হোসাইনের শাহাদাতের স্মরণে শোকের মাতম, বক্ষ বিদীর্ণকরণ ও গালে আঘাত করার মধ্যে সাওয়াব প্রত্যাশা:

আর এটাও ইসলামী আকিদা ও বিশ্বাসের (বিপদ ও মুসিবতে ধৈর্য ধারণ) পরিপন্থী। শিয়াগণ শোক, মাতম ও বিলাপের জন্য মাহফিল ও মাজলিস তথা সভা ও সমাবেশের আকিদায় বিশ্বাস করে এবং তারা প্রতি বছর মহররম মাসের প্রথম দশকে আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের বিশ্বাস নিয়ে হোসাইন রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর শাহাদাতের স্মরণে বিভিন্ন মাঠে ও ময়দানে এবং মহাসড়কে বড় বড় শোক মিছিলের আয়োজন করে। অতঃপর তারা তাদের হাত দ্বারা তাদের গালে, বক্ষে ও পিঠে আঘাত করে এবং কাঁদতে কাঁদতে বক্ষ বিদীর্ণ করে। আর বিশেষ করে প্রত্যেক মহররম মাসের দশম তারিখে তারা ইয়া হোসাইন! ... ইয়া হোসাইন! শ্লোগানে শ্লোগানে চীৎকার করে। কারণ, বন্ধুত্বের আবেগ ভর্তি তাদের চীৎকার পৌঁছে যায় পরিপূর্ণতার চরম শিখরে।

আরা তারা ঐ দিন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সারিবদ্ধভাবে কাঠ বা অনুরূপ বস্তু দ্বারা নির্মিত হোসাইনের কফিন বহন করে (র‍্যালিতে) বের হয় এবং সকল প্রকার সৌন্দর্য ও অলঙ্কার দ্বারা সুসজ্জিত ঘোড়া পরিচালিত করে; আর এর দ্বারা তারা কারবালার ময়দানে হোসাইনের ঘোড়া ও তার দলবলের সেই দিনের অবস্থার অভিনয় করে। আর তাদের সাথে এই হৈচৈ ও গোলযোগ অংশগ্রহণের জন্য তারা বড় ধরনের মজুরি দিয়ে শ্রমিক ভাড়া করে; আরা তারা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের গালি দেয় এবং তাদের থেকে নিজেদেরকে মুক্ত মনে করে। আর তাদের এই প্রথম স্তরের জাহেলী কর্মকাণ্ডগুলো আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের সাথে বিবাদ ও বিতর্কের দিকে নিয়ে যায়; বিশেষ করে যখন তারা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের গালি দেয়, নিন্দা করে এবং আবূ বকর, ওমর ও ওসমানের মত খলিফাদের থেকে নিজেদেরকে মুক্ত মনে করে। অতঃপর তাদের কারণেই সৎব্যক্তিদের মধ্যে রক্তপাতের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে বলে মনে করত।

আর শিয়াগণ হোসাইনের মাতম তথা শোক প্রকাশে এইভাবে বহু অর্থ-সম্পদ খরচ করে। কারণ, তারা বিশ্বাস করে যে, এটা তাদের দীনের মূল কর্মকাণ্ড ও মহান প্রতীক তথা নিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত। আর শিয়াগণ তাদের সন্তানদেরকে এই মাতমের সময় কাঁদতে অভ্যস্ত করে তোলে; সুতরাং যখন তারা বড় হয়, তখন তারা যখন ইচ্ছা কাঁদতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। অতএব তাদের কাঁদাটা হল একটা ঐচ্ছিক বিষয়; আর তাদের শোক-দুঃখ হল কৃত্তিম শোক-দুঃখ; অথচ পবিত্র শরীয়ত দৃঢ়ভাবে শোকের মাতম (কান্নাকাটি), বক্ষ বিদীর্ণকরণ ও গালে আঘাত করাকে নিষেধ করেছে এবং আল-কুরআন আদম সন্তানদেরকে ধৈর্য ধারণ করার ও আল্লাহর সিদ্ধান্তের প্রতি সন্তুষ্ট থাকার উপদেশ দিয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱسۡتَعِينُواْ بِٱلصَّبۡرِ وَٱلصَّلَوٰةِۚ إِنَّ ٱللَّهَ مَعَ ٱلصَّٰبِرِينَ ١٥٣ ﴾ [سورة البقرة: 153]

“হে মুমিনগণ! ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে তোমরা সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।” —( সূরা আল-বাকারা: ১৫৩)

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿ وَبَشِّرِ ٱلصَّٰبِرِينَ ١٥٥ ٱلَّذِينَ إِذَآ أَصَٰبَتۡهُم مُّصِيبَةٞ قَالُوٓاْ إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّآ إِلَيۡهِ رَٰجِعُونَ ١٥٦﴾ [سورة البقرة: 155-156]

“তুমি শুভ সংবাদ দাও ধৈর্যশীলগণকে, যারা তাদের উপর বিপদ আপতিত হলে বলে, ‘আমরা তো আল্লাহরই এবং নিশ্চিতভোবে আমরা তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী।” —( সূরা আল-বাকারা: ১৫৫-১৫৬)

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿ وَتَوَاصَوۡاْ بِٱلۡحَقِّ وَتَوَاصَوۡاْ بِٱلصَّبۡرِ ٣ ﴾ [سورة العصر: 3]

“এবং তারা পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় ও পরস্পরকে ধৈর্যের উপদেশ দেয়।” —( সূরা আল-‘আসর: ৩)

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿ وَتَوَاصَوۡاْ بِٱلصَّبۡرِ وَتَوَاصَوۡاْ بِٱلۡمَرۡحَمَةِ ١٧ ﴾ [سورة البلد: 17]

“এবং যারা পরস্পরকে উপদেশ দেয় ধৈর্য ধারণের ও দয়া-দাক্ষিণ্যের।” —( সূরা আল-বালাদ: ১৭)

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿... وَٱلصَّٰبِرِينَ فِي ٱلۡبَأۡسَآءِ وَٱلضَّرَّآءِ وَحِينَ ٱلۡبَأۡسِۗ أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ صَدَقُواْۖ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُتَّقُونَ ١٧٧﴾ [سورة البقرة: 177]

“... অর্থ-সংকটে, দুঃখ-ক্লেশে ও সংগ্রাম-সংকটে ধৈর্য ধারণ করলে। এরাই তারা যারা সত্যপরায়ণ এবং এরাই মুত্তাকী।” —(সূরা আল-বাকারা: ১৭৭)

অতঃপর তাদের মতে নিষ্পাপ ইমামগণ এবং তাদের নিকট যাদের আনুগত্য করা সর্বাবস্থায় ওয়াজিব, তাদের থেকেও এইরূপ সাব্যস্ত হয়েছে। ‘নাহজুল বালাগাহ’ (نهج البلاغة) নামক গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে:

“আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকালের পর তাঁকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উদ্দেশ্য করে বলেন: আপনি যদি দুঃখ প্রকাশ করা থেকে নিষেধ না করতেন এবং ধৈর্য ধারণ করার নির্দেশ না দিতেন, তবে আমরা আপনার শোকে (কাঁদতে কাঁদতে) চোখের পানি শেষ করে ফেলতাম।”

নাহজুল বালাগাহ’ (نهج البلاغة) নামক গ্রন্থে আরও উল্লেখ করা হয়েছে:

“আলী আ. বলেন: যে ব্যক্তি বিপদ-মুসিবতের সময় তার হাতকে উরুতে মারে, সে ব্যক্তির আমল বিনষ্ট হয়ে যায়।”

‘মুন্তাহাল আমাল’ (منتهى الأمال) নামক গ্রন্থের লেখক ফারসি ভাষায় উল্লেখ করেন, যার আরবি (বাংলা) অনুবাদ হল:

“হোসাইন তার বোন যয়নবকে কারবালার ময়দানে বলেছেন: হে আমার বোন! আমি তোমাকে আল্লাহর নামে শপথ দিয়ে বলছি, তোমার কর্তব্য হল এই শপথ রক্ষা করা। সুতরাং যখন আমি নিহত হব, তখন তুমি বক্ষ বিদীর্ণ করো না এবং তুমি তোমার নখ দ্বারা তোমার চেহারায় আঁচড় কাটবে না। আর আমার শাহাদাতের কারণে তুমি ধ্বংস ও মৃত্যুকে ডাকবে না।”[1]

আবূ জাফর আল-কুমী বর্ণনা করেন:

“আমীরুল মুমিনীন আ. তাঁর সাথীদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময় বলেন: তোমরা কালো পোষাক পরিধান করো না। কারণ, এটা ফেরাউনের পোষাক।”[2]

‘তাফসীর আস-সাফী’-এর মধ্যে- ﴿ وَلَا يَعۡصِينَكَ فِي مَعۡرُوفٖ ﴾ (তারা সৎকাজে তোমাকে অমান্য করবে না, —সূরা আল-মুমতাহিনা: ১২) -আয়াতের নীচে বর্ণিত আছে: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীদেরকে আনুগত্যের শপথ দেয়ার সময় বলেছেন যে, তারা যেন কালো পোষাক পরিধান না করে, বক্ষ বিদীর্ণ না করে এবং ধ্বংসকে আহ্বান না করে। আর আল-কুলাইনী’র ‘ফুরু‘উল কাফী’ (فروع الكافي) নামক গ্রন্থে বর্ণিত আছে: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাইয়্যেদা ফাতেমা যোহরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন: “যখন আমি মৃত্যুবরণ করব, তখন তুমি তোমার চেহারায় আঁচড় কাটবে না, ধ্বংসকে ডাকবে না এবং আমার নিকট বিলাপরত অবস্থা দাঁড়াবে না।”

সেখানে শিয়াদের কিতাবসমূহে অনেক বেশি বর্ণনা (রেওয়ায়েত) বর্ণিত রয়েছে, যাতে বিপদ-মুসিবত ও তার উপর অধৈর্য হয়ে বিলাপ করা, ধ্বংস ও মৃত্যুকে ডাকা, বক্ষ বিদীর্ণকরণ, গালে আঘাত করা ইত্যাদি ধরনের দুঃখ প্রকাশ থেকে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে। এখানে আমি তাদের বর্ণনাসমূহ থেকে শুধু কয়েকটি নমুনা করেছি। আর যিনি এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে আগ্রহী, তার উচিত হবে আমার ‘হাকীকাতুল মা’তম’ (حقيقة المأتم) অধ্যয়ন করা; তাতে আমি বিস্তারিত আলোচনা করেছি এবং তাদের কিতাবসমূহ থেকে বর্ণনাসমূহ (রেওয়ায়েতসমূহ) উল্লেখ করেছি তাদের এই শোক-আহাজারি ও সভা-সমাবেশসমূহের জওয়াব স্বরূপ, যেগুলো ‘ইসলামে ধৈর্য’ (الصبر في الإسلام)-এই আকিদা-বিশ্বাসের পরিপন্থী।

আমার ব্যস্ততার মাঝে যতটুকু সম্ভব হয়েছে, দ্বাদশ জাফরীয়া রাফেযীয়া শিয়াদের বাতিল (অসার) আকিদাসমূহ থেকে ততটুকু পরিমাণ আমি আল্লাহর মুমিন বান্দাদের সামনে পেশ করেছি। আর আমি প্রতিটি অধ্যায়ে তাদের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থপঞ্জি থেকে শুধু স্বল্প সংখ্যক নমুনা উল্লেখ করেছি। সুতরাং যিনি আরও বেশি জানতে ও বুঝতে চান, তার উচিত তিনি যেন স্বয়ং শিয়াদের মূল গ্রন্থসমূহ অধ্যয়ন করেন। কারণ, এই গ্রন্থগুলো এ ধরনের বক্তব্য দ্বারা, এমনকি তার চেয়ে জঘন্য বক্তব্যসমষ্টি দ্বার ভরপুর।

পরিশেষে মহান আল্লাহ তা‘আলার নিকট প্রার্থনা করছি, তিনি যেন তাঁর অনুগ্রহ ও ইহসান দ্বারা শিয়াদের মিথ্যা বর্ণনাসমূহ, আকিদা-বিশ্বাস এবং তাদের পথভ্রষ্টতা থেকে মুসলিম সম্প্রদায়কে হেফাজত করেন। কারণ, তা সৎকর্মসমূহ নষ্ট করবে, মুমিন ব্যক্তিকে ঈমান শূন্য করবে এবং তাকে ইসলাম থেকে খারিজ (বের) করে দেবে। তাঁর নিকট আরও প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদেরকে সরল-সঠিক পথ প্রদর্শন করেন এবং আমাদেরকে সুস্পষ্ট সত্য বিধানের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখেন; আর তিনি যেন আমাদেরকে মুক্তিপ্রাপ্ত সাহায্যপ্রাপ্ত সুস্পষ্ট হকের উপর প্রতিষ্ঠিত দল (ফিরকা) আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আকিদা-বিশ্বাসের উপর সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত রাখেন। তাঁর নিকট আরও প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদেরকে এমন কথা, কাজ, নিয়ত ও হেদায়েত অর্জনের তাওফিক দান করেন, যা তিনি ভালবাসেন এবং পছন্দ করেন। আর তিনি সকল বস্তুর উপর ক্ষমতাবান।

و صلى الله على محمد و آله و أصحابه و أزواجه و أتباعه أجمعين و بارك و سلم تسليما ... و آخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.

(আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর পরিবার-পরিজন, সঙ্গী-সাথীগণ, স্ত্রীগণ এবং সকল অনুসারীর উপর রহমত, বরকত ও শান্তি বর্ষণ করুন ... আর আমাদের সর্বশেষ দাবি, আবেদন ও নিবেদন হল, সকল প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য নিবেদিত ...)।

মুহাম্মদ আবদুস সাত্তার আত-তুনসাবী

০৪. ১১. ১৪০৩ হিজরি।

>
[1] মুন্তাহাল আমাল (منتهى الأمال), প্রথম খণ্ড, পৃ. ২৪৮

[2] আবূ জাফর মুহাম্মদ ইবন বাবুইয়া আল-কুমী, মান লা ইয়াহদুরুহুল ফকিহ (من لا يحضره الفقيه), পৃ. ৫১