প্রশ্ন-৩৪ : বর্তমানের কিছু যুবকের মাঝে আকীদা শিক্ষা করা, এ ব্যাপারে পড়াশুনা করা ও এর উপর গুরুত্ব প্রদানের প্রতি অনীহা ও বিমুখতা পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং তাদেরকে অন্যান্য ব্যাপারে মশগূল থাকতে দেখা যাচ্ছে। এ জাতীয় যুবকদের ব্যাপারে আপনার দিকনির্দেশনা কী?

উত্তর : পরম করুনাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি। প্রশংসা মাত্রই আল্লাহ তা‘আলার জন্য যিনি জগৎ সমূহের প্রতিপালক। দরুদ বর্ষিত হোক আমাদের নাবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার পরিবার ও সকল সঙ্গী সাথীর উপর।

পরকথা হলো, আমি যুবকদেরকে এবং সকল মুসলিমকে উপদেশ প্রদান করি যেন তারা অন্যান্য বিষয় শেখার পূর্বেই আক্বীদা শেখার প্রতি গুরুত্ব প্রদান করে।[1] কেননা আক্বীদাই মূল। সকল আমল কবুল হওয়া ও না হওয়া আক্বীদা (বিশ্বাস) এর বিশুদ্ধতার উপর নির্ভরশীল। আক্বীদা যদি সকল নাবী-রসূল আলাইহিমুস সালামদের, বিশেষত শেষ নাবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রাপ্ত ওহী অনুযায়ী বিশুদ্ধ হয় তাহলে সকল আমল একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ও আল্লাহ ও তার রসূলের শরী‘আত অনুযায়ী হলেই মাত্র তা কবুল করা হয়। আর যদি আক্বীদা বাতিল ও ভ্রষ্ট হয়, যদি তা প্রতিষ্ঠিত হয় পার্থিব লাভ, বাপ-দাদার (পূর্ব পুরুষের) অন্ধ অনুকরণের উপর অথবা যদি আক্বীদা শিরকযুক্ত হয় তাহলে সকল আমল পরিত্যাজ্য হবে। যদিও উক্ত ব্যক্তি একনিষ্ঠতার সাথে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই আমল করুক না কেন। কেননা আল্লাহ তা‘আলা শুধু তারই সন্তুষ্টির জন্য ও তার রসূলের পদ্ধতি অনুযায়ী হওয়া ছাড়া কোনো আমল গ্রহণ করেন না। সুতরাং যে ব্যক্তি নিজের মুক্তি ও তার আমলের কবুল হওয়া কামনা করে এবং প্রকৃত মুসলিম হতে চায় তার উচিত হবে, আক্বীদার ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া, সহীহ ‘আক্বীদা ও আক্বীদা বিরোধী বিষয়াবলি সম্পর্কে জানা, যাতে তার আমল বিশুদ্ধ ‘আক্বীদা অনুযায়ী হয়। তবে এটা একমাত্র আলেম ও বিজ্ঞ লোকদের নিকট থেকে জ্ঞানার্জনের মাধ্যমেই সম্ভব, যারা উম্মাহর সালাফে সালেহীনের নিকট থেকে ইলম অর্জন করেছেন।[2]

আল্লাহ তা‘আলা তার নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে বলেন,

فَاعْلَمْ أَنَّهُ لا إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ

‘জেনে নাও যে তিনি আল্লাহ, এক ও একক। তিনি ভিন্ন আর কোনো সত্য ইলাহ  নেই। তুমি তোমার গোনাহের জন্য ও মুমিন নর-নারীর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো’। (সূরা মুহাম্মাদ আয়াত ১৯)

ইমাম বুখারী (রহ.) একটি অনুচ্ছেদ রচনা করেন এভাবে, باب العلم قبل القول والعمل ‘কোনো কথা বলা বা কোনো কাজ করার পূর্বে সে সংক্রান্ত বিষয়ে ইলম অর্জনের অধ্যায়’ (সহীহ বুখারী ১/৩৭)।

‘‘তিনি فَاعْلَمْ أَنَّهُ لا إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ  জেনে নাও যে তিনি আল্লাহ এক ও একক। তিনি ভিন্ন আর কোনো সত্য ইলাহ নাই। এ আয়াতে উল্লেখ করেছেন (সূরা মুহাম্মাদ আয়াত ১৯)। আলস্নহ তা‘আলা আরো বলেন,

 وَالْعَصْرِ * إِنَّ الأِنْسَانَ لَفِي خُسْرٍ * إِلاَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ

‘মহাকালের শপথ। মানুষ অবশ্যই ক্ষতিতে আছে। তবে তারা ব্যতীত যারা ঈমান আনে, সৎকাজ করে, পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় এবং পরস্পরকে ধৈর্যের উপদেশ দেয়’। (সূরা আল আছর )

এখানে আল্লাহ তা‘আলা ক্ষতি থেকে মুক্তিকে ৪টি মাসআলার উপর নির্ভরশীল করেছেন:

প্রথম মাসআলা : ‘‘ঈমান’’ অর্থাৎ ছহীহ আক্বীদা’’।

দ্বিতীয় মাসআলা : বিশুদ্ধ আমল ও বিশুদ্ধ কথা : বিশুদ্ধ আমল ও বিশুদ্ধ কথা ঈমানের অংশ হওয়া সত্ত্বেও এ বিষয়ের উপর গুরুত্বারোপ করার জন্য খাছকে (বিশেষ বিষয়কে) আম (ব্যাপক বিষয়ের) উপর আতফ (পুনঃউল্লেখ) করেছেন। নতুবা আমল আগে থেকেই ঈমানের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

তৃতীয় মাসআলা : হক বা সত্য পথের নছীহত প্রদান করবে অর্থাৎ তারা আল্লাহর পথে আহবান করে এবং সৎ কজের আদেশ প্রদান করে ও অসৎ কাজ থেকে বাধা প্রদান করে। যেহেতু মুসলিমরা ‘‘(আল-আমরু বিল মা‘রুফ ওয়ান নাহি আনিল মুনকার) সৎকাজের আদেশ প্রদান ও অসৎ বিষয় থেকে বাধা প্রদান করা বিষয়ে আদিষ্ট; সুতরাং প্রথমে নিজেকে সংশোধন করে মানহাজ সম্পর্কে জেনে অপরকে সে পথে আহবান করবে।

চতুর্থ মাসআলা : একে অপরকে ধৈর্যধারণের উপদেশ দেয়া। আল্লাহর পথে  সৎকাজের আদেশ প্রদানে যে কষ্ট বিপদ-আপদ, মুছীবতের সম্মুখীন হবে সে ক্ষেত্রে ধৈর্যধারণ করবে।

এই চারটি মাসআলার বাস্তবায়ন ব্যতিরেকে কোনো মুসলিমের সৌভাগ্যবান হওয়া সম্ভব নয়। সাধারণ সংস্কৃতি, সাংবাদিকতা ও মানুষের মতামত, বৈশ্বিক বিষয় ইত্যাদির প্রতি তাওহীদ শেখার পরে মনোযোগ দেবে; যাতে ভালো-মন্দ সম্পর্কে জানতে পারে এবং মানুষকে বর্তমানে ঘূর্ণায়মান বিভিন্ন অহিতকর বিষয়, ভ্রান্ত আহবান থেকে সতর্ক করতে পারে। তবে এটা হতে হবে আল্লাহ তা‘আলা ও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি ঈমান ও ‘ইলমের অস্ত্রে সজ্জিত হওয়ার পরে।

‘আকীদা ও দ্বীনী বিষয়ের ‘ইলম ছাড়াই সংস্কৃতি, সাংবাদিকতা ও রাজনৈতিক কাজ-কর্মে লিপ্ত হওয়ার দ্বারা ব্যক্তির কোনো উপকার হয় না। বরং অহেতুক কাজে সময় অপচয় করা হয় মাত্র। সে হক ও বাতিলের মাঝে পার্থক্য নিরূপণ করতে পারে না। অনেক ‘আক্বীদা জ্ঞানহীন ব্যক্তি এসকল কাজে লিপ্ত হয়ে নিজে পথভ্রষ্ট হয় এবং অন্যকেও পথভ্রষ্ট করে। তাদের নিকট সুস্পষ্ট কোনো ‘ইলম না থাকার কারণে তারা মানুষকে সংশয়ে ফেলে দেয়।[3]

তাদের নিকট ভালো মন্দ নিরূপণ করা, কোনো বিষয় গ্রহণযোগ্য নাকি পরিত্যাজ্য, কোন কাজ কীভাবে সমাধান করতে হবে এ সংক্রান্ত কোন ‘ইলম নেই।

‘আক্বীদা ও দীন সম্পর্কে বিশুদ্ধ ‘ইলম না থাকা সত্ত্বেও সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে লিপ্ত হওয়ার কারণে তাদের অনেকের নিকট সন্দেহ-সংশয়ের অবতারণা ঘটে। তারা হককে বাতিল এবং বাতিলকে হক মনে করে।


[1]. শায়খ তামিম আদ দারী (রা.) কর্তৃক বর্ণিত রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিম্নোক্ত হাদীছ থেকে এমত (মানহাজ গ্রহণ করেছেন) নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, দীন হলো কল্যাণ কামিতা। আমরা (ছাহাবীগণ) বললাম কার জন্য? নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,  আল্লাহর জন্য, তার কিতাবের জন্য, তার রসূলের জন্য, মুসলিম নেতাদের জন্য ও সকল মুসলিম জন্য, সাধারণের জন্য। (সহীহ মুসলিম হা/৫৫)

রসূলুল্লাহ সল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মু‘আয ইবনে জাবাল (রা.) কে ইয়ামানে প্রেরণের সময় দিক নির্দেশনা স্বরূপ বলেন, তাদেরকে প্রথমে যে বিষয়ের আহবান করবে তা হলো তারা যেন, আল্লাহর একত্ব-তাওহীদের স্বীকৃতি প্রদান করে। (সহীহ বুখারী হা/৬৯৩৭)

[2]. তারা হলো, আহলুল ‘ইলমগণ যাদেরকে উম্মাহর কল্যাণকামী, মানহাজে অটল ও একনিষ্ট বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তবে যেন কোন  প্রবৃত্তিপূজারী ও ভ্রষ্টদল ফিরকাবাজ না হয়।

[3]. এটা বিশেষ করে রাজনৈতিক আন্দোলনকারী দলবাদীরা যারা তাদের আলোচনা, বক্তৃতা, বাণী ও লিখনিতে বিভিন্ন মুসলিম সমাজে রাজনৈতিক গোলযোগ সৃষ্টি করে। আমরা আল্লাহর নিকট তাদের জন্য হিদায়াত ও সঠিক দীনের উপর অটল থাকা কামনা করি।