নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইসরা ও মিরাজ কি শরীর ও রূহ মিলেই হয়েছিল? না কি শুধু রূহের মাধ্যমে হয়েছিল? এ ব্যাপারে আলেমদের দু’টি মত পাওয়া যায়। অধিকাংশ আলেমের মতে শরীর ও রূহের মিলিত অবস্থায় মিরাজ হয়েছিল। আর তা হয়েছিল জাগ্রত অবস্থায়; ঘুমন্ত অবস্থায় নয়। এর দলীল হলো, আল্লাহ তা‘আলা মিরাজের ঘটনায় বলেন,
﴿سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَىٰ بِعَبْدِهِ لَيْلًا مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الْأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ﴾
‘‘পবিত্র তিনি যিনি নিয়ে গেছেন এক রাতের কিয়দাংশে নিজের বান্দাকে মাসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার পরিবেশকে আমি করেছি বরকতময়’’। সূরা বানী ইসরাঈল: ১)
বড় বড় বিষয়ের আলোচনা আসলেই সুবহানাল্লাহ বা আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করা হয়। মিরাজ যদি স্বপ্নযোগে হতো, তাহলে এতে বড় কিছু ছিল না, তাকে বিরাট মনে করা হতো না, কুরাইশরা একে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিতো না এবং একদল মুসলিম মুরতাদ হয়েও যেতো না। কেননা দেহ ও ‘রূহ’এর সমন্বয়ে গঠিত সত্তাকে عبد বা বান্দা বলা হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তিনি তার বান্দাকে রজনীর কিয়দাংশে ভ্রমণ করিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَمَا جَعَلْنَا الرُّؤْيَا الَّتِي أَرَيْنَاكَ إِلَّا فِتْنَةً لِّلنَّاسِ وَالشَّجَرَةَ الْمَلْعُونَةَ فِي الْقُرْآنِ﴾
‘‘আর আমি যে দৃশ্য তোমাকে দেখিয়েছি তা এবং কুরআনে উল্লেখিত অভিশপ্ত গাছকে শুধু মানুষের জন্য একটি ফিতনা বানিয়ে রেখে দিয়েছি’’। (সূরা বানী ইসরাঈল: ৬০)
ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, এখানে চোখের দেখা উদ্দেশ্য। মিরাজের রাত্রিতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখানো হয়েছে। ইমাম বুখারী এটি বর্ণনা করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, مَا زَاغَ الْبَصَرُ وَمَا طَغَىٰ ‘‘তার দৃষ্টি বিভ্রম হয়নি, দৃষ্টি লক্ষ্যচুত্য হয়নি’’। (সূরা নাজম: ১৭) চোখ দেহেরই একটি যন্ত্র বা অংশ; রূহের অংশ নয়। সেই সঙ্গে আরো জানা যাচ্ছে, যে বোরাকে করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তা আলোকজ্জ্বল চকচকে সাদা একটি জন্তু। এ বিশেষণ বিশিষ্ট প্রাণীর উপর আরোহন করা দেহের জন্যই প্রযোজ্য হতে পারে। রূহের জন্য এ জাতিয় বিশেষণ ও অবস্থা প্রযোজ্য হতে পারেনা। কেননা রূহ নড়াচড়া করা এবং একস্থান থেকে অন্যস্থানে স্থানান্তরিত হওয়ার জন্য বাহনে আরোহন করার মুখাপেক্ষী নয়।
অন্য আরেকটি দল বলেছে, শুধু রূহের মাধ্যমে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মিরাজ হয়েছে; শরীর সহকারে নয়। ইবনে ইসহাক আয়েশা এবং মুআবীয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে এ কথা বর্ণনা করেছেন। হাসান বসরী থেকেও অনুরূপ কথা পাওয়া যায়। তবে তাদের এ কথা প্রমাণ করে না যে, স্বপ্নের মাধ্যমে ইসরা ও মিরাজ হয়েছিল। বরং তাদের কথার অর্থ হলো রূহকে রাতে ভ্রমণ ও মিরাজ করানো হয়েছিল। দেহ থেকে রূহ বিচ্ছিন্ন হয়ে মিরাজে গিয়েছিল। অতঃপর দেহের মধ্যে রূহ ফিরে এসেছে। এটি ছিল নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খাস বৈশিষ্ট। তিনি ছাড়া অন্য কারো রূহ মৃত্যুর আগে পরিপূর্ণরূপে আসমানে উঠার ফযীলত পাবেনা।
স্বপ্নের ব্যাপারে কথা হলো, ঘুমন্ত লোক স্বপ্নে যা দেখে তা কখনো উদাহরণ স্বরূপ হয়ে থাকে। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞাত জিনিস কখনো তার সামনে উদাহরণ আকারে পেশ করা হয়। সে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে যে আসমানে উড়ছে, মক্কা যাচ্ছে। অথচ তার রূহ উপরে উঠে নেই, মক্কাতেও যায় নেই। স্বপ্ন সম্রাট (স্বপ্নের ফেরেশতা) কেবল তার সামনে একটা উদাহরণ পেশ করেছে। সুতরাং দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আসলেই রূহ উপরে উঠা এবং নিছক একটা স্বপ্ন দেখার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।
যারা বলে ইসরা ও মিরাজ হয়েছিল রূহের মাধ্যমে; শরীরের মাধ্যমে নয়, তারা আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে শারীক ইবনে আবী নুমুরের সুত্রে হাদীছ দ্বারা দলীল পেশ করেছেন। সেখানে এসেছে, অতঃপর আমি জাগ্রত হয়ে দেখলাম যে আমি হাতীমের মধ্যেই আছি।
এ হাদীছের দু’টি জবাব রয়েছে। প্রথম জবাব হলো এ হাদীছটি শারীকের ভুল-ত্রুটির মধ্যে গণ্য। হাদীছের হাফেযগণ ইসরা ও মিরাজের হাদীছ বর্ণনায় শারীক ইবনে আবু নুমুরকে ভুলকারী হিসাবে সাব্যস্ত করেছেন। আর দ্বিতীয় জবাব হলো শারীকের হাদীছে জাগ্রত হওয়া দ্বারা এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় স্থানান্তরিত হওয়া উদ্দেশ্য। ইমাম ইবনে কাছীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, শারীক ভুল করেছেন, এ কথা বলার চেয়ে হাদীছের ব্যাখ্যা করাই উত্তম। আল্লাহ তা‘আলাই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন।
ইমাম ইবনে কাছীর রাহিমাহুল্লাহ আরো বলেন, মিরাজ হওয়ার পূর্বে আমরা স্বপ্নে আরেকবার মিরাজ হওয়াকে অস্বীকার করিনা। যেভাবে মিরাজ হয়েছে, হুবহু সেভাবে আরেকবার মিরাজ সংঘটিত হতে পারে। কেননা তিনি যে স্বপ্নই দেখতেন, সকালের মতই সুস্পষ্ট সত্য হিসাবে বাস্তবায়িত হতো। অহী নাযিলের সূচনা সম্পর্কিত হাদীছে ইতিপূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে যে, জাগ্রত অবস্থায় তার সামনে যা সংঘটিত হয়েছে, তার পূর্বে ঘুমন্ত অবস্থায় তার অনুরূপ দেখেছেন। যাতে করে স্বপ্নটি তার জন্য ভূমিকা স্বরূপ হয় এবং তার অন্তরে দৃঢ়তা প্রদানকারী হয় এবং তিনি যেন স্বস্তি লাভ করেন। আল্লাহ তা‘আলাই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন।