প্রশ্ন-৫২ : দাঈদের মর্যাদার কথা শ্রবণের পর জাগরণপ্রেমী কিছু যুবকের মাঝে দাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক চেতনা[1] ও উদ্যম পরিলক্ষিত হয়। এরপর অতিদ্রুতই এই উৎসাহ কেটে যায়। এ ব্যাপারে আপনার দিকনির্দেশনা কী?

উত্তর : الصحوة الإسلامية বা ইসলামী চেতনা/জাগরণ’ শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমার আপত্তি রয়েছে; এ শব্দ যেখানে সেখানে ব্যবহার করা ঠিক নয়। পত্রিকায় একাধিকবার প্রকাশ করা হয়েছে যে, মূলতঃ এর দ্বারা প্রত্যেক যুগে অব্যাহত থাকা সৎ আলিমদের অবদানকে অস্বীকার করা হয়। আরো অস্বীকার করা হয় এই উম্মাহর অবশিষ্ট কল্যাণকর বিষয়কে। অস্বীকার করা হয় সে সকল কল্যাণকর বিষয়কে যা কিয়মাত পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকবে।

দাওয়াতের ক্ষেত্রে উদ্যম-আগ্রহ থাকা ভালো। মানুষের মাঝে ভালো কাজ করা দাওয়াত প্রদান করা ইত্যাদির প্রতি আগ্রহ উদ্দীপনা থাকে। তবে কারো জন্য জ্ঞানার্জন ছাড়াই সরাসরি দাওয়াতি কাজে প্রবেশ করা উচিত নয়। বরং দাওয়াতি কাজে আত্মনিয়োগ করার পূর্বে ইলম অর্জন করা উচিত। যাতে সে আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লাহর পথে আহবান করার নিয়ম ও দাওয়াতের পন্থা সম্পর্কে জানতে পারে। সে যে কাজের প্রতি আহবান করবে সে বিষয়ে তার নিকট যেন জ্ঞান থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

{ قُلْ هَذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللَّهِ عَلَى بَصِيرَةٍ }

 বল, এটা আমার পথ, আমি জেনে-বুঝে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেই। (সূরা ইউসুফ ১২:১০৮) অর্থাৎ ইলমের ভিত্তিতে।

সুতরাং মূর্খ ব্যক্তি দাওয়াত দেওয়ার জন্য উপযুক্ত নয়। অবশ্যই তার নিকট ইখলাছ (একনিষ্ঠতা), ছবর- ধৈর্য-সহ্য এবং হিকমাত ইত্যাদি বিষয়েও জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। আর দাওয়াতী পদ্ধতিসমূহ ও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম আনীত  মানহাজ সম্পর্কে  জানা।

দাওয়াতের প্রতি শুধু ভালোবাসা-শুধু আবেগ উদ্যম নিয়ে সরাসরি দাওয়াতী কার্জকর্মে প্রবেশ করার দ্বারা মূলতঃ দাওয়াতকে নষ্ট করা হয়। এর দ্বারা লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি। এর দ্বারা অনেক সমস্যার উদ্রেক হয়। মানুষ তাদের নিয়ে মুশকিলে পড়ে যায়। ব্যক্তির ভালো কাজের প্রতি আগ্রহ-উদ্যম থাকলে সে ছাওয়াব পাবে ইনশাআল্লাহ। কিন্তু যদি সে দাওয়া ক্ষেত্রে প্রবেশ করতে চায় তাহলে তার উচিত হবে প্রথমে ইলম অর্জন করা। যে ইলম অনুযায়ী প্রত্যেকেই দাওয়াতের জন্য উপযোগী হতে পারে।

মূর্খতার সাথে উদ্যম কোন উপকার করে না। বরং অপকারই করে থাকে।[2]


[1]. অনেক দাঈ ও যুবকদের মুখে জাগরণ, যুব-জাগরণ অথবা ইসলামী জাগরণ বেশি বেশি শোনা যায়। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, উম্মাতে ইসলামিয়্যাহ অবচেতন ছিল অথবা অনুপস্থিত ছিল উম্মাতে ইসলামিয়্যাহর কোন দাওয়াত ছিল না। এটা সহীহ নয়। কেননা মুসলিমগণ বিশেষত এদেশের মুসলিমগণ সর্বদা কল্যাণের উপর অটল ছিল। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদীছে বলেন,

