মুহাম্মদ ইবন ইয়াকুব আল-কুলাইনী তার ‘উসুলুল কাফী’ (أصول الكافي) নামক গ্রন্থের মধ্যে "باب طينة المؤمن و الكافر" (মুমিন ও কাফিরের মাটির অধ্যায়) নামে একটি অধ্যায়ের উল্লেখ করেন এবং তাতে অনেকগুলো বর্ণনা নিয়ে আসেন; তন্মধ্যে আমরা কিছুসংখ্যক বর্ণনা উল্লেখ করছি:
“আবদুল্লাহ ইবন কাইসান থেকে বর্ণিত, তিনি আবূ আবদিল্লাহ আ. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: আমি তাকে বললাম, আমি তোমার গোলাম আবদুল্লাহ ইবন কাইসান, তিনি বললেন: বংশ সম্পর্কে আমার জানা আছে; কিন্তু আমি তোমাকে চিনতে পারছি না, সে বলল: আমি তাকে বললাম, আমি অথবা পাহাড়ে জন্ম গ্রহণ করেছি এবং পারস্য ভূমিতে বড় হয়েছি। আর ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্যভাবে মানুষের সাথে মিশেছি। অতএব আমি এক ব্যক্তির সাথে মিশি, অতঃপর আমি তার উত্তম আচার-আচরণ, উত্তম চরিত্র ও আমানতদারিতা লক্ষ্য করি। অতঃপর আমি তাকে অনুসন্ধান চালাই এবং তাকে তোমাদের শত্রুতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি। আবার অন্য এক ব্যক্তির সাথে মিশি, অতঃপর আমি তার অসৎ চরিত্র, স্বল্প আমানতদারীতা ও অশ্লিলতা লক্ষ্য করি।
অতঃপর আমি তাকে অনুসন্ধান চালাই এবং তাকে তোমাদের বন্ধুত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি; সুতরাং এটা কিভাবে হয়? সে বলল, অতঃপর তিনি আমাকে বললেন: হে ইবনু কাইসান! তুমি কি জান না যে, আল্লাহ তা‘আলা জান্নাত থেকে কিছু মাটি গ্রহণ করেছেন এবং জাহান্নাম থেকে কিছু মাটি গ্রহণ করেছেন; অতঃপর তা সামগ্রিকভাবে মিশ্রিত করেছেন। অতঃপর এটা থেকে ওটা, ওটা থেকে এটা বের করে দিয়েছেন; সুতরাং তুমি যাদের আমানতদারীতা, উত্তম চরিত্র ও উত্তম আচার-আচরণ লক্ষ্য করেছ, তাদের সাথে জান্নাতের মাটির সংস্পর্শ রয়েছে। আর তারা প্রত্যাবর্তন করবে ঐ দিকে, যার থেকে তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর তুমি যাদের স্বল্প আমানতদারীতা, অসৎ চরিত্র ও অশ্লিলতা লক্ষ্য করেছ, তাদের সাথে জাহান্নামের মাটির সংস্পর্শ রয়েছে। আর তারা প্রত্যাবর্তন করবে ঐ দিকে, যার থেকে তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন:
“ইবরাহীম থেকে বর্ণিত, তিনি আবূ আবদিল্লাহ আ. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: আল্লাহ তা‘আলা যখন আদম আ.কে সৃষ্টি করার পরিকল্পনা করেন, তখন তিনি জিবরাইল আ.কে জুমার দিনের প্রথম মুহূর্তে প্রেরণ করলেন; অতঃপর সে তার ডান হাত দ্বারা এক মুষ্টি (মাটি) গ্রহণ করলেন, যে মুষ্টির পরিমাণ হল সপ্তম আকাশ থেকে শুরু করে দুনিয়ার আকাশ পর্যন্ত এবং তিনি প্রত্যেক আসমান থেকে মাটি গ্রহণ করেছেন। আর তিনি অপর এক মুষ্টি গ্রহণ করলেন সাত যমিনের উপরিভাগ থেকে শুরু করে সাত যমিনের প্রান্তসীমা পর্যন্ত সীমানা থেকে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তার পরিকল্পনা স্থির করলেন; অতঃপর তিনি প্রথম মুষ্টি গ্রহণ করেন তাঁর ডান হাতে এবং অপর মুষ্টি গ্রহণ করেন তাঁর বাম হাতে। অতঃপর তিনি মাটিকে দ্বিখণ্ডিত করলেন; অতঃপর তিনি যমিন থেকে যাদেরকে সৃষ্টি করলেন তারা যমিনে ছড়িয়ে গেল এবং আসমান যমিন থেকে যাদেরকে সৃষ্টি করলেন তারা আসমানে ছড়িয়ে পড়ল। অতঃপর তিনি তাঁর ডান হাতের মুষ্টিকে লক্ষ্য করে বললেন: তোমার থেকে সৃষ্টি হবে নবী ও রাসূলগণ, অসীয়তকারীগণ, সত্যবাদীগণ, মুমিনগণ, সৌভাগ্যবানগণ এবং তিনি যাদেরকে সম্মানিত করতে চান তারা; ফলে তিনি যা যেভাবে বলেছেন, তা তাদের জন্য আবশ্যক হয়ে যায়। আর তিনি তাঁর বাম হাতের মুষ্টিকে লক্ষ্য করে বললেন: তোমার থেকে সৃষ্টি হবে অহঙ্কারীগণ, মুশরিকগণ, কাফিরগণ, সীমালংঘনকারীগণ এবং তিনি যাদেরকে অপমানিত ও ভাগ্যাহত করতে চান তারা; ফলে তিনি যা যেভাবে বলেছেন, তা তাদের জন্য আবশ্যক হয়ে যায়।
অতঃপর মাটির দুই খণ্ড সামগ্রিকভাবে মিশ্রিত হয়ে গেছে। আর এটাই হল আল্লাহ তা‘আলার বাণী: إِنَّ ٱللَّهَ فَالِقُ ٱلۡحَبِّ وَٱلنَّوَىٰ (আল্লাহই শস্যবীজ ও আঁটি অঙ্কুরিত করেন; —সূরা আল-আন‘আম: ৯৫) এ আয়াতে (তাদের মতে) "الحب" (শস্যবীজ) হল, মুমিনগণের মাটি, যাতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ভালবাসা বা মহব্বত ঢেলে দিয়েছেন; আর "النوى" (আঁটি) হল কাফিরগণের মাটি, যারা সকল প্রকার কল্যাণ থেকে দূরে অবস্থান করে। আর এ জন্যই "النوى"-কে "النوى" বলে নামকরণ করা হয়েছে; কেননা, সে (কাফির) সকল প্রকার কল্যাণ থেকে দূরে বহুদূরে অবস্থান করে। আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন: يُخۡرِجُ ٱلۡحَيَّ مِنَ ٱلۡمَيِّتِ وَيُخۡرِجُ ٱلۡمَيِّتَ مِنَ ٱلۡحَيِّ (কে) জীবিতকে মৃত থেকে বের করে এবং মৃতকে জীবিত থেকে বের করে; —সূরা ইউনুস: ৩১) এ আয়াতে (তাদের মতে) "الحي" (জীবিত) হল, মুমিন ব্যক্তি, যার মাটিকে কাফিরের মাটি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে; আর "الميت" (মৃত) হল, যাকে জীবিত থেকে বের করা হয়েছে; আর সে হল কাফির, যাকে মুমিনের মাটি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। সুতরাং "الحي" (জীবিত) বলতে মুমিন ব্যক্তি এবং "الميت" (মৃত) বলতে কাফির ব্যক্তিকে বুঝায়। আর (তাদের মতে) এটাই হল আল্লাহ তা‘আলার বাণী: أَوَ مَن كَانَ مَيۡتٗا فَأَحۡيَيۡنَٰهُ (যে ব্যক্তি মৃত ছিল, যাকে আমি পরে জীবিত করেছি ...; —সূরা আল-আন‘আম: ১২২) —এর বাস্তবতা। সুতরাং তার মৃত্যুটা ছিল তার মাটি কাফিরের মাটির সাথে মিশ্রিত হওয়া; আর তার জীবন হল যখন আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নির্দেশের মাধ্যমে তাকে (কাফিরের মাটি থেকে) পৃথক করলেন। সুতরাং এটা ঐটার মত, আল্লাহ তা‘আলা মুমিন ব্যক্তিকে অন্ধকারে প্রবেশের পর জন্মের সময় আলোর দিকে বের করে নিয়ে আসেন; আর কাফির ব্যক্তিকে আলোতে প্রবেশের পর (জন্মের সময়) অন্ধকারের দিকে বের করে নিয়ে আসেন। আর (তাদের মতে) এটাই হল আল্লাহ তা‘আলার বাণী: لِّيُنذِرَ مَن كَانَ حَيّٗا وَيَحِقَّ ٱلۡقَوۡلُ عَلَى ٱلۡكَٰفِرِينَ (যাতে সে সতর্ক করতে পারে জীবিতগণকে এবং যাতে কাফিরদের বিরুদ্ধে শাস্তির কথা সত্য হতে পারে। —সূরা ইয়াসীন: ৭০) —এর বাস্তবতা।”
এই বর্ণনাসমূহ থেকে শিয়াদের ভ্রান্ত আকিদা-বিশ্বাস সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠে যে, কাফিরগণ ও তাদের সাথে সংযুক্ত সকল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অনুসারীগণের (অর্থাৎ- শিয়াগণ ব্যতীত বাকি সকলের) পুণ্যসমূহ রাফেযী শিয়াদেরকে দিয়ে দেয়া হবে; আর তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী তাদের (শিয়াদের) পাপসমূহ বহন করবে কাফিরগণ ও তাদের সাথে সংযুক্ত সকল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অনুসারীবৃন্দ। আর এই বিশ্বাসটি মহান প্রতিপালকের ন্যায় বা ইনসাফের পরিপন্থী; আর সুস্থ বিবেক এবং প্রকৃতি তা অস্বীকার করে। আর আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٞ وِزۡرَ أُخۡرَىٰ﴾ [سورة الأنعام: 164]
“আর কেউ অন্য কারও বোঝা বহন করবে না।” —(সূরা আল-আন‘আম: ১৬৪)
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ كُلُّ نَفۡسِۢ بِمَا كَسَبَتۡ رَهِينَةٌ ٣٨﴾ [سورة المدثر: 38]
“প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ কৃতকর্মের দায়ে আবদ্ধ।” —(সূরা আল-মুদ্দাছছির: ৩৮)
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ فَمَن يَعۡمَلۡ مِثۡقَالَ ذَرَّةٍ خَيۡرٗا يَرَهُۥ ٧ وَمَن يَعۡمَلۡ مِثۡقَالَ ذَرَّةٖ شَرّٗا يَرَهُۥ٨ ﴾ [سورة الزلزة: 7-8]
“কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে সে তা দেখবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে সে তাও দেখবে।” —( সূরা আল-যিলযাল: ৭-৮)
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ وَتُوَفَّىٰ كُلُّ نَفۡسٖ مَّا عَمِلَتۡ﴾ [سورة النحل: 111]
“এবং প্রত্যেককে তার কৃতকর্মের পূর্ণফল দেয়া হবে।” —(সূরা আন-নাহল: ১১১)
এই অর্থে আল-কুরআনের আরও বহু আয়াত এবং অনেক বিশুদ্ধ হাদিস রয়েছে; যেগুলো এই অর্থকে সুস্পষ্ট করে এবং তাদের এই ভ্রান্ত আকিদাকে প্রত্যাখ্যান করে। সুতরাং তাদের এই আকিদাটি বাতিল, কুরআন-সুন্নাহ পরিপন্থি এবং বিবেক ও ইনসাফ বর্জিত।