(১) سوء الظن بالله আল্লাহ সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করা

আল্লাহ সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করা মারাত্মক অপরাধ। কেননা আল্লাহর উপর ভালো ধারণা রাখা তাওহীদের দাবি আর তার সম্পর্কে খারাপ ধারণা করা সেটার পরিপন্থী। আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের স্বভাব সম্পর্কে বলেন যে, তারা তার সম্পর্কে অসত্য ধারণা পোষণ করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَظُنُّونَ بِاللَّهِ غَيْرَ الْحَقِّ ظَنَّ الْجَاهِلِيَّةِ يَقُولُونَ هَلْ لَنَا مِنَ الْأَمْرِ مِنْ شَيْءٍ قُلْ إِنَّ الْأَمْرَ كُلَّهُ لِلَّهِ﴾

‘‘তারা জাহেলী যুগের ধারণার মতো আল্লাহ সম্পর্কে অসত্য ধারণা পোষণ করে। তারা বলে, আমাদের জন্য কিছু করণীয় আছে কি? হে রসূল! তুমি বলো, সব বিষয় আল্লাহর হাতে’’। (সূরা আলে-ইমরান: ১৫৪)

আল্লাহ তা‘আলা অন্য আয়াতে বলেন, তারা আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

 ﴿وَيُعَذِّبَ الْمُنَافِقِينَ وَالْمُنَافِقَاتِ وَالْمُشْرِكِينَ وَالْمُشْرِكَاتِ الظَّانِّينَ بِاللَّهِ ظَنَّ السَّوْءِ عَلَيْهِمْ دَائِرَةُ السَّوْءِ وَغَضِبَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ وَلَعَنَهُمْ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيرًا﴾

‘‘আর যেসব মুনাফিক নারী-পুরুষ এবং মুশরিক নারী-পুরুষ আল্লাহ সম্পর্কে মন্দ ধারণা পোষণ করে তাদেরকে তিনি শাস্তি দিবেন। তারা নিজেরই অকল্যাণের চক্রে পড়ে গেছে। আল্লাহর গযব পড়েছে তাদের উপর, তিনি তাদেরকে লা’নত করেছেন এবং তাদের জন্য জাহান্নাম প্রস্ত্তত রেখেছেন। তাদের প্রত্যাবর্তন স্থল অত্যন্ত মন্দ’’। (সূরা ফাতাহ: ৬)

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ প্রথমোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে তাদের ধারণা এই যে, তিনি তার রসূলকে সাহায্য করবেন না এবং তার দাওয়াত অচিরেই মিটে যাবে। আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণার ব্যাখ্যায় আরো বলা হয়েছে যে, উহুদ যুদ্ধে তিনি যে কষ্ট পেয়েছেন, তা আল্লাহ তা‘আলার নির্ধারণ ও হিকমত অনুযায়ী ছিল না। আল্লাহ তা‘আলার হিকমত ও তাক্বদীরকে অস্বীকার করার দ্বারাও খারাপ ধারণার ব্যাখ্যা করা হয়েছে। মন্দ ধারণার ব্যাখ্যায় আরো বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা তার রসূলের কাজ-কর্মকে পরিপূর্ণ করবেন না এবং তার দীনকে সকল দীনের উপর বিজয় দান করবেন না। এটিই ছিল সূরা আলফাতাহয় উল্লেখিত মুনাফেক ও মুশরেকদের খারাপ ধারণা। এ ধারণাকে খারাপ ধারণা এ জন্য বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা, তার হিকমত, তার প্রশংসা এবং তার সত্য ওয়াদা-অঙ্গীকারের প্রতি এরূপ ধারণা পোষণ শোভনীয় নয়।

যে ব্যক্তি ধারণা করলো যে, আল্লাহ তা‘আলা বাতিলকে সবসময় সত্যের বিরুদ্ধে এমনভাবে বিজয়ী রাখবেন যে, সত্যের দাওয়াত একদম মিটে যাবে অথবা উহুদ যুদ্ধে যা হয়েছিল, তা আল্লাহ তা‘আলার ফায়ছালা ও তাক্বদীর অনুযায়ী হয়নি অথবা তার ফায়ছালা ও নির্ধারণ এমন পরিপূর্ণ হিকমতপূর্ণ নয় যে, তিনি এর জন্য প্রশংসার যোগ্য; এমনকি তারা ধারণা করেছিল যে, আল্লাহর তাক্বদীর বলতে শুধু তার ইচ্ছা ছাড়া অন্যকিছু নয়। প্রকৃতপক্ষে এটিই ছিল কাফেরদের ধারণা। সুতরাং কাফেরদের জন্য জাহান্নামের আগুন ছাড়া অন্য কিছু নেই।

অধিকাংশ মানুষই আল্লাহ সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করে থাকে। বিশেষ করে ঐ সমস্ত বিষয়ে, যা তাদের নিজেদের সাথে সম্পৃক্ত অথবা যা অন্যদের সাথে সম্পৃক্ত। যারা আল্লাহর পবিত্র সত্তা, তার পবিত্র নামসমূহ, তার ত্রুটিমুক্ত ছিফাতসমূহ এবং তার হিকমত সম্পর্কে ও তিনি যথাযথ প্রশংসার হকদার- এ সম্পর্কে অবগত, তারাই কেবল তার প্রতি মন্দ ধারণা থেকে মুক্ত।

