মূসা ‘আলাইহিস সালাম বনী ইসরাঈল, ফির‘আউন এবং ফির‘আউনের কাওমের এ দীর্ঘ ঐতিহাসিক কাহিনী শুধু একটি কাহিনী ও গল্প নয়, বরং সত্য-মিথ্যার প্রতিযোগিতা, ন্যায়-অন্যায়ের লড়াই স্বাধীনতা ও দাসত্বের টানা-হেঁচড়া, অক্ষম ও হীনদের মস্তকোত্তলণ, অত্যাচারী ও উন্নত মস্তকদের হীনতা বরণ ও ধ্বংস, সত্যের সফলতা এবং বাতিলের পরাভূত ও অপদস্থ হওয়া, ধৈর্য ও পরীক্ষা, শোকর এবং অনুগ্রহের বিকাশ ক্ষেত্র। মোটকথা, অকৃতজ্ঞতা ও না-শুকরীর নিকৃষ্ট পরিণতির এমন মহৎ ও ফলশ্রুতিপূর্ণ এবং তথ্যাবলীর এমন সারগত বিষয় নিহিত রয়েছে এবং প্রত্যেক রুচিসম্পন্ন ব্যক্তিকে তা জ্ঞানের সীমা ও সুক্ষ্মদৃষ্টি অনুযায়ী চিন্তা ও গবেষণার দাওয়াত প্রদান করছে। তৎসমূদয় হতে নমুনাস্বরূপ নিম্নের কয়েকটি জ্ঞানগর্ভ বিষয় বিশেষভাবে চিন্তনীয় ও অনুধাবনীয়।
মানুষ যদি কোনো বিপদ ও পরীক্ষার সম্মুখীন হয়, তবে তার অবশ্য কর্তব্য হয় ধৈর্য ও সন্তুষ্টির সাথে এর মুকাবিলা করা। এরূপ করলে নিঃসন্দেহে সে মহা মঙ্গল লাভ করবে এবং নির্ঘাত সে সফলকাম হবে। মূসা ‘আলাইহিস সালাম ও ফির‘আউনের পূর্ণ ঘটনাটি এর জীবন্ত সাক্ষী।[1]
যে ব্যক্তি নিজের সমূদয় কাজ-কর্মে আল্লাহ তা‘আলার ওপর ভরসা ও নির্ভর রাখে এবং একমাত্র তাকেই খাঁটি অন্তরের সাথে নিজের পৃষ্ঠপোষক মনে করে, আল্লাহ তা‘আলা অবশ্যই তার যাবতীয় বিপদ সহজসাধ্য করে দেন এবং তার সমস্ত বিপদকে মুক্তি ও সফলভাবে রূপান্তরিত করে দেন। মূসা ‘আলাইহিস সালাম ক্কিবতীকে হত্যা করা, মিসরবাসীরা মূসা ‘আলাইহিস সালামকে হত্যা করার জন্য পরামর্শ করা, অতঃপর শত্রু দলেরই মধ্য থেকে একজন সমব্যথী ব্যক্তি মূসা ‘আলাইহিস সালামকে মিসরবাসীদের ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে অবহিত করা, এরূপে তার মাদায়েন চলে যাওয়া এবং নবুওয়াত লাভ।[2]
যদি আল্লাহর কোনো বান্দা সত্যের সাহাযার্থে জীবন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়, তবে আল্লাহ তা‘আলা বাতিলের পুজারীদেরই মধ্য থেকে তার সাহায্যকারী তৈরি করে দেন। আমাদের সম্মুখে মূসা ‘আলাইহিস সালামের দৃষ্টান্ত বিদ্যমান। যখন ফির‘আউন ও তার সভাসদ তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল, তখন তাদেরই মধ্য থেকে একজন সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তি তৈরি হয়ে গেলেন যিনি মূসা ‘আলাইহিস সালামের পক্ষ থেকে পূর্ণ প্রতিবাদ করলেন। অনুরূপভাবেই ক্কিবতীকে হত্যা করার পর যখন তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত করা হয়েছিল, তখন একজন আল্লাহভক্ত ক্কিবতী মূসা ‘আলাইহিস সালামকে এ বিষয়ে সংবাদ প্রদান করলেন এবং তাকে মিসর থেকে বের হয়ে যাওয়ার সৎ পরামর্শ দিলেন, যা ভবিষ্যতে মূসা ‘আলাইহিস সালামের নানাবিধ মহাসাফল্যর কারণ হয়েছিল।[3]
সবরের ফল সর্বদা মিষ্ট হয়ে থাকে, ফল লাভ করতে যতই দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে হোক না কেন, তবুও সে ফল মিষ্টই লাগবে। বনী ইসরাঈল কত দীর্ঘকাল পর্যন্ত মিসরে নিঃসহায়তা, দাসত্ব এবং পেরেশান অবস্থায় জীবন কাটিয়েছিল এবং পুরুষ সন্তানদের হত্যা ও মেয়ে সন্তানদের দাসী হওয়ার অপমান সহ্য করছিল, কিন্তু পরিশেষে এমন সময় এসেই পড়ল, যখন তারা সবরের মিষ্ট ফল লাভ করল এবং ফির‘আউনের ধ্বংস ও নিজেদের সম্মানজনক মুক্তি তাদের সর্বপ্রকার সাফল্যের পথ মুক্ত করে দিল।[4] যেমন, আল্লাহর বাণী:
﴿وَتَمَّتۡ كَلِمَتُ رَبِّكَ ٱلۡحُسۡنَىٰ عَلَىٰ بَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيلَ بِمَا صَبَرُواْۖ ١٣٧﴾ [الاعراف: ١٣٧]
“এবং বনী ইসরাঈলদের ওপর আপনার রবের নেক বাণী পূর্ণ হলোই হলো শুধু এ জন্য যে, তারা ধৈর্যধারণ করেছে।’’ [সূরা আল আ‘রাফ, আয়াত: ১৩৭]
সত্যকে কেউ কবুল করুক বা না করুক, সত্যের প্রতি আহ্বানকারীর কর্তব্য সত্য উপদেশ প্রদানে বিরত না থাকা। যেমন, শনিবারের মর্যাদা নষ্ট করায় তাদেরই মধ্য হতে কতিপয় সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তি তাদেরকে বুঝাল। তাদের কতক লোক এও বলেছিল যে এদেরকে বুঝানো নিষ্ফল, কিন্তু সত্যের প্রতি পাকা আহ্বানকারীরা উত্তর করলেন,
﴿مَعۡذِرَةً إِلَىٰ رَبِّكُمۡ وَلَعَلَّهُمۡ يَتَّقُونَ ١٦٤﴾ [الاعراف: ١٦٤]
‘‘কিয়ামতের দিন আমরা আল্লাহ তা‘আলার সম্মুখে এ ওযরতো পেশ করতে পারবো যে, আমরা অনবরত সত্যের প্রচার করতে রয়েছি’’, অদৃশ্য জগতে কি নিহিত রয়েছে, তার জ্ঞান তো আমাদের নেই। বিচিত্র কি যে, এরা পরহেযগার হয়ে যাবে”। [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৬৪]
[2] মুহাম্মাদ জামীল আহমদ, আম্বিয়া ই-কুরআন, (লাহোর: শায়খ গোলাম আলী এন্ড সন্স, তা.বি), খ.২, পৃ. ২৭৮।
[3] প্রাগুক্ত।
[4] হিফজুর রহমান সিউহারবী, কাসাসুল কুরআন (লাহোর: মোস্তাক বুক কর্ণার, তা.বি) খ. ১, পৃ. ৩৫৮-৩৬০)