আল ইরশাদ-সহীহ আকীদার দিশারী ইসলামী আকীদা শাইখ ড. ছলিহ ইবনে ফাওযান আল ফাওযান ৪ টি
العقيدة الإسلامية - ইসলামে আকীদার গুরুত্ব

সঠিক ইসলামী আকীদা দিয়েই আল্লাহ তা‘আলা রসূলগণকে পাঠিয়েছেন, কিতাবসমূহ নাযিল করেছেন এবং সমস্ত জিন-ইনসানের উপর এটি কবুল করে নেয়াকে আবশ্যক করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ مَا أُرِيدُ مِنْهُمْ مِنْ رِزْقٍ وَمَا أُرِيدُ أَنْ يُطْعِمُونِ (৫৭) إِنَّ اللَّهَ هُوَ الرَّزَّاقُ ذُو الْقُوَّةِ الْمَتِينُ﴾

‘‘আমি জিন এবং মানুষকে একমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছি। আমি তাদের কাছে কোন রিযিক চাই না কিংবা তারা আমাকে খাওয়াবে তাও চাই না। আল্লাহ নিজেই রিযিকদাতা এবং প্রবল শক্তিধর ও পরাক্রমশালী’’। (সূরা আয যারিয়াত: ৫৬-৫৮)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا﴾

‘‘তোমার রব এ ফায়ছালা দিয়েছেন যে, তাকে ছাড়া তোমরা অন্য কারো ইবাদত করো না। আর মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করো’’। (সূরা বানী ইসরাঈল: ২৩)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ﴾

‘‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রসূল পাঠিয়েছি। তার মাধ্যমে এ নির্দেশ দিয়েছি যে তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো আর তাগুতকে বর্জন করো’’। (সূরা আন-নাহাল: ৩৬)

সমস্ত রসূলই এ সহীহ আকীদার দাওয়াত নিয়ে এসেছেন। সমস্ত আসমানী কিতাবই এ সহীহ আকীদার বিশদ বিবরণ দেয়ার জন্য নাযিল হয়েছে এবং এটাকে ভঙ্গকারী অথবা এটাকে ত্রুটিযুক্তকারী বিষয়গুলো স্পষ্ট করার জন্যই অবতীর্ণ হয়েছে। প্রাপ্ত বয়স্ক প্রত্যেক মানুষকেই তা গ্রহণ করার আদেশ করা হয়েছে।

সুতরাং আকীদার বিষয়টি যেহেতু এত মর্যাদাবান ও গুরুত্বপূর্ণ, তাই সর্বপ্রথম এর প্রতি গুরুত্ব দেয়া, এ নিয়ে গবেষণা করা এবং এর জ্ঞান অর্জন করা জরুরী। কেননা এ পরিশুদ্ধ আকীদার উপরই মানুষের ইহ-পরকালীন সৌভাগ্য নির্ভর করে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنْ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى لَا انْفِصَامَ لَهَا وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ﴾

‘‘যে ব্যক্তি ‘তাগুতকে’[1] অস্বীকার করে এবং আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করে, সে ধারণ করে নেয় সুদৃঢ় হাতল, যা বিচ্ছিন্ন হবার নয়। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’’। (সূরা আল বাকারা: ২৫৬)

অর্থাৎ যে ব্যক্তি এ সঠিক আকীদা থেকে হাত গুটিয়ে নিবে, সে এ বিষয়ে নিজস্ব খেয়াল-খুশী ও বাতিল ধারণার দিকে ধাবিত হবে। সুতরাং যে ব্যক্তি সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হবে সে তার সামনে বাতিল ছাড়া অন্য কিছু দেখতে পাবে না।

সূরা হাজ্জের ৬২ নং আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ذَلِكَ بِأَنَّ اللَّهَ هُوَ الْحَقُّ وَأَنَّ مَا يَدْعُونَ مِن دُونِهِ الْبَاطِلُ﴾

 ‘‘আল্লাহই সত্য; আর তার পরিবর্তে তারা যাকে ডাকে, তা বাতিল’’।

সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত লোকের পরিণাম জাহান্নামের দিকেই হবে। তা কতই না নিকৃষ্ট বাসস্থান।

[1]. মোটকথা তাগুতকে অস্বীকার না করা পর্যন্ত কারো ইসলাম পরিশুদ্ধ হবে না। কালেমায়ে তায়্যেবা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর মর্মার্থ এটিই। সুতরাং لاإله এই কথার মাধ্যমে প্রত্যেক ঐ তাগুতকে অস্বীকার করা হয়েছে, আল্লাহর পরিবর্তে যার ইবাদত করা হয়। আর إلا الله কালেমার এ অংশের মাধ্যমে কেবল আল্লাহর একত্ব সাব্যস্ত করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ﴾

  ‘‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসূল পাঠিয়েছি। তার মাধ্যমে এ নির্দেশ দিয়েছি যে তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, আর তাগুতকে বর্জন করো’’ (সূরা আন নাহাল: ৩৬) ।

সুতরাং আল্লাহর ইবাদতকে একটি বিষয় হিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। আর তাগুতের ইবাদতকে অন্য একটি বিষয় হিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। সুতরাং একজন মানুষ কেবল তখনই মুসলিম বলে গণ্য হবে, যখন সে আল্লাহর ইবাদত করবে এবং একই সাথে তাগুত থেকে দূরে থাকবে।

আর طاغوت শব্দের উৎপত্তি হয়েছে الطغيان থেকে। তাগুত বলা হয় এমন প্রত্যেক ব্যক্তিকে, যে অন্যায় ও বিদ্রোহে সীমা লংঘন করে। আল্লাহ তা‘আলা মূসা আলাইহিস সালামকে লক্ষ্য করে বলেছেন,

﴾ اذْهَبْ إِلَىٰ فِرْعَوْنَ إِنَّهُ طَغَى ﴿

‘‘এখন তুমি যাও ফেরাউনের কাছে। কেননা সে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে’’। (সূরা ত্বহা: ২৪) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿إِنَّا لَمَّا طَغَى الْمَاءُ حَمَلْنَاكُمْ فِي الْجَارِيَةِ﴾

‘‘যে সময় পানির তুফান সীমাঅতিক্রম করলো তখন আমি তোমাদেরকে জাহাজে আরোহন করিয়েছিলাম’’। (সূরা আল হাক্কাহ: ১১) অর্থাৎ পানি যখন অত্যন্ত বেড়ে গেল। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴾  فَأَمَّا ثَمُودُ فَأُهْلِكُوا بِالطَّاغِيَةِ ﴿

‘‘তাই সামূদ জাতিকে একটি সীমাহীন বিপদ দিয়ে ধ্বংস করা হয়েছে’’। (সূরা আলহাক্কাহ: ৫)

অর্থাৎ বিকট ও ভয়াবহ একটি চিৎকারের মাধ্যমে। সুতরাং যে ব্যক্তি বা বিষয় সীমা অতিক্রম করে, তাকেই তাগুত বলা হয়। শয়তানকে আল্লাহর আদেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করার কারণে এবং সীমালংঘন করার কারণে তাগুত বলা হয়। আল্লাহ ব্যতীত অন্য যে মাবুদের ইবাদত করা হয়, সে মাবুদ যদি উক্ত ইবাদতের প্রতি সন্তুষ্ট থাকে, তাহলে তাকে তাগুত বলা হয়। যাদুকর এবং গণক উভয়ই তাগুত। এমনি আল্লাহ ব্যতীত অন্যান্য প্রত্যেক মাবুদই তাগুত।

মানুষ যা সত্য বলে বিশ্বাস করে এবং যাকে সে দীন হিসাবে গ্রহণ করে তাই তার আকীদা। এ আকীদাটি যদি আল্লাহ তা‘আলার প্রেরিত রসূলগণের দীন এবং তার নাযিলকৃত কিতাবসমূহ অনুযায়ী হয়, তাহলে তা সহীহ আকীদা হিসাবে গণ্য হয়। তার মাধ্যমে আল্লাহর আযাব থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে এবং দুনিয়া ও আখিরাতে সৌভাগ্য লাভ করা যাবে।

আর এ আকীদা যদি আল্লাহ তা‘আলার প্রেরিত রসূলগণের আনীত আকীদার বিরোধী হয় এবং তার নাযিলকৃত আসমানী কিতাবসমূহের পরিপন্থী হয়, তাহলে তার অনুসারীরা আযাবের সম্মুখীন হবে এবং দুনিয়া ও আখিরাতে হতভাগ্য হবে।

কেউ পরিশুদ্ধ আকীদা গ্রহণ করলে দুনিয়াতে তার জান-মাল নিরাপদ থাকবে এবং অন্যায়ভাবে তার উপর আক্রমণ করা নিষিদ্ধ হবে।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন,

أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوا أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ وَيُقِيمُوا الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ فَإِذَا فَعَلُوا ذَلِكَ عَصَمُوا مِنِّي دِمَاءَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ إِلَّا بِحَقِّ الْإِسْلَامِ وَحِسَابُهُمْ عَلَى اللَّهِ  

‘‘আমাকে মানুষের সাথে জিহাদ করার আদেশ দেয়া হয়েছে যতক্ষণ না তারা এ সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রসূল এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করবে ও যাকাত দিবে। যখন তারা এ কাজগুলো সম্পাদন করবে তখন তারা আমার হাত থেকে নিজেদের জান ও মাল নিরাপদ করে নিবে’’।[1]

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَكَفَرَ بِمَا يُعْبَدُ مِنْ دُونِ اللَّهِ حَرُمَ مَالُهُ وَدَمُهُ وَحِسَابُهُ عَلَى اللَّهِ

‘‘যে ব্যক্তি ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্যান্য বাতিল মাবুদের ইবাদতকে অস্বীকার করবে, তার জান-মাল মুসলিমদের নিকট সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকবে এবং তার অন্তরে লুকায়িত বিষয়ের হিসাব আল্লাহর উপরই ন্যস্ত হবে’’।[2]

এ পরিশুদ্ধ আকীদাই কিয়ামতের দিন বান্দাকে আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচাবে।  মুসলিম শরীফে জাবের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে মারফু সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,  

مَنْ لَقِىَ اللَّهَ لاَ يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا دَخَلَ الْجَنَّةَ وَمَنْ لَقِيَهُ يُشْرِكُ بِهِ شيئا دَخَلَ النَّارِ

‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক না করে মৃত্যু বরণ করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি তার সাথে কাউকে শরীক করে মৃত্যু বরণ করবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে’’।[3]

ইমাম বুখারী ও মুসলিম সাহাবী ইতবান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

فَإِنَّ اللَّهَ حَرَّمَ عَلَى النَّارِ مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ يَبْتَغِى بِذَلِكَ وَجْهَ اللَّهِ

  ‘‘আল্লাহ তা‘আলা এমন ব্যক্তির উপর জাহান্নামের আগুন হারাম করে দিয়েছেন, যে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলেছে’’।[4]

পরিশুদ্ধ আকীদার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা মানুষের সমস্ত গুনাহ মোচন করে দেন। ইমাম তিরমিযী আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, আমি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, আল্লাহ তা‘আলা হাদীছে কুদছীতে বলেছেন,

يَا ابْنَ آدَمَ إِنَّكَ لَوْ أَتَيْتَنِى بِقُرَابِ الأَرْضِ خَطَايَا ثُمَّ لَقِيتَنِى لاَ تُشْرِكُ بِى شَيْئًا لأَتَيْتُكَ بِقُرَابِهَا مَغْفِرَةً  

‘‘হে বনী আদম! তুমি যদি যমীন পরিপূর্ণ গুনাহ্ নিয়ে আমার কাছে আগমন করো এবং আমার সাথে অন্য কিছুকে শরীক না করে মিলিত হও, তাহলে যমীন পরিপূর্ণ ক্ষমাসহ আমি তোমার সাথে সাক্ষাৎ করবো।[5]

হাদীছের শব্দ قرابها অর্থ হলো ملؤها অর্থাৎ যমীন ভর্তি বা তার কাছাকাছি। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমা পাওয়ার শর্ত হলো শিরকমুক্ত পরিশুদ্ধ আকীদা থাকা চাই। চাই শিরকের পরিমাণ বেশী হোক বা কম হোক, ছোট শিরক হোক বা বড় শিরক হোক। যার আকীদা শিরকমুক্ত হবে সেই মুক্ত ও পরিশুদ্ধ অন্তরের মালিক বলে গণ্য হবে। এ শ্রেণীর লোকের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَوْمَ لَا يَنفَعُ مَالٌ وَلَا بَنُونَ إِلَّا مَنْ أَتَى اللَّهَ بِقَلْبٍ سَلِيمٍ﴾

‘‘সেদিন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোনো উপকারে আসবে না; কিন্তু যে পরিশুদ্ধ অন্তর নিয়ে আল্লাহর কাছে আসবে’’। (সূরা শুআরা: ৮৮-৮৯)

আল্লামা ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ ইতবান ইবনে মালেকের হাদীছের ব্যাখ্যায় বলেন, সেসব পরিশুদ্ধ তাওহীদের অধিকারীগণ ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে, যারা তাদের তাওহীদের সাথে শিরক মিশ্রিত করেনি। আর যাদের অবস্থা শিরকমুক্ত হবে না, তারা ক্ষমাপ্রাপ্তও হবে না।

সুতরাং তাওহীদপন্থী যে লোক আল্লাহর সাথে কোনো কিছুকে শরীক না করা অবস্থায় যমীন ভর্তি গুনাহ নিয়ে সাক্ষাৎ করবে, আল্লাহ তা‘আলা তার সাথে যমীন ভর্তি ক্ষমা নিয়ে সাক্ষাৎ করবেন। যার তাওহীদ ত্রুটিযুক্ত হবে, সে এ ফযীলত অর্জন করতে পারবে না। সুতরাং যে খাঁটি তাওহীদের সাথে শিরক মিশ্রিত হয় না, তার সাথে কোনো গুনাহ অবশিষ্ট থাকে না। কেননা পরিশুদ্ধ আকীদা আল্লাহ তা‘আলার ভালোবাসা, তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, তার ভয়, একমাত্র তার নিকট আশা-ভরসা ইত্যাদিকে আবশ্যক করে। আর এটি নিঃসন্দেহে গুনাহ মোচন হওয়ার কারণ। যদিও এটা যমীন ভর্তি হোক না কেন। সুতরাং শিরকের নাপাকী আসতেই পারে। কিন্তু তাকে দূর করার খুব শক্তিশালী মাধ্যম ও উপায় রয়েছে। ইমাম ইবনুল কাইয়্যিমের কথা এখানেই শেষ।