সুতরাং জ্ঞানী, বুদ্ধিমান এবং নিজের কল্যাণকামী ব্যক্তির উচিত এ বিষয়টির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা। পক্ষান্তরে মহান প্রভুর প্রতি মন্দ ধারণা পোষণকারীগণ যেন তার নিকট তাওবা করে এবং ক্ষমা চায়।

হে প্রিয় পাঠক! আপনি মানুষের মাঝে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখতে পারেন। দেখবেন অনেক মানুষই তাক্বদীরের উপর অসন্তুষ্ট এবং তাক্বদীরকে দোষারোপকারী। তারা বলে থাকে এ রকম হওয়া উচিত ছিলনা, এমন হওয়া ঠিক ছিলনা। এ রকম অভিযোগ কেউ কম করে আবার কেউ বেশি করে। আপনি আপনার নিজের মধ্যেই অনুসন্ধান করুন। আপনি কি তাক্বদীরের উপর আপত্তি করা হতে মুক্ত? কবি বলেছেনঃ

فإن تنجُ منها تنجُ من ذي عظيمة   + وإلا فإني لا إخالك ناجيا

‘‘হে বন্ধু! তুমি যদি তাক্বদীরের উপর আপত্তি করা থেকে মুক্ত হয়ে থাক তাহলে জেনে রাখো যে, তুমি একটি বিরাট মুছীবত থেকে বেঁচে গেলে। আর এ থেকে মুক্তি না পেলে তুমি নাজাত পাবে বলে আমার মনে হয় না’’।

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ আরো বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে এ ধারণা পোষণ করলো যে, আল্লাহ তা‘আলা তার রসূলকে সাহায্য করবেন না, তার কাজকে পরিপূর্ণ করবেন না, তাকে শক্তিশালী করবেন না, তার দলকেও শক্তিশালী করবেন না, তাদেরকে উচ্চ মর্যাদা দান করবেন না এবং তাদের শত্রুদের উপর তাদেরকে বিজয়ী করবেন না এবং তিনি তার দীন ও কিতাবকে বিজয়ী করবেন না, শিরককে তাওহীদের উপর বিজয়ী রাখবেন ও বাতিলকে হকের উপর এভাবে চিরস্থায়ী করবেন যে, তাওহীদ ও সত্যের দাওয়াত মিটে যাবে, অতঃপর সেটা আর কখনো প্রতিষ্ঠিত হবেনা, সে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করলো এবং তার বড়ত্ব, পূর্ণতা, সুউচ্চ ও প্রশংসার গুণাবলীর বিপরীত বিশেষণের দিকে তাকে সম্বন্ধ করলো। কেননা আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা, ক্ষমতা, হিকমত এবং উলুহীয়াত তার দিকে উপরোক্ত বিষয়ের সম্বন্ধ হওয়াকে অস্বীকার করে। তার দল ও সৈনিকগণের অপদস্থ ও লাঞ্ছিত হওয়াকেও অস্বীকার করে। তার হিকমত এটিও অস্বীকার করে যে, স্থায়ী সাহায্য, সার্বক্ষণিক বিজয় আল্লাহর শত্রু, তার সাথে অংশীদার সাব্যস্তকারী ও তার সমকক্ষ নির্ধারণকারীদের জন্যই হবে। যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি এরূপ ধারণা পোষণ করে সে আল্লাহ তা‘আলাকে চিনতে পারেনি, তার অতি সুন্দর নামসমূহ ও সুউচ্চ গুণনাবলী সম্পর্কেও পরিচয় লাভ করতে পারেনি।

যে ব্যক্তি উহুদ যুদ্ধে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও মুসলিমদের পরাজয় বরণ আল্লাহর ফায়ছালা অনুযায়ী হয়নি বলে ধারণা করে সে আল্লাহ তা‘আলাকে চিনতে পারেনি, তার প্রভুত্ব, রাজত্ব ও বড়ত্ব সম্পর্কে জানতে পারেনি। যে ব্যক্তি মনে করে ঐ পরাজয় এবং অন্যান্য ক্ষতি আল্লাহর নির্ধারিত তাক্বদীর অনুযায়ী পরিপূর্ণ হিকমত এবং এমন প্রশংসিত উদ্দেশ্যে হয়নি, যার জন্য তার প্রশংসা করা আবশ্যক, সে আল্লাহ তা‘আলার রুবুবীয়াত, রাজত্ব ও বড়ত্ব সম্পর্কে অবগত নয়। আর যে ব্যক্তি এ ধারণা করলো যে, উহুদ যুদ্ধে মুমিনদের যা হয়েছে, তা আল্লাহর নিছক ইচ্ছায় হয়েছে তার পিছনে কোনো হিকমত ছিলনা, তার ধারণা সঠিক নয়। অনুরূপ যে ব্যক্তি ধারণা করলো, উহুদ যুদ্ধে মুসলিমদের যে কষ্ট হয়েছে আর যে বিজয় ছুটে গেছে, -এ দু’টির মধ্যে প্রথমটিই আল্লাহ তা‘আলার নিকট অধিক প্রিয় এবং মূল উদ্দেশ্য ছিল, সেও তার প্রভুত্ব, রাজত্ব ও বড়ত্ব সম্পর্কে অবগত হতে পারেনি।

