শির্ক কী ও কেন? তৃতীয় পরিচ্ছেদ ড. মুহাম্মদ মুয্‌যাম্মিল আলী ২ টি
সর্বপ্রথম কোন্ জাতি শির্কে লিপ্ত হয়?

এ বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে, আদম আলাইহিস সালাম স্বীয় প্রভুর সান্নিধ্যে চলে যাওয়ার প্রক্কালে তাঁর সন্তানদেরকে তিনি সঠিক ধর্মের উপরেই একই মুসলিম জাতিভুক্ত রেখে গেছেন। তখন তাদের ধর্ম ছিল এক ও অভিন্ন এবং মহান আল্লাহই ছিলেন তাদের একক রব ও উপাস্য। তাদের মাঝে এ অবস্থা পরবর্তী কয়েক প্রজন্ম পর্যন্ত বিরাজমান ছিল। কালের পরিক্রমায় যখন তাদের মাঝে ধর্মীয় শিক্ষার অবনতি ঘটে, তখন তাদের চির শত্রু শয়তান তাদের পিতা-মাতার বিরুদ্ধে যেভাবে ষড়যন্ত্র করেছিল ঠিক সেভাবেই সে তাদের বিরুদ্ধেও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল এবং অবশেষে তাদেরকে মু’মিন ও মুশরিক দু’টি দলে বিভক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন:

﴿وَمَا كَانَ ٱلنَّاسُ إِلَّآ أُمَّةٗ وَٰحِدَةٗ فَٱخۡتَلَفُواْۚ﴾ [يونس: ١٩]

‘‘মানুষেরাতো (ধর্মের দিক থেকে প্রারম্ভে) একই জাতিভুক্ত ছিল, অতঃপর তারা (এ ক্ষেত্রে) মতবিরোধে লিপ্ত হয়।’’[1]

এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মানুষেরা দীর্ঘ এক সময় পর্যন্ত একই ধর্ম ও একই বিশ্বাসের উপরে প্রতিষ্ঠিত ছিল। পরবর্তীতে তাদের মাঝে এ বিষয়ে মতভেদের সূত্রপাত হয়। এতে কিছু লোক পূর্বের ন্যায় তাওহীদী বিশ্বাসের উপরেই বহাল থাকে, আর কিছু লোক সে বিশ্বাসের পরিপন্থী কর্মে লিপ্ত হয়। আমরা হাদীস দ্বারা অবগত হয়েছি যে, আদম আলাইহিস সালাম থেকে নূহ আলাইহিস সালাম পর্যন্ত দশ যুগ বা প্রজন্মের সকল লোক ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল।

উক্ত হাদীসে বর্ণিত ‘আশারাতু ক্বুরুন’ এর অর্থ এক হাজার বছরও হতে পারে, আবার দশ প্রজন্মের লোকও হতে পারে। তবে ‘আল-ইসলাম’ শব্দের দ্বারা এ যুগকে সীমাবদ্ধ করাতে প্রথম অর্থই অগ্রগণ্য বলে মনে হয়। কারণ, এতে মনে হয় যে, মানুষেরা এ সময়সীমা পর্যন্ত ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং আদম ও নূহ আলাইহিস সালাম এর মাঝে পরবর্তী আরো অনেক যুগ রয়েছে যাতে সকল লোকেরা ইসলামের উপর একমত ছিল না; বরং পরবর্তীতে তারা মু’মিন ও কাফির এ দু’দলে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। যার ফলশ্রুতিতে তাদেরকে সংশোধনের জন্যে প্রথমে আল্লাহ তা‘আলা ইদ্রীস আলাইহিস সালাম-কে তাদের নিকট নবী হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন[2]। এরপর প্রথম রাসূল হিসেবে শরী‘আত দিয়ে নূহ আলাইহিস সালাম-কে তাদের নিকট প্রেরণ করেছিলেন।

‘কুরুন’ ‘قرون’ শব্দটিকে কুরআন ও হাদীসে প্রজন্মের অর্থে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। যেমন আল্লাহ বলেন :

﴿ وَكَمۡ أَهۡلَكۡنَا مِنَ ٱلۡقُرُونِ مِنۢ بَعۡدِ نُوحٖۗ ﴾ [الاسراء: ١٧]

‘‘আর আমি অনেক প্রজন্মের মানুষদেরকে ধ্বংস করেছি নূহ এর পরে।’’[3]