আকীদা বিশুদ্ধ থাকলে আমল কবুল হয় এবং আমল দ্বারা বান্দা উপকৃত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِّن ذَكَرٍ أَوْ أُنثَىٰ وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُم بِأَحْسَنِ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ﴾

‘‘যে পুরুষ বা নারীই সৎকাজ করবে, সে যদি মুমিন হয়, তাহলে তাকে আমি দুনিয়ায় পবিত্র-পরিচ্ছন্ন জীবন দান করবো এবং আখিরাতে তাদের প্রতিদান দেবো তাদের সর্বোত্তম কাজ অনুসারে’’। (সূরা আন নাহাল: ৯৭)

আর যদি আকীদা পরিশুদ্ধ না হয়, তাহলে বিপরীত হবে। কেননা বাতিল আকীদা সমস্ত আমল বরবাদ করে দেয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَلَقَدْ أُوحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ﴾

‘‘তোমার প্রতি এবং তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়েছে, যদি আল্লাহর সাথে শরীক করো, তবে তোমার কর্ম নিস্ফল হবে এবং তুমি ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত হবে’’। (সূরা আয যুমার: ৬৫)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَلَوْ أَشْرَكُوا لَحَبِطَ عَنْهُمْ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ﴾

‘‘তারা যদি শিরক করতো, তাহলে তাদের আমলসমূহ বরবাদ হয়ে যেতো’’। (সূরা আনআম: ৮৮)

শিরকপূর্ণ বাতিল আকীদার কারণে বানদার জন্য জান্নাত হারাম হয়ে যায় ও সে আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমা হতে বঞ্চিত হয়। এর কারণে মানুষ আল্লাহর আযাবের সম্মুখীন হবে এবং চিরকাল জাহান্নামে থাকবে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ﴾

‘‘নিশ্চয় আল্লাহ তার সাথে শিরক করার গুনাহ মাফ করবেন না। শিরক ছাড়া অন্যান্য যেসব গুনাহ রয়েছে সেগুলো যাকে ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করে দিবেন’’। (সূরা আন নিসা: ৪৮)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنْصَارٍ﴾

নিশ্চয় যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শিরক করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেন এবং তার বাসস্থান হয় জাহান্নাম। বস্ত্তত যালেমদের কোনো সাহায্যকারী নেই। (সূরা আল মায়েদা: ৭২)

বাতিল আকীদা পোষণকারীর জান ও মালের কোনো নিরাপত্তা থাকে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ لِلَّهِ﴾

‘‘তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর ফিতনা (শিরক) অবসান না হওয়া পর্যন্ত এবং দীন পরিপূর্ণরূপে আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট না হওয়া পর্যন্ত’’। (সুরা আল আনফাল: ৩৯)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿فَاقْتُلُوا الْمُشْرِكِينَ حَيْثُ وَجَدْتُمُوهُمْ وَخُذُوهُمْ وَاحْصُرُوهُمْ وَاقْعُدُوا لَهُمْ كُلَّ مَرْصَدٍ فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوْا الزَّكَاةَ فَخَلُّوا سَبِيلَهُمْ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ﴾

‘‘অতঃপর মুশরিকদের হত্যা করো। যেখানেই তাদেরকে পাও, তাদেরকে বন্দী এবং অবরোধ করো। আর প্রত্যেক ঘাঁটিতে তাদের সন্ধানে ওঁৎ পেতে বসে থাকো। কিন্তু যদি তারা তাওবা করে, সালাত কায়েম করে এবং যাকাত প্রদান করে তাহলে তাদের রাস্তা ছেড়ে দাও। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’’। (সূরা আত তাওবা: ৫)

অপরপক্ষে মানুষের অন্তর, সামাজিক আচার-আচরণ ও জীবন-যাপনে পরিশুদ্ধ আকীদার বিরাট প্রভাব রয়েছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যামানায় দু’দল লোক মসজিদ নির্মাণ করেছিল। একদল লোক সৎ নিয়ত ও আল্লাহ তা‘আলার প্রতি সহীহ আকীদা পোষণ করে মসজিদ নির্মাণ করেছিল। অন্য একটি দল অসৎ উদ্দেশ্যে এবং বাতিল আকীদার উপর একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিল। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তার নবীকে ঐ মসজিদে সালাত আদায় করার আদেশ করলেন, যা তাকওয়া এবং পরিশুদ্ধ ঈমানের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর যে মসজিদ কুফুরী করার জন্য এবং অসৎ উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছে, তাতে তিনি তার নবীকে সালাতের জন্য দাঁড়াতে নিষেধ করেছেন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَالَّذِينَ اتَّخَذُوا مَسْجِدًا ضِرَارًا وَكُفْرًا وَتَفْرِيقًا بَيْنَ الْمُؤْمِنِينَ وَإِرْصَادًا لِمَنْ حَارَبَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ مِنْ قَبْلُ وَلَيَحْلِفُنَّ إِنْ أَرَدْنَا إِلَّا الْحُسْنَى وَاللَّهُ يَشْهَدُ إِنَّهُمْ لَكَاذِبُونَ لَا تَقُمْ فِيهِ أَبَدًا لَمَسْجِدٌ أُسِّسَ عَلَى التَّقْوَى مِنْ أَوَّلِ يَوْمٍ أَحَقُّ أَنْ تَقُومَ فِيهِ فِيهِ رِجَالٌ يُحِبُّونَ أَنْ يَتَطَهَّرُوا وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُطَّهِّرِينَ فَمَنْ أَسَّسَ بُنْيَانَهُ عَلَى تَقْوَى مِنَ اللَّهِ وَرِضْوَانٍ خَيْرٌ أَمْ مَنْ أَسَّسَ بُنْيَانَهُ عَلَى شَفَا جُرُفٍ هَارٍ فَانْهَارَ بِهِ فِي نَارِ جَهَنَّمَ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ﴾

‘‘যারা সত্যের দাওয়াতকে ক্ষতিগ্রস্থ করার উদ্দেশ্যে, কুফুরী করার জন্য, মুমিনদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে এবং ঐ ব্যক্তির জন্য গোপন ঘাটি বানাবার উদ্দেশ্যে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছে যে ইতিপূর্বে আল্লাহ ও তার রসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, তারা অবশ্যই কসম খেয়ে বলবে, ভালো ছাড়া আর কোনো ইচ্ছাই আমাদের ছিল না। কিন্তু আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, তারা একেবারেই মিথ্যাবাদী। তুমি কখনো সেখানে দাঁড়াবে না, তবে যে মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে তাকওয়ার উপর প্রথম দিন থেকেই, সেটিই তোমার দাঁড়াবার যোগ্য স্থান। সেখানে রয়েছে এমন লোক, যারা পবিত্রতা অর্জন করাকে ভালোবাসে। আর আল্লাহ পবিত্র লোকদের ভালবাসেন। তুমি কি মনে করো, যে ব্যক্তি আল্লাহ ভীতি ও তার সন্তুষ্টি অর্জনের উপর নিজের ইমারতের ভীত্তি স্থাপন করলো সে ভাল, না যে ব্যক্তি তার ইমারতের ভিত উঠালো পতনমুখী একটি গর্তের কিনারায়, অতঃপর তা তাকে নিয়ে সোজা জাহান্নামের আগুনে গিয়ে পড়লো? এ ধরণের যালেমদেরকে আল্লাহ কখনো সোজা পথ দেখান না’’। (সূরা আত তাওবা: ১০৭-১০৯)