আসল কথা হলো, আল্লাহ তা‘আলা যেসব অপছন্দনীয় জিনিস সৃষ্টি করেছেন এবং তা যেসব সৃষ্টি অপ্রীতিকর ফলাফল প্রদান করে, তাও তিনি বিনা হিকমতে নির্ধারণ করেননি। কেননা এগুলোও ভালো ফলাফল প্রদান করে। যদিও আল্লাহ তা‘আলার নিকট সেটা অপছন্দনীয়। সুতরাং বাহ্যিক দৃষ্টিতে অকল্যাণকর সৃষ্টিগুলো তিনি অযথা নির্ধারণ করেননি অযথা এগুলোর ইচ্ছা করেননি এবং বিনা উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেননি।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,ذَلِكَ ظَنُّ الَّذِينَ كَفَرُوا فَوَيْلٌ لِلَّذِينَ كَفَرُوا مِنَ النَّارِ ‘‘এটিই ছিল কাফেরদের ধারণা। সুতরাং কাফেরদের জন্য জাহান্নামের আগুনের দুর্ভোগ ছাড়া অন্য কিছু নেই’’। (সূরা সোয়াদ: ২৭)

অধিকাংশ মানুষই আল্লাহ সম্পর্কে অসত্য ধারণা পোষণ করে। বিশেষ করে ঐ সমস্ত বিষয়ে, যা তাদের নিজেদের সাথে সম্পৃক্ত অথবা যা অন্যদের সাথে সম্পৃক্ত। যারা আল্লাহর পবিত্র সত্তা, তার অতিসুন্দর নামসমূহ, তার ত্রুটিমুক্ত সুউচ্চ ছিফাতসমূহ এবং তার হিকমত সম্পর্কে ও তিনি যথাযথ প্রশংসার যোগ্য হওয়া সম্পর্কে তারাই কেবল তার সম্পর্কে অসত্য ধারণা থেকে মুক্ত থাকতে পারে।

যে মুমিন আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হলো, সে আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করল। যে ব্যক্তি এ বিশ্বাস পোষণ করল যে, আল্লাহ তা‘আলা তার সৎ বান্দাদেরকে শাস্তি দিবেন এবং তার বন্ধু ও শত্রুদের সাথে একই আচরণ করবেন, সেও আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করলো।

যে ব্যক্তি মনে করলো যে, আল্লাহ তার বান্দাদেরকে আদেশ-নিষেধ না করেই বেকার ছেড়ে দেন, তিনি তাদের নিকট রসূল প্রেরণ করেন না, তাদের নিকট কিতাব প্রেরণ করেন না; বরং পশুর ন্যায় অযথা ছেড়ে দেন, সেও আল্লাহ তা‘আলার প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করলো।

এমনি যে ব্যক্তি কল্পনা করল যে, আল্লাহ তা‘আলা ভালো কাজের বিনিময়ে ছাওয়াব ও খারাপ কাজের শাস্তি দেয়ার জন্য তার বান্দাদেরকে মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবিত করবেন না, সেখানে সৎকর্মশীলের সৎকর্মের বদলা ও যালেমদের যুলুমের বদলা দিবেন না এবং যে বিষয়ে মানুষেরা মতভেদ করছে, তাতে তিনি ফায়ছালা প্রদান করবেন না, সমস্ত সৃষ্টির সামনে তার সত্যতা ও রসূলদের সত্যতা তুলে ধরবেন না এবং এটিও বর্ণনা করবেন না যে, কাফেররাই ছিল মিথ্যুক, সেও আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করলো।

এমনি যারা ধারণা পোষণ করে যে, বান্দা আল্লাহ তা‘আলার আদেশ বাস্তবায়ন করে তার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য যেসব সৎ আমল কেরেছে সেটা নষ্ট করে দিবেন, বিনা কারণেই সেটা বাতিল করে দিবেন এবং যেই কর্মে বান্দার কোনো হাত নেই, তার কোনো এখতিয়ার, ক্ষমতা ও তা অর্জনে তার কোনো ইচ্ছাও নেই, তাতে আল্লাহ শাস্তি দিবেন, সে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করলো।

যে ব্যক্তি ধারণা করলো যে, আল্লাহ তা‘আলা যেহেতু অন্যায় কর্ম সৃষ্টি করেছেন এ কারণেই অন্যায় কাজ করার কারণে বান্দাকে শাস্তি দিবেন, বান্দা স্বীয় ইচ্ছা, শক্তি ও স্বাধীনতা দিয়ে অন্যায় করে নেই অথবা আল্লাহ সম্পর্কে ধারণা করলো যে, তিনি সেই সমস্ত মুজিযা দ্বারা তার শত্রুদেরকে শক্তিশালী করবেন যা দ্বারা তিনি তার নবী-রসূলদেরকে শক্তিশালী করেছেন এবং তার মুমিন বান্দাদেরকে পথভ্রষ্ট করার জন্য শত্রুদের মাধ্যমে তা প্রকাশ করবেন সে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করলো।

