শির্ক কী ও কেন? চতুর্থ পরিচ্ছেদ ড. মুহাম্মদ মুয্‌যাম্মিল আলী ১৮ টি
প্রাক ইসলামী যুগে আরব জনপদে প্রচলিত শির্ক

ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রাসূল হয়ে প্রেরিত হওয়ার প্রাক্কালে আরব দ্বীপের অধিবাসীদের অধিকাংশ লোকেরাই ‘আরবুল ‘আরিবাহ ও ‘আরবুল মুসতা‘রিবাঃ[1] এর অধঃস্তন বংশধর ছিল। মক্কা নগরী ও এর পার্শ্ববর্তী স্থানসমূহে আল- ‘আরাবুল মুসতা‘রিবাঃদের বসবাস ছিল। তবে আল-‘আরাবুল ‘আরিবাহ বলে পরিচিত লোকেরাই হলো আরব দ্বীপের আদি অধিবাসী এবং ‘আরাবুল মুসতা‘রিবাহ বলে পরিচিতরা হলো সেখানে অভিবাসনকারী। এদের প্রথম পুরুষ যিনি এ দ্বীপে অভিবাসন গ্রহণ করেন, তিনি হলেন ইসমাঈল আলাইহিস সালাম। তাঁকে আমাদের আদি পিতা ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম তাঁর মাতাসহ ছোট বেলায় কা‘বা শরীফের পার্শ্বে আল্লাহর আদেশে রেখে গিয়েছিলেন।

ইসমাঈল আলাইহিস সালাম বড় হয়ে জনগণকে তাঁর পিতা ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম-এর দ্বীনের প্রতি আহ্বান জানান। ফলে সে সময়ের অধিকাংশ লোকেরাই তাঁর অনুসারী হয়ে যেয়ে মহান আল্লাহর উলূহিয়্যাত ও রুবূবিয়্যাতে সম্পূর্ণরূপে তাওহীদে বিশ্বাসী হয়ে যায়।[2] যুগের আবর্তনে যখন তাদের মধ্যে কয়েক প্রজন্ম অতিক্রান্ত হয়ে যায় এবং দীর্ঘদিন যাবৎ ধর্ম সম্পর্কে তারা নতুন করে কোনো শিক্ষা পায়নি, তখন তারা ধর্মের অনেক বিষয়াদি ধীরে ধীরে ভুলতে থাকে। এক পর্যায়ে তাদের মাঝে শুধু তাওহীদী বিশ্বাস এবং ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম-এর স্মৃতি বিজড়িত কিছু ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ও নিদর্শনাদি ব্যতীত আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে নি।

অবশেষে তারা তাওহীদী বিশ্বাস থেকেও বিচ্যুত হয়ে মূর্তি পূজা করার ফলে মুশরিকে পরিণত হয়। তাদের মাঝে প্রতিমা পূজার মাধ্যমে শির্কী কর্মকাণ্ডের সূচনা হয় কা‘বা শরীফের সম্মানে এর পার্শ্ব থেকে সংগৃহীত পাথরের চার পার্শ্বে ত্বওয়াফ করার মাধ্যমে, যা তারা মক্কা থেকে দূর-দূরান্তে হিজরত করার সময় সাথে করে নিয়ে অবতরণ স্থলের এক পার্শ্বে স্থাপন করতো।[3] তাদের মাঝে ইব্রাহীম ও ইসমাঈল আলাইহিস সালাম-এর ধর্মের কিছু বিষয়াদি যেমন : কা‘বা শরীফের সম্মান করা, এর ত্বওয়াফ, হজ্জ ও ‘উমরা করা, সাফা ও মারওয়াহ পর্বতদ্বয়ে সা‘য়ী করা, আরাফা ও মুযদলিফায় অবস্থান গ্রহণ করা, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে উট ও বকরী কুরবানী বা উৎসর্গ করা...ইত্যাদি কর্ম প্রচলিত ছিল। যদিও এ সব ক্ষেত্রে তারা নিজ থেকে কিছু বিষয়াদি সংযোজন ও বিয়োজন করেছিল যা মূল ধর্মীয় কর্মের অন্তর্ভুক্ত ছিল না।[4]

>
[1]. আল-‘আরবুল ‘আরিবাহ (العرب العاربة) হচ্ছে, ইয়া‘রুব ইবন ইয়াশজান (يعرب بن يشجان) এর বংশধর, আর আল- ‘আরাবুল মুসতা‘রিবাহরা (العرب المستعربة) হলো ইসমাঈল ইবন ইব্রাহীম -এর বংশধর। দেখুন : আল-মুবারকপুরী, সফ্ইউর রহমান, আর-রাহীক্বুল মাখতূম; (রিয়াদ : দারুস সালাম, সংস্করণ বিহীন, ১৯৯৪ খ্রি.), পৃ. ১৬; ইবনে হিশাম, প্রাগুক্ত; ১/৭৭।

[2]. তদেব; পৃ. ৩৫।

[3]. ইবন কাছীর, আল-বেদায়াতু ওয়ান নেহায়াহ; (বৈরুত : মাকতাবাতুল মা‘আ-রিফ, ৬ষ্ঠ সংস্করণ, ১৯৮৫ খ্রি.), ১/১৮৮।

[4]. ইবনে কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ, এগাছাতুল লহফান; ২/১৬৫-১৬৬। (সংক্ষিপ্তাকারে)
মক্কাবাসীদের ধর্মীয় অবস্থার অবনতি

এরপর তাদের ধর্মীয় অবস্থার আরো অবনতি ঘটে। তাদের মাঝে মূর্তিপূজার মাধ্যমে শির্কী কর্মকাণ্ড শুরু হয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রেসালত লাভের প্রায় ৩০০ বছর পূর্বে[1] খুযা-‘আহ গোত্র প্রধান ও মান্যবর ব্যক্তিত্ব ‘আমর ইবন লুহাই এর মাধ্যমে। ঐতিহাসিক ইবন হেশামের বর্ণনামতে ‘আমর ইবন লুহাই কোনো উপলক্ষে মক্কা থেকে সিরিয়া গমন করে সেখানকার লোকদেরকে কতিপয় মূর্তির পূজা করতে দেখে বলে : এ মূর্তিগুলো কী, যাদের আপনারা উপাসনা করছেন?

উত্তরে লোকেরা বললো : এদের কাছে বৃষ্টি চাইলে এরা আমাদেরকে বৃষ্টি দান করে, সাহায্য চাইলে তারা আমাদের সাহায্য করে। এ কথা শুনে ‘আমর ইবন লুহাই বললো : এদের মধ্য থেকে একটি মূর্তি আমাকে দান করুন, আমি সেটিকে আরব দেশে নিয়ে যাব, ফলে আরবরা এর উপাসনা করবে। এতে লোকেরা তাকে ‘হুবল’ নামের একটি মূর্তি দান করে। অতঃপর সে তা নিয়ে মক্কায় আগমন করে এবং তা কা‘বা শরীফের নিকটতম এক স্থানে সম্মানের সাথে স্থাপন করার পর আরব জনগণকে এর উপাসনা ও সম্মান করার জন্য নির্দেশ করে।[2]

এ ‘আমর ইবন লুহাই ছিল জিন সাধক। সে তার অনুগত জিন এর পরামর্শ অনুযায়ী নূহ আলাইহিস সালাম-এর জাতির উপাস্য সেই মূর্তিগুলো জিদ্দা এলাকা থেকে মাটি খনন করে বের করে নিয়ে আসে। সেগুলোকে নূহ আলাইহিস সালাম-এর সময়কার প্রলয়ঙ্করী বন্যা ও তুফান এতদঅঞ্চলে বহন করে নিয়ে এসেছিল। ধীরে ধীরে বন্যার পানি নেমে যাবার সময় এগুলো জিদ্দা এলাকার চরাঞ্চলে আটকা পড়েছিল এবং পরবর্তিতে তা বালুর নিচে চাপা পড়ে গিয়েছিল।

‘আমর ইবন লুহাই তার অনুগত জিনের পরামর্শে এগুলোকে বের করে নিয়ে এসে হজ্জের মৌসুমে ‘আরব জনগণকে এগুলোর উপাসনা করার প্রতি আহ্বান জানায়। লোকেরা এতে তার আনুগত্য করলে সে বিভিন্ন গোত্রের মাঝে তা বন্টন করে দেয়।[3] সে অনুযায়ী ‘ওয়াদ’ (وَدْ) নামের মূর্তিটি ছিল দাওমাতুল জানদাল এলাকার ‘কালব’ গোত্রের নিকট, সুয়া‘ (سُوَاع) নামের মূর্তিটি ছিল ‘হুজায়েল’ গোত্রের নিকট, ‘য়াগুছ’ (يغوث) নামের মূর্তিটি ছিল ‘মুরাদ’ গোত্রের নিকট, ‘ইয়াউক’ (يعوق) নামের মূর্তিটি ছিল হামাদন গোত্রের নিকট, আর ‘নাছর’ (نسر) নামের মূর্তিটি ছিল ইয়ামনের ‘হিময়ার’ গোত্রের নিকট।[4] এ পাঁচটি মূর্তির পাশাপাশি ‘আরব জনপদে আরো অসংখ্য মূর্তি ছিল।

>
[1]. শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী, আল-ফাওযুল কাবীর; পৃ. ৫।

[2]. ইমাম বুখারী, প্রাগুক্ত; কিতাবুত তাফসীর, বাব নং- ৩৯৮, ওয়ালা তাজারুন্না ওয়াদ্দান... হাদীস নং ৪৬৩৬, ৪/১৮৭৩; ইবনে হিশাম, প্রাগুক্ত; ১/৭৬; ইবনে কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ, এগাছাতুল লহফান; ২/১৬৫;ইবনে কাছীর, আল-বেদায়াতু ওয়ান নেহায়াহ; ১/১৮৮।

[3]. ইবনে কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ, এগাছাতুল লহফান; ২/১৬৩-১৬৪ ।

[4]. ইবনে হিশাম, প্রাগুক্ত; ১/৮৭; ইবনে কাছীর, তাফছীরুল ক্বুরআনিল ‘আযীম; ৪/৪৫৪-৪৫৫; ইবনে কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ, এগাছাতুল লহফান; ২/১৬২-১৬৪।
‘আরব জনপদে উল্লেখযোগ্য মূর্তিসমূহ

আরবের লোকেরা ছোট এবং বড় বিভিন্ন রকমের মূর্তিদেরকে আল্লাহ তা‘আলার রুবূবিয়্যাত ও উলূহিয়্যাতের বৈশিষ্ট্যে সমকক্ষ বানিয়ে নিয়েছিল। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি মূর্তি নিম্নরূপ :

লাত :

এটি ‘ত্বায়েফ’ নামক স্থানের ‘ছক্বীফ’ গোত্রের প্রসিদ্ধ এক দেবী মূর্তির নাম। এর মাধ্যমে তারা কুরায়েশ গোত্রের উপর গর্ব করতো। ইমাম ইবনে কাছীর এর বর্ণনা মতে এটি ছিল একটি সাদা পাথরের মূর্তি। এর মধ্যে একটি ঘরের চিত্র অংকিত ছিল। কা‘বা ঘরের ন্যায় এটিকে তারা পর্দা দ্বারা আবৃত করে রেখেছিল। অনুরূপভাবে তারা কা‘বা শরীফের প্রাঙ্গণের ন্যায় এর প্রাঙ্গণকেও পবিত্র জ্ঞান করতো। ছক্বীফ গোত্র থেকেই এর খাদেম নিয়োগ করা হতো। ইমাম ইবনে জারীর এর বর্ণনা মতে তারা ‘আল্লাহ’ শব্দের স্ত্রী লিঙ্গ হিসেবে এর নাম ‘লাত’ রেখেছিল।[1] ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, সেখানে সুদূর অতীতে একটি চারকোণা বিশিষ্ট পাথরে বসে একজন ইয়াহূদী ব্যক্তি হাজীদের জন্য ‘সাতু’ তৈরী করে খেতে দিত। লোকটি সেখানে মৃত্যুবরণ করলে তার সততা ও ভাল কর্মের জন্য লোকেরা এ-পাথরকে সম্মান করে এর পার্শ্বে অবস্থান গ্রহণ করতে আরম্ভ করে।[2] কুরায়েশ এবং সমগ্র আরব গোত্রের লোকেরাও একে পূজা ও সম্মান করতো।[3]

উযযা :

‘উয্যা’ নামের এ দেবীটি মক্কার নিকটবর্তী ‘নাখলাহ’ নামক স্থানে স্থাপিত ছিল। এটা কুরায়েশ গোত্রের দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে বড়মাপের দেবতা ছিল।[4] কুরায়েশরা কা‘বা শরীফের হরমের ন্যায় এর জন্যও একটি হরম (পবিত্র এলাকা) নির্ধারণ করেছিল। সম্ভবত এটি ছিল কুরায়েশদের যুদ্ধের দেবী। তাদের সাথে কারো যুদ্ধ হলে তারা এ দেবীর কাছে যুদ্ধে জয় কামনা করতো। সে জন্যই উহুদ যুদ্ধের সময় আবূ সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহু মুসলিমদের লক্ষ্য করে বলেছিলেন : ‘‘আমাদের উয্যা দেবতা আছে, তোমাদের কোনো উয্যা নেই।’’[5] মূলত এ দেবতাটি ছিল বত্নে নাখলাহ নামক স্থানের তিনটি ছোট বাবলা গাছের সমষ্টি।[6] এ গাছগুলোতে একটি মহিলা জিন থাকতো। এর উপাসকরা তা বুঝতে না পারলেও এ জিনই এর উপাসকদেরকে এ গাছের মধ্য থেকে অলৌকিকভাবে শব্দ শুনাতো।[7] মক্কা বিজয়ের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খালিদ ইবন আল-ওয়ালীদ রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে তা ধ্বংস করার জন্য প্রেরণ করেছিলেন। তিনি পর পর তৃতীয় গাছটি কাটতে উদ্যত হলে আকস্মিকভাবে সে জিনটি ঘাড়ে হাত রেখে, দাঁত কটমট করে, এলোমেলো কেশে কুৎসিত হাবশী মহিলার আকৃতিতে আত্ম প্রকাশ করে। খালেদ রাদিয়াল্লাহু আনহু তরবারী দিয়ে তার ঘাড়ে আঘাত করলে তা দ্বিখণ্ডিত হয়ে হঠাৎ একটি কবুতরে রূপান্তরিত হয়ে মরে যায়। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট ফিরে এসে সর্বশেষ গাছ কাটতে গিয়ে তিনি যা দেখলেন তা তাঁকে জানালেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-তা শুনে বললেন :

«تِلْكَ الْعُزَّى وَ لاَ عُزَّى بَعْدَهَا لِلْعَرَبِ»

‘‘এ হাবশী মহিলাই মূলত ‘উয্যা’ ছিল, আরবদের জন্য এরপর আর কোন উয্যা থাকবে না।’’[8] অপর এক বর্ণনামতে উয্যা নামের এ দেবীটি একটি সাদা পাথর ছিল।[9]

মানাত :এটি প্রাচীন দেব-দেবীদের মাঝে অন্যতম একটি দেবীর নাম। সম্ভবত এটি ছিল কুরবানীর দেবী। এর নামে পশুর রক্ত প্রবাহিত করা হতো।[10] এটাকে ভাগ্যদাতা ও মৃত্যুদানকারী বলে মনে করা হতো।[11] মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী ‘কুদায়েদ’ নামক স্থানে এটি স্থাপিত ছিল। হজ্জ উপলক্ষে ‘ইয়াসরিব’ তথা মদিনার আওস এবং খযরজ গোত্রদ্বয়ের লোকেরা এসে এর চার পার্শ্বে ত্বওয়াফ করতো।[12] এতে (শয়তানের পক্ষ থেকে নিযুক্ত) একটি মহিলা জিন থাকতো এবং এ জিনই এর পূজারীদেরকে নানা রকম অলৌকিক কর্মকাণ্ড করে দেখাতো। মক্কা বিজয়ের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশে সা‘য়ীদ ইবন যায়দ আল-আশহালী রাদিয়াল্লাহু আনহু এ মূর্তিটি ধ্বংস করতে যান। এ সময় সে জিনটি কালো বর্ণের একটি মহিলা আকৃতিতে উলঙ্গ অবস্থায় এলোমেলো কেশে আত্মপ্রকাশ করে নিজের জন্য ধ্বংসের আহ্বান করে বুক চাপড়াতে ছিল। সা‘য়ীদ রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে এ অবস্থাতেই হত্যা করেন।[13]

>
[1]. ইবনে কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম; ৪/২৫।

[2]. তদেব।

[3]. ইবনে কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ, এগাছাতুল লহফান; ২/১৬৮; ইবনে জারীর আত-ত্ববারী, প্রাগুক্ত; ২৭/৫৯।

[4]. ইবনে হিশাম, প্রাগুক্ত; ১/৮৪; ড. ফারুক হামাদাহ, আল-ওয়াসিয়্যাতুন নববীয়্যাহ; (আল-মাগরিব : দারুছ ছেক্বাফাহ, ১ম সংস্করণ, ১৯৮৩ খ্রি.), পৃ. ১৬।

[5]. মাওলানা সয়ৈদ সুলায়মান নদভী, প্রাগুক্ত; পৃ. ৪১৮।

[6]. ড. হাসান ইব্রাহীম হাসান, তারীখুল ইসলাম; (কায়রো : মাকতাবাতুন নাহদাতিল মিশরিয়্যাঃ, ১৪ সংস্করণ, ১৯৯৬ খিষ্টাব্দ.), পৃ. ৬১; মাওলানা সৈযদ সুলায়মান নদভী, তারীখু আরদিল ক্বুরআন; (করাচী : দারুল এশা‘আত, ১ম সংস্করণ, তারিখ বিহীন), পৃ. ৪২০; ইবনে জারীর আত-ত্ববারী, প্রাগুক্ত; ২৭/৫৯।

[7]. ইবনুল জাওযী, প্রাগুক্ত ; পৃ. ৬৮।

[8]. ইবনে কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ, এগাছাতুল লহফান; ২/১৬৮-১৬৯; আল-মুবারক পূরী, প্রাগুক্ত; পৃ. ৪০৯-৪১০।

[9]. وقال آخرون كانت العزى حجرا أبيض وقال آخرون كان بيتا بالطائف تعبده ثقيف -দেখুন : ইবনে জারীর আত-ত্ববারী, প্রাগুক্ত; ২৭/৫৯।

[10]. মাওলানা সৈয়দ সুলায়মান নদভী, তারীখু আরদিল কুরআন; (করাচী : দারুল এশা‘আত, সংস্করণ বিহীন, তারিখ বিহীন), পৃ. ৪১৮।

[11] . তদেব।

[12] . তদেব।

[13]. সফিয়্যুর রহমান মুবারকপুরী, প্রাগুক্ত; পৃ. ৪১০; -আত-ত্ববারী, আবু জা‘ফর মুহাম্মদ ইবনে জারীর, প্রাগুক্ত ; ২৭/৫৯।
লাত উযযা ও মানাতকে নারীর নামে নামকরণ করার কারণ

লাত, উয্যা ও মানাত এগুলো তিনটি নারী দেবীর নাম। এগুলো মুশরিকদের কল্যাণ ও অকল্যাণ করতে পারে এ ধারণার ভিত্তিতে তারা এদেরকে সব সময় কল্যাণার্জন এবং অকল্যাণ দূরীকরণের জন্য আহ্বান করতো। তাদের এ আহ্বান সম্পর্কে আল্লাহ বলেন :

﴿ إِن يَدۡعُونَ مِن دُونِهِۦٓ إِلَّآ إِنَٰثٗا وَإِن يَدۡعُونَ إِلَّا شَيۡطَٰنٗا مَّرِيدٗا ١١٧ ﴾ [النساء: ١١٧]

‘‘তারাতো আল্লাহকে ব্যতীত শুধু নারীদের আহ্বান করে, আসলে তারা কেবল অবাধ্য শয়তানকেই আহ্বান করে’’।[1]

এখানে ‘ইনাসান’ বলে লাত, উয্যা, মানাত ও অন্যান্য নারী নামের সকল দেবীদেরকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে।[2] এগুলোকে ‘ইনাস’ বলার পিছনে মোট তিনটি কারণ থাকতে পারে :

এক. ‘ইনাসান’ শব্দটি ‘উন্সা’ শব্দের বহুবচন। এর অর্থ নারী। লাত, উয্যা ও মানাত এ তিনটিকে নারীর নামে নামকরণ করার কারণে এদেরকে ‘ইনাসান’ বলা হয়ে থাকতে পারে। মূলত কোনো নারীদের সাথে এদের ঐতিহাসিক কোনো সম্পর্ক থাকার কারণে নয়।[3]

দুই. আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার মতে ‘ইনাস’ অর্থ ‘আওছান’ তথা প্রতিমাসমূহ। ‘আওছান’ শব্দটি ‘ওয়াসান’ শব্দের বহুবচন। আরবীতে বহুবচন জাতীয় শব্দগুলো স্ত্রীলিঙ্গ হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। যেহেতু মুশরিকরা একাধিক ‘ওয়াছান’ তথা প্রতিমাকে আহ্বান করতো, সে জন্য এগুলোকে ‘ইনাছান’ বলা হয়েছে।[4]

তিন. মুশরিকরা ফেরেশ্তাদেরকে আল্লাহর মেয়ে মনে করে এদের মাধ্যমে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার জন্য এদের উপাসনা করতো। তারা এগুলোর নারী আকৃতির মূর্তি তৈরী করে এদের পূজা-অর্চনার জন্য কিছু নিয়ম নীতি তৈরী করেছিল, এদের গলায় অলংকার ঝুলিয়ে দিয়ে বলেছিল: এরা আল্লাহর মেয়ে যাদের আমরা উপাসনা করি। বিশিষ্ট তাবেঈ দাহহাক (রহ.) থেকে এ ব্যাখ্যাটি বর্ণিত হয়েছে।[5] ‘তারা এ সব মূর্তিকে আহ্বান করে মূলত অবাধ্য শয়তানকেই সাহায্যের জন্য আহ্বান করতো’ উক্ত আয়াতে এ কথা বলার কারণ হলো : শয়তানই মূলত তাদেরকে এ সবের আহ্বান করতে প্ররোচিত করতো। উবাই ইবনে কা‘ব রাদিয়াল্লাহু আনহু এর বর্ণনা মতে এ সব মূর্তির সাথে একটি করে মহিলা জিন থাকতো।[6]

আর এ জিনরাই অদৃশ্যে থেকে তাদের আহ্বানকারীদের উপকার করে দিত। ফলে মুশরিকরা এ উপকারকে এ সব মূর্তির কাজ বলেই মনে করতো। তাদের ধারণা মতে ফেরেশ্তারা আল্লাহর মেয়ে হওয়ার কারণে তারা আল্লাহর অতীব নিকটতম ও প্রিয়ভাজন। তাদের সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারলে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া সম্ভব। সে জন্যেই তারা তাদের উপাসনা করতো এবং বলতো: ‘‘তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেবে, এ উদ্দেশ্যেই আমরা তাদের উপাসনা করছি’’।[7] আরো বলতো : ‘‘এরা আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য শাফা‘আতকারী।’’[8]

লাত, উয্যা ও মানাত এ তিনটি দেবীকে নারীর নামে নামকরণ করার কারণ হিসেবে যে তিনটি কারণ বর্ণনা করা হয়েছে, এর যে কোনটির কারণে এগুলোর উপর্যুক্ত নামকরণ হয়ে থাকতে পারে। তৃতীয় সম্ভাবনাটির কথা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত না হলেও মুশরিকরা যে ফেরেশ্তাদেরকে আল্লাহর মেয়ে মনে করতো এবং ফেরেশ্তাদেরকে উদ্দেশ্য করেই যে তারা এ তিনটি দেবীকে উপর্যুক্ত নামে নামকরণ করেছিল, তা স্বয়ং কুরআন দ্বারাই প্রমাণিত। তারা যে ফেরেশ্তাদেরকে নারী মনে করতো সে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿وَجَعَلُواْ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةَ ٱلَّذِينَ هُمۡ عِبَٰدُ ٱلرَّحۡمَٰنِ إِنَٰثًاۚ﴾ [الزخرف: ١٩]

‘‘তারা ফেরেশ্তাদেরকে, যারা আল্লাহর বান্দা, তাদেরকে নারী বলে স্থির করেছে’’।[9] আবার ফেরেশ্তাদেরকে যে তারা আল্লাহর মেয়ে মনে করতো, সে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿أَفَرَءَيۡتُمُ ٱللَّٰتَ وَٱلۡعُزَّىٰ ١٩ وَمَنَوٰةَ ٱلثَّالِثَةَ ٱلۡأُخۡرَىٰٓ ٢٠ أَلَكُمُ ٱلذَّكَرُ وَلَهُ ٱلۡأُنثَىٰ ٢١ تِلۡكَ إِذٗا قِسۡمَةٞ ضِيزَىٰٓ ٢٢ إِنۡ هِيَ إِلَّآ أَسۡمَآءٞ سَمَّيۡتُمُوهَآ أَنتُمۡ وَءَابَآؤُكُم مَّآ أَنزَلَ ٱللَّهُ بِهَا مِن سُلۡطَٰنٍۚ﴾ [النجم: ١٩، ٢٣]

‘‘তোমরা কি ভেবে দেখেছ লাত, উয্যা ও তৃতীয় আরেকটি মানাত সম্পর্কে? পুত্র-সন্তান কি তোমাদের জন্যে আর কন্যা-সন্তান আল্লাহর জন্যে। এটা হবে খুব অন্যায় বন্টন। এগুলো কতকগুলো নাম বৈ আর কিছুই নয়, যা তোমরা ও তোমাদের পূর্বপুরুষেরা রেখেছো, এসবের কোনো প্রমাণ আল্লাহ অবতীর্ণ করেন নি।’’[10]উক্ত আয়াত দু’টির দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, তারা ফেরেশ্তাদেরকে আল্লাহর মেয়ে মনে করেই তাদের উপাসনার মাধ্যমে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার উদ্দেশ্যে লাত, উয্যা ও মানাত নামের এ তিনটি দেবীকে নারীর নামে নামকরণ করেছিল। সে জন্যে ইমাম ইবনে কাছীরও তাঁর তাফসীরে দাহহাক কর্তৃক বর্ণিত ব্যাখ্যাকে أَفَرَأَيْتُمُ اللاَّتَ...الآية এর সাথে সামঞ্জস্যশীল বলে মন্তব্য করেছেন।[11]

>
[1]. আল-কুরআন, সূরা নিসা : ১১৭।

[2]. আল-কুরত্বুবী, আবু ‘আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবন আহমদ আল-আনসারী, আহকামুল কুরআন; (মিশর : আল-হাইআতুল মিশরিয়্যাতু লিল কুত্তাব, ৩য় সংস্করণ, ১৯৮৭ খ্রি.), ১০/৭৮।

[3]. তদেব।

[4]. ইবনে কাছীর, তাফছীরুল কুরআনিল ‘আযীম; ১/৫৬৮।

[5]. ইবনে জারীর ত্ববারী দাহহাক থেকে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন :

قال جرير عن الضحاك في الآية : قال المشركون للملائكة بنات الله وإنما نعبدهم ليقربونا إلى الله زلفى .قال فاتخذوهن أربابا وصوروهن جواري ، فحكموا وقلدوا وقالوا هؤلاء بنات الله الذي نعبده يعنون الملائكة .قال ابن كثير : هذا التفسير شبيه بقول الله تعالى :[ أفرأيتم اللات والعزى ] الآيات. –

দেখুন : ইবনে কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম; ১/৫৬৮।

[6]. তদেব।

[7].আল-কুরআন, সূরা যুমার : ৩।

[8]. আল-কুরআন, সূরা ইউনুস : ১৮।

[9].আল-কুরআন, সূরা যুখরূফ : ১৯।

[10]. আল-কুরআন, সূরা নাজম : ১৯।

[11].ইবনে কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম; ১/৫৬৮।

মুশরিকরা লাত, উয্যা ও মানাতের নামে কোনো নারী আকৃতির মূর্তি তৈরী না করলেও তারা যে ফেরেশ্তাদেরকে উদ্দেশ্যে করেই এ সব নাম রেখে এগুলোর উপাসনা করতো, তা নিম্নোক্ত আয়াত দ্বারাও প্রমাণিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

﴿وَيَوۡمَ يَحۡشُرُهُمۡ جَمِيعٗا ثُمَّ يَقُولُ لِلۡمَلَٰٓئِكَةِ أَهَٰٓؤُلَآءِ إِيَّاكُمۡ كَانُواْ يَعۡبُدُونَ ٤٠ قَالُواْ سُبۡحَٰنَكَ أَنتَ وَلِيُّنَا مِن دُونِهِمۖ بَلۡ كَانُواْ يَعۡبُدُونَ ٱلۡجِنَّۖ أَكۡثَرُهُم بِهِم مُّؤۡمِنُونَ ٤١ ﴾ [سبا: ٤٠، ٤١]

‘‘আর যেদিন তিনি সবাইকে একত্রিত করবেন, অতঃপর ফেরেশ্তাদের বলবেন: এরা কি তোমাদেরই উপাসনা করতো? তারা বলবে : আপনি পবিত্র, আপনিই আমাদের অভিভাবক, ওরা নয়; বরং তারা জিনেরই উপাসনা করতো এবং তাদের অধিকাংশরাই এদের উপর ঈমান আনয়ন করতো।’’[1]

এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মুশরিকরা কোনো কোনো ফেরেশ্তাদের উপাসনা করতো। আর এ দেবীগুলোর নাম নারীর নামে রাখাতে মনে হয় যেন তারা তিনজন ফেরেশ্তাকে উদ্দেশ্য করেই এ তিনটি দেবীর নাম এভাবে রেখেছিল। যদিও সে সব দেবীর স্থানে নারীর আকৃতির কোনো মূর্তি ছিল বলে কোন নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায় না। তা পাওয়া না গেলেও তৎকালীন সময়ে আরব উপদ্বীপের বনী ইসমাঈল এবং অন্যান্য ইয়াহূদী ও খ্রিষ্টানরা ফেরেশ্তা ও নবীদেরকে ইলাহ ও রবের আসনে সমাসীন করেছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

﴿ وَلَا يَأۡمُرَكُمۡ أَن تَتَّخِذُواْ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةَ وَٱلنَّبِيِّ‍ۧنَ أَرۡبَابًاۗ ﴾ [ال عمران: ٨٠]

‘‘কোন নবী তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিতে পারেন না যে, তোমরা ফেরেশ্তা ও নবীদেরকে অসংখ্য রব হিসেবে গ্রহণ করবে।’’[2]এ আয়াত দ্বারাও এ কথা প্রমাণিত হয় যে, কুরাইশরা কোনো কোনো ফেরেশ্তাকে আল্লাহ্‌র রুবূবিয়্যাতের বৈশিষ্ট্যের অধিকারী বানিয়ে নিয়েছিল এবং সে ধারণার ভিত্তিতে তারা তাদের নিকট নিজেদের জীবনের কল্যাণ কামনা করতো ও অকল্যাণ দূরীকরণের জন্য তাদেরকে আহ্বান করতো। লাত, উয্যা ও মানাত নামের দেবীগুলোকে নারীর নামে নামকরণ করাতে বুঝা যায় যে, তারা তিনজন ফেরেশতাদের উদ্দেশ্য করেই এ তিনটি দেবীর নামকরণ করেছিল; কারণ, তারা ফেরেশ্তাদেরকে আল্লাহর মেয়ে মনে করতো।

والله أعلم بالصواب

>
[1]. আল-কুরআন, সূরা সাবা : ৪১।

[2]. আল-কুরআন, সূরা আলে ইমরান : ৮০।

ঐতিহাসিক বর্ণনামতে এ দেবতা দু’টি মূলত ‘জুরহাম’ গোত্রের দু’জন মানুষ ছিল। য়াসাফ না-য়েলাহকে ভালবাসতো। একদা কা‘বা শরীফের অভ্যন্তরে তারা অবৈধভাবে যৌনকর্মে লিপ্ত হলে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে তাৎক্ষণিক শাস্তিস্বরূপ দু’টি পাথরে রূপান্তরিত করেন। সাধারণ লোকেরা যাতে এদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে সে জন্য লোকেরা এ পাথর দু’টির একটিকে কা‘বা শরীফের পার্শ্বে এবং অপরটিতে যমযম কূপের পার্শ্বে স্থাপন করেছিল। দীর্ঘদিন যাবত এ পাথর দু’টি এভাবেই ছিল। যুগের পরিক্রমায় এ পাথর দু’টির বাস্তব ইতিহাসও পরবর্তী লোকেরা ভুলে যায়। এরই মধ্যে তাদের মাঝে মূর্তি পূজার প্রচলন হয়, তখন অন্যান্য মূর্তির সাথে এ-গুলোকেও তারা পূজা করতে থাকে। কুরায়েশরা পরবর্তিতে কা‘বা শরীফের পাশেরটিকে অপরটির নিকটে স্থানান্তরিত করেছিল এবং এ দু’টির নিকট তারা পশু যবাই ও কুরবানী করতো।[1]

>
[1]. তদেব; ২/১৭০।

এটি ছিল একটি সাদা রঙ্গের পাথর। এর মাথায় ছিল একটি টুপির নকশা। মক্কা ও ইয়ামনের মধ্যবর্তী স্থানে এর জন্য একটি গৃহ ছিল। খাছ‘আম, বুজায়লা ও অন্যান্য নিকটতম স্থানের লোকেরা এটাকে সম্মান করতো এবং তাদের মনোবাঞ্ছনা পূরণের জন্য এর উদ্দেশ্যে অর্থ সম্পদ প্রেরণ করতো। এটি ধ্বংস করার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জারীর ইবন ‘আব্দুল্লাহ আল-বাজালী রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে একদল অশ্বারোহী বাহিনী দিয়ে প্রেরণ করেছিলেন।[1]

>
[1]. ইবনে হাজার আসকালানী, ফতহুল বারী বিশরহিল বুখারী;, বৈরুত : দ্বারুল মা‘রিফাহ, সংস্করণ বিহীন, সন বিহীন, ৮/৭১।

এ দেবতাটি ছিল ‘দাওস’ নামক গোত্রের নিকট পূজনীয়। ‘আরব জনপদে এভাবে যখন মূর্তি পূজার হিড়িক পড়ে যায়, তখন মক্কা ও এর বাইরের সকল জনগণই নিজ নিজ গৃহে উপাসনার জন্য পৃথক পৃথক মূর্তি গ্রহণ করেছিল। যখন তাদের কেউ কোথাও ভ্রমণে যাওয়ার জন্য তৈরী হতো, তখন সে ব্যক্তির গৃহের সর্বশেষ কাজ হতো এ মূর্তির গায়ে হাত বুলানো এবং ভ্রমণ থেকে ফিরে আসলেও গৃহে প্রবেশ করলে তাদের প্রথম কাজই হতো সম্মানের উদ্দেশ্যে এ মূর্তির গায়ে হাত বুলানো।[1]

>
[1]. ইবন হিশাম, প্রাগুক্ত; ১/৮৩; ইবনে কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ, এগাছাতুল লহফান; ২/১৭১; ইবনে কাছীর, আল-বেদায়াতু ওয়ান নেহায়াহ; ১/১৯১-১৯২।

মুশরিকরা সাধারণত উপর্যুক্ত জড়পদার্থের মূর্তি এবং মানুষ ও ফেরেশ্তাদের নামে নির্মিত মূর্তিসমূহের প্রতি এরা তাদের লাভ ও ক্ষতি করতে পারে- এ ধারণার ভিত্তিতে এদেরকে সাহায্যের জন্য যেমন আহ্বান করতো, তেমনি কোনো কোনো এলাকার লোকেরা জিনের ব্যাপারেও উপর্যুক্ত ধারণা পোষণ করে জিনদেরকেও সাহায্যের জন্য আহ্বান করতো। যেমন আল্লাহ বলেন :

﴿ أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ يَبۡتَغُونَ إِلَىٰ رَبِّهِمُ ٱلۡوَسِيلَةَ أَيُّهُمۡ أَقۡرَبُ وَيَرۡجُونَ رَحۡمَتَهُۥ وَيَخَافُونَ عَذَابَهُ﴾ [الاسراء: ٥٧]

‘‘যাদেরকে তারা আহ্বান করে তারা নিজেরাই তো তাদের রবের অধিক নিকটবর্তী হওয়ার ব্যাপারে প্রতিযোগিতা করে, তারা তাঁর রহমতের আশা করে এবং তাঁর শাস্তিকে ভয় করে।’’[1]

এ আয়াতের তাফসীরে ইবন মাস‘ঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে :

[قَال كانَ نَفَرٌ مِنَ الجِنِّ أَسْلَمُوْا وَكَانُوْا يُعْبَدُوْنَ فَبَقِيَ الذينَ كانُوْا يَعْبُدُوْنَ على عِبَادَتِهِمْ وَقَدْ أَسْلَمَ النَّفَرُ مِنَ الْجِنِّ]

‘‘একদল জিন ইসলাম গ্রহণ করেছিল যাদের উপাসনা করা হতো; তাদের ইসলাম গ্রহণ করা সত্ত্বেও যারা তাদের উপাসনা করতো তারা যথারীতি তাদের উপাসনায় থেকে যায়।’’[2]

বিপদে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করা আল্লাহর উপাসনা হওয়া সত্ত্বেও কোনো কোনো লোকেরা যে জিনদের উপাসনা করতো, তা জিনদের স্বীকারোক্তির দ্বারাও প্রমাণিত হয়। যেমন জিনরা বলেছিল :

﴿كَانَ رِجَالٞ مِّنَ ٱلۡإِنسِ يَعُوذُونَ بِرِجَالٖ مِّنَ ٱلۡجِنِّ فَزَادُوهُمۡ رَهَقٗا ٦ ﴾ [الجن: ٦]

‘‘মানুষের মধ্যকার কিছূ লোকেরা জিনদের মধ্যকার কিছু জিনের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করতো, ফলে তারা জিনদের আত্মম্ভরিতা বাড়িয়ে দিত।’’[3]

এ ছাড়াও আল্লাহর অবাধ্যতায় মুশরিকরা শয়তানের নির্দেশের আনুগত্য করে মূর্তি পূজা করার কারণে তারা আল্লাহর আনুগত্যের ক্ষেত্রে শয়তানকে শরীক করে নিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

﴿ وَجَعَلُواْ لِلَّهِ شُرَكَآءَ ٱلۡجِنَّ وَخَلَقَهُمۡۖ ﴾ [الانعام: ١٠٠]

‘আর মুশরিকরা শয়তানকে আল্লাহর শরীক করে নিয়েছে, অথচ তিনি তাদের সৃষ্টি করেছেন।’’[4]এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে কাছীর বলেন : ‘‘যারা আল্লাহর উপাসনায় জিন তথা শয়তানকে শরীক করে নিয়েছিল উক্ত আয়াতে তাদের সে উপাসনার প্রতিবাদ করা হয়েছে। তারা শয়তানের নির্দেশের আনুগত্য করার কারণেই মূর্তি পূজা করেছিল বিধায়, প্রকৃতপক্ষে তারা শয়তানেরই আনুগত্য করেছে এবং তার কাছেই সাহায্য চেয়েছে ও তারই সুপারিশ কামনা করেছে।”[5]

>
[1]. আল-কুরঅন, সূরা বনী ইসরাঈল : ৫৭।

[2]. বুখারী, প্রাগুক্ত; বাব নং ২০৬, হাদীস নং ৪৪৩৮; ৪/১৭৪৮; মুসলিম, প্রাগুক্ত; কিতাবুত তাফসীর, বাব নং ৩, হাদীস নং ৩০৩০, ৪/২৩২১; কুরত্ববী, প্রাগুক্ত; ১০/২৭৯।

[3]. আল-কুরআন, সূরা জিন : ৬।

[4]. আল-কুরআন, সূরা আন‘আম : ১০০।

[5]. তিনি বলেন :

هذا رد على المشركين الذين عبدوا مع الله غيره وأشركوا به في عبادته أن عبدوا الجن فجعلوهم شركاء له في العبادة تعالى الله عن شركهم وكفرهم فإن قيل فكيف عبدت الجن مع أنهم إنما كانوا يعبدون الأصنام فالجواب أنهم ماعبدوها إلا عن طاعة الجن وأمرهم إياهم بذلك كقوله إن يدعون من دونه إلا إناثا وإن يعبدون إلا شيطانا مريدا

দেখুন : ইবনে কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম; ২/১৬৫।

পাথর পূজার ক্ষেত্রে তারা বহুদূর অগ্রসর হয়েছিল। প্রথমত কা‘বা শরীফ ও এর প্রাঙ্গণে ছড়িয়ে থাকা পাথর অন্যত্র বহন করে নিয়ে পাথর পূজার সূত্রপাত হয়। পরবর্তীতে তারা যখনই কোথাও অবতরণ করতো তখন তাদের সাথে কা‘বা শরীফের প্রাঙ্গণের পাথর না থাকলে সেখানকারই একটি ভাল পাথরের পূজা করতো। কোন পাথর না পেলে কিছু মাটি বা বালু একত্রিত করে এর উপর ছাগলের দুধ দোহন করে সে মাটি বা বালু একটু শক্ত হলেই এটিকে মূর্তি মনে করেই এর চার পার্শ্বে ত্বওয়াফ করতো। এ সম্পর্কে আবু রাজা-আল আত্বারিদী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন :
‘‘আমরা (পাথর না পেলে) বালু একত্রিত করতাম এবং এর উপর ছাগলের দুধ দোহন করে এর উপাসনা করতাম। আমরা সাদা পাথর পেলে কিছুদিন এর উপাসনা করতাম। অতঃপর তা ফেলে দিতাম।’’[1]

>
[1]. ইবনে কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ, এগাছাতুল লহফান; ২/১৭৩।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ১৮ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 পরের পাতা »