আমরা কমবেশী সকলেই জানি যে, শয়তান অহঙ্কারবশত আল্লাহ তা‘আলার আদেশকে অমান্য করে আদম আলাইহিস সালামকে সেজদা না করার কারণে মহান আল্লাহ তাকে তাঁর রমহত থেকে বিতাড়িত করে জান্নাত থেকে বহিষ্কার করেছিলেন। বহিষ্কৃত হওয়ার প্রাক্কালে সে এ মর্মে প্রতিজ্ঞা করে বের হয়েছিল যে, বনী আদমের মধ্যকার আল্লাহর একনিষ্ঠ অল্প সংখ্যক বান্দাদের ব্যতীত অবশিষ্ট সবাইকেই সে তার বহুমুখী ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার সরল ও সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করবে।
আল্লাহ তা‘আলা তার এ প্রতিজ্ঞার জবাবে বলেছিলেন: ‘‘আমার বান্দাদের উপর তোমার কোনো কর্তৃত্ব নেই, তবে পথভ্রষ্টদের মধ্যকার যারা তোমার অনুসরণ করবে, তাদের কথা সতন্ত্র’’।[1] শয়তান তার এ প্রতিজ্ঞা পূরণের জন্য সকল বনী আদমের পিছনে জিন ও মানুষের মধ্যকার তার অনুসারীদেরকে দিবানিশি লাগিয়ে রেখেছে। তারা বিভিন্ন কৌশলে তাদের ঈমান ও ‘আমল নষ্ট করার কাজে সর্বদা তৎপর রয়েছে। সাধারণ মানুষতো দুরের কথা স্বয়ং রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এরও ‘আমল নষ্ট করার ব্যাপারে চেষ্টা করতেও তার অনুসারীরা ত্রুটি করে নি। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- বলেন:
‘‘জিনদের মধ্যকার একটি দুষ্ট জিন এসে গত রাতে আমার সালাত ভেঙ্গে দেয়ার জন্য আক্রমণ করেছিল। তাকে পাকড়াও করার ব্যাপারে আল্লাহ আমাকে সুযোগ করে দিয়েছিলেন, ফলে আমি তাকে ভীত সন্ত্রস্ত করে মসজিদের পায়ার সাথে বেঁধে রাখতে চেয়েছিলাম, যাতে তোমরা সকালে এসে তাকে দেখতে পাও। কিন্তু ততক্ষণে আমার মনে পড়লো সুলায়মান এর সেই দো‘আর কথা, তিনি বলেছিলেন: হে আমার প্রতিপালক! আমাকে এমন রাজত্ব দান করুন যা আমার পরে আর কারো জন্যে শোভা পায়না। তাঁর এ দো‘আর কথা মনে পড়ায় আমি তাকে ছেড়ে দেই।’’।[2]
রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ‘আমল নষ্ট করার ক্ষেত্রে শয়তানের অনুসারীদের ষড়যন্ত্র সীমাবদ্ধ থাকলেও তাঁর উম্মতগণের ঈমান ও ‘আমল উভয়ই নষ্ট করার ক্ষেত্রে তার অনুসারীদের রয়েছে নানাবিধ কৌশল। বিভিন্ন জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মানব সমাজে যে-সব শির্কী ধ্যান-ধারণা, কর্ম ও অভ্যাসের প্রচলন রয়েছে, তা তাদের ষড়যন্ত্রেরই ফসল। তারা যাকে যে কৌশল অবলম্বন করলে পথভ্রষ্ট করা যায়, তাকে সে কৌশলেই পথভ্রষ্ট করার চেষ্টা করে চলেছে। তাদের ষড়যন্ত্রের হাত থেকে আল্লাহর তা‘আলার রহমতে কেবল তারাই রক্ষা পেতে পারে যাদের শরী‘আত সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান রয়েছে।
আল্লাহর অলিগণের ওসীলা ও তাঁদের শাফা‘আত সম্পর্কে সাধারণ মুসলিম জনমনে শয়তান যে অতিরঞ্জিত ধারণা প্রদান করেছে, সে ধারণা দু’টিকে সাধারণ জনগণের অন্তরে বদ্ধমূল করা এবং এ দু’টিকে কেন্দ্র করে তাদেরকে প্রত্যক্ষ শির্কে নিমজ্জিত করার জন্য তার রয়েছে বিভিন্ন অপকৌশল। নিম্নে তার কিছু অপকৌশলের বর্ণনা প্রদান করা হলো:
প্রথম অপকৌশল:
কোন কবরে কারো প্রয়োজন পূর্ণ হওয়া
ওলিগণ আল্লাহ ও সাধারণ মানুষের মাঝে মাধ্যম ও শাফা‘আতকারী হওয়ার বিষয় দু’টিকে প্রমাণ করার জন্য শয়তান সাধারণ মানুষদের কাছে কৌশল হিসেবে সে-সব লোকদের উদাহরণ এনে উপস্থাপন করে যারা তাদের কোনো প্রয়োজন কোনো কবরে উপস্থাপন করার পর তা অর্জিত হয়েছে বলে মনে করে। এ ধরনের লোকদের উদাহরণ উপস্থাপন করে শয়তান সাধারণ লোকদের অন্তরে এ কুমন্ত্রণা দেয় যে, অলিগণের উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্য রয়েছে বলেই সে-সব লোকদের মনস্কামনা তাঁদের কবরে পূর্ণ হয়েছে।
শয়তানের এ অপকৌশল থেকে বেরিয়ে আসার উপায়:
শয়তানের এ-জাতীয় অপকৌশল ও ষড়যন্ত্রের জাল থেকে বেরিয়ে আসার জন্য জনগণকে জানতে হবে যে, আল্লাহই হলেন মানুষের ভাগ্যের একক নিয়ন্তা। প্রতিটি মানুষ তার জীবনে কী কর্ম করবে এবং জীবিতদের মধ্য থেকে কারা তার প্রয়োজন পূরণে সহযোগিতা বা দো‘আ করবে, এ-সব কিছু আগাম জানার ভিত্তিতে তিনি হিকমত ও পরীক্ষার বিষয়কে সামনে রেখে তা নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে তারতম্য করেছেন। তাই সকলেই সম্পদশালী হতে চাইলেও একসাথে সবাই সম্পদশালী হতে পারেনা। সবাই সুস্থ শরীর, দীর্ঘায়ূ ও সন্তানাদি কামনা করলেও তা পায়না।
আল্লাহর বিচারে যাকে যখন যা দেয়া উচিত, তখন তাকে তিনি তা দিয়ে থাকেন। সে-জন্য কেউ সন্তান আগে পায়, কেউ পরে পায়, আবার কেউ অদৌ পায়ই না। এ ভাবে যারা ভাগ্যের পরীক্ষায় পড়ে তাদের করণীয় হচ্ছে- ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য যখন যে কর্ম করা প্রয়োজন তখন তা নিজে বা অপর জীবিত মানুষদের সহযোগিতা নিয়ে করতে হবে। অতঃপর কর্মের ফল প্রাপ্তির জন্য আল্লাহর উপরে অগাধ আস্থা রেখে ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করতে হবে।
মনে মনে এ দৃঢ় বিশ্বাস লালন করতে হবে যে, আজ হোক কাল হোক আল্লাহর ইচ্ছায় আমার ভাগ্যে পরিবর্তন আসবেই। কোনো অবস্থাতেই ধৈর্যহারা হয়ে আল্লাহর উপর থেকে আস্থা হারিয়ে ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় অন্য কারো দারস্থ বা শরণাপণ্ণ হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। বিশেষ করে কোনো মৃত ওলি বা দরবেশের কবরের দারস্ত হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কেননা, কোনো মানুষ তিনি যত বড় মাপেরই ওলি হয়ে থাকুন না কেন- মরে গেলে তাঁর পক্ষে পরের উপকার করাতো দূরের কথা তখন তিনি তাঁর নিজেরই কোনো উপকার করতে পারেন না।
ইহজগতে থাকাবস্থায় মানুষের দেহের সাথে তার আত্মার স্বাভাবিক সম্পর্ক থাকে বিধায়, একজন মানুষ সাধ্যানুযায়ী তার নিজের ও অপর মানুষের উপকার করতে পারে। কিন্তু মরে যাওয়ার পর তার দেহের সাথে আত্মার স্বাভাবিক সম্পর্ক থাকেনা বিধায়, তার পক্ষে নিজের ও পরের কারোই কোনো উপকার করা সম্ভব হয়না। সে-জন্য তখন তাঁরা জীবিতদের দো‘আর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকেন। তাই সাধারণ, ওলি ও দরবেশ নির্বিশেষে সকলের কবর যিয়ারতে কেবল তাদের মাগফিরাত কামনা ও তাদের জন্য দো‘আ করার উদ্দেশ্যেই যেতে হয়, তাঁদের কাছে কিছু চাওয়ার জন্যে নয়।
এতো হলো শরী‘আতে কথা। কিন্তু শয়তান কবর যিয়ারতের এ উদ্দেশ্যকেই সাধারণ মানুষের কাছে বিকৃত করে দিয়েছে। তাদের এ বুদ্ধি দিয়েছে যে, কবর যিয়ারতের উক্ত বিধান ওলিদের বেলায় প্রযোজ্য নয়। কেননা, তাঁরা আল্লাহর সান্নিধ্য ও নৈকট্য লাভ করে জান্নাতবাসী হয়ে গেছেন। সুতরাং তাদের জন্য মাগফিরাতের দো‘আ করার কোনো প্রয়োজন নেই। তাঁদের কবর যিয়ারতে যেতে হবে নিজের প্রয়োজনের কথা তাঁদের জানানোর জন্যে! কেননা, তাঁরা মরেও মরেন নি। তাঁদের এ মৃত্যু কেবল স্থান পরিবর্তন বৈ আর কিছুই নয়। দুনিয়াতে থাকাকালে যেমন তাঁরা মানুষের কল্যাণ করেছেন, ইন্তেকালের পরেও তাঁরা মানুষের কল্যাণের জন্য নিজেদের নিবেদিত করে রেখেছেন। যারা তাঁদের কাছে নিজেদের প্রয়োজনের কথা জানায়, তাঁরা তাদের প্রয়োজন পূর্ণ করে দেন?! নাউজুবিল্লাহ ।
শয়তানের এ প্রবঞ্চনা থেকে বাঁচার উপায়:
শয়তানের এ-জাতীয় প্রবঞ্চনা থেকে বাঁচতে হলে আমাদেরকে জানতে হবে যে, বাহ্যিক দৃষ্টিতে কোনো কবরে আবদার করে কারো উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে থাকলেও আসলে তা কবরস্থ ওলির কারণে পূর্ণ হয়েছে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। কেননা, কবরে আবেদনকারীর উদ্দেশ্য দু’ভাবে পূর্ণ হতে পারে:
এক, কবরে অবেদনকারীর প্রয়োজন যদি সন্তান দান, রোগ মুক্তি ইত্যাদির মত বিষয় হয় যা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অপর কেউ পূর্ণ করতে পারে না, তা যদি কোনো কবরে চেয়ে বা কবরের কূপের পানি ও গাছের ফল খেয়ে কেউ পেয়ে থাকে, তা হলে বুঝতে হবে যে, আসলে সে ব্যক্তির এ প্রয়োজন আল্লাহ তা‘আলাই পূর্ণ করেছেন। এর সাথে সে ওলির মধ্যস্থতা ও শাফা‘আতের কোনই সম্পর্ক নেই। আল্লাহই সে ব্যক্তির ঈমানী পরীক্ষা গ্রহণের জন্য তার ভাগ্যে তা বিলম্বে দানের বিষয়টি লিখে রেখেছিলেন। সে যদি কবরে না যেয়ে ধৈর্যের সাথে এ সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করে তার বাড়ীতে বসেই আল্লাহর কাছে বিনয়ের সাথে তা চাইতে থাকতো, তা হলে ঠিক এ সময়েই তার বাড়ীতে বসেও তার এ উদ্দেশ্য পূর্ণ হতো। কিন্তু তা না করে কবরে যাওয়ার কারণে তার ঈমান ও ধৈর্যের পরীক্ষায় সে অকৃতকার্য হয়েছে বলে নিজেকে প্রমাণ করে দিল।
দুই, আর যে সকল প্রয়োজন আল্লাহ ব্যতীত অপর কোনো মানুষ বা জিনের পক্ষে স্বাভাবিকভাবে পূর্ণ করা সম্ভব, কারো এমন কোনো প্রয়োজন কোনো কবরে আবেদনের পর পূর্ণ হয়ে থাকলে বুঝতে হবে যে, শয়তান নিজেই কবরে আবেদনকারী এবং অন্যান্য আরো লোকদের ঈমান নষ্ট করার জন্য সে ব্যক্তির প্রয়োজন পূর্ণ করে দিয়েছে।
আমাদের আরো মনে রাখতে হবে যে, কারো উত্তম জীবন ও জীবিকা লাভ করা তার ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল নয়। আমরা এ-জগতে যেমন নিজেদের ইচ্ছায় আগমন করি নি, তেমনিভাবে সবাই আল্লাহর কাছে উত্তম জীবিকা চাইলেও তা সমানভাবে পাই না। আবার যারা আল্লাহকে বিশ্বাসই করেনা তারাতো আল্লাহর কাছে কিছুই চায় না। তা সত্ত্বেও তারা এ দুনিয়ায় আমাদের অনেকের চেয়ে ভাল জীবন ও জীবিকা লাভ করে। এতে প্রমাণিত হয় যে, মানুষের জীবন ও জীবিকার বিষয়টি আল্লাহর ইচ্ছাধীন। তিনি ইচ্ছা করে আমাদের সৃষ্টি করেছেন। সুস্থ জীবন ও উত্তম জীবিকা লাভের জন্য আমাদেরকে সতর্কতা অবলম্বন এবং ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় কর্ম করার নির্দেশ করেছেন এবং কারা কী করবে তা আগাম জানার আলোকে আমাদের ভাগ্যে তা লিখে রেখেছেন।
এখন আমরা যদি তাঁর তাওহীদে বিশ্বাসী হয়ে সুস্থ জীবন ও উত্তম জীবিকা লাভের জন্য প্রয়োজনীয় কর্ম করে তাঁর কাছে তা কামনা করি, তা হলে তা পাই আর না পাই, অন্তত আমাদের ঈমান ঠিক থাকবে। আর যারা তাঁকে বিশ্বাস করেনা, অথচ উত্তম জীবন ও জীবিকা লাভের জন্য প্রয়োজনীয় কাজ করে, অথবা তাঁর উপর বিশ্বাস রাখে কিন্তু মৃত অলিগণের কাছে বা তাঁদের মাধ্যম ও শাফা‘আতে উত্তম জীবন ও জীবিকা চেয়ে তা পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কাজ করে, তিনি হিকমতের ভিত্তিতে তাদের অনেককেও তা দিয়ে থাকেন কেননা; তারা সকলেই তাঁর সৃষ্টি। তারা তাঁকে বিশ্বাস করুক আর না-ই করুক, তাঁর তাওহীদে বিশ্বাসী হোক আর না-ই হোক এবং তাঁর কাছে সরাসরি কিছু চাক আর না-ই চাক, কাফির-মুশরিক-মুসলিম নির্বিশেষে সকলের জন্যই তাঁর দান অবারিত।