নামেই পরিচিত হয়। এটি একটি ফিকহি স্কুল যার শিকড় অনেক গভীরে। যারা এখান থেকে স্নাতক হয়ে বের হয় তারা এর প্রাতিষ্ঠানিক বৈশিষ্ট দ্বারা প্রভাবিত হয় বলে তাদের ‘দেওবন্দি’ বলে ডাকা হয়।
দেওবন্দ বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করা হয় এক দল ভারতীয় আলেমদের দ্বারা যখন ব্রিটিশ রা ১৮৫৭ সালে ভারতে ইসলামী জাগরণ কে রুখে দিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠা হওয়াটা ছিল ভারতীয় উপমহাদেশে পশ্চিমা আধুনিকতা এবং বস্তুবাদি সভ্যতার উথ্বানের বিরুদ্ধে একটি শক্ত প্রতিক্রিয়া, যার উদ্দেশ্যই ছিল ভারতীয় মুসলিমদের এমন বিপদ থেকে বাঁচানো; বিশেষ করে যখন বৃটিশরা ভারতের রাজধানী দিল্লিকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছিল এবং এর পুরো দখল নিয়ে নিয়েছিল। তৎকালীন উলামারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে গিয়েছিলেন এই ভেবে যে ইসলামকে হয়ত বৃটিশরা পশ্চিমা শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে মিলিয়ে ফেলতে পারে এবং ধ্বংস করে দিতে পারে। তাই শায়খ ইমদাদউল্লাহ আল মুহাজির আল মাক্কি এবং তাঁর ছাত্র শায়খ কাশিম আল নানুতুবী এবং তাঁদের সাথীরা মিলে একটি পরিকল্পনা করেন ইসলাম এবং ইসলামী শিক্ষাকে হেফাজত করার জন্য। ইসলামী স্কুল এবং ইসলামীক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করাকেই তাঁরা এর সমাধান মনে করলেন। মাদ্রাসা আল ইসলামীয়্যাহ আল আরাবিয়্যাহ ছিল তৎকালীন বৃটিশ শাসনকালে দেওবন্দে প্রতিষ্ঠিত ভারতের ইসলাম এবং শরিয়ার কেন্দ্রবিন্দু।
এই সুপরিচিত ইসলামী চিন্তাধারার প্রধান কর্ণধারগন হলেন,
১। মুহাম্মাদ কাশিম
২। রাশিদ আহমেদ গাঙ্গুহি
৩। হুসায়ন আহমাদ আল-মাদানি
৪। মুহাম্মাদ আনোয়ার শাহ কাশ্মিরি
৫। আবুল-হাসান আল-নদভী
৬। আল-মুহাদ্দিস হাবীব আল-রাহমান আল-আ’যমী
তাঁদের চিন্তাধারা এবং বিশ্বাস
মৌলিক বিশ্বাস (আকিদা) এর দিক থেকে তাঁরা ‘আবু মানসুর আল মাতুরীদি’ এর চিন্তাধারা/অভিমতের অনুসারী।
ইসলামী ফিকহ এবং খুটিনাটি বিষয়ে তাঁরা ইমাম আবু হানিফার অনুসারী।
তাঁরা আত্মশুদ্ধির অংশ হিসেবে সূফী তরিকা ‘নাকশেবন্দিয়া, চিশতিয়া, কাদেরিয়া, শাহারওয়ারদিয়া এর অনুসারী। দেওবন্দিদের চিন্তাধারা এবং মুলনীতি গুলোকে নিচের মত করে একত্রিত করা যায়,
ইসলামী শিক্ষা, ইসলামের শক্তি এবং রীতিনীতি কে সংরক্ষন করা।
ইসলাম প্রচার এবং ক্ষতিকর ফিকহি চিন্তাধারা প্রতিরোধের পাশাপাশি ক্ষতিকর ধর্মপ্রচারকদের প্রতিরোধ করা।
ইসলামী সংস্কৃতির প্রচার এবং ক্ষতিকর বৃটিশ সংস্কৃতির প্রতিরোধ
আরবী ভাষার প্রচারের প্রতি গুরুত্বের সাথে নজর দেয়া, কারন এটা ইসলামী শরিয়ার মুল উৎস থেকে জ্ঞান লাভ করার উপকারিতা দিবে
যুক্তি, আবেগ, জ্ঞান এবং আধ্যাত্মিকতাকে সমন্বয় করা।
(দেখুনঃ আল মাউজু’আ আল মুয়াসসারা ফিল আদয়ান ওয়াল মাযাহিব-১/৩০৮)
যেহেতু দেওবন্দিরা আকিদার ক্ষেত্রে ‘মাতুরীদি’ অভিমত অনুসরণ করে, আমাদের আগে ‘মাতুরীদি’ আকিদার সংজ্ঞা জানতে হবে।
এটা হলো একটা দার্শনিক দল (কালামী), যা ‘আবু মানসুর আল মাতুরীদি’র পর নামকরণ করা হয় তার নামের সাথে মিল রেখে। এটা যুক্তিবাদ এবং দার্শনিক প্রমানের উপর ভিত্তি করে গড়ে ঊঠেছে যেন তারা মুতাযিলা, জাহমিয়্যাহ এবং অন্যদের বিপরীতে একটি সতন্ত্র সত্য ইসলামী আকিদা প্রতিষ্ঠা করতে পারে। উৎসের দিক থেকে মাতুরীদিরা ইসলামের ভিত্তিকে দুটি ভাগে ভাগ করে।