এ আয়াতে ‘قرون’ শব্দ দ্বারা প্রজন্মই উদ্দেশ্য করা হয়েছে। অনুরূপভাবে (خَيْرُ النَّاسِ قَرْنِيْ) ‘‘আমার যুগের মানুষেরা সর্বোত্তম মানুষ’’[4] এ-হাদীসেও ‘ক্বরন’ (قرن) শব্দটি প্রজন্মের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা এর হাদীসে বর্ণিত ‘ক্বুরুন’ (قرون) শব্দটি প্রজন্মের অর্থে ব্যবহৃত না হয়ে ‘সময়’ এর অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। হাদীসের বাহ্যিক অর্থের দ্বারা যদিও এ কথা মনে হয় যে, আদম ও নূহ আলাইহিস সালাম-এর মধ্যে মোট এক হাজার বছর অতিবাহিত হয়েছে এবং এ সময়ের সকল লোকেরা মুসলিম ছিল; কিন্তু এ বাহ্যিক অর্থটি ইতিহাস ও বাস্তবতার সাথে খাপ খায় না। কেননা, বাস্তবতা এ কথার সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, একটি জাতির মধ্যে বিভ্রান্তি হঠাৎ করে এসে যায় না, বরং তা ধীরে ধীরে হয়ে থাকে এবং আল্লাহ তা‘আলাও কোনো জাতির বিভ্রান্তির প্রথম অবস্থাতেই নবী ও রাসূল প্রেরণ করেন না। এমতাবস্থায় ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর হাদীসের বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করলে বলতে হবে যে, মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি শুরু হয়েছে নূহ আলাইহিস সালাম-এর যুগ থেকেই এবং আল্লাহ তাঁকে তাঁর জাতির বিভ্রান্তির প্রারম্ভেই রাসূল করে পাঠিয়েছেন, যদিও তা বাস্তবতা বহির্ভূত।

এ দিকে ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, আদম আলাইহিস সালামের সন্তানদের দ্বারা মূর্তিপূজার কারণে যখন তাদের কুফরী কার্যকলাপ চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদের নিকট ইদ্রীস আলাইহিস সালাম-কে নূহ আলাইহিস সালাম-এর পূর্বে নবী হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন। তিনি এসে তাদেরকে তাওহীদের দিকে আহ্বান জানালে তারা তাঁকে অস্বীকার করে, ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে (ইদ্রীস আলাইহিস সালাম) মর্যাদাপূর্ণ স্থানে উঠিয়ে নেন।[5] এ ইতিহাসও ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা এর হাদীসের বাহ্যিক অর্থের সম্পূর্ণ বিপরীত। এ কারণে আমরা এ কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু এর হাদীস দ্বারা আদম ও নূহ আলাইহিস সালাম এর মধ্যকার মোট সময় নির্ধারণ করার উদ্দেশ্য করা হয় নি;বরং এর উদ্দেশ্য সে সময়সীমা বর্ণনা করা যে সময়ের মধ্যে সকল লোকেরা ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, যদিও তাঁদের উভয়ের মাঝে এ সময়সীমার বাইরে আরো অনেক সময় ছিল, যাতে লোকেরা ইসলাম তথা তাওহীদের উপর একমত ছিল না।

তবে ইমাম ইবন হিববান তাঁর সহীহ গ্রন্থে আবু উমামাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন, যার দ্বারা ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমার হাদীসের বাহ্যিক অর্থ গৃহীত হওয়ার সমর্থন পাওয়া যায়। হাদীসটি নিম্নরূপ:

«أَنَّ رَجُلًا قَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ ! أَ نَبِيٌّ كَانَ آدَمُ ؟ قَالَ : نَعَمْ مُكَلَّمٌ . قَالَ: فَكَمْ كَانَ بَيْنَهُ وَ بَيْنَ نُوْحٍ؟ قَالَ : عَشَرَةُ قُرُوْنٍ»

‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকটে এসে এক ব্যক্তি বললো : হে আল্লাহর রাসূল! আদম কি নবী ছিলেন? উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : ‘‘হ্যাঁ, তিনি এমন একজন নবী ছিলেন যার সাথে আল্লাহ তা‘আলা কথা বলেছেন।’’ লোকটি আবার বললো : তিনি এবং নূহ এর মধ্যে কত বছরের ব্যবধান ছিল? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-বললেন : ‘‘দশ যুগ’’ অর্থাৎ এক হাজার বছর।’’[6]

এ হাদীসে বর্ণিত ‘عشرة قرون’ শব্দের দ্বারা উভয়ের মধ্যবর্তী সময় এক হাজার বছরের মধ্যে সীমিত বলে প্রমাণিত হয়।

উভয় হাদীসের মধ্যে সমাধান:

ইমাম ইবন কাছীর রহেমাহুল্লাহ ইবন আব্বাস ও আবু উমামাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুমার হাদীস দু’টি বর্ণনা করার পর উভয় হাদীসের মধ্যে সমাধান কল্পে যা বলেছেন, সংক্ষেপে তা নিম্নে বর্ণিত হলো :