যে মনে করবে যে, আল্লাহ থেকে যা আসবে তা সব এক রকমই ভালো, এমন কি যে ব্যক্তি সারা জীবন আল্লাহর আনুগত্যে কাটিয়েছে, তাকে চিরকালের জন্য জাহান্নামে পাঠানো এবং যে ব্যক্তি সারা জীবন আল্লাহর প্রতি, তার রসূলদের প্রতি ও তার দীনের প্রতি শত্রুতা পোষণ করে কাটিয়েছে তাকে ইলদীয়ীনের সর্বোচ্চ স্থানে পাঠানোও আল্লাহর জন্য একই রকম উত্তম এবং উভয়টি একই রকম সুন্দর, যে ব্যক্তি ধারণা করল, ভালো-মন্দ-এ দু’টির মাঝে অহীর মাধ্যম ছাড়া পার্থক্য সৃষ্টি করা সম্ভব নয়, কারণ মানুষের বিবেক কোনোটিকে মন্দ ও কোনোটিকে সুন্দর সাব্যস্ত করতে সক্ষম নয়, সেও আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করলো।

এমনি যে ব্যক্তি বিশ্বাস করলো যে, আল্লাহ তা‘আলা নিজের সত্তা ও গুণাবলী এবং তার কর্মসমূহ সম্পর্কে যে সংবাদ দিয়েছেন, তার প্রকাশ্য অর্থ বাতিল এবং তা কেবল উপমা স্বরূপ, এ সম্পর্কে মূল সত্যকে সুস্পষ্ট করে উল্লেখ না করে শুধু সংকেত ব্যবহার করেছেন এবং তার দিকে ইশারা করে ধাঁধায় ফেলে রেখেছেন, সে আল্লাহর প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করলো ।

এমনি যে ব্যক্তি মনে করলো যে, কুরআন মাজীদে সর্বদা  উপমা, উদাহরণ এবং বাতিল বিষয়গুলো পেশ করা হয়েছে, সেও আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করল। এমনি যারা মনে করলো, আল্লাহ চেয়েছেন যে তার বান্দারা স্বীয় কালামের অর্থ পরিবর্তন করার জন্য তাদের মন-মস্তিস্ক, বোধশক্তি ও চিন্তা-গবেষণার অনুসরণ করুক, কুরআনের আসল ব্যাখ্যা বাদ দিয়ে অন্য ব্যাখ্যা বের করুক, কুরআনের ব্যাখ্যার জন্য নতুন নতুন পদ্ধতি অন্বেষণ করুক, অপছন্দনীয় ব্যাখ্যা বের করুক, এমন তাবীল আবিস্কার করুক যা কেবল ধাঁধায় নিক্ষেপকারী ও যুক্তি-তর্কের মতোই এবং যা কেবল কাশফ ও বয়ানের মতই সে তার প্রতি খুব নিকৃষ্ট ধারণা পোষণ করলো।

যে ব্যক্তি ধারণা করলো যে, তিনি তার অতি সুন্দর নামসমূহ এবং সুউচ্চ গুণাবলী জানার জন্য তাদেরকে বিবেক-বুদ্ধি ও নিজস্ব মতামতের উপর ছেড়ে দিয়েছেন; তার কিতাবের উপর নির্ভর করতে বলেননি, যে মনে করে আল্লাহ তা‘আলা তাদের থেকে চেয়েছেন যে, তারা তার কালামের সেই অর্থ গ্রহণ না করুক, যা তাদের পরস্পরের সম্বোধন ও আরবী ভাষা থেকে তারা জানতে পেরেছে, অথচ আল্লাহ তা‘আলা খোলাখুলিভাবে তাদের জন্য ঐ সত্যকে প্রকাশ করার ক্ষমতা রাখা সত্ত্বেও তা করেন, যা প্রকাশ করে দেয়াই উচিত ছিল এবং যেসব শব্দ তাদেরকে বাতিল আকীদার দিকে নিয়ে যায় ঐসব শব্দের সমস্যা থেকে তাদেরকে বাঁচাতে সক্ষম থাকার পরও আল্লাহ তা‘আলা তা না করে হিদায়াত ও সঠিক পথের বিপরীত দিকে তাদেরকে নিয়ে গেছেন, তারাও আল্লাহর ব্যাপারে খারাপ ধারণা পোষণ করল।

 কোনো ব্যক্তি যদি মনে করে, আল্লাহ ব্যতীত সে এবং তার উস্তাদই সত্যকে সুস্পষ্ট শব্দের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম সে আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমতার সাথে অপারগতার ধারণা করলো। আর যে ব্যক্তি মনে করে তিনি সত্যকে সুস্পষ্ট করে বর্ণনা করতে সক্ষম ঠিকই, কিন্তু তা বর্ণনা না করে এবং সত্যকে সুস্পষ্ট না করে অস্পষ্ট রেখেছেন। শুধু তাই নয়; বরং বাতিল, অসম্ভব এবং ভ্রান্ত আকীদার মধ্যে নিক্ষেপ করেছেন, সে আল্লাহ তা‘আলার হিকমত এবং রহমত সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করলো।