لا تزال طائفة من أمتي على الحق ظاهرين

আমার উম্মাহর একটি দল হকের উপর অটল থাকবে। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

لا تجتمع أمتي على ضلالة

আমার উম্মাহ গোমরাহীর উপর ঐক্যমত পোষণ করবে না। কাশফুল খফা হাদীছ নং ২৯৯৯ তাযকিরাতুল মুহতাজ (পৃ. নং ৫১)।

উম্মাতে মুহাম্মাদী সবসময় জাগ্রতই ছিল এবং রববানী আলিমগণ সব যুগেই বর্তমান ছিলেন। কোন যুগই রববানী আলিমহীন ছিল না। আমরা যদি এর বিপরীত কথা বলি তাহলে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছকে অস্বীকার করা হবে। নাউযুবিল্লাহ মিন যালিক। সহীহ হাদীছে এসেছে,

لا تزال طائفة من أمتي قائمة بأمر الله، لا يضرهم من خذلهم حتى يأتي أمر الله وهم ظاهرون على الناس

আমার উম্মাহর একটি দল আল্লাহর বিধানের উপর অটল থাকবে, যারা তাদেরকে পরিত্যাগ করবে তারা তাদের কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। কিয়ামত আসা পর্যন্ত তারা মানুষের মাঝে দৃশ্যমান থাকবে (সহীহ মুসলিম ৩/১০৩৭, ১৫২৪)।

যারা জাগরণের কথা বলে এবং এর ইতিহাস বর্ণনা করে তারা মূলতঃ মিসরে হাসানুল বান্নার হাতে ইখওয়ানুল মুসলিমীন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ইতিহাস বর্ণনা করে। এর প্রমাণ হলো মুহাম্মাদ কুতুব ওয়াকি‘উনা আল মু‘আছির গ্রন্থের ৪০১ পৃষ্ঠায় বলেন, আমরা শুধু এই আন্দোলন সম্পর্কে পড়ে থাকি যে এই আন্দোলন একজন ব্যক্তির অন্তরে শুরু হয়েছে তিনি হলেন মিশরের হাসানুল বান্নাহ আল্লাহ তা‘আলা তাকে  উজ্জল আত্মা এবং আল্লাহর নৈকট্য দান করুন।

আলহামদুলিল্লাহ তিনি বলেননি যে তিনি কোন প্রসিদ্ধ শায়খের নিকট ‘ইলম অর্জন করেছেন যাতে লোকের তাকে আলিম না ভেবে বসে। বিবেকবান লোকেরা আলিম ছাড়া অন্য কোন লোকের নিকট থেকে ইলম গ্রহণ করে না। নির্বোধ লোকেরা প্রত্যেক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী ও উচ্ছৃঙ্খল লোকদেরকেই বিশ্বাস করে থাকে। ৪০৩ নং পৃষ্ঠায় বলেছে ‘ এই উজ্জল আন্দোলন হাসানুল বান্নার হৃদয়ে অঙ্কিত ছিল। এরপর তিনি তা আল্লাহর পথের আন্দোলনে রূপান্তরিত করেন। সে সময় সারা বিশ্বে বিশেষত মিসরে এমনটা ঘটা ছিল সময়ের দাবি।

উল্লেখিত মন্তব্য থেকে বুঝা যায় যে প্রাথমিকভাবে ইখওয়ানুল মুসলিমীনের কাজ-কর্ম গড়ে উঠেছিল প্রত্যাখ্যান-মতামত খণ্ডণের মাধ্যমে। এর স্বপক্ষে অনেক ইখওয়ানী নেতা-কর্মীর পক্ষ থেকে দলীল রয়েছে। মুহাম্মাদ কুতুব ‘আসসহওয়াতুল ইসলামিয়্যাহ’ নামে একটি বই লিখেছেন। প্রকাশক উক্ত বইয়ের ভূমিকায় লিখেছে ‘ইসলামী পুনর্জাগরণ ইসলামী বিশ্বে যে সাড়া ফেলেছে তা বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের সবচেয়ে বড় ঘটনা।

মুহাম্মাদ কুতুব উক্ত কিতাবের ৭৫ নং পৃষ্ঠায় বলেন, ইসলামী পুনর্জাগরণ আল্লাহ কর্তৃক পূর্বনির্ধারিত সময়েই সংঘটিত হয়েছে। যদি এই জাগরণ আকস্মিক বিষয়ই হতো তাহলে বিশ্বের সকল প্রান্তের লোকদেরকে একই সাথে কে জাগালো?

আমি বলব, ‘নিঃসন্দেহে প্রত্যেক কাজ আল্লাহর পূর্ব নির্ধারিত। কিন্তু এই বিশৃঙ্খল জাগরণে কোন উপকার বা কল্যাণ নাই। আর এতে আকস্মিকতার কিইবা আছে?

সে ৬৩ নং পৃষ্ঠায় বলেছে, ইমাম শহীদ (হাসানুল বান্না রহিমাহুল্লাহ) যখন এই জাগরণ নিয়ে আগমন করেন তখন আল্লাহ তা‘আলা যাদের উপর রহমাত নাযিল করেছেন তারা ব্যতীত বাকি সবাই এ ব্যাপারে গাফলতিতে রয়েছে।

৯৬ নং পৃষ্ঠায় ‘আন্দোলনের পদ্ধতির’ শিরোনামে বলেন, বর্তমানে অনেক কর্ম-তৎপর জামাত আন্দোলনে অবশ্য পালনীয় পদ্ধতির ব্যাপারে মতপার্থক্য করে থাকে। অথচ ইমাম শহীদ (হাসানুল বান্না) এর পদ্ধতি উপর তার প্রতিষ্ঠিত আন্দোলন চলছিল। এখানে তারা জামাত ভিন্ন আর কোন জামাত ছিল না।

আমি বলব, সাউদী ও অন্যান্য দেশে ইসলামের শুরু থেকে আজ অবধি শীর্ষে অবস্থিত কুরআন-সুন্নাহর উপর প্রতিষ্ঠিত সালাফী দাওয়াত কী তখন অনুপস্থিত ছিল? মুসলিমগণ এখনো পর্যন্ত এ দাওয়াতের ফলাফল ভোগ করছেন। অন্যান্য দাওয়াতের অনিষ্টের মত এ দাওয়াতে কোন অনিষ্ট নেই। অথচ  সে এই দাওয়াতের অস্তিত্ব দেখতে পায়নি। এ প্রকার লোকদের ব্যাপারে কবি বলেন,

সত্য সেতো সূর্য যেন

সকল চক্ষু দেখে

কিন্তু সে ও আবরণ ঢাকে,

অন্ধকে দূরে রাখে

অপর একজন কবি বলেন,

রুগ্ন চক্ষু করে না বরদাশত

সূর্যালোক কোন কাল

রোগীর মুখে সুস্বাদু খাবার

সেটাও তো ভেজাল।

বাকর আবু যায়দ ‘মু‘জামুল মানাহী লাফযিয়্যাহ’ নাম গ্রন্থের ২০৯ নং পৃষ্ঠায় ‘ইসলামী পুনর্জাগরণ’ শিরোনামে লিখেছেন, আল্লাহ তা‘আলা এ বিষয়ে কোন হুকুম প্রদান করেননি। এটা একটা নতুন পরিভাষা। আমরা সালাফে সালেহীনদের থেকে এরকম কোন পরিভাষা দেখতে পাইনি। হিজরী পঞ্চদশ শতকে এসে খ্রিষ্টানদের চার্চে প্রত্যাবর্তনের পর এ শব্দের ব্যবহার শুরু হয়েছে। মুসলিমদের জন্য আল্লাহ তা‘আলা এবং তার রসূল ছালাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনুমতি প্রদান করেননি এমন কোন বিষয় ধর্মে সংযোজন করা জায়েয নয়।

ইসলাম ধর্মে শারঈ পরিভাষাগুলো সুনির্দিষ্ট। যেমন; ইসলাম, ঈমান, ইহসান, তাকওয়া ইত্যাদি এবং এগুলোর প্রতি সম্বন্ধকৃত ব্যক্তি যথাক্রমে মুসলিম, মু‘মিন, মুহসিন ও মুত্তাক্বী।

আমার জানা নাই এই الصحوةالإسلامية (ইসলামী পুনর্জাগরণ) এর প্রতি সম্বন্ধকৃত ব্যক্তিকে কি বলে নিসবাত করা হবে صاحٍ নাকি? অন্য কিছু? (এখানেই তার বক্তব্য শেষ)।

[2]. দ্বিরার ইবনে আমর বলেছেন, ‘সেই আল্লাহর কসম, মূর্খতার ভিত্তিতে কোন কাজ করা হলে তাতে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়ে থাকে’ (আল ফাক্বীহ ওয়াল মুতাফাককি ১/১৯)।