তিনি বলেন : ‘‘যেহেতু ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর হাদীসে ‘عشرة قرون’ দশ যুগ পর্যন্ত তাদের মধ্যে ইসলামী ধ্যান-ধারণা প্রচলিত থাকার কথা বর্ণিত হয়েছে, সেহেতু ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর হাদীসকে আবু উমামাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর হাদীসের পরিপূরক হিসেবে গণ্য করতে হবে। এবার ‘قرن’ শব্দের অর্থ যদি যুগ ধরা হয়, তা হলে উভয় হাদীসের অর্থ দাঁড়াবে : আদম ও নূহ আলাইহিস সালাম-এর মধ্যকার প্রথম দশ যুগ অর্থাৎ এক হাজার বছর আদম সন্তানদের মাঝে ইসলাম ছিল। তাঁদের মধ্যকার পরবর্তী যুগসমূহে মানুষেরা ইসলাম থেকে বিচ্যুত হয়ে গিয়েছিল। ক্বরন (قرن) শব্দ দ্বারা যদি ‘প্রজন্ম’ এর অর্থ গ্রহণ করা হয়, যেমন কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে তা এ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে,[7] তা হলে হাদীস দু’টির অর্থ হবে : আদম ও নূহ এর মাঝে দশ প্রজন্মের মানুষ অতিবাহিত হয়েছে, যারা সকলেই ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। নূহ পূর্ববর্তী মানুষেরা সাধারণত দীর্ঘজীবী হতেন বিধায়, আদম ও নূহ আলাইহিমাস সালাম-এর মাঝে এক হাজার বছর অতিবাহিত না হয়ে হাজার হাজার বছর অতিবাহিত হওয়ারই কথা। এ কথাটি সত্য হওয়ার পাশাপাশি যেহেতু ক্বরন (قرن) দ্বারা প্রজন্মের অর্থ গ্রহণ করলে তা বাস্তবতা ও ইতিহাসের নিরিখে সঠিক বলে মনে হয় না, তাই ক্বরন (قرن) শব্দ দ্বারা ‘যুগ’ এর অর্থই গ্রহণ করতে হবে’’[8]

আমার মতে ইমাম ইবন কাছীর (রহ.) কর্তৃক উপরে বর্ণিত উভয় হাদীসের সমাধান গ্রহণ করার পাশাপাশি নিম্নরূপভাবেও উভয় হাদীসের মধ্যে সমাধান করা যেতে পারে। আর তা হলো- আবু উমামাহ এর হাদীসে ইসলাম শব্দটি না থাকায় হতে পারে সে হাদীসে ‘قرن’ দ্বারা আদম ও নূহ এর মাঝে দশ প্রজন্মের মানুষ অতিবাহিত হওয়ার কথাই বর্ণিত হয়েছে। সে সময়ের মানুষেরা অধিক আয়ু লাভ করতেন বিধায়, দশ প্রজন্ম অতিবাহিত হতে কয়েক হাজার বছর সময় লেগেছে। এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে কতকাল তারা ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল এ বিষয়ের বর্ণনা আবু উমামাঃ এর হাদীসে বর্ণিত হয় নি। অন্যদিকে ইবন আব্বাসের হাদীসে ‘عشرة قرون’ দশ যুগ বা প্রজন্মের ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে। এখন যদি এ হাদীসে বর্ণিত ‘ عشرة قرون’ দ্বারা আদম ও নূহ আলাইহিস সালাম-এর মধ্যে দশ যুগ অতিবাহিত হয়েছে বলে মনে করা হয়, তা হলে তা বাস্তবতা ও ইতিহাসের সাথে খাপ খায় না।

তাই বাধ্য হয়ে এ-কথা বলতে হবে যে, ইবন আব্বাসের হাদীস দ্বারা উভয়ের মধ্যকার মোট সময়ের বর্ণনা করার উদ্দেশ্য করা হয়নি; বরং কত সময় তারা ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, তা বর্ণনা করাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মূল উদ্দেশ্য ছিল এবং এ উদ্দেশ্যেই বোধ হয় তিনি তাতে ‘ইসলাম’ শব্দটি অতিরিক্ত যোগ করেছিলেন। অতএব, প্রমাণিত হলো যে, আদম ও নূহ আলাইহিস সালাম-এর মাঝে দশ প্রজন্মের লোক অতিবাহিত হয়েছে। তবে আদম আলাইহিস সালাম-এর তিরোধানের পর তাঁর বংশধররা এক হাজার বছর পর্যন্ত ইসলামের উপর কায়েম ছিল। পরবর্তী সময়ের প্রজন্মের লোকেরা পথভ্রষ্ট হয়ে যায়। সে জন্য তাদের হেদায়াতের উদ্দেশ্যে প্রথমত আল্লাহ তা‘আলা ইদ্রীস আলাইহিস সালাম-কে নবী হিসেবে প্রেরণ করেন এবং তিনি খুব একটা সফলকাম হতে না পারলে পরবর্তীতে আদম আলাইহিস সালাম থেকে নিয়ে নূহ আলাইহিস সালাম পর্যন্ত দশ প্রজন্ম অতিক্রান্ত হওয়ার প্রাক্কালে নূহ আলাইহিস সালাম-কে প্রথম রাসূল হিসেবে তাদের নিকট প্রেরণ করা হয়।

والله أعلم

[1]. আল-কুরআন, সূরা ইউনুস : ১৯।

[2] ইদ্রিস আলাইহিস সালাম এর প্রেরণকাল, তিনি নবী কিংবা রাসূল ছিলেন, এ সম্পর্কে কুরআন বা হাদীস থেকে বিস্তারিত পওয়া যায় না। যদিও ঐতিহাসিকগণ তাকে ‘আখনূখ’ বলেছেন এবং আদম ও নূহ আলাইহিমাস সালামের মধ্যবর্তী সময়ে প্রেরিত হয়েছিলেন বলেছেন, কিন্তু কেউ কেউ মনে করেন তিনি এবং ইলিয়াস আলাইহিস সালাম একই ব্যক্তি। সে হিসেবে তিনি বনী ইসরাইলের একজন নবী। আদম ও নূহ এর মাঝখানে তিনি প্রেরিত হন নি। এর আরও একটি যৌক্তিক কারণ হচ্ছে, তিনি যদি আদম ও নূহ এর মাঝখানে এসে থাকবেন তবে নিশ্চয় সেখানে শির্ক হয়ে থাকবে, যা উপরোক্ত হাদীসের বিপরীত। কারণ, রাসূল প্রেরিত হওয়ার জন্য সর্বজন গৃহীত শর্ত হচ্ছে, তাদের উম্মতের মধ্যে ঈমানদার ও কাফের উভয় শ্রেণি থাকবেন। তবে যদি তাঁকে কেবল নবী বলা হয়, সেটা ভিন্ন কথা। [সম্পাদক]

[3]. আল-কুরআন, সূরা ইসরা : ১৭।

[4]. বুখারী, প্রাগুক্ত; কিতাবুল মানাক্বিব, বাবু ফাদাইলিস সাহাবাহ; ৩/৫/১৬৩; ইমাম আহমদ, প্রাগুক্ত; ১/৩৭৮।

[5]. ইবনুল জাওযী, আবুল ফরজ আব্দুর রহমান, তলবীসে ইবলীস; (বৈরুত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম সংস্করণ, ১৯৮৩ খ্রি.), পৃ. ৬৩-৬৪।

[6]. ইবন কাছীর, ইসমাঈল, আবুল ফেদা, ক্বাছাছুল আম্বিয়া; সম্পাদনা ও টীকা : ‘আব্দুল কাদির আহমদ আত্বা, (কায়রো : মাত্ববায়াতু হেসান, ১ম সংস্করণ, ১৯৮১ খ্রি.), পৃ. ১০৪। ইবনে হিববানের বর্ণনা মতে এ হাদীসটি ইমাম মুসলিমের শর্তানুযায়ী সহীহ, তবে তিনি তাঁর সহীহ মুসলিমে তা বর্ণনা করেন নি।

[7].আল-কুরআন, সূরা ইসরা এর ১৭ নং আয়াত, এবং সূরা মু’মিনুন এর ৩১ নং আয়াত দ্রষ্টব্য।

[8].ইবনে কাছীর, কাসাসুল আম্বিয়া; পৃ.১০৪, ১০৫।
আদম সন্তানদের পথভ্রষ্ট হওয়ার প্রকৃতি

আদম সন্তানদের তাওহীদ থেকে অংশীবাদের দিকে চলে যাওয়ার সূত্রপাত হয় প্রথমত তাদের মধ্যকার সৎমানুষদের বৈঠকশালা ও কবরসমূহের পার্শ্বে অবস্থান গ্রহণ এবং তাঁদের মূর্তি তৈরী করার মধ্য দিয়ে। প্রথমে মূর্তি তৈরীর উদ্দেশ্য ছিল সৎ মানুষদের স্মরণ করা এবং এর মধ্য দিয়ে তাঁদের সৎকর্মসমূহের অনুসরণ করা। শয়তানের প্ররোচনায় পড়েই মূলত তারা এ কাজটি করেছিল বলে তিনটি ঐতিহাসিক বর্ণনা পাওয়া যায় :

প্রথম বর্ণনা :

ইমাম ইবন আল-জাওযী ঐতিহাসিক হিশাম ইবন মুহাম্মদ ইবন আস-সা-ইব আল-ক্বালবী থেকে বর্ণনা করেছেন। হিশাম বলেন : আমার পিতা বলেছেন : সর্বপ্রথম মূর্তি পূজা করা হয় আদম আলাইহিস সালাম-এর তিরোধানের পর। শীশ এর সন্তানরা আদম আলাইহিস সালাম-কে ভারতের (বর্তমান শ্রীলংকার) ‘ইয়াজ’ নামক পৃথিবীর সবচেয়ে উর্বরতম সেই পর্বতের গুহায় দাফন করে যেখানে তাঁকে বেহেশত্ থেকে অবতরণ করানো হয়েছিল। হিশাম বলেন : আমার পিতা আমাকে বলেছেন, তিনি আবূ সালেহ থেকে এবং তিনি ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন : ‘‘আদম আলাইহিস সালাম এর ছেলে শীশ এর সন্তানরা সে গুহাতে আদম আলাইহিস সালাম-এর শরীরের পার্শ্বে আগমন করে এর সম্মান করতো এবং তাঁর জন্য আল্লাহ তা‘আলার রহমত কামনা করতো। এদের এ অবস্থা দেখে কাবিলের সন্তানদের একজন বললো : হে কাবিলের সন্তানগণ! বনী শীশদের একটি ত্বওয়াফ করার স্থান রয়েছে যার চার পার্শ্বে তারা ত্বওয়াফ করে এবং এটাকে তারা সম্মান করে, অথচ তোমাদের এ ধরনের কিছু নেই। তাই সে তাদের জন্য একটি মূর্তি তৈরী করলো এবং সে-ই হলো প্রথম মানুষ যে মূর্তি তৈরী করলো।’’[1]

দ্বিতীয় বর্ণনা :

এ বর্ণনাটিও ইমাম ইবন আল-জাওযী হিশাম থেকে, তিনি তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, ‘ওয়াদ্দ’ ‘সুয়া‘’ ‘য়াগুছ’ ‘য়াউক’ ও নসর’ এরা সকলেই সৎ মানুষ ছিলেন। তারা সকলেই এক মাসের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন। ফলে তাঁদের স্বজনরা তাঁদের জন্য খুবই বেদনার্ত হয়। তাদের এ অবস্থা দেখে কাবিল গোত্রের এক ব্যক্তি বললো: আমি কি তোমাদের জন্য তাঁদের আকৃতিতে আত্মাবিহীন পাঁচটি মূর্তি তৈরী করে দেব? তারা সবাই এতে সম্মত হলে সে তাদের জন্য তাঁদের আকৃতিতে পাঁচটি মূর্তি নির্মাণ করে দিল। এর পর লোকেরা তাদের রক্তের সম্পর্কানুযায়ী এ মূর্তিগুলোর নিকটে এসে এগুলোকে নিজের ভাই, চাচা ও চাচাতো ভাই এর মত মনে করে এগুলোকে সম্মান ও এর চার পার্শ্বে ত্বওয়াফ করতে থাকলো।

এ অবস্থার উপর এ যুগ অথবা এ প্রজন্ম অতিবাহিত হয়ে যায়। এ মূর্তি নির্মাণ করা হয় ইয়াজাজ ইবন মাহলাইল ইবন কাইনান ইবন আনূশ ইবন শীশ ইবন আদম আলাইহিস সালাম-এর যুগে। এরপর দ্বিতীয় যুগ বা প্রজন্ম আসলে তারা এ মূর্তিগুলোকে প্রথম প্রজন্মের বা যুগের চেয়ে আরো অধিক পরিমাণে সম্মান প্রদর্শন করে। এরপর আসে তৃতীয় যুগ বা প্রজন্মের লোকেরা, তারা বললো : প্রথম যুগের জনগণ আল্লাহ তা‘আলার নিকট এ পাঁচটি মূর্তির শাফা‘আত প্রাপ্তির আশায় এঁদের সম্মান করেছে। এ মনে করে এ মূর্তিগুলোর উপাসনা করার ফলে তারা এগুলোর মান-মর্যাদা অনেক বৃদ্ধি করে। এভাবে তাদের কুফরী কার্যকলাপ মারাত্মক আকার ধারণ করলে অবশেষে আল্লাহ তা‘আলা ইদ্রীস আলাইহিস সালাম-কে তাদের নিকট সর্বপ্রথম নবী হিসেবে প্রেরণ করে তাদেরকে তাওহীদের প্রতি আহ্বান জানান, কিন্তু তারা তাঁকে অস্বীকার করে। ফলে আল্লাহ তা‘আলা ইদ্রীস আলাইহিস সালাম-কে সমুন্নত স্থানে উঠিয়ে নেন। কলবী আবূ সালেহ থেকে এবং আবূ সালেহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে যে বর্ণনা করেছেন, সে অনুযায়ী বনী আদমের অবস্থা নূহ পর্যন্ত এভাবে গুরুতর থেকে গুরুতর হতে থাকে, অবশেষে আল্লাহ নূহ আলাইহিস সালাম-কে তাদের নিকট রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেন।’’[2]