আর যে ব্যক্তি ধারণা করলো, আল্লাহ তা‘আলা ও তার রসূল ব্যতীত সে এবং তার উস্তাদরাই সত্যকে সুস্পষ্ট করে বর্ণনা করেছে এবং হিদায়াত ও সত্য কেবল তাদের কালামের মধ্যেই আর আল্লাহর বাহ্যিক কালাম থেকে কেবল তুলনা, উপমা এবং গোমরাহী ছাড়া অন্য কিছু গ্রহণ করার সুযোগ নেই এবং মুশরিক ও দিশেহারা লোকদের কালামের মধ্যে রয়েছে হিদায়াত ও সত্য, তাদের ধারণা আল্লাহর প্রতি খুবই মন্দ।

এরা সকলেই আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা পোষণকারী এবং আল্লাহর ব্যাপারে অসত্য ও জাহেলিয়াতের ধারণা পোষণকারী।

যারা আল্লাহর প্রতি অসত্য ও জাহেলিয়াতের ধারণা পোষণ করে, তাদের ব্যাপারে ইমাম ইবনুল কাইয়্যিমের কথা এখানেই শেষ হলো। যে এর চেয়ে বেশি জানতে চায় সে যেন ইমামের অন্যতম কিতাব যাদুল মাআদ অধ্যায়ন করে। আল্লাহ সহায়।

(২) الاستهزاء بشيئ فيه ذكر الله আল্লাহর যিকির সম্বলিত বিষয় নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা

প্রত্যেক মুসলিমের উপর আবশ্যক হলো, আল্লাহর কিতাব, রসূলের সুন্নাত এবং মুসলিমদের আলেমদেরকে সম্মান করা এবং যারা আল্লাহর যিকির সম্বলিত কোনো জিনিস নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে অথবা কুরআন নিয়ে বিদ্রুপ করে অথবা রসূলকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে তাদের হুকুম সম্পর্কে অবগত হওয়া। এসব বিষয় নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা সম্পর্কে মুসলিমদের সতর্ক হওয়া আবশ্যক। কেননা যে ব্যক্তি আল্লাহর যিকির সম্বলিত কোনো বিষয়, কুরআন অথবা রসূল কিংবা কোনো একটি সুন্নাত নিয়ে বিদ্রুপ করলো সে আল্লাহর সাথে কুফুরী করলো। কেননা সে আল্লাহ তা‘আলার রুবুবীয়াত ও রিসালাতকে অবজ্ঞা করেছে। আর এটি তাওহীদের পরিপন্থি এবং আলেমদের ইজমা অনুযায়ী কুফুরী।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ لَيَقُولُنَّ إِنَّمَا كُنَّا نَخُوضُ وَنَلْعَبُ قُلْ أَبِاللَّهِ وَآَيَاتِهِ وَرَسُولِهِ كُنْتُمْ تَسْتَهْزِئُونَ لَا تَعْتَذِرُوا قَدْ كَفَرْتُمْ بَعْدَ إِيمَانِكُمْ إِنْ نَعْفُ عَنْ طَائِفَةٍ مِنْكُمْ نُعَذِّبْ طَائِفَةً بِأَنَّهُمْ كَانُوا مُجْرِمِينَ﴾

‘‘তুমি যদি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করো, তাহলে তারা অবশ্যই বলবে, আমরা কেবল আলাপ-আলোচনা ও হাসি-তামাসা করছিলাম। বলো: তোমরা কি আল্লাহ, তার আয়াতসমূহ এবং তার রসূলকে নিয়ে উপহাস করছিলে? তোমরা এখন ওযর পেশ করোনা। তোমরা তো ঈমান আনার পর কুফুরী করেছো। তোমাদের মধ্যে কোনো কোনো লোককে যদি আমি ক্ষমা করে দেই, তবে অবশ্য কিছু লোককে আযাবও দিবো। কারণ তারা ছিল অপরাধী ’’। (সূরা তাওবা: ৬৫-৬৬)

 কোনো কোনো যুদ্ধে মুনাফেকরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করেছিল। তাদের সম্পর্কে উপরোক্ত আয়াত দু’টি নাযিল হয়। ইমাম ইবনে জারীর এবং অন্যান্য আলেমগণ ইবনে উমার, মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব, যায়েদ ইবনে আসলাম এবং কাতাদাহ থেকে বর্ণনা করেন যে, জনৈক মুনাফেক তাবুক যুদ্ধের দিন বললো, এসব কারীর চেয়ে অধিক পেটুক, কথায় এদের চেয়ে অধিক মিথ্যুক এবং যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর সাক্ষাতে এদের চেয়ে অধিক ভীরু আর কাউকে দেখিনি। অর্থাৎ লোকটি তার কথা দ্বারা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার কারী সাহাবায়ে কেরামের দিকে ইঙ্গিত করছিল।

আওফ ইবনে মালেক লোকটিকে বললেন, তুমি মিথ্যা বলছো এবং তুমি একজন পাক্কা মুনাফিক। আমি অবশ্যই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ খবর জানাবো। আওফ তখন এ খবর জানানোর জন্য রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে চলে গেলেন। গিয়ে দেখলেন কুরআন তার চেয়েও অগ্রগামী অর্থাৎ আওফ পেঁŠছার পূর্বেই অহীর মাধ্যমে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যাপারটি জেনে ফেলেছেন। এরই মধ্যে মুনাফিক রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে চলে আসল। লোকটি এমন সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে উপস্থিত হল, যখন তিনি সফরের উদ্দেশ্যে উটনীর উপর আরোহন করে রওয়ানা দিচ্ছিলেন। তারপর সে বললো, ‘হে আল্লাহর রসূল! আমরা হাসি-তামাশা করছিলাম এবং চলার পথে আরোহীদের মতোই পরস্পর আলাপ-আলোচনা করছিলাম। যাতে করে আমাদের পথ চলার কষ্ট লাঘব হয়। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন তাকে উদ্দেশ্য করে বলছিলেন,

﴿أَبِاللَّهِ وَآَيَاتِهِ وَرَسُولِهِ كُنْتُمْ تَسْتَهْزِئُونَ (৬৫) لَا تَعْتَذِرُوا قَدْ كَفَرْتُمْ بَعْدَ إِيمَانِكُمْ﴾

‘‘তোমরা কি আল্লাহ, তার আয়াতসমূহ এবং তার রসূলকে নিয়ে উপহাস করছিলে? তোমরা এখন ওযর পেশ করো না। তোমরা তো ঈমান আনার পর কুফুরী করেছো’’।[1] (সূরা তাওবা: ৬৫-৬৬)

উপরোক্ত আয়াত দু’টি এবং তার শানে নুযুলের মধ্যে সুস্পষ্ট দলীল পাওয়া যায় যে, আল্লাহ তা‘আলা, তার রসূল, তার নিদর্শন, রসূলের সুন্নাত এবং রসূলের সাহাবীদেরকে ঠাট্টা-বিদ্রুপকারীরা কাফের হয়ে যাবে। কেননা যে এমনটি করলো, সে আল্লাহ তা‘আলার রুবুবীয়াত এবং তার রসূলের রিসালাতকে খাটো করলো। আর এটি তাওহীদ ও আকীদা পরিপন্থী কাজ। যদিও সে প্রকৃত পক্ষে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করার ইচ্ছা করেনি।

দীনি ইলম ও আলেম সম্প্রদায়কে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা, আলেমদেরকে সম্মান না করা অথবা তারা যে ইলমকে ধারণ করে রেখেছেন, তার কারণে তাদের কুৎসা বর্ণনা করাও কুফুরী। তারা প্রকৃতপক্ষে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করার ইচ্ছা করার উদ্দেশ্য না করে থাকলেও এ কাজটি কুফুরী। কারণ যাদের ব্যাপারে উপরোক্ত আয়াত দু’টি নাযিল হয়েছে, তারা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে অযুহাত পেশ করেছিল যে, তাদের কাছ থেকে যে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ প্রকাশিত হয়েছে, আসলে তারা তা অনিচ্ছা সত্বেই করেছে।

তাদের কথা:﴿إِنَّمَا كُنَّا نَخُوضُ وَنَلْعَبُ﴾  ‘‘আমরা কেবল হাসি-তামাসা উপহাস-পরিহাস করছিলাম’’। অর্থাৎ আমরা আসলে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করার ইচ্ছা পোষণ করিনি। আমরা শুধু খেল-তামাশা করছিলাম। আন্তরিক ইচ্ছার বিপরীত কাজ-কর্মকে খেল-তামাশা বলা হয়। আল্লাহ তা‘আলা তার রসূলের মাধ্যমে সংবাদ দিয়েছেন যে, তাদের এ অযুহাত আল্লাহর নিকট কোনো কাজে আসবে না। এ কথার কারণে তারা ঈমান আনয়নের পর কুফুরী করেছে। যার মাধ্যমে তারা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেছিল। তাদের অযুহাত কবুল করা হয়নি যে, তারা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের ক্ষেত্রে আন্তরিক ছিল না। তারা কেবল খেল-তামাশার ইচ্ছা করেছিল। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের জবাবে আল্লাহ তা‘আলার কালাম তিলাওয়াত করা ছাড়া আর কোনো কথাই বলেননি। তিনি শুধু বলে যাচ্ছিলেন,

﴿أَبِاللَّهِ وَآَيَاتِهِ وَرَسُولِهِ كُنْتُمْ تَسْتَهْزِئُونَ لَا تَعْتَذِرُوا قَدْ كَفَرْتُمْ بَعْدَ إِيمَانِكُمْ﴾

‘‘তোমরা কি আল্লাহ, তার আয়াতসমূহ এবং তার রসূলকে নিয়ে উপহাস করছিলে? তোমরা এখন ওযর পেশ করোনা। তোমরা তো ঈমান আনার পর কুফুরী করেছ’’। (সূরা তাওবা: ৬৫-৬৬)

কেননা এ বিষয়গুলো এমন যে, তা নিয়ে হাসি-তামাশা ও ঠাট্টা-বিদ্রুপ চলে না। এগুলোর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা আবশ্যক। আল্লাহর আয়াতগুলো তিলওয়াতের সময় আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ও তার রসূলের প্রতি ঈমান রেখে এবং তার আয়াতের প্রতি সম্মান রেখে ভীত-সন্ত্রস্ত হওয়া আবশ্যক। যারা এগুলো নিয়ে খেল-তামাশা করে, তারা এগুলোর মর্যাদা নষ্ট করে।

শাইখ মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব রহিমাহুল্লাহ বলেন, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের যেসব সুস্পষ্ট বাক্য উপরোক্ত হাদীছে উল্লেখ করা হয়েছে, সেটা এবং তার অনুরূপ বাক্যের মাধ্যমে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ হয়ে থাকে। আর যেসব সুস্পষ্ট কথা ও আচরণ দ্বারা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ হয়ে থাকে তা হচ্ছে, যেমন ঠোঁট লম্বা করা, জিহবা বের করা, চোখ দ্বারা ইঙ্গিত করা। এমনি লোকদেরকে যখন সালাত  আদায় ও যাকাত প্রদানের আদেশ করা হয়, তখন তাদের থেকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের আরো অনেক কথা ও আচরণ প্রকাশ পায়। উপরোক্ত বিষয়গুলো নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করার কারণে যেখানে মানুষ কাফের হয়ে যায়, তাহলে তাওহীদ নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করলে কেমন হবে! শাইখের কথা এখানেই শেষ।

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সুসাব্যস্ত ও সুপ্রমাণিত সুন্নাত নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করাও অনুরূপ। যেমন কেউ লম্বা দাঁড়ি নিয়ে বিদ্রুপ করলো, মোচ খাটো করা নিয়ে বিদ্রুপ করলো অথবা মেসওয়াক নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করলো অথবা অনুরূপ অন্যান্য বিষয় যেমন সৎকাজের আদেশ ও অন্যায় কাজের নিষেধ নিয়ে বিদ্রুপ করলো।

ইবনে ইসহাক বলেছেন, উমাইয়্যা ইবনে যায়েদ ইবনে আমর গোত্রের বন্ধু ওয়াদীয়া ইবনে ছাবেত এবং বনু সালামার বন্ধু আশজা গোত্রের মাখশী ইবনে হিময়ার নামক জনৈক ব্যক্তিসহ একদল মুনাফেক রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিকে ইঙ্গিত করে বিদ্রুপ করলো। তিনি তখন তাবুক যুদ্ধে যাচ্ছিলেন। মুনাফেকরা পরস্পর বলাবলি করলো, তোমরা কি মনে করো, রোমকদের বীরত্ব ও যুদ্ধ আরবদের পারস্পরিক যুদ্ধের মতোই? আল্লাহর কসম! আমরা যেন দেখতে পাচ্ছি, আগামীকাল তোমাদেরকে ধুলোমাখা অবস্থায় রশী দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। গুজব রটানোর জন্য এবং মুমিনদেরকে ভয় দেখিয়ে দুর্বল করে দেয়ার জন্য তারা এসব কথা বলেছিল।

মাখশী ইবনে হিময়ার তখন বললো, আল্লাহর কসম! আমি এ মর্মে মুকাদ্দমা পেশ করতে চাই যে, তোমাদের এ কথার কারণে আমাদের ব্যাপারে কুরআন নাযিল হওয়ার বদলে আমাদের প্রত্যেককেই ১০০টি করে বেত্রাঘাত করা হোক। বর্ণনাকারী বলেন, আমি যতদূর জানতে পেরেছি, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন আম্মার ইবনে ইয়াসিরকে বলেছিলেন, তুমি তাড়াতাড়ি ঐসব লোকের কাছে যাও। তারা তো আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তারা যা বলেছে, তা সম্পর্কে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করো। তারা যদি অস্বীকার করে, তাহলে বলো, তোমরা অবশ্যই এসব কথা বলেছো।

আম্মার তাদের কাছে গেলেন এবং তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন। এরই মধ্যে তারা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে উপস্থিত হয়ে অযুহাত পেশ করলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার বাহনের পাশে দাঁড়ানো ছিলেন। এমন সময় ওয়াদীয়া ইবনে ছাবিত এসে তার উটের রশি ধরে বলতে লাগলো, ইয়া রসূলাল্লাহ! আমরা কেবল হাসি-তামাশা করছিলাম। মাখশী ইবনে হিময়ার তখন বললো, ইয়া রসূলাল্লাহ! আমার সুনাম ও আমার পিতার সুনাম-সুখ্যাতি আমাকে তাদের থেকে আলাদা রেখেছে। সম্ভবত তিনি আল্লাহ তা‘আলার এ বাণী,

