এতেও ইলমুল গায়েবের দাবি করা হয়। যেমন আকাশের কথা চুরি করে শ্রবণকারীর উপর নির্ভর করে যমীনে ভবিষ্যতে যা ঘটবে সে সম্পর্কে খবর দেয়া। জিনেরা চুপেচাপে আসমানের ফেরেশতাদের কথা থেকে মাঝে মাঝে দু’একটি কথা শুনে ফেলে। তারা এ কথাটি গণকের কানে ঢেলে দেয়। গণক তার সাথে একশটি মিথ্যা কথা মিশায়। আর মূর্খ লোকেরা আসমানের ফেরেশতাদের থেকে চুপিসারে জিনদের শ্রুত একটি কথা সত্য হওয়ার কারণে বাকিসব মিথ্যা কথা বিশ্বাস করে।
আল্লাহ তা‘আলা একমাত্র গায়েবের খবর জানেন। সুতরাং যে ব্যক্তি ভবিষ্যৎ বাণী করা কিংবা অন্য কোনোভাবে ইলমুল গায়েবের ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলার অংশীদার হওয়ার দাবি করলো অথবা ইলমুল গায়েবের দাবিদারকে সত্যায়ন করলো, সে আল্লাহ তা‘আলার খাস বিশেষণের মধ্যে অন্যকে শরীক নির্ধারণ করলো। সেই সঙ্গে সে আল্লাহ তা‘আলা এবং তার রসূলের প্রতি মিথ্যারোপও করলো।
গণক ও ভাগ্য গণনাকারীদের অনেক শয়তানী কাজ-কর্মই শিরক থেকে মুক্ত নয়। ইলমুল গায়েবের দাবি করার জন্য যেসব মাধ্যম যেমন জিন-শয়তান, পাপাত্মা ইত্যাদির সাহায্য নেয়া হয়, তারা ঐসব মাধ্যমের ইবাদতও করে থাকে। সুতরাং ইলমুল গায়েবের দাবি করা, ভাগ্য গণনা করা এবং ভবিষ্যৎ বাণী করা শিরক। কেননা এতে আল্লাহ তা‘আলার খাস ইলমের মধ্যে অংশীদারিত্বের দাবি করা হয়। এদিক থেকে এটি বড় শিরক। সেই সঙ্গে এতে আল্লাহ ছাড়া অন্যের নৈকিট্য লাভের চেষ্টা করা হয় এবং অন্যের ইবাদতও করা হয়।
সহীহ মুসলিম শরীফে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কতিপয় স্ত্রী থেকে বর্ণিত আছে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
مَنْ أَتَى عَرَّافاً فسأله عن شيئ فَصَدَّقَهُ بِمَا يَقُولُ لَمْ تُقْبَلْ لَهُ صَلاَةٌ أَرْبَعِينَ يَوْماً
‘‘যে ব্যক্তি কোনো গণকের কাছে গেল, অতঃপর তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করল এবং গণকের কথাকে সত্য বলে বিশ্বাস করল, চল্লিশ দিন পর্যন্ত তার নামাজ কবুল হবে না’’।[1]
আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
مَنْ أَتَى كَاهِناً فَصَدَّقَهُ بِمَا يَقُولُ فَقَدْ كَفَرَ بِمَا أُنْزِلَ عَلَى مُحَمَّدٍ
‘‘যে ব্যক্তি গণকের কাছে আসল, অতঃপর গণক যা বলল তা সত্য বলে বিশ্বাস করল সে মূলত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর যা নাযিল করা হয়েছে তা অস্বীকার করল। ইমাম আবু দাউদ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন’’।[2]
মুসলিমদেরকে যেসব বিষয় থেকে সতর্ক করা আবশ্যক, তার মধ্যে যাদুকর, গণক এবং ভেলকিবাজ, ফাঁকিবাজ ও ধোঁকাবাজদের বিষয়টি অন্যতম। সংশোধন করার বদলে তারা পৃথিবীতে বিপর্যয় ও ফাসাদ সৃষ্টি করে। তাদের কেউ কেউ নিজেকে মানুষের সামনে রোগ-ব্যাধির ডাক্তার হিসাবে প্রকাশ করে। মূলতঃ সে মানুষের ঈমান-আকীদা বরবাদ করে দেয়। কেননা সে রোগীকে আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য হাস-মুরগী-কবুতর, গরু-খাসী ইত্যাদি যবেহ করার আদেশ করে অথবা তার জন্য শিরকী যাদুমন্ত্র, তেলেসমাতি, শয়তানের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা সম্বলিত তাবীয লিখে দেয়।
যাদুকর ও গণকদের আরেকটি শ্রেণী ভবিষ্যৎ বক্তার পোষাকে মানব সমাজে আত্মপ্রকাশ করে। ভাগ্য গণনা করা, গায়েবী বিষয়ের খবর এবং হারানো বস্তুর স্থানের সন্ধান দেয়ার জন্য মূর্খরা তাদের কাছে এসে হারানো বস্তুর স্থান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। গণকরা তাদেরকে সেটার স্থান সম্পর্কে খবর দেয় অথবা শয়তানের সাহায্যে তাদের হারানো বস্তু এনে দেয়।
তাদের কেউ আবার অলীর আকৃতিতে মানুষের সামনে উপস্থিত হয় এবং অলৌকিক জিনিস এবং কারামত দেখায়। যেমন তারা আগুনে ঝাপ দেয়, অস্ত্র দিয়ে নিজের শরীরে আঘাত করে, সাপ ধরে ইত্যাদি। প্রকৃত পক্ষে এরা মিথ্যুক, ভেলকিবাজ এবং শয়তানের দোসর। এদের প্রত্যেকেই ফন্দিবাজি, ধোঁকাবাজি ও ফাঁকিবাজির মাধ্যমে মানুষের ধন-সম্পদ আত্মসাৎ করতে চায়। সেই সঙ্গে তারা মানুষের ঈমান- আকীদাও নষ্ট করে।
সুতরাং এদের ধোঁকাবাজি, ফাঁকিবাজি ও ভেলকিবাজি থেকে মুসলিমদের সাবধান থাকা আবশ্যক। তাদের খপ্পরে পড়া থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকা জরুরী। মুসলিম শাসকদের উচিত তাদেরকে ধরে তাওবা করানো। তাওবা করলে তো ভালো অন্যথায় এদেরকে হত্যা করা আবশ্যক। এতেই মুসলিমগণ তাদের ক্ষতি, ফিতনা ও ফাসাদ থেকে নিরাপদ থাকবে। সেই সঙ্গে তাদের ব্যাপারে আল্লাহর হুকুমু বাস্তবায়ন হবে।
সহীহ বুখারীতে বাজালা ইবনে আবাদাহ থেকে বর্ণিত আছে, উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু মুসলিম গভর্ণরদের কাছে পাঠানো নির্দেশনামায় লিখেছেন,
أَنِ اقْتُلُوا كُلَّ سَاحِرٍ وَسَاحِرَةٍ قَالَ: فَقَتَلْنَا ثَلاَثَ سَوَاحِرَ
‘‘তোমরা প্রত্যেক যাদুকর পুরুষ এবং যাদুকর নারীকে হত্যা করো। বাজালা বলেন, এ নির্দেশের পর আমরা তিনজন যাদুকর মহিলাকে হত্যা করেছি’’।[3]
জুনদুব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে ‘মারফু’ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
حَدُّ السَّاحِرِ ضَرْبَةٌ بِالسَّيْفِ
‘‘যাদুকরের শাস্তি হচ্ছে তলোয়ারের এক আঘাতে গর্দান উড়িয়ে দেয়া’’।[4] ইমাম তিরমিযী হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।
[1]. সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: গণকের কাজ নিষিদ্ধ এবং গণকের কাছে যাওয়াও নিষিদ্ধ।
[2]. ইমাম আলবানীও হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন, দেখুন: সিলসিলা ছহীহা, হাদীছ নং- ৩৩৮৭।
[3]. সুনানে বায়হাকী, অধ্যায়: যাদুকরকে কাফের বলা এবং তাকে হত্যা করা।
[4]. তিরমযী, অধ্যায়: যাদুকরের শাস্তি। ইমাম আলবানী (রহি.) এই হাদীছকে সহীহ বলেছেনঃ দেখুন: সিলসিলা যঈফা, হাদীছ নং- ১৪৪৬।