উপর্যুক্ত এ দু’টি বর্ণনার দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, মূর্তি নির্মাণের কাজটি তাদের অনেকটা স্বেচ্ছা প্রনোদিতভাবেই হয়েছিল। তবে প্রকৃতপক্ষে তা শয়তানের প্ররোচনার ফলেই হয়েছিল; কারণ শয়তানই বনী আদমকে পথভ্রষ্ট করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিল এবং এ সব যে শয়তানের প্ররোচনায়ই হয়েছে তাও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। সূরা নূহ এ বর্ণিত হয়েছে :

﴿ وَقَالُواْ لَا تَذَرُنَّ ءَالِهَتَكُمۡ وَلَا تَذَرُنَّ وَدّٗا وَلَا سُوَاعٗا وَلَا يَغُوثَ وَيَعُوقَ وَنَسۡرٗا ٢٣ ﴾ [نوح: ٢٣]

‘‘তারা বললো: তোমরা তোমাদের দেবতাদের পরিত্যাগ করো না, আরো পরিত্যাগ করো না ওয়াদ্দ, সুয়া‘, য়াগুছ, য়া‘উক ও নছরকে’’[3]

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, এগুলো হচ্ছে নূহ আলাইহিস সালাম-এর জাতির পূর্ব পুরুষদের মধ্যকার পাঁচজন সৎ মানুষের নাম। তাঁরা মৃত্যুবরণ করার পর শয়তান তাঁদের জাতির নিকট এসে এ মর্মে প্ররোচনা দান করে যে, তোমরা তাঁদের বৈঠকশালাতে তাঁদের মূর্তি দাঁড় করো এবং তাঁদের নামে এগুলোর নামকরণ করো। শয়তানের নির্দেশে তারা তা করে। ধীরে ধীরে এ প্রজন্মের লোকদের বিদায়ের পর পরবর্তী প্রজন্মের লোকদের নিকট এ মূর্তিগুলোর প্রকৃত ইতিহাস বিলুপ্ত হয়ে গেলে এগুলোর উপাসনা করা হয়।’’[4]

ইমাম ইবন জারীর আত-ত্ববারী (২২৪-৩১০) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন : ‘‘এরা পাঁচজন আদম ও নূহ আলাইহিস সালাম-এর মধ্যবর্তী সময়ের সৎ মানুষ ছিলেন। তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণকারী অনেক মানুষ ছিল। তাঁরা মৃত্যুবরণ করার পর তাঁদের অনুসারীরা বললো : আমরা যদি তাঁদের প্রতিকৃতি নির্মাণ করি, তা হলে তা দেখে আমরা আল্লাহর উপাসনার প্রতি অধিক আগ্রহী ও মনোযোগী হতে পারবো। এ মনে করে তারা তাঁদের প্রতিকৃতি তৈরী করলো। এদের মৃত্যুর পর দ্বিতীয় প্রজন্মের জনগণের নিকট ইবলীস (শয়তান) এসে বললো : তোমাদের পূর্বপুরুষগণ এঁদের উপাসনা করতো, এঁদের ওসীলায় তারা বৃষ্টি কামনা করতো। এভাবে শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে তারা তাঁদের উপাসনা করতে আরম্ভ করে।’’[5]

উপর্যুক্ত এ সব বর্ণনার দ্বারা বুঝা যায় যে, এ পাঁচ জন সৎ মানুষের মূর্তি নির্মাণ মূলত শয়তানের প্ররোচনায়ই হয়েছিল। এটি শয়তানের সে প্রতিজ্ঞা বাস্তবায়নেরই প্রারম্ভিক কাজ ছিল, যা সে জান্নাত হতে বিতাড়িত হওয়ার সময় আদম সন্তানদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য করেছিল।

তৃতীয় বর্ণনা :

ইমাম ইবন কাছীর আবু জা‘ফর আল-বাক্বির থেকে ‘ওয়াদ্দ’ সম্পর্কে একটি বর্ণনা দিয়েছেন। সংক্ষেপে তা নিম্নরূপ : ইমাম আবু জা‘ফর আল-বাক্বির এর নিকট ইয়াযীদ ইবন আল-মুহাল্লাব সম্পর্কে আলোচনা করা হলে তিনি বলেন : ইয়াযীদ ইবন আল-মুহাল্লাব এমন এক স্থানে নিহত হয়েছিলেন যেখানে সর্বপ্রথম গায়রুল্লাহর উপাসনা করা হয়েছিল। ‘ওয়াদ্দ’ নামের একজন সৎ মানুষ ছিলেন, তিনি তাঁর জাতির কাছে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁর তিরোধানের পর ব্যাবিলনের মানুষেরা তাঁর কবরের পার্শ্বে অবস্থান গ্রহণ করে তাঁর জন্য খুবই আহাজারী করতো। ইবলীস তাদের এ অবস্থা দেখে একজন মানুষের আকৃতি ধরে আগমন করে তাদেরকে বললো : এ ব্যক্তির জন্য তোমাদের যে কী দুঃখ ও বেদনা, আমি তা লক্ষ্য করেছি। আমি কি তোমাদের জন্য তাঁর প্রতিকৃতি নির্মাণ করে দেব? যা তোমরা তোমাদের যৌথ মিলন কেন্দ্রসমূহে রেখে এর মাধ্যমে তাঁকে স্মরণ করবে?

তারা এতে সম্মত হলে সে তাঁর অনুরূপ একটি মূর্তি তৈরী করে দিল। তারা এটিকে তাদের যৌথ মিলনকেন্দ্রে রেখে তাঁকে স্মরণ করতে থাকে। তাদের স্মরণের এ অবস্থা দেখে শয়তান পুনরায় এসে বললো : আমি কি তোমাদের প্রত্যেকের গৃহে রাখার জন্য অনুরূপ মূর্তি তৈরী করে দেব? তারা এতেও সম্মত হলে সে প্রত্যেক গৃহবাসীর জন্য এর অনুরূপ মূর্তি তৈরী করে দেয়। তারা তা গ্রহণ করে এর মাধ্যমে তাঁকে স্মরণ করতে থাকে। তাদের সন্তানরা তাদের এ সকল কার্যকলাপ দেখতে থাকে। বংশ বৃদ্ধি হয়ে যখন নতুন প্রজন্ম তাদের স্থান দখল করে নিল এবং তাঁকে স্মরণ করার মূল কারণ সম্পর্কে পরবর্তী প্রজন্মের লোকেরা অজ্ঞ রয়ে গেল, তখন তাদের সন্তানের সন্তানেরা আল্লাহকে ব্যতীত এ মূর্তিরই উপাসনা করতে লাগলো। ফলে ‘ওয়াদ্দ’ই হলেন প্রথম দেবতা যাকে আল্লাহর সাথে উপাসনা করা হয়।’’[6]

এ তিনটি ঐতিহাসিক বর্ণনা আমাদেরকে মোটামুটিভাবে এ প্রমাণ দিচ্ছে যে, তাওহীদ থেকে অংশীবাদের দিকে মানুষের পথভ্রষ্টতার সূত্রপাত হয় সৎমানুষদের (যারা সাধারণ মানুষদের পরিভাষায় আউলিয়া) কবরসমূহে প্রারম্ভে অবস্থান গ্রহণ এবং পরবর্তীতে তাঁদেরকে স্মরণ ও আল্লাহ তা‘আলার উপাসনায় আগ্রহ লাভের উদ্দেশ্যে তাঁদের মূর্তি নির্মাণের মধ্য দিয়ে। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে পরবর্তী প্রজন্মের লোকদের কাছে সেই সৎ মানুষদের মূর্তি নির্মাণের পিছনে তাদের পূর্বপুরুষদের কী উদ্দেশ্য ছিল, তা হারিয়ে যায়। এর সাথে সংযোজিত হয় আল্লাহর রুবূবিয়্যাত সম্পর্কিত ধর্মীয় জ্ঞানের অভাব। সে কারণে তারা পথভ্রষ্টতার দিকে অনেক দূর এগিয়ে যায়।

তারা এ সব মূর্তির সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কী কী কর্মপন্থা অবলম্বন করেছিল, এর বিশদ কোন বর্ণনা কুরআন ও হাদীসে পাওয়া না গেলেও এ কথা অত্যন্ত জোর দিয়ে বলা যায় যে, আউলিয়াদেরকে কেন্দ্র করে আজকের সাধারণ মানুষেরা যে সব অলীক ধ্যান-ধারণা পোষণ করে, তারাও তাঁদের অলিদের ব্যাপারে সে ধরনের ধ্যান-ধারণা পোষণ করতে শুরু করেছিল। তাঁদেরকে তাদের দুনিয়া-আখেরাতের জীবনের কল্যাণার্জন ও অকল্যাণ দূরীকরণের ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে শরীক করে নিয়েছিল। তাঁদেরকে আল্লাহর দরবারে তাদের অভাব অভিযোগ উপস্থাপনের মাধ্যম ও সুপারিশকারী হিসেবে গণ্য করেছিল। সে সময়ে কোনো শরী‘আত না থাকাতে[7] তারা তাদের অলিদের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য এমন সব কর্ম করতে আরম্ভ করেছিল যা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা‘আলার উপাসনার শামিল ছিল। এভাবে তারা শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে আল্লাহর উলূহিয়্যাত ও রুবূবিয়্যাতে শির্কী কর্মে নিমজ্জিত হয়েছিল।