১) ঐশী অথবা যৌক্তিকঃ এই বিষয় গুলো হলো সেগুলো, যা স্বাধীনভাবে যৌক্তিক কারন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। এর মধ্যে পড়ে তাওহিদ এবং আল্লাহ তা’লার গুন সংক্রান্ত।
২) আইনি বিষয় অথবা এমন বিষয়, যেগুলো কারন অনুসন্ধান দ্বারা দেখলে থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে, কিন্তু যৌক্তিক ভাবে কোনক্রমেই প্রমাণ করা যাবেনা যে তা আসলেই আছে। যেমনঃ নবুয়্যাত, কবরের আযাব, পরকালের বিষয়গুলো। এটা বলে রাখা ভালো যে, তাঁদের কেউ কেউ নবুয়্যাত কে যুক্তিকতার মানদণ্ডে আনা যেতে পারে বলে মনে করেন।
এটা পরিস্কার যে এই ধ্যান-ধারণা গুলো ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতে’র কর্মপদ্ধতির সাথে বৈপরিত্য রাখে। কারন ‘আহলুস সুন্নাহ’ এর নিকট কুরআন, সুন্নাহ এবং সাহাবিদের মতামতই চুড়ান্ত পথ নির্দেশক। এটা তাদের বেদআতের একটা বিশেষ দিক যে তাঁরা ধর্মের উৎস গুলোকে যুক্তি দিয়ে ভাগ করেছে প্রতিষ্ঠিত বর্ণনা গুলোর বিপরীতে, যা সেসব দার্শনিকদের মিথ্যা বিশ্বাস, যারা মনে করে ধর্মীয় বাণী (কুরআন আর হাদীস) স্বাভাবিক যুক্তির বিরুদ্ধে যায়। তাই তারা যুক্তি এবং প্রতিষ্ঠিত বর্ণনা গুলোর মধ্যে মধ্যস্ততা করার চেষ্টা চালায়। ফলশ্রুতিতে দেখা যায় তারা যুক্তি বা কিয়াস কে এমন সব যায়গায় নিয়ে আসতে থাকে যেখানে কিয়াসের কোন স্থান নেই। আর এতে করে তাঁরা এমন সব নিয়ম কানুন নিয়ে আসলো যা মুল শরিয়ার বিপরীতে অবস্থান করে, যা তাদের এই কথা বলতে অনুপ্রাণিত করে যে, ‘তারা এই বর্ণনার অর্থ বুঝতে পারেনি এবং আল্লাহই এটা ভালো জানেন’ অথবা ভুল ব্যাখ্যা উপস্থাপন করে।
আসলে ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত’ এর অভিমত হলো, সঠিক যুক্তি এবং সুপ্রমাণিত ইসলামী বর্ণনাগুলোর মধ্যে কোন বিরোধ নেই।
(দেখুনঃ আল মাউজু’আ আল মুয়াসসারা ফিল আদয়ান ওয়াল মাযাহিব আল-মুয়াসসিরা-১/৯৯)
মাতুরীদি আকিদার প্রতি ‘আহলুস সুন্নাহ’ এর দৃষ্টিভঙ্গী
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত আছে যে, এই উম্মাত ৭৩ টি ভাগে বিভক্ত হবে। যার প্রত্যেকটির সাথে প্রত্যেকটির বিস্তর মতপার্থক্য হবে। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যাখ্যা করেছেন, এই বিভক্তি থেকে বেঁচে যাওয়া দলটি হবে তাঁরা, যারা হুবুহু রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবীদের অনুসরণ করবে।
সন্দেহাতীত ভাবে তাঁরাই ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা’আ’ যারা একনিষ্ঠ ভাবে কুরআন এবং সুন্নাহের অনুসারী ‘ইলম’ এবং ‘আমল’ উভয় দিক থেকে, আর তাঁরাই মুক্তিপ্রাপ্ত দল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, ইলম এবং আমলের দিক দিয়ে যে মুলনীতি অনুসরন করেছেন, তাঁর সাহাবীরা যা অনুসরণ করেছেন, তাঁরা তারই অনুসারী।
এটা কোন ব্যক্তি বা দলের জন্য ‘আহলুস সুন্নাহ’ দাবী করার পক্ষে যথেষ্ট হতে পারেনা যখন তাঁরা সালাফদের কর্মনীতির বিরুদ্ধে চলে যায়। বিশেষ করে সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেঈদের বিরুদ্ধে। বরং এটা আবশ্যিক যে তাঁরা ইলম, আমল, মুয়ামালাত এবং আত্মশুদ্ধি সব ক্ষেত্রে তাঁদের কর্মপদ্ধতির উপরই অটল থাকবে।
মাতুরীদিরা হলো সেই দল, যাদের মতামতের মধ্যে সত্য আর মিথ্যার মিশ্রন রয়েছে। আর কিছু কিছু মতামত সরাসরি সুন্নাহের বিরুদ্ধে যায়। এটা জানা কথা যে, এরকম দল গুলোর সঠিক-বেঠিক হওয়া নির্ভর করবে তারা কতটুকু সুন্নাতের নিকটবর্তী বা কতটুকু সুন্নাত থকে দূরে তাঁর উপর ভিত্তি করে। আর যত বেশি সুন্নাতের নিকটবর্তী হবে, তত বেশি তাঁরা সত্যের নিকটবর্তী। আর যত বেশি তাঁরা সুন্নাত থেকে দূরে যাবে, তত বেশি তাঁরা সত্যের থেকে দূরে সরে যাবে। তাদের কেউ কেউ মৌলিক ইসলামী মূলনীতির ব্যপারে কিছু সুন্নাহের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছে, আর তাদের কেউ কেউ তারচেয়েও কঠিন বিষয়ের সুন্নাহের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছে। তাঁদের কেউ কেউ অন্য কিছু দলের সমালোচনা করে এবং তাদেরকে বাতিল বলে যে দলগুলো সুন্নাহ থেকে আরো বেশি বিচ্যুত হয়েছে। তাই মিথ্যার প্রতি তাঁদের সমালোচনা আর বাতিলিকরন আর তাঁদের থেকে সত্যের পক্ষে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে, তার জন্য তাঁরা প্রশংসার দাবি রাখেন। কিন্তু তাঁরা খুব দ্রুত সত্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশকে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং কিছু বাতিল কে সঙ্গ দিয়েছেন। তাঁরা ছোট বিদআত কে উপেক্ষা করে তার চেয়ে বড় বিদআত কে সমালোচনা/খণ্ডন করে, এবং ছোট মিথ্যার বিপরীতে বড় মিথ্যার সমালোচনা/খণ্ডন করে। এই যুক্তিতে ‘আহলুল কালাম’ দার্শনিকরা ‘আহলুস সুন্নাহের’ মধ্যে থাকার দাবি করে।
(ইমাম ইবনে তাইমিয়্যার বক্তব্য থেকে নেয়া, আল ফাতাওয়া, ১/৩৪৮)
তাহলে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে যার উত্তর দেয়া প্রয়োজন, তা হলো, তাদের ব্যাপারে আমাদের কর্তব্য কি হবে যারা মাতুরীদি এবং তাদের মতই আকিদা পোষণ করে, যেমন দেওবন্দি?
উত্তর নির্ভর করবে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি বিশেষে পার্থক্য এর উপর ভিত্তি করে।
যদি কেউ একগুঁয়ে ভাবে বিদআত প্রচার করে, তাহলে আমাদের অবশ্যই অন্যদেরকে তাঁর ব্যাপারে সাবধান করতে হবে এবং ব্যাখ্যা করে বুঝাতে হবে কোথায় তাদের ভুল রয়েছে এবং কোথায় তাদের পদস্খলন হয়েছে।
আর যদি এমন হয় যে, ব্যক্তি তার বিদআতের ব্যাপারে একগুঁয়ে নয় বরং বুঝা যায় যে সে সত্য অনুসন্ধানী, তখন আমাদের উচিত হবে তাকে উপদেশ দেয়া এবং সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলা তার ভুলের ব্যাপারে, হয়ত আল্লাহ্ তাকে হেদায়াতের পথে ফিরিয়ে আনবেন।
এই উপদেশ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকেও বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, ‘দ্বীন হলো নসিহাত”। আমরা (সাহাবা) জিজ্ঞাস করলাম, “কার জন্য”। তিনি বললেন, “ আল্লাহ্ , তাঁর কিতাব, তাঁর রাসুল, মুসলিম নেতা এবং সকল মুসলিমের জন্য” – সহীহ মুসলিম ৫৫
অনুদিত
ফতোয়া (ইসলামকিউএ)
শায়খ মুহাম্মাদ সালেহ আল মুনাজ্জিদ
অনুবাদ কৃতজ্ঞতাঃ নূর-উদ্দিন আল-মাসউদ