[3] তাই কোনো কবরে কারো প্রয়োজন পূর্ণ হলে এতে কারো বিভ্রান্ত হবার কোনই অবকাশ নেই।
এছাড়াও আমাদের আরো মনে রাখতে হবে যে, কালোবাজারী করে সম্পদ অর্জন করলে তা যেমন আল্লাহরই দান হয়ে থাকে, তেমনিভাবে কোনো কবরে কিছু চাওয়ার পর তা পেলে তাও আল্লাহরই দান হয়ে থাকবে। এতে কালোবাজারী করা যেমন বৈধ হয়ে যাবেনা, তেমনি এতে কবরে কিছু চাওয়াও বৈধ হয়ে যাবেনা। সম্পদ দেওয়ার মালিক যেমন আল্লাহ, তেমনি বিপদ থেকে রক্ষা করার মালিকও তিনিই। এতে মৃত অলিগণের ওসীলা ও শাফা‘আতের কোনই হাত নেই। ‘কুরায়শরা লাত, উয্যা, মানাত ও হুবল নামের সৎ মানুষ ও ফেরেশ্তাদের মূর্তি ও জিনের মাধ্যম ও শাফা‘আতে আল্লাহর কাছে উত্তম জীবন ও জীবিকা এবং বৃষ্টির জন্য আবদার করে অনেক সময় তা পেতো।[4]
তাই বলে কি এ-কথা স্বীকার করা যাবে যে, তারা তাদের দেব-দেবীদের ওসীলা ও শাফা‘আতেই এ-সব পেতো? বা তাদের দেব-দেবীদের এ-সব দেয়ার যোগ্যতা ছিল? তা যদি স্বীকার করা না যায়, তা হলে আমাদের কিছু প্রাপ্তির পিছনেও মৃত ওলিগণের মধ্যস্থতা, শাফা‘আত ও দানের বিষয়কে স্বীকার করা যাবে না। কেননা, তাঁরা ওয়াদ, সুয়া‘, ইয়াগুছ, য়াউক ও নছর এবং ফেরেশ্তা ও জিনদের মতই আল্লাহর সৃষ্ট জীব। তাঁরা আল্লাহর ওলি হয়ে এবং ফেরেশ্তারা আল্লাহর অনুগত বান্দা হয়েও যদি আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছার বাইরে নিজ থেকে মানুষের কোনো উপকার করতে না পারেন, তা হলে আমরা যাদের ওলি বলে মনে করি, তাঁরাও মৃত্যুর পর মানুষের কোনো উপকার করতে পারবেন না। প্রকৃতপক্ষে ওলিদের ব্যাপারে এ ধরনের ধারণা করা কুফরী বৈ আর কিছুই নয়।
এ সম্পর্কে প্রখ্যাত হানাফী আলেম আল্লামা শামী বলেন:
(إن ظن أن الميت يتصرف في الأمور دون الله اعتقاده ذلك كفر)
‘‘যদি (কেউ) এ ধারণা করে যে, আল্লাহ ব্যতীত মৃত মানুষেরা পার্থিব বিষয়াদি পরিচালনায় হস্তক্ষেপ করেন, তা হলে তার এ ধারণা কুফরের অন্তর্গত বলে বিবেচিত হবে’’।[5]
রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কারো কোনো উপকার করতে পারেন না:
কোন মৃত মানুষ যদি কারো উপকার করতে পারে তা হলে সর্বাগ্রে তা আমাদের রাসূল-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এরই পারার কথা। অথচ বাস্তবতা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তাঁর তিরোধানের পর মুসলিমগণ বহু অপ্রত্যাশিত ঘটনার শিকার হয়েছিলেন; কিন্তু বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য কখনও কোনো সাহাবীকে তাঁর রওজা মুবারকে যেয়ে তাঁর নিকট কোনো অভিযোগ করতে বা সাহায্য চাইতে দেখা যায় নি। বা তাঁকে তাঁদের বিপদ দূর করতে এবং সমস্যার সমাধান করে দেয়ার জন্য কিছু বলেছেন বলেও কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। সাহাবীগণ যেমন তাঁর কাছ থেকে কোনো সাহায্য চাননি, তেমনি তিনি নিজ থেকে আগ্রহী হয়েও তাঁদের কোনো উপকার করেন নি। তাঁর যদি কোনো উপকার করার সামর্থ্য থাকতো, তা হলে তাঁর তিরোধানের পরপরই খিলাফতের বিষয় নিয়ে মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে কোনো বিতর্কের সৃষ্টি হতো না।
‘উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে একজন অগ্নিপূজকের হাতে শহীদ হতে হতো না। ‘উছমান রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বিদ্রোহীদের হাতে নির্মমভাবে শাহাদৎ বরণ করতে হতো না। ‘উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর হত্যার বিষয়কে নিয়ে ‘আলী ও মু‘আবিয়া এর মধ্যে কোনো যুদ্ধবিগ্রহ হতো না। ইয়াজীদ ইবনে মু‘আবিয়ার সৈনিকদের দ্বারা মদীনায় লুটতরাজ, গণহত্যা ও শ্লীলতাহানির মত জঘন্য কর্ম সংঘটিত হতো না। সর্বোপরি কারবালা প্রান্তরে ইয়াযীদের সৈন্যদের হাতে তাঁর দৌহিত্র হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর নির্মমভাবে শাহাদৎ বরণ করতে হতো না। তাঁর হাদীসসমূহ মানুষের বানানো হাদীসের সাথে মিলে একাকার হয়ে যেতো না। ইমাম বুখারী ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ তাঁর রওযা মুবারকের পার্শ্বে যেয়ে তাঁর নিকট থেকে তাঁর হাদীসগুলো জেনে নিতেন।
ফলে মুসলিম উম্মাহের মাঝে বিভিন্ন ‘আমলের ক্ষেত্রে তাঁর হাদীসকে কেন্দ্র করে কোনো মতভেদের সৃষ্টি হতো না। তাঁর হাদীসসমূহের মধ্যে কোন্টি নাসিখ ও কোন্টি মানসূখ, তাও জেনে নেয়া সম্ভব হতো। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখছি তিনি এ-সব ক্ষেত্রে কোনো কিছুই করতে পারেন নি। এতে প্রমাণিত হয় যে, তাঁর এ-সব ক্ষেত্রে কাউকে কোনো সাহায্য করার কোনই সামর্থ্য নেই। এই যদি হয় দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ মানব ও আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় মানুষের অবস্থা, তা হলে তাঁর উম্মতের মাঝে এমন কে থাকতে পারেন, যিনি মৃত্যুর পর জীবিত মানুষের প্রয়োজন পূরণ করতে পারেন? বস্তুত কোনো মানুষ মরে যাওয়ার পর যদি তার ব্যাপারে এ ধারণা করা হয় যে, তিনি এখনও মানুষের উপকার করতে পারেন এবং এ ধারণার ভিত্তিতে যদি সে ব্যক্তিকে আহ্বান করা হয়, তা হলে তা হবে প্রকাশ্য শির্ক। এ-জাতীয় শির্ককারীদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন:
﴿ إِن تَدۡعُوهُمۡ لَا يَسۡمَعُواْ دُعَآءَكُمۡ وَلَوۡ سَمِعُواْ مَا ٱسۡتَجَابُواْ لَكُمۡۖ وَيَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ يَكۡفُرُونَ بِشِرۡكِكُمۡۚ ﴾ [فاطر: ١٤]
‘‘তোমরা যদি তাদেরকে (সাহায্যের জন্য) আহ্বান কর, তা হলে তারা তোমাদের ডাক শুনবে না, আর শুনলেও তারা তোমাদের ডাকের কোনো জবাব দিবেনা। আর কেয়ামতের দিন তারা তোমাদের শির্ককে অস্বীকার করবে’’।[6] তারা বলবে: প্রভু হে ! আমরা তাদের সাহায্য করতে পারি বলে ওরা আমাদের প্রতি মিছেমিছি যে ধারণা করেছিল, সে ধারণার ভিত্তিতেই ওরা আমাদেরকে তাদের সাহায্য করার জন্য আহ্বান করেছে। আমরা কখনও তাদেরকে সাহায্যের জন্য আমাদেরকে আহ্বান করতে বলিনি। আপনাকে সাহায্যের জন্য আহ্বান না করে আমাদেরকে আহ্বান করার করণে ওরা যে শির্ক করেছে, আমরা তাদেরকে তা শিক্ষা দেইনি।
ওলিগণ কারো উপকার করতে না পারার প্রমাণ
ওলিগণ যে মৃত্যুর পর মানুষের কোনো উপকার করতে পারেন না এর জ্বলন্ত প্রমাণ হলো- দীর্ঘকাল থেকে তাঁদের কবরকে কেন্দ্র করে অসংখ্য মূর্খ মানুষেরা কত শির্কী কর্ম করে চলেছে, কত লোকেরা তাঁদের কবরে সেজদা করছে, তাঁরা জীবিত থাকতে এমনটি কেউ করলেতো তাঁরা তাতে অবশ্যই বাধা দিতেন। কিন্তু তাঁদের মৃত্যুর পর তাঁদের কবরকে কেন্দ্র করে যে-সব শির্কী কর্ম করা হচ্ছে, তাত্থেকে তাঁরা কাউকে বারণ করছেন না। এতে প্রমাণিত হয় যে, তাঁরা আসলে কিছুই করতে পারেন না।
যদি পারতেন তা হলে অন্তত তাঁদের কবরে সেজদা করা থেকে লোকদের বারণ করতেন। সাধারণ লোকেরা তাঁদেরকে অসীম শক্তির অধিকারী বলে মনে করে। তাঁরা যা চান তাই করতে পারেন বলে মনে করে। ২০০৩ সালে যখন ইরাক ইঙ্গ-মার্কিনীদের অবৈধ হামলার শিকার হয়, তখন ওলীদের গোপন শক্তি থাকার ব্যাপারে বিশ্বাসী লোকেরা ভেবেছিল এবার বুশ-ব্লেয়ারের খবর হয়ে যাবে। যে মাটিতে শুয়ে আছেন গউছুল আ‘যম আব্দুল কাদির জীলানী, সে মাটিতে এবার ওদের বারোটা বাজবেই। তাঁর অভিসম্পাতে ওরা ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু দেখা গেল হিতে বিপরীত হয়ে গেল। ওরা এ-সব মুসলিমদের কাল্পনিক বিশ্বাসকে মিথ্যায় পর্যবসিত করে দিয়ে এক মাসের মধ্যেই সমগ্র ইরাক দখল করে নিল। কই বড় পীরতো তাঁর দেশ রক্ষার জন্য কিছুই করলেন না।
এমনকি তাঁদের শক্তিতে বিশ্বাস পোষণকারীদের প্রবঞ্চনা করার জন্য শয়তানের পক্ষ থেকেও কিছু করা সম্ভব হলোনা। হাজারো নিরপরাধ শিশু ও নারী অন্যায়ভাবে দুস্কৃতিকারী দখলদারদের হাতে নির্মমভাবে আত্মাহুতি দিল, তা দেখেও তিনি কিছু করলেন না। এরপরেও কি এ-কথা বিশ্বাস করা যায় যে, ওলিগণ অনেক কিছু করতে পারেন!? কেউ হয়তো বলতে পারেন যে, সাদ্দাম হোসেনের স্বৈরশাসন থেকে দেশের জনগণকে রক্ষার জন্য হয়তো আব্দুল কাদির তাঁকে সাহায্যের জন্য আহ্বানকারীদের ডাকে সাড়া না দিয়ে নীরব ছিলেন।
এমন চিন্তাকারীকে বলবো: সাদ্দাম হোসেনকে যদি সরাতেই হয়, তা হলে তা বুশ আর ব্লেয়ারকে দিয়ে কেন? সাধারণ মানুষের বিশ্বাস অনুযায়ী তিনি নিজেই তো তাকে সরানোর জন্য যথেষ্ট ছিলেন। তা না হয় আল্লাহর কাছে বলে দিতেন-প্রভু! সাদ্দামকে সরিয়ে দাও। ফলে আল্লাহ তাকে সরিয়ে দিতেন। কিন্তু তিনি কিছুই করলেন না। যা হবার তা-ই হয়ে গেল। এ-সব কিছু মিলে এ-কথা প্রমাণিত হয়ে গেল যে, আসলে ওলিগণ সাধারণ মানুষের মতই মৃত। সাধারণ মৃত মানুষের মত তাঁরাও কারো জন্যে কিছুই করতে পারেন না। কোনো অন্যায়ের কথা তাঁরা নিজ থেকে জানতে পারেন না, জানতে পারলেও তাঁরা তা রোধ করতে পারেন না। সে জন্যেই যুগ যুগ ধরে তাঁদের কবরকে কেন্দ্র করে শির্কী কর্ম অহরহ হয়েই চলেছে। এর পরেও কি আমরা তাঁদের নিয়ে এ-সব আকাশকুসুম ও অলীক কল্পনা লালন করতেই থাকবো? اللهم لا
إِنَّ عِبَادِي لَيۡسَ لَكَ عَلَيۡهِمۡ سُلۡطَٰنٌ إِلَّا مَنِ ٱتَّبَعَكَ مِنَ ٱلۡغَاوِينَ ٤٢ ﴾ [الحجر: ٤٢]
দেখুন: আল-কুরআন:সূরা:আল-হিজর: ৪২।
[2].বুখারী, প্রাগুক্ত; (আবওয়াবুল মাসাজিদ, বাব নং ৪২, হাদীস নং৪৪৯), ১/১৭৬ ;মুসলিম, প্রাগুক্ত; (কিতাবুল মাসাজিদ, বাবনং-৮, হাদীস নং-৫৪১), ১/৩৮৪;= =রাহওয়ায়হ, ইসহাক ইবনে ইবরাহীম ইবন মিখলদ, মুসনাদ; সম্পাদনা: ড.আব্দুল গফুর আল-বেলূচী, (মদীনা: মাকতাবাতুল আইমান, ১ম সংস্করণ, ১৯৯১ খ্রি.); ১/১৪৮।
[3].এ প্রসংগে আল্লাহ বলেন:
{كُلًا نُمِدُّ هَؤْلاَءِ وَ هَؤُلاَءِ مِنْ عَطَاءِ رَبِّكَ وَ مَا كَانَ عَطَاءُ رَبِّكَ مَحْظُوْراً
‘‘আমি তোমার রবের দান থেকে এদের ও ওদের সবাইকে দিয়ে থাকি। আর তোমার রবের দান কারো জন্যে নিষিদ্ধ নয়’’। আল-কুরআন, সূরা বনী ইসরাঈল: ২০।
[4]. ইবনে তাইমিয়্যাঃ, এক্বতেদাউস সিরাতিল মুস্তাকীম; পৃ. ৩২০।
[5]. ইবনে ‘আবিদীন, প্রাগুক্ত;২/১৭৫।
[6]. আল-কুরআন, সূরা ফাতির : ১৪।