আদম সন্তানদেরকে এভাবে পথভ্রষ্ট করার মাধ্যমে শয়তান প্রত্যেক যুগে বনী আদমকে পথভ্রষ্ট করার পদ্ধতি ও কৌশল সম্পর্কে অবগত হয়ে যায় এবং পরবর্তী প্রতিটি জাতিকে শির্কে নিমজ্জিত করার ক্ষেত্রে সে তার পরিচিত এই পদ্ধতি ও কৌশল প্রয়োগ করতে থাকে। যদিও যুগের চাহিদানুযায়ী প্রয়োজনের নিরিখে এ পদ্ধতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে সে নিত্য নতুন পন্থা অবলম্বন করেছে। কুরআনুল কারীম আমাদের জন্য এ কথার উত্তম সাক্ষ্য যে, শয়তান এ পদ্ধতি প্রয়োগ করেই অতীতে হূদ, সালেহ, ইব্রাহীম, মূসা ও ঈসা আলাইহিস সালাম-এর জাতিসমূহকে পথভ্রষ্ট করেছিল। তাদেরকে নিজ হাতে তৈরী মুর্তিসমূহের ব্যাপারে একই ধরনের ধারণা ও উপাসনায় লিপ্ত করেছিল। শয়তান এভাবে যুগের পর যুগ ধরে বনী আদমকে পথভ্রষ্ট করার জন্য তার সেই পূর্ব প্রতিজ্ঞা পূরণের জন্য বিরামহীনভাবে কাজ করে চলেছে।

তার এ প্রচেষ্টার ফলে যে ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম-একনিষ্ঠ তাওহীদের অনুসারী ও ঘোষণাকারী ছিলেন, এক সময় সে ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম-এর বংশধরদেরকেও সে পথভ্রষ্টতার অতলতলে নিক্ষেপ করেছিল। মহান আল্লাহ একান্ত অনুগ্রহে শেষ নবী ও রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে প্রেরণ করার ফলে দ্বীনে ইব্রাহীমের অনুসারী বলে দাবীদার অনুসারীদের মধ্যে পুনরায় তাওহীদের পতাকা উড্ডীন হয়েছিল; কিন্তু শয়তানের নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টার ফলে সেই তাওহীদী বিশ্বাসের মাঝেও সুদূর অতীতকাল থেকেই শয়তান পুনরায় শির্কী চিন্তা-ভাবনা ও কর্মের অনুপ্রবেশ ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। যার ফলে বর্তমানে মুসলিম বিশ্বের অসংখ্য মুসলিমদের অবস্থা সেই দ্বীনে ইব্রাহীমের অনুসারী বলে দাবীদারদের অনুরূপ হয়ে গেছে, যাদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন :

﴿ وَمَا يُؤۡمِنُ أَكۡثَرُهُم بِٱللَّهِ إِلَّا وَهُم مُّشۡرِكُونَ ١٠٦ ﴾ [يوسف: ١٠٦]

‘‘এদের অধিকাংশরাই মুশরিক অবস্থায় আল্লাহর উপর বিশ্বাস করে’’।[8]

>
[1]. ইবনুল জাওযী, প্রাগুক্ত; পৃ. ৬৩, ৬৪; ইবনু কাইয়্যিম আল-জাওযী, এগাছাতুল লহফান; ২/১৬২।

[2]. তদেব।

[3]. আল-কুরআন, সূরা নূহ : ২৩।

[4]. বুখারী, প্রাগুক্ত; কিতাবুত তাফছীর, সূরা নূহ, ৩/৬/২৮১।

[5]. ইবনে কাছীর, জামিউল বয়ান ফী তাফছীরিল ক্বুরআন; ১২/২৯/৬২; ইবনু কাইয়্যিম আল-জাওযীয়্যাহ. এগাছাতুল লহফান; ২/১৬১।

[6]. ইবনু কাছীর, ক্বাসাসুল আম্বিয়া; পৃ. ১১৫; জালালুদ্দীন আস-সুয়ূতী, আদ-দুররুল মানছূর; ৬/২৬৯।

[7] শরী‘আত ছিল না, এটা স্বাভাবিক অর্থে নয়, অর্থাৎ শরী‘আত সম্পর্কে মানুষ অজ্ঞ হয়ে গিয়েছিল। [সম্পাদক]

[8].আল-কুরআন, সূরা ইউসুফ : ১০৬।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ২ পর্যন্ত, সর্বমোট ২ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে