ইউসুফ ‘আলাইহিস সালামের ঘটনা থেকে শিক্ষা

ইউসুফ ‘আলাইহিস সালামের এ বিস্ময়কর ও অভিনব কাহিনীতে ধী-সম্পন্ন লোকদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চারিত্রিক মাসআলা নিহিত আছে। আসলে এ কিচ্ছাটি শুধু একটি ঘটনাই নয়, ফযীলত ও আখলাকের এমন একটি সূবর্ণ কাহিনী যার প্রত্যেকটা দিক নছীহত ও জ্ঞানের মণি-মুক্তা দ্বারা কানায় কানায় পরিপূর্ণ।

ঈমানী শক্তি, আত্মসংযম, সবর, শুকর, পরিত্রতা, দীনদারী, বিশ্বস্ততা, ক্ষমা, দীন প্রচারের অনুপ্রেরণা, আল্লাহর বাণীকে সমুন্নত করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা, আত্মসংশোধন ও আল্লাহভীতির ন্যায় উচ্চ পর্যায়ের আখলাক এবং মহৎ গুণাবলীর একটি দুর্লভ স্বর্ণ শৃঙ্খল যা এ কিসসাটির প্রত্যেক পরতে দেখা যায়। তন্মধ্যে নিম্ন হতে নিম্নবর্ণিত কয়েকটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

যদি কোনো ব্যক্তির নিজস্ব প্রকৃতি ও স্বভাব উত্তম হয় এবং তার পরিবেশও পবিত্র-নিস্কলঙ্ক হয়, তবে সে ব্যক্তির জীবন মহৎ চরিত্রাবলীর মধ্যে সুষ্পষ্ট এবং উচ্চস্তরের গুণাবলীর মধ্যে বিশিষ্ট হবে এবং তিনি সর্ব প্রকারের মাহাত্ম্য ও বুযুর্গীর ধারক ও বাহক হবেন।[1] ইউসুফ ‘আলাইহিস সালামের পবিত্র যিন্দিগী তার অতি উত্তম দৃষ্টান্ত। তিনি ইয়াকূব, ইসহাক এবং ইবরাহীম ‘আলাইহিমুস সালামের মতো অতি উচ্চ মর্যাদাশলি নবী ও পয়গাম্বরগণের সন্তান ছিলেন, সুতরাং নুবুওয়াত ও রিসালাতের দোলনায় প্রতিপালিত হন। নবুওয়াত ও রিসালাতের পরিবারের পরিবেশে শিক্ষা দীক্ষা লাভ করেন। তার নিজস্ব নেক প্রকৃতি এবং স্বভাবগত পবিত্রতা যখন এমন পবিত্র পরিবেশ দেখতে পায় তখন তার সমূদয় প্রশংসনীয় ফযীলত ও গুণ প্রদীপ্ত হয়ে উঠে! ফলে শৈশব, যৌবন এবং বাধ্যর্ক্যর এমনকি জীবনের সমস্ত কাজ পরহেযগারী, সাধুতা, ধৈর্য্য, দ্বীনদারী এবং আল্লাহর ভালোবাসার এমন উজ্জ্বল বিকাশক্ষেত্র হয়ে গেল যে, মানুষের জ্ঞান এতগুলো পূর্ণ গুণাবলীর সমাবেশযুক্ত একজন মানুষকে দেখে বিস্ময়ে অবাক হয়ে যায়।
যদি কোনো ব্যক্তির মধ্যে আল্লাহর প্রতি ঈমান সঠিক এবং সুদৃঢ় হয় এবং তার ওপর তার বিশ্বাস মজবুত ও দৃঢ় হয়, তবে এ পথের সমস্ত জটিলতা ও মুশকিল তার জন্য সহজ শুধু নয়; বরং সহজতর হয়ে যায়, সত্য দর্শনের পর সমস্ত বিপদ ও মুসীবত অতি তুচ্ছ হয়ে যায়। ইউসুফ ‘আলাইহিস সালামের গোটা জীবনের মধ্যে এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে পরিদৃষ্ট হয়।[2]

পরীক্ষা, মুসীবত এবং ধ্বংসের আকৃতিতেই হোক কিম্বা ধন দৌলত এবং রিপুর কামনা বাসনার সুন্দর সুন্দর উপকরণের আকারেই হোক, সর্বাবস্থায় মানুষের উচিৎ আল্লাহ তা‘আলার দিকে রুজু হওয়া। আল্লাহরই দরবারে কাকুতি মিনতি করা যেন তিনি সত্যের ওপর দৃঢ়পদ রাখেন এবং ধৈর্য্য দান করেন। আযীযে মিসরের বিবি এবং মিসর শহরের সুন্দরী রমণীদের অসৎ প্ররোচন এবং তাদের মনস্কামপূর্ণ না করলে জেলে আবদ্ধ করার ধমক। অতঃপর জেলখানার নানা প্রকার কষ্ট ও সমস্ত অবস্থায় ইউসুফ ‘আলাইহিস সালামের নির্ভর, তার দো‘আ এবং কাকুতি-মিনতিসমূহের কেন্দ্রস্থল কেবল আল্লাহরই সাথে সংশ্লিষ্ট দেখা যায়। তাকে আযীযে মিসরের সম্মুখে আবেদন করতেও দেখা যায় না। ফির‘আউনের দরবারেও আবদার করতে দেখা যায় না। তিনি সে মিসরের সুন্দরী রমণীদের সঙ্গে মন লাগাচ্ছে না। নিজের পালনকারীর সুন্দরী স্ত্রীর সঙ্গেও না বরং প্রত্যেক ক্ষেত্রে শুধু আল্লাহ তা‘আলার সাহায্য প্রার্থীই দেখা যায়।[3] যেমন তিনি বলেছেন:

﴿قَالَ رَبِّ ٱلسِّجۡنُ أَحَبُّ إِلَيَّ مِمَّا يَدۡعُونَنِيٓ إِلَيۡهِۖ ٣٣﴾ [يوسف: ٣٣]

“হে আমার রব, এ মহিলারা আমাকে যেদিকে আহ্বান করছে তার চেয়ে জেলখানাই আমার নিকট শ্রেয়।” [সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৩৩]

﴿مَعَاذَ ٱللَّهِۖ إِنَّهُۥ رَبِّيٓ أَحۡسَنَ مَثۡوَايَۖ ٢٣﴾ [يوسف: ٢٣]

“আল্লাহর আশ্রয় ভিক্ষা চাইছি। নিঃসন্দেহে তিনি (আযীয মিসর) আমার মুরব্বি আমাকে সম্মান ও মর্যাদার সহিত রেখেছেন।” [সূরা ইউসুফ, আয়াত: ২৩]

যখন আল্লাহ তা‘আলার মহব্বত এবং ভালোবাসা অন্তরের গভীরে প্রবেশ করে, তখন মানুষের জীবনের সম্পূর্ণ উদ্দেশ্য একমাত্র তিনিই হয়ে যান। তার দীনের দাওয়াত, তাবলীগের আকাঙ্ক্ষা সর্বক্ষণ ধমনীসমূহে ও শিরায় শিরায় ধাবিত হতে থাকে। যেমন, জেলখানায় কঠিন মুসীবতের সময় নিজের সাথীদের সাথে ইউসুফ ‘আলাইহিস সালামের সর্বপ্রথম কথা এটিই ছিল। যা আল-কুরআনের

﴿يَٰصَٰحِبَيِ ٱلسِّجۡنِ ءَأَرۡبَابٞ مُّتَفَرِّقُونَ خَيۡرٌ أَمِ ٱللَّهُ ٱلۡوَٰحِدُ ٱلۡقَهَّارُ ٣٩﴾ [يوسف: ٣٩]

“হে আমার জেলখানার বন্ধুদ্বয়! পৃথক পৃথক বহু দেবতার উপাসনাই কি ভালো? না কি একমাত্র মহা শক্তিশান আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতই উত্তম?” [সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৩৯] শীর্ষক বাণীতে উল্লেখ পাওয়া যায়।

দীনদারী ও বিশ্বস্ততা এমন একটি নি‘আমত যে, একে মানুষের ধর্মীয় ও পার্থিব সৌভাগ্যের চাবিকাঠি বলা যেতে পারে। আযীযে মিসরের এখানে ইউসুফ ‘আলাইহিস সালাম যেরূপে প্রবেশ করেছিলেন, ঘটনাবলীর বিস্তৃত বিবরণে তা জানা গিয়েছে। এটি ইউসুফ ‘আলাইহিস সালামের দীনদারী এবং বিশ্বস্ততারই ফল ছিল যে, প্রথম তিনি আযীযে মিসরের দৃষ্টিতে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন এবং প্রিয় হন। তৎপর একেবারে সমগ্র মিসর রাজ্যের মালিকই হয়ে বসেন।[4]

আত্মনির্ভরশীলতা মানুষের উচ্চ শ্রেণির গুণাবলীর অন্তর্গত একটি মহৎ গুণ। আল্লাহ তা‘আলা যাকে এ দৌলত দান করে সে ব্যক্তিই দুনিয়ার সর্বপ্রকার মুসীবত ও দুঃখ কষ্ট অতিক্রম করে দুনিয়া ও আখিরাতের উন্নতি লাভ করতে পারে।

[1] সম্পাদন পরিষদ, সীরাত বিশ্বকোষ, ১ম সংস্করণ (ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৯৫ খৃ.), খ. ২, পৃ. ১৩০।

[2] প্রাগুক্ত।

[3] মওলানা হিফযুর রহমান, প্রাগুক্ত, খ. ১, পৃ. ৩৩৭।

[4] মওলানা আহমদ ও অন্যান্য, কাসাসুল কুরআন, ১০ম সংস্করণ (মিসর, ১৯৬৯ খ.) খ. ১, পৃ. ৩১২।