[1] . বুখারী, অধ্যায়: কিতাবুল ঈমান।

[2] . মুসলিম, অধ্যায়: লা-ইলাহা পাঠ না করা পর্যন্ত লোকদের সাথে জিহাদ করার আদেশ।

[3]. সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: যে ব্যক্তি শিরক করে মৃত্যু বরণ করল, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।

[4] . বুখারী, অধ্যায়: বাড়িঘরে সালাতের স্থান নির্ধারণ করা, মুসলিম, অধ্যায়: জামা‘আতের সাথে সালাত পড়া হতে বিরত থাকার অনুমতি।

[5] . তিরমিযী, অধ্যায়: গুনাহ্ করার পর বান্দার জন্য আল্লাহর ক্ষমা। ইমাম আলবানী (রহি.) হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন। দেখুন: সিলসিলায়ে সহীহা, হা/১২৭।

وجوب معرفة العقيدة الإسلامية - সঠিক ইসলামী আকীদা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের আবশ্যকতা

প্রিয় ভাইগণ! আল্লাহ তা‘আলা আমাকে এবং আপনাদেরকে ইসলামের সঠিক আকীদা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের তাওফীক দান করুন। কেননা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ইসলামের সহীহ আকীদা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা জরুরী। সহীহ আকীদার অর্থ এবং তার ভিত্তি সম্পর্কে জানা আবশ্যক। সে সঙ্গে সহীহ আকীদা পরিপন্থী এবং যা এটাকে ভঙ্গ ও বাতিল করে দেয় সে সম্পর্কেও জানা আবশ্যক। বড় এবং ছোট উভয় প্রকার শিরকই সহীহ আকীদাকে ভঙ্গ কিংবা ত্রুটিপূর্ণ করে দেয়।

আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদে বলেন,

﴿فَاعْلَمْ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ﴾

‘‘তুমি জেনে নাও যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো উপাস্য নেই। অতঃপর তোমার গুনাহ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করো’’। (সূরা মুহাম্মাদ: ১৯)

ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ তার সহীহ গ্রন্থে তাওহীদের জ্ঞান অর্জনের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে যে অধ্যায় রচনা করেছেন, তা হলো باب العلم قبل القول والعمل অর্থাৎ কথা ও কাজের আগে জ্ঞান থাকা জরুরী। অতঃপর তিনি উপরোক্ত আয়াত দিয়ে দলীল পেশ করেছেন।

হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রহিমাহুল্লাহ বলেন, ইবনুল মুনীর বলেছেন, ইমাম বুখারীর উদ্দেশ্য হলো কথা ও আচরণের বিশুদ্ধতার জন্য জ্ঞান থাকা জরুরী। সুতরাং জ্ঞান ছাড়া কথা ও আচরণের কোনো মূল্য নেই। তাই তাওহীদের জ্ঞানকে কথা ও কাজের উপর প্রাধান্য দিতে হবে। তাওহীদের জ্ঞানই নিয়তকে পরিশুদ্ধ করে। আর নিয়ত মানুষের আমলকে বিশুদ্ধতা দান করে।

এ কারণেই আলেমগণ আকীদার হুকুম-আহকাম শিক্ষা করা এবং এটাকে শিক্ষা দেয়ার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছেন। তারা সকল প্রকার ইলম অর্জনের উপর সহীহ আকীদার ইলম অর্জনকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এ বিষয়ে তারা নির্দিষ্টভাবে অনেক কিতাব রচনা করেছেন। এতে তারা বিস্তারিতভাবে আকীদার মাসায়েল এবং তা গ্রহণ করার আবশ্যকতা বর্ণনা করেছেন। সে সঙ্গে তারা সহীহ আকীদা ভঙ্গকারী বা এটাকে ত্রুটিযুক্তকারী শিরক, বিদআত এবং কুসংস্কারগুলোও বর্ণনা করেছেন। এটিই হচ্ছে لاإله إلا الله -এর ব্যাখ্যা। এটি শুধু মুখের উচ্চারণের নাম নয়। বরং এর অর্থ, মর্মার্থ, তাৎপর্য ও দাবি রয়েছে। এগুলো জানা এবং প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে সে অনুপাতে আমল করা আবশ্যক। এ আকীদাকে ভঙ্গকারী এবং ত্রুটিযুক্তকারী অনেক বিষয় রয়েছে। এগুলো সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা ব্যতীত কারো কাছে এটা পরিষ্কার হয় না।

এ জন্যই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন স্তরের পাঠ্যসূচীতে আকীদার বিষয়কে সর্বোচ্চ স্থানে রাখা আবশ্যক এবং প্রত্যেক দিনের ক্লাশরুটিনে আকীদার ক্লাশের সংখ্যা যথেষ্ট থাকা চাই। যোগ্য শিক্ষকগণ এটা পাঠ দান করবে। আকীদার বিষয়ে কাউকে পাশ বা ফেল করানোর সময় বিশেষ গুরুত্ব দেয়া আবশ্যক। কিন্তু বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ পাঠ্যসূচী ও শিক্ষাক্রম এর সম্পূর্ণ বিপরীত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাঠ্যসূচী তৈরী করার সময় আকীদার প্রতি যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করা হয় না। এতে মুসলিমদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আকীদা সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে তারা শিরক, বিদআত এবং কুসংস্কারকে বৈধ মনে করে এটাকেই আকীদা হিসাবে গ্রহণ করতে পারে। কেননা তারা লোকদেরকে এর উপর দেখতে পাবে। এগুলো যে ভুল ও বাতিল, তারা তা বুঝতে পারবে না।


এ জন্যই আমীরুল মুমিনীন উমার ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন,

يوشك أن تنقض عرى الإسلام عروة عروة إذا نشأ في الإسلام من لا يعرف الجاهلية

‘‘অচিরেই ইসলামের বন্ধন (হুকুম-আহকাম, আদেশ-নিষেধ ও বিধি-বিধান) একটি একটি করে খুলে ফেলা হবে। বিশেষ করে যখন ইসলামের মধ্যে এমন লোকের আবির্ভাব ঘটবে, যারা কুফর ও শিরক সম্পর্কে অজ্ঞ হবে।

এ জন্যই মুসলিম ছাত্রদের জন্য পাঠ্যসূচী হিসাবে এমন সহীহ-শুদ্ধ কিতাব নির্বাচন করা আবশ্যক, যা সালাফে সালেহীন ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মানহাজের উপর লিখিত হয়েছে এবং আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাত থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এগুলো মুসলিম ছাত্রদের পাঠ্যসূচী হিসাবে নির্ধারণ করা হবে। সে সঙ্গে সালাফে সালেহীনদের মানহাজের পরিপন্থী কিতাবগুলো পাঠ্যসূচী থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া উচিত। যেমন আশায়েরা, মু‘তাযিলা, জাহমীয়া এবং সালাফদের মানহাজ থেকে বিচ্যুত অন্যান্য গোমরাহ ফির্কার কিতাবগুলো যেন পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত না করা হয়।

মুসলিম সমাজের সরকারী-বেসরকারী নিয়মতান্ত্রিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহীহ আকীদার পাঠদানের সাথে সাথে মসজিদগুলোতেও ইলমী দারসের (বিদ্যা পাঠদান) ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক। এসব দারসে সালাফী আকীদার পাঠদান করাকে সর্বোচ্চ স্থানে রাখা চাই। এখানে মূল কিতাব এবং এটার ব্যাখ্যা পড়ানো হবে। যাতে করে ছাত্র এবং উপস্থিত সাধারণ লোকেরা উপকৃত হতে পারে। সে সঙ্গে আকীদা সম্পর্কিত বড় বড় কিতাবগুলো সংক্ষিপ্ত করে লিখে সাধারণ লোকদের সামনে এটার ব্যাখ্যা-বিশেস্নষণ করাও জরুরী। এর মাধ্যমে সহীহ ইসলামী আকীদার প্রচার ও প্রসার ঘটবে। ইনশা-আল্লাহ। এর পাশাপাশি রেডিও এবং অন্যান্য প্রচার মাধ্যমে যেসব ধর্মীয় অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়, তার প্রতিও গুরুত্বারোপ করা জরুরী। প্রচার মাধ্যমগুলোতে এমন কিছু নিয়মিত প্রোগ্রামসূচী থাকা চাই, যাতে ইসলামী আকীদার মাস‘আলাগুলো প্রচার করা হবে।

শাসক ও নের্তৃবৃন্দের পাশাপাশি মুসলিম উম্মাহর প্রত্যেক ব্যক্তিরই আকীদার উপর বিশেষভাবে গুরুত্ব প্রদান করা আবশ্যক। তাদের উচিত আকীদার কিতাবগুলো অধ্যয়ন করা। সালাফদের মানহাজের উপর যেসব কিতাব লেখা হয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা রাখা আবশ্যক। একই সঙ্গে সালাফদের মানহাজের পরিপন্থী যেসব কিতাব লেখা হয়েছে, সেগুলো সম্পর্কেও সচেতন থাকা জরুরী। এতে করেই জ্ঞানে পরিপক্ক একজন মুসলিম তার দীনকে ভালোভাবে জানতে পারবে এবং আহলে সুন্নাতের আকীদার মধ্যে বাতিলপন্থীরা যেসব সন্দেহ ঢুকিয়ে দিতে চায়, তার উপযুক্ত জবাব প্রদান করতে সক্ষম হবে।

হে মুসলিম! আপনি যখন কুরআনুল করীমের মধ্যে গভীর দৃষ্টি দিবেন, তখন দেখতে পাবেন যে, কুরআনের অনেক আয়াত ও সূরা আকীদার বিষয়ে গুরুত্ব প্রদান করেছে। আপনি দেখবেন মক্কী সূরাগুলোকে সঠিক আকীদা বর্ণনার জন্যই খাস করা হয়েছে এবং এর উপর যেসব সন্দেহ সৃষ্টি করা হয়েছে, তাতে সেগুলোর পরিস্কার জবাব রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ সূরা ফাতিহার কথাই বলা যেতে পারে।

আল্লামা ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ এ মক্কী সূরাটির ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে বলেন, জেনে রাখা আবশ্যক যে, এ সূরাটি সুমহান উদ্দেশ্যগুলো সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছে এবং পরিপূর্ণ আকারে এটাকে নিজের মধ্যে ধারণ করেছে। তাতে আমাদের একমাত্র মাবুদ মহান আল্লাহর পরিচয়কে তার তিনটি নামের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। এতে আল্লাহ তা‘আলার সমস্ত অতি সুন্দর নাম ও সুমহান গুণাবলীর অর্থ বিদ্যমান এবং এর উপরই বাকিসব নাম ও গুণাবলীর ভিত্তি। এগুলো হচ্ছে الله, الرب এবং الرحمن। সূরাটির মূল বিষয় হলো আল্লাহ তা‘আলার উলুহীয়াত, রবুবীয়াত এবং তার সুবিশাল রহমত সম্পর্কে। إياك نعبد -এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার একচ্ছত্র উলুহীয়াত সাব্যস্ত করা হয়েছে। إياك نستعين -এর মাধ্যমে তার রুবুবীয়াত সাব্যস্ত হয়েছে। আর আল্লাহ তা‘আলার কাছে সীরাতুল মুস্তাকীমের হিদায়াত চাওয়ার সম্পর্ক হচ্ছে তার রহমত ছিফাতের সাথে। কারণ তিনি তার বান্দার প্রতি দয়াশীল বলেই তাদেরকে সীরাতুল মুস্তাকীমের পথ দেখান।

আর الحمد বা আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা তিনটি বিষয়কে শামিল করে। তিনি তার উলুহীয়াত, রবুবীয়াত এবং রহমত এ তিনটি কারণেই প্রশংসিত। আল্লাহ তা‘আলার বড়ত্বের কারণেই তার প্রশংসা ও গুণাবলী বর্ণনা করা আবশ্যক। সূরা ফাতিহায় পুনরুত্থান এবং বান্দাদের ভালো-মন্দ আমলের বিনিময় দেয়ার বিষয়টিও সাব্যস্ত হয়েছে। সেদিন আল্লাহ তা‘আলা একাই সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে ফায়ছালা করবেন এবং তার ফায়ছালা হবে পরিপূর্ণ ইনসাফ ভিত্তিক। সূরা ফাতিহার আয়াত: ﴾ ﴿مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ উপরোক্ত সব বিষয়কে সাব্যস্ত করেছে। এ সূরাটি নবীদের নবুওয়াতকেও একাধিকভাবে সাব্যস্ত করেছে।

অতঃপর ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ নবী-রসূলদের নবুওয়াত ও রিসালাত সম্পর্কে এমন দীর্ঘ আলোচনা করেছেন, যা অত্যন্ত উপকারী। সূরা ফাতিহা ও মক্কী সূরা সমূহের বিষয়বস্ত্ত সম্পর্কে আলোচনা করার শেষ পর্যায়ে তিনি বলেছেন, শুধু এ সূরাতেই নয়; বরং পুরো কুরআন নাযিল হয়েছে তাওহীদ, এটার হক ও এটা কবুলকারীদের পুরস্কারের ব্যাপারে এবং শিরক ও এটাকে প্রত্যাখ্যানকারী মুশরিকদের শাস্তির ব্যাপারে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ﴾  الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ ﴿ এর মধ্যে তাওহীদ রয়েছে ﴾  الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ ﴿ এর মধ্যে তাওহীদ রয়েছে এবং ﴿إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ﴾ -এর মধ্যেও তাওহীদ রয়েছে,اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ﴾  ﴿ এর মধ্যেও রয়েছে তাওহীদ। সে সঙ্গে তাওহীদপন্থী হওয়ার কারণে যারা আল্লাহর পক্ষ হতে পুরস্কৃত হয়েছেন এখানে তাদের পথের হিদায়াতও চাওয়া হয়েছে।

﴿غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ﴾ এর মধ্যেও রয়েছে তাওহীদ। অর্থাৎ যারা তাওহীদকে প্রত্যাখ্যান করা এবং এটা থেকে দূরে থাকার কারণে শাস্তিপ্রাপ্ত হয়েছে, এখানে তাদের আলোচনা করা হয়েছে এবং তাদের পথে পরিচালিত না করার প্রার্থনা করা হয়েছে।

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ আরো বলেন, কুরআনের অধিকাংশ সূরাতেই দু’প্রকার তাওহীদের বিশদ বিবরণ এসেছে। কুরআনে রয়েছে আল্লাহ তা‘আলার পবিত্র সত্তা, তার অতি সুন্দর নামাবলী ও সুমহান গুণাবলী সম্পর্কে সংবাদ। এটি হচ্ছে التوحيد العلمي الخبري (আল্লাহ তা‘আলার পরিচিত ও খবর সংক্রান্ত তাওহীদ)। আর রয়েছে তাতে তাওহীদের সাথে একমাত্র তার ইবাদতের দিকে আহবান। তিনি এক, অদ্বিতীয় ও তার কোনো শরীক নেই। সেই সঙ্গে তাতে রয়েছে আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যান্য বস্ত্তর ইবাদত প্রত্যাখ্যান করার আহবান। আর এটি হচ্ছে তাওহীদুল উলুহীয়াহ। আর এটিকে التوحيد الإرادي والطلبي (কামনা-বাসনা সংক্রান্ত তাওহীদ) বলা হয়।

অথবা কুরআনের মধ্যে রয়েছে আদেশ, নিষেধ ও আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য করা আবশ্যক হওয়ার বিষয়াদি। আর এটি হচ্ছে তাওহীদের হক এবং এটার পরিপূরক। অথবা তাতে রয়েছে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে তাওহীদ পন্থীদেরকে সম্মানিত করা ও দুনিয়াতে তাদেরকে পুরস্কৃত করা এবং আখিরাতে তাদেরকে যা দিয়ে সম্মানিত করবেন এটার খবরাদি।

অথবা তাতে রয়েছে মুশরিক ও দুনিয়াতে তাদের উপর যে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি নেমেছিল এবং আখিরাতে তাদের জন্য যে বিরাট শাস্তি অপেক্ষা করছে তার বিবরণ। আর এটি হলো তাওহীদ থেকে বিচ্যুত লোকদের পুরস্কারের খবরাদি। ইমাম ইবনুল কাইয়্যিমের বক্তব্য এখানেই শেষ।

পরিশুদ্ধ আকীদা পোষণ করার প্রতি এত গুরুত্ব দেয়ার পরও যারা কুরআন পড়ে তাদের অধিকাংশই সঠিকভাবে আকীদা বুঝে না। এর ফলে তারা হকের সাথে বাতিলের সংমিশ্রণ ঘটায় এবং আকীদার ক্ষেত্রে ভুল-ভ্রান্তিতে লিপ্ত হয়। তারা বাপ-দাদাদেরকে যে আকীদার উপর পায়, তার অনুসরণ করার কারণেই এমনটি হয়ে থাকে। চিন্তা-গবেষণার সাথে কুরআন না পড়াও তাদের বিভ্রান্তির অন্যতম কারণ। মূলতঃ আল্লাহর সাহায্য ব্যতীত বিভ্রান্তি থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই এবং তার সাহায্য ব্যতীত সঠিক আকীদার উপর টিকে থাকারও কোনো শক্তি নেই।

الدعوة إلى العقيدة الإسلامية - পরিশুদ্ধ ইসলামী আকীদার দিকে দাওয়াত দেয়ার গুরুত্ব

আল্লাহ তা‘আলা যে মুসলিমকে সহীহ আকীদার নিয়ামত প্রদান করেন ও এটাকে আঁকড়ে ধরার তাওফীক দিয়ে সম্মানিত করেন, তার উপর আবশ্যক হয় যে, সসে শিরক ও জাহেলীয়াতের অন্ধকার থেকে বের করে আনার জন্য এবং তাওহীদ ও সহীহ আকীদার আলোর দিকে আসার জন্য মানুষকে দাওয়াত দিবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنْ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى لَا انْفِصَامَ لَهَا وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ اللَّهُ وَلِيُّ الَّذِينَ آمَنُوا يُخْرِجُهُم مِّنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا أَوْلِيَاؤُهُمُ الطَّاغُوتُ يُخْرِجُونَهُم مِّنَ النُّورِ إِلَى الظُّلُمَاتِ أُولَٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ﴾

‘‘যে ব্যক্তি ‘তাগুতকে’ অস্বীকার করে এবং আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করে, সে ধারণ করে নিয়েছে সুদৃঢ় হাতল, যা বিচ্ছিন্ন হবার নয়। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ। যারা ঈমান আনে আল্লাহ তাদের বন্ধু। তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে আসেন। আর যারা কুফুরী করে তাদের বন্ধু হচ্ছে তাগুত। তারা তাদের আলো থেকে অন্ধকারে টেনে নিয়ে যায়। এরা আগুনের অধিবাসী। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে’’। (সূরা আল বাকারা: ২৫৬-২৫৭)

সমস্ত রসূল আকীদা পরিশুদ্ধ করার দাওয়াত দেয়ার মাধ্যমেই তাদের দাওয়াতের সূচনা করেছেন। এর আগে তারা অন্য কিছু দিয়ে শুরু করেননি। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ﴾

‘‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রসূল পাঠিয়েছি। তার মাধ্যমে এ নির্দেশ দিয়েছি যে তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, আর তাগুতকে বর্জন করো’’। (আন নাহল: ৩৬)

প্রত্যেক রসূলই প্রথম যখন তার জাতির লোকদেরকে দাওয়াত দিতেন, তখন তিনি বলতেন,

﴿ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ﴾

‘‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো। তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোনো সত্য মাবুদ নেই’’। (সূরা হুদ: ৫০)

নূহ আলাইহিস সালাম, হুদ আলাইহিস সালাম, সালেহ আলাইহিস সালাম, শুআইব আলাইহিস সালাম, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম, মূসা আলাইহিস সালাম, ঈসা আলাইহিস সালাম, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সমস্ত রসূল আলাইহিমুস সালামও অনুরূপ করতেন।

সুতরাং যারা এ আকীদার জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হবে এবং এর উপর আমল করার তাওফীক পাবে, তারা যেন এটিকে নিজের মধ্যে সীমিত না রাখে। বরং তারা হিকমত ও উত্তম নছীহতের মাধ্যমে লোকদেরকে এ দিকে দাওয়াত দিবে। এ আকীদার দিকে দাওয়াত দেয়াকেই মূল কাজ মনে করবে এবং এখান থেকে যাত্রা শুরু করবে।

সুতরাং তাওহীদের দাওয়াত দেয়ার পূর্বে ফরয বা ওয়াজিব কোনো বিষয় বাস্তবায়ন করা কিংবা হারাম কোনো জিনিস বর্জন করার দিকে দাওয়াত দিবে না। এতে করেই সহীহ আকীদা প্রতিষ্ঠিত হবে। কেননা আকীদা হলো ইসলামের মূল ভিত্তি এবং সমস্ত আমলকে পরিশুদ্ধকারী। আকীদা ঠিক হওয়া ব্যতীত কোনো আমলই সহীহ হয় না, কবুল হয় না এবং আমলের ছাওয়াবও দেয়া হয় না। আর এ সহজ কথাটি সকলেরই জানা আছে যে, ভিত্তি প্রস্তর ব্যতীত কোনো ঘর প্রতিষ্ঠিত হয় না এবং এটা ঠিকও থাকে না।

এ জন্যই রসূলগণ সর্বপ্রথম আকীদা সংশোধনের প্রতি গুরুত্ব দিতেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ইসলাম প্রচারের জন্য সাহাবীদেরকে পাঠাতেন তখন সর্বপ্রথম আকীদা সংশোধন করার দাওয়াত দেয়ার আহবান জানানোর উপদেশ দিতেন।

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মুআয রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে ইয়ামানে পাঠালেন, তখন তিনি বললেন,

إِنَّكَ تَأْتِى قَوْمًا مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ فليكن أول ما تدعو إليه شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وفي رواية إلى أن يوحدوا الله فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوا لِذَلِكَ فَأَعْلِمْهُمْ أَنَّ اللَّهَ افْتَرَضَ عَلَيْهِمْ خَمْسَ صَلَوَاتٍ فِى كُلِّ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوا لِذَلِكَ فَأَعْلِمْهُمْ أَنَّ اللَّهَ افْتَرَضَ عَلَيْهِمْ صَدَقَةً تُؤْخَذُ مِنْ أَغْنِيَائِهِمْ فَتُرَدُّ فِى فُقَرَائِهِمْ فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوا لِذَلِكَ فَإِيَّاكَ وَكَرَائِمَ أَمْوَالِهِمْ وَاتَّقِ دَعْوَةَ الْمَظْلُومِ فَإِنَّهُ لَيْسَ بَيْنَهَا وَبَيْنَ اللَّهِ حِجَابٌ

‘‘তুমি এমন এক সম্প্রদায়ের কাছে যাচ্ছো যারা আহলে কিতাব। সর্বপ্রথম যে জিনিসের দিকে তুমি তাদেরকে আহবান জানাবে তা হচ্ছে, ‘‘লা-ইলাহ ইল্লাল্লাহ’’এর সাক্ষ্য দান করা’’। অন্য বর্ণনায় আছে, তুমি তাদেরকে এককভাবে আল্লাহর ইবাদত করার আহবান জানাবে। এ বিষয়ে তারা যদি তোমার আনুগত্য করে তাহলে তাদেরকে জানিয়ে দাও যে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর দিনে-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন। এ ব্যাপারে তারা যদি তোমার কথা মেনে নেয় তাহলে তাদেরকে জানিয়ে দাও যে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর যাকাত ফরয করেছেন, যা বিত্তশালীদের কাছ থেকে নিয়ে গরীবদেরকে দেয়া হবে। তারা যদি এ ব্যাপারে তোমার আনুগত্য করে তাহলে তাদের উৎকৃষ্ট মালের ব্যাপারে তুমি খুব সাবধান থাকবে। আর মাযলুমের বদ দু‘আকে পরিহার করে চলবে। কেননা মাযলুমের ফরিয়াদ এবং আল্লাহ তা‘আলার মাঝখানে কোনো পর্দা নেই’’।[1]

এ হাদীছ শরীফ, কুরআনুল কারীমে আলোচিত রসূলদের দাওয়াত এবং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনী নিয়ে গবেষণা করেই কেবল আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়ার সঠিক মানহাজ গ্রহণ করা যায়। আর এ আকীদা পরিশুদ্ধ করার জন্যই সর্বপ্রথম মানুষকে দাওয়াত দিবে। আর এটা এককভাবে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করা এবং তিনি ব্যতীত অন্যের ইবাদত বর্জন করার মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হবে। তিনি এক, অদ্বিতীয় এবং তার কোনো শরীক নেই। এটিই হচ্ছে কালেমায়ে তাইয়্যেবা লা-ই লাহা ইল্লাল্লাহ-এর সঠিক অর্থ।

নবুওত পাওয়ার পর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কাতে ১৩ বছর অবস্থান করে এককভাবে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করা এবং মূর্তির ইবাদত বর্জন করার মাধ্যমে মানুষের আকীদা সংশোধনের দাওয়াত দিয়েছেন। সালাত, যাকাত, সিয়াম, হজ ও জিহাদের আদেশ এবং সুদ, যেনা-ব্যভিচার, মদ্যপান এবং জুয়া খেলাসহ অন্যান্য হারাম কাজ বর্জনের নির্দেশ দেয়ার আগে তিনি কেবল আকীদা সংশোধনের দাওয়াত দিতেন।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ নীতি অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে সমসাময়িক ঐসব দলের দাওয়াতের মানহাজ ভ্রান্ত হওয়ার প্রমাণ করে, যারা দীনের দাওয়াত দেয়ার দাবি করে ঠিকই; কিন্তু তারা আকীদা সংশোধনের প্রতি দাওয়াত দেয়ার তেমন কোনো গুরুত্ব প্রদান করে না। তারা কেবল চরিত্র ও আচার-আচরণ ঠিক করাসহ অধিকতর কম গুরুত্বপূর্ণ কতিপয় বিষয়ের উপর জোর দেয়। অথচ এসব জামা‘আতের লোকেরা কতিপয় ইসলামী দেশে কবরের উপর নির্মিত মাযার ও সমাধির নিকট অনেক মানুষকে বড় শির্কে লিপ্ত দেখে। কিন্তু তার কোনো প্রতিবাদ করে না এবং তা থেকে নিষেধও করে না। ভাষণ-বক্তৃতা এবং লেখালেখির মাধ্যমে খুব কম সংখ্যক লোক আকীদা সংক্রান্ত এসব ভুল-ভ্রান্তির প্রতিবাদ করে থাকে। এসব জামা‘আতের লোকদের কাতারে এমন লোক রয়েছে, যারা শিরক ও সুফীবাদের চর্চা করে। তারা অন্যদেরকে নিষেধ করে না এবং সতর্কও করে না। অথচ সুস্পষ্ট কুফুরীতে লিপ্ত কাফের ও নাস্তিকদেরকে দাওয়াত দেয়ার আগে নিজের দলের লোকদেরকে দাওয়াত দেয়া ও সংশোধন করা উত্তম। কেননা নাস্তিক ও বিধর্মীরা তো সুস্পষ্টরূপেই তাদের কুফুরীর ঘোষণা দিয়েছে এবং স্বীকার করে নিয়েছে যে, তারা রসূলদের আনীত দীনের বিরোধীতায় লিপ্ত রয়েছে। কিন্তু কবর পূজারী ও বিভ্রান্ত উপরোক্ত সুফীরা ধারণা করে যে, তারা মুসলিম। তারা আরো ধারণা করে, তারা যার উপর রয়েছে এটাই প্রকৃত ইসলাম। সুতরাং তারা নিজেরা ধোঁকার মধ্যে রয়েছে এবং অন্যদেরকেও ধোঁকা দিচ্ছে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সর্বপ্রথম নিকটবর্তী কাফেরদেরকে দাওয়াত দেয়ার আদেশ করেছেন। তিনি বলেন,

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قَاتِلُوا الَّذِينَ يَلُونَكُم مِّنَ الْكُفَّارِ وَلْيَجِدُوا فِيكُمْ غِلْظَةً وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمُتَّقِينَ﴾

হে ঈমানদারগণ! কাফেরদের মধ্যে যারা তোমাদের নিকটবর্তী তাদের সাথে যুদ্ধ করো। তারা যেন তোমাদের মধ্যে কঠোরতা দেখতে পায়। জেনে রাখো আল্লাহ মুত্তাকীদের সাথে আছেন’’। (সূরা আত তাওবা: ১২৩)

সুতরাং মুসলিমদের কাতারকে বহিরাগত আকীদা থেকে পরিষ্কার না করা হলে দুশমনদের মোকাবেলায় টিকে থাকা সম্ভব নয়।

বর্ণনা করা হয় যে, জনৈক কবরপূজারী এক লোককে মূর্তিপূজা করতে দেখে প্রতিবাদ করল। মূর্তিপূজক কবর পূজারীকে বলল, তুমি এমন এক সৃষ্টির ইবাদত করছো, যা তোমার সামনে উপস্থিত নয়। আর আমি এমন এক সৃষ্টির পূজা করছি, যা আমার সামনে উপস্থিত রয়েছে এবং সে আমার দিকে ঝুকে রয়েছে। বলো তো আমাদের উভয়ের মধ্যে কার কাজটি উত্তম? এভাবেই মূর্তিপূজক কবরপূজারীকে বিতর্কে হারিয়ে দিল। যদিও তারা উভয়ই পথভ্রষ্ট মুশরিক। তারা এমন বস্ত্তর ইবাদত করে, যে কারো ক্ষতি কিংবা উপকার সাধন করার ক্ষমতা রাখে না। তবে গোমরাহীর দিক থেকে কবরপূজারী মূর্তিপূজকের চেয়ে বেশী অন্ধকারের মধ্যে ডুবে রয়েছে এবং অসম্ভব বস্ত্ত প্রার্থনায় সে তার মূর্তিপূজক সাথীর সীমা ছাড়িয়ে গেছে। সুতরাং দাওয়াতের ক্ষেত্রে অন্যান্য জিনিসের চেয়ে আকীদা সংশোধনের দিকে বেশী জোর দেয়া আবশ্যক। প্রথমে মুসলিমগণ নিজেরা ভালোভাবে আকীদা পাঠ করবে এবং বুঝবে। অতঃপর অন্যদেরকে এটা শিক্ষা দেয়ার কাজে আত্মনিয়োগ করবে। যারা আকীদার ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত হয়েছে অথবা এটা বুঝতে ভুল করেছে, তাদেরকে সহীহ আকীদার দিকে আহবান করবে।

আল্লাহ তা‘আলা তার কিতাবে বলেন,

﴿قُلْ هَذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللَّهِ عَلَى بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي وَسُبْحَانَ اللَّهِ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ﴾

  ‘‘বলো! এটিই আমার পথ। পূর্ণ প্রজ্ঞার সাথে আমি আল্লাহর দিকে আহবান জানেই। আমি এবং আমার অনুসারীরা। আল্লাহ পবিত্র। আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই’’। (সূরা ইউসুফ: ১০৮)

ইমাম ইবনে জারীর এ আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে বলেন, আল্লাহ তা‘আলা তার নবী মুহাম্মাদকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, হে মুহাম্মাদ! তুমি বলো, আমি যে দাওয়াত দিচ্ছি, যে পথের উপর অটল থেকে আল্লাহর তাওহীদের ঘোষণা দিচ্ছি এবং বাতিল মাবুদ ও মূর্তিপূজা বর্জন করে ইখলাসের সাথে তার ইবাদতের দিকে আহবান জানাচ্ছি, তার আনুগত্য করাকেই যথেষ্ট মনে করছি এবং তার বিরোধীতা বর্জন করছি, এটাই আমার তরীকা ও দাওয়াত। আমি আল্লাহর দিকে আহবান করছি। তিনি এক ও অদ্বিতীয়, তার কোনো শরীক নেই। আমি জেনে-বুঝে নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করেই এদিকে আহবান করছি। আমার অনুসারী সাহাবীগণও সজ্ঞানে আমাকে বিশ্বাস করে এদিকেই দাওয়াত দিচ্ছে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তার নবীকে বলেছেন, হে নবী! তুমি বলো, আমি আল্লাহ তা‘আলার রাজত্বে তার কোনো অংশীদার কিংবা তার সাম্রাজ্যে তিনি ব্যতীত অন্য কোনো মাবুদ থাকা হতে তার পবিত্রতা ও মহত্ত্বের ঘোষণা করছি। আর আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই। অর্থাৎ যারা আল্লাহ তা‘আলার সাথে শিরক করে, তাদের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি তাদের অন্তর্ভুক্ত নই এবং তারাও আমার দলভুক্ত নয়। ইমাম ইবনে জারীরের কথা এখানেই শেষ।

উপরোক্ত মর্যাদাবান আয়াতটি ইসলামে সহীহ আকীদা জানা এবং তার দিকে দাওয়াত প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীগণ এ বিষয়ে তার অনুসরণ করেছেন এবং উপরোক্ত দু’টি বিশেষণেই বিশেষিত হয়েছেন। তারা সহীহ আকীদা সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞানী ছিলেন এবং সেদিকেই তারা দাওয়াত দিতেন।

সুতরাং যারা সহীহ আকীদা শিখবে না, এর প্রতি গুরুত্ব দিবে না এবং এদিকে দাওয়াত দিবে না, তারা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রকৃত অনুসারী নয়। যদিও সে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিকে নিজেকে সম্বন্ধ করে এবং তার অনুসারী হওয়ার দাবি করে।

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ আল্লাহ তা‘আলার এ বাণীর ব্যাখ্যায় বলেন,

﴿ادْعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُم بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ﴾

‘‘হে নবী! হিকমত এবং উত্তম উপদেশ সহকারে তোমার রবের পথে দাওয়াত দাও এবং লোকদের সাথে বিতর্ক করো সর্বোত্তম পদ্ধতিতে’’

আল্লাহ তা‘আলা এখানে দাওয়াতের বিভিন্ন স্তর বর্ণনা করেছেন এবং মানুষের অবস্থা অনুপাতে এটাকে তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। কেননা মানুষ যদি হকের সন্ধানী হয় এবং হক জানার পর অন্যকে এটার দিকে আহবানকারী হবে বলে আশা করা যায়, এমন ব্যক্তিকে হিকমতের সাথে দাওয়াত দিতে হবে, তার জন্য নছীহত পেশ এবং তার সাথে বিতর্ক করার দরকার নেই। আর যদি কোনো লোক সত্যের বিরুদ্ধাচরণকারী হয় এবং তার ব্যাপারে ধারণা করা হয় যে, সে সত্য জানতে পারলে এটা দ্বারা প্রভাবিত হবে এবং মেনে নিবে তাহলে এমন ব্যক্তিকে উৎসাহ দিয়ে ও ভয় দেখিয়ে নছীহত করার প্রয়োজন রয়েছে।

আর যদি কোনো লোক অহঙ্কারী ও হকের বিরোধী হয়, তাহলে তার সাথে উত্তম পদ্ধতিতে বিতর্ক করতে হবে। সে যদি বিরোধীতা বর্জন করে এবং হকের দিকে ফিরে আসে তাহলে ভালো। অন্যথায় সম্ভব হলে তার সাথে তর্ক-বিতর্ক বাদ দিয়ে অন্য পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে।[2] ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহর কথা এখানেই শেষ।

উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে দাওয়াতের মানহাজ সুস্পষ্ট হলো এবং এ বিষয়ে মুসলিমদের করণীয় সম্পর্কেও জানা গেল। সে সঙ্গে দাওয়াতের দাবিদার কিছু দলের মানহাজ ভুল বলেও প্রমাণিত হলো। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে এবং রসূল সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সহীহ সুন্নাতে দাওয়াতের বিশুদ্ধ মানহাজ বর্ণনা করেছেন, তারা তার বিরোধীতা করে যাচ্ছে।


[1]. সহীহ বুখারী, হা/১৩৯৫, সহীহ মুসলিম, হা/১৯, ইবনে মাজাহ, হা/১৭৮৩, আবূ দাউদ, হা/১৫৮৪।

[2]. যেমন তার বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করা বা অন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ৪ পর্যন্ত, সর্বমোট ৪ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে