البداء শব্দের অর্থ গোপন থাকার পরে প্রকাশ হওয়া; [কুরআনুল কারীমে এ শব্দটি সৃষ্টির গুণ হিসেবে এসেছে, স্রষ্টার জন্য নয়] যেমন আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
﴿ وَبَدَا لَهُم مِّنَ ٱللَّهِ مَا لَمۡ يَكُونُواْ يَحۡتَسِبُونَ ٤٧ ﴾ [سورة الزمر: 47]
“এবং তাদের (কাফেরদের) জন্য আল্লাহর নিকট থেকে এমন কিছু প্রকাশিত হবে, যা তারা কল্পনাও করেনি। —(সূরা আয-যুমার: ৪৭)
অথবা শব্দটির অর্থ: নতুন রায় বা সিদ্ধান্তের উৎপত্তি যা পূর্বে ছিল না; [কুরআনুল কারীমে এ শব্দটি সৃষ্টির গুণ হিসেবে এসেছে, স্রষ্টার জন্য নয়] যেমন আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
﴿ثُمَّ بَدَا لَهُم مِّنۢ بَعۡدِ مَا رَأَوُاْ ٱلۡأٓيَٰتِ لَيَسۡجُنُنَّهُۥ حَتَّىٰ حِينٖ ٣٥﴾ [سورة يوسف: 35]
“নিদর্শনাবলী দেখার পর তাদের [মিসর রাজের সভাসদদের] মনে হল যে, তাকে কিছু কালের জন্য কারারুদ্ধ করে রাখতে হবে।” — (সূরা ইউসূফ: ৩৫)
আর البداء (আল-বাদা) শব্দের দু’টি অর্থই প্রথমে মূর্খতা এবং পরে জ্ঞান প্রকাশ বা হাসিল হওয়াকে আবশ্যক করে তোলে; আর উভয়টিই আল্লাহর ক্ষেত্রে অসম্ভব। কারণ, আল্লাহ তা‘আলার জ্ঞান সর্বপ্রাচীন ও চিরস্থায়ী। কেননা, আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَعِندَهُۥ مَفَاتِحُ ٱلۡغَيۡبِ لَا يَعۡلَمُهَآ إِلَّا هُوَۚ وَيَعۡلَمُ مَا فِي ٱلۡبَرِّ وَٱلۡبَحۡرِۚ وَمَا تَسۡقُطُ مِن وَرَقَةٍ إِلَّا يَعۡلَمُهَا وَلَا حَبَّةٖ فِي ظُلُمَٰتِ ٱلۡأَرۡضِ وَلَا رَطۡبٖ وَلَا يَابِسٍ إِلَّا فِي كِتَٰبٖ مُّبِينٖ ٥٩ ﴾ [سورة النمل: 59]
“অদৃশ্যের চাবিকাঠি তাঁরই নিকট রয়েছে, তিনি ব্যতীত অন্য কেউ তা জানে না। জলে ও স্থলে যা কিছু আছে, তা তিনিই অবগত; তাঁর অজ্ঞাতসারে একটি পাতাও পড়ে না। মাটির অন্ধকারে এমন কোন শস্যকণাও অঙ্কুরিত হয় না, আর রসযুক্ত কিংবা শুষ্ক এমন কোন বস্তু নেই, যা সুস্পষ্ট কিতাবে নেই”। — (সূরা আল-আন‘আম: ৫৯)
আর শিয়াদের মতে, البداء তথা অজানার পরে জানার বিষয়টি আল্লাহ তা‘আলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য; যেমন তাদের মৌলিক গ্রন্থসমূহ থেকে উদ্ধৃত নিম্নোক্ত বক্তব্যসমূহ তাই প্রমাণ করে:
মুহাম্মদ ইবন ইয়াকুব আল-কুলাইনী তার ‘উসুলুল কাফী’ গ্রন্থের মধ্যে البداء -এর বিষয়ে একটি পরিপূর্ণ অধ্যায়ের উল্লেখ করেছেন এবং তার নাম দিয়েছেন "باب البداء"; আর তাতে তিনি অনেকগুলো বর্ণনা নিয়ে এসেছেন। তার মধ্য থেকে কিছু বর্ণনা আমরা উল্লেখ করছি:
যুরারা ইবন আ‘ইউন থেকে বর্ণিত, তিনি (জাফর সাদেক অথবা মুসা কাযেম) তাদের একজন থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: البداء-এর মত অন্য কোন কিছুকে আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করে কেউ আল্লাহর ইবাদত করতে পারে নি। [অর্থাৎ আল্লাহর জন্য ‘বাদা’ সাব্যস্ত করার মাধ্যমেই সবচেয়ে বড় ইবাদাত সম্পন্ন হয়, নাউযুবিল্লাহ]
আর ইবনু আবি উমাইয়েরের এক বর্ণনায় আছে, তিনি হিশাম ইবন সালেম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি আবূ আবদিল্লাহ আ. থেকে বর্ণনা করেন: আল্লাহ তা‘আলাকে البداء- ‘বাদা’ সাব্যস্ত করার মত অন্য কোন কিছু দিয়ে সম্মানিত করা হয় না।
আর মারাযেম ইবন হাকিম থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি আবূ আবদিল্লাহ আ.-কে বলতে শুনেছি: আল্লাহর জন্য পাঁচটি বিষয়ের স্বীকৃতি দেয়ার পূর্বে কোন নবী ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারত না; সেগুলো হল: البداء বা (কোন গোপন কিছু প্রকাশ পাওয়া) المشيئة বা (ইচ্ছা) সিজদা, ইবাদত বা দাসত্ব এবং আনুগত্য।
রাইয়ান ইবন সালত থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি রেযা আ.-কে বলতে শুনেছি: আল্লাহ যত নবী প্রেরণ করেছেন, তাদের প্রত্যেকেই মদকে নিষিদ্ধ করত এবং আল্লাহর জন্য البداء-এর স্বীকৃতি প্রদান করত।
কুলাইনী নিজেও বলেন: আবূ জাফরের পরে আল্লাহর মনে হল আবূ মুহাম্মদের কথা, যা তিনি আগে জানতেন না; যেমনিভাবে তাঁর মনে হল ইসমাঈল চলে যাওয়ার পর মূসার কথা[1], যখন তার অবস্থা সম্পর্কে তিনি পরিষ্কার ধারণা পেলেন। আর তিনি (আল্লাহ) হলেন তেমন, যেমন তোমার নিকট তোমার মনে যা উদয় হয়; যদিও বাতিলগণ তা অপছন্দ করুক। আর আবূ মুহাম্মদ আমার ছেলে এবং আমার পরবর্তী বংশধর। তার নিকট প্রয়োজনীয় জ্ঞান রয়েছে এবং তার সাথে রয়েছে ইমামতের উপকরণ।[2] আর এভাবেই শি‘আরা আল্লাহর উপর ও তাদের ইমামদের উপর মিথ্যারোপ করে; তারা আল্লাহর ব্যাপারে অন্যায়ভাবে জাহেলী ধারণা পোষণ করে। আর তারা দাবি করে যে, আল্লাহ আবূ জাফর (মুহাম্মাদ ইবন আলী)কে ইমাম বানানোর ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন; অতঃপর সে যখন ইমাম হওয়ার পূর্বেই মারা গেল, তখন মহান ক্ষমতাধর আল্লাহর মনে হল যে, ইমাম হবে আবূ মুহাম্মদ; অতঃপর তিনি তাই করলেন। আর এটা অনুরূপ যে, আল্লাহ চেয়েছিলেন ইসমাঈলকে ইমাম বানাতে, অতঃপর (নাউযুবিল্লাহ) আল্লাহর কাছে নতুন কিছু প্রকাশ পেল; তখন তিনি পূর্ববর্তী রায়কে পরিবর্তন করেছেন এবং মূসা আল-কাযেমকে মানুষের ইমাম বানিয়েছেন। আর এভাবেই তারা তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা’র উপর মিথ্যারোপ করেছে। সুতরাং তারা যা বলে, তার কারণে তাদের ধ্বংস অনিবার্য।
তারা ভুলে গেছে -আল্লাহ যে তাদেরকে অভিশাপ দিন- তাদের এই মিথ্যা বক্তব্যসমূহের ফলে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি অজ্ঞতার সম্পর্ক আবশ্যক হয়ে পড়ে; আর তা স্পষ্ট কুফরী।
আর কুলাইনী আবূ হামযা আস-সুমালী থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন আমি আবূ জাফর আ.-কে বলতে শুনেছি: হে সাবিত! নিশ্চয় আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা এই বিষয়ের (মাহাদী আগমনের) সময় নির্ধারণ করেছেন সত্তর বছরের মধ্যে। অতঃপর যখন হোসাইন আ. নিহত হলেন, তখন জগতবাসীর উপর আল্লাহর প্রচণ্ড রাগ হয় এবং তার আগমনের সময়কাল একশত চল্লিশ[3] বছরে পিছিয়ে দেন। অতঃপর আমরা তোমাদের নিকট তার বর্ণনা দিলাম এবং তোমরাও এই ঘটনা প্রচার করে দিলে। সুতরাং তোমরা গোপন বিষয় স্পষ্ট করে দিলে; আর আল্লাহ তা‘আলা এর পরে আমাদের জানা মতে তার আগমনের কোন সময় নির্ধারণ করেননি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ يَمۡحُواْ ٱللَّهُ مَا يَشَآءُ وَيُثۡبِتُۖ وَعِندَهُۥٓ أُمُّ ٱلۡكِتَٰبِ ٣٩﴾ [سورة الرعد: 39]
“আল্লাহ যা ইচ্ছা তা নিশ্চিহ্ন করেন এবং যা ইচ্ছা তা প্রতিষ্ঠিত রাখেন; আর তাঁরই নিকট রয়েছে উম্মুল কিতাব।” —(সূরা আর-রা‘দ: ৩৯) আবূ হামযা বলেন: আমি এই ঘটনাটি আবূ আবদিল্লাহ আ.-এর নিকট বর্ণনা করলাম; তখন তিনি বললেন: বিষয়টি এই রকমই ছিল।[4]আর তার কথায় ‘এই বিষয় দ্বারা’ (بهذا الأمر) উদ্দেশ্য হল, ইমাম মাহদী’র আত্মপ্রকাশ। অতঃপর তাদের এই সকল কথা এবং দাবিসমূহ সুস্পষ্ট ভ্রান্ত দাবি ও অসার। কারণ, البداء-এর আকিদা (নাউযুবিল্লাহ) এই কথা আবশ্যক করে তোলে যে, আল্লাহ তা‘আলার অবস্থা হল এমন, এসব বিষয় তিনি জানতেন না, যেগুলো পরবর্তীতে এসেছে। অতঃপর যখন তা প্রকাশ পেল এবং আল্লাহ তা‘আলা তা জানতে পারলেন, তখন তিনি তাঁর পুরাতন রায়কে পরিবর্তন করলেন এবং নতুন প্রেক্ষাপট ও অবস্থার আলোকে নতুন রায় বা সিদ্ধান্ত প্রস্তুত করলেন। অথচ আল্লাহ তা‘আলার প্রতি অজ্ঞতার সম্পর্ক জুড়ে দেয়াটা স্পষ্ট কুফরী, যা যথাস্হানে আলোচিত হয়েছে।
[2] উসুলুল কাফী (أصول الكافي), পৃ. ৪০
[3] অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার নিকট এই জ্ঞান ছিল না যে, হোসাইন শীঘ্রই মারা যাবে; অতঃপর যখন তিনি তা জানতে পারলেন, তখন তিনি বিষয়টিকে বিলম্বিত করে দিলেন। (আল্লাহ তাদেরেকে ধ্বংস করুন)।
[4] উসুলুল কাফী (أصول الكافي), পৃ. ২৩২; (ভারত প্রকাশনা)।