﴿إِنْ نَعْفُ عَنْ طَائِفَةٍ مِنْكُمْ نُعَذِّبْ طَائِفَةً﴾

‘‘তোমাদের মধ্যে কোনো কোনো লোককে যদি আমি ক্ষমা করে দেই, তাহলে অবশ্যই কিছু লোককে আযাবও দিবো’’ দ্বারা মাখশী ইবনে হিময়ারকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। অর্থাৎ এ আয়াতে যাকে ক্ষমা করা হয়েছে বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে, তিনি হলেন, মাখশী ইবনে হিময়ার। অতঃপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন তার নাম রাখলেন আব্দুর রাহমান। তিনি আল্লাহর কাছে দু‘আ করলেন, তিনি যেন তাকে এমন স্থানে শহীদ হিসাবে মৃত্যু দান করেন, যা কেউ জানতে না পারে। পরবর্তীতে তিনি ইয়ামামার যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেছেন। তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রহিমাহুল্লাহ বলেন, আল্লাহ তা‘আলা মুনাফেকদের সম্পর্কে সংবাদ দিয়েছেন যে, তারা ঈমান আনয়ন করার পর কুফুরী করেছে। অথচ তারা বলেছিল, আমরা আন্তরিকভাবে কুফুরী আকীদা পোষণ করে কুফুরী বাক্য উচ্চারণ করিনি। বরং আমরা কেবল হাসি-তামাশা ও খেলা করছিলাম। আল্লাহ তা‘আলা এখানে বর্ণনা করেছেন যে, তার আয়াত নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা কুফুরী। যে ব্যক্তি অন্তর খুলে এসব কথা বলার জন্য প্রস্ত্তত হয় সে ব্যতীত অন্য কারো পক্ষ হতে এ কথা বের হওয়ার কল্পনা করা যায় না। তাদের অন্তরে যদি ঈমান থাকতো, তাহলে তাদের ঈমান তাদেরকে এ কথা বলা থেকে বারণ করতো। কুরআন সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করছে যে, অন্তরের ঈমান অনুপাতেই বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমল হয়ে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَيَقُولُونَ آمَنَّا بِاللَّهِ وَبِالرَّسُولِ وَأَطَعْنَا ثُمَّ يَتَوَلَّى فَرِيقٌ مِنْهُمْ مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ وَمَا أُولَئِكَ بِالْمُؤْمِنِينَ (৪৭) وَإِذَا دُعُوا إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ إِذَا فَرِيقٌ مِنْهُمْ مُعْرِضُونَ (৪৮) وَإِنْ يَكُنْ لَهُمُ الْحَقُّ يَأْتُوا إِلَيْهِ مُذْعِنِينَ (৪৯) أَفِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ أَمِ ارْتَابُوا أَمْ يَخَافُونَ أَنْ يَحِيفَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ وَرَسُولُهُ بَلْ أُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ (৫০) إِنَّمَا كَانَ قَوْلَ الْمُؤْمِنِينَ إِذَا دُعُوا إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ أَنْ يَقُولُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ﴾         

‘‘তারা বলে, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহ ও রসূলের প্রতি এবং আমরা আনুগত্য করেছি কিন্তু এরপর তাদের মধ্য থেকে একটি দল মুখ ফিরিয়ে নেয়। এ ধরনের লোকেরা কখনোই মুমিন নয়। যখন তাদেরকে ডাকা হয় আল্লাহ ও তার রসূলের দিকে, যাতে রসূল তাদের পরস্পরের মধ্যে ফায়ছালা করে দেন তখন তাদের মধ্যকার একটি দল পাশ কাটিয়ে যায়। তবে যদি সত্য তাদের অনুকূল থাকে, তাহলে বড়ই বিনীত হয়ে রসূলের কাছে আসে। তাদের মনে কি রোগ আছে? না তারা সন্দেহের শিকার হয়েছে? না তারা ভয় করছে যে, আল্লাহ ও তার রসূল তাদের প্রতি যুলুম করবেন? আসলে তারা নিজেরাই যালেম। মুমিনদের কথা হচ্ছে, যখন তাদেরকে আল্লাহ ও রসূলের দিকে ডাকা হয়, যাতে রসূল তাদের মধ্যে ফায়সালা করেন, তখন তারা বলে, আমরা শুনলাম ও আনুগত্য করলাম। এরাই সফলকাম হবে’’। (সূরা নূর: ৪৭-৫১)

যারা রসূলের আনুগত্য করা থেকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের থেকে ঈমান নাকোচ করে দিয়েছেন। তিনি আরো সংবাদ দিয়েছেন যে, মুমিনদেরকে তাদের পারস্পরিক বিবাদ নিস্পত্তির জন্য আল্লাহ ও তার রসূলের দিকে আহবান করা হলে তারা শ্রবণ করে এবং আনুগত্য করে। সুতরাং আল্লাহ উল্লেখ করেছেন যে, এটি ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়ার বক্তব্য এখানেই শেষ।

এতে করে জানা গেলো যে, যারা ইসলামী শরী‘আতকে দোষারোপ করে, যারা বলে বর্তমান বিশ্বের জন্য ইসলামী শরী‘আত উপযোগী নয়, যারা বলে ইসলামী শরী‘আতের দ-বিধির মধ্যে নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতা রয়েছে, যারা বলে ইসলাম নারীদের উপর যুলুম করেছে এবং যারা এ জাতিয় অন্যান্য কুফুরী বাক্য উচ্চারণ করে, তারা কাফের। এসব কথা থেকে বাঁচার জন্য আমরা আল্লাহর কাছে অনুগ্রহ ও নিরাপত্তা কামনা করছি।


[1]. ঘটনাটি সহীহ। দেখুন: তাফসীরে ইবনে কাছীর, (৪/১৭১)।

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ২ পর্যন্ত, সর্বমোট ২ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে