কুরআন অবতীর্ণকালীন সময়ে সমাজে যারা কাহিন বা জ্যোতির্বিদ নামে পরিচিত ছিল, তারা মোট দু’টি মাধ্যমের উপর নির্ভর করে ভবিষ্যদ্বাণী করতো :
এক . তারকারাজির গতিবিধির প্রতি লক্ষ্য করে আবহমান কাল থেকে জ্যোতির্বিদরা আন্দাজ ও অনুমানের উপর নির্ভর করে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল, সে অভিজ্ঞতার আলোকে তাদের মাঝে ভবিষ্যদ্বাণী করার যে রীতি চলে আসছিল, সে রীতি অনুযায়ী তারা কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করতো।
দুই. জিনরা উর্ধ্বাকাশে গিয়ে ফেরেশতারা পৃথিবীর কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করলে গোপনে তা শ্রবণ করে তাদের কাছে এসে এর সাথে আরো অসংখ্য মিথ্যা মিশ্রণ করে সংবাদ দিতো এবং সে সংবাদের আলোকেই তারা কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করতো। ফলে তাদের কিছু কথা বাস্তবের সাথে মিলে যেতো। এ জাতীয় ভবিষ্যৎ প্রবক্তাদের উত্তরসূরীরা এখনও সকল দেশেই কম-বেশী রয়েছে। তবে এদেরকে আর আধুনিক জ্যোতির্বিদদেরকে একপাল্লায় বিচার করা যায় না; কারণ, পুরাতন জ্যোতিষ ও তাদের উত্তরসূরীগণ পুরাতন নিয়মানুযায়ী তারকার গতিবিধি লক্ষ্য করে আন্দাজ ও অনুমান করে মানুষের ভাগ্যের ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করেন। তারা একদিকে যেমন বাস্তবে সত্যিকার অর্থেই কিছু ঘটতে যাচ্ছে এমন কিছু জেনে কোনো কথা বলতে পারেন না, অপরদিকে তেমনি তারা যা বলেন এর দু’একটি কথা ঘটনাক্রমে সত্য বলে প্রমাণিত হলেও বাদবাকী সবই মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়। যেমন ২০০৪ সনে অনুষ্ঠিত আমেরিকার নির্বাচনের ফলাফল দ্বারা তাদের মিথ্যাবাদিতা প্রমাণিত হয়েছে। তথাকথিত জ্যোতির্বিদরা বলেছিল
এবারের নির্বাচনে জন কেরি জয়ী হবেন, কিন্তু বাস্তবে তা হয় নি। পক্ষান্তরে আধুনিক জ্যোতির্বিদগণ যা বলেন তা কোনো অদৃশ্য সম্পর্কিত বিষয় নয়। তারা আধুনিক বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে সৌরজগত সম্পর্কে নিত্য নতুন যে সব আবিষ্কারের কথা বলেন, তাদের সে সব কথা সত্য হোক আর না হোক তা যেমন মানুষের ভাগ্যের সাথে সম্পৃক্ত কোনো অদৃশ্য সম্পর্কিত কথা নয়, তেমনি তা মিথ্যা হলেও এতে মানুষের ব্যক্তি জীবনেও এর কোনো বিরূপ প্রভাব নেই। জ্যোতিষরা মানুষের ভাগ্য সম্পর্কে জানে এবং এ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে এ মর্মে জনমনে যে বিশ্বাস রয়েছে ইসলামী শরী‘আতে এ বিশ্বাসের কোনো স্থান নেই। বরং নিম্ন জগতের ঘটনা প্রবাহের উপর উর্ধ্ব জগতের তারকার প্রভাবে বিশ্বাস করাকে ইসলামে শির্কী বিশ্বাস বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এমন বিশ্বাসীকে হাদীসে কুদসীতে কাফির বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।[1]
১. জিন ও জিন সাধকরা গায়েব সম্পর্কে জানতে পারে বলে বিশ্বাস করা :
আমাদের দেশের অনেক লোকেরা জিনসাধকদের ব্যাপারে এ বিশ্বাস রাখেন যে, এরা ইচ্ছা করলে গায়েব সম্পর্কে জানতে পারে। সে-জন্য দেখা যায় কারো কিছু চুরি হলে বা কেউ কোনো সমস্যায় পতিত হলে, তারা দ্রুত কোনো জিনসাধকের শরণাপন্ন হন। সেখানে যেয়ে চুরি হওয়া দ্রব্য এবং চোর সম্পর্কে জানতে চান। দ্রব্যটি এখনও অক্ষত অবস্থায় আছে কি না এবং কিভাবে তা পাওয়া যেতে পারে, সে সম্পর্কেও জানতে চান। বিভিন্ন রোগীরাও তাদের নিকট গিয়ে তাদের রোগটা কী এবং কিভাবে তা আরোগ্য হতে পারে, তা জানতে যান।
জিনসাধকেরা মানুষের সমস্যার সমাধান কল্পে যে সব কথা বলে, অনেক সময় তা বাস্তবের সাথেও মিলে যায়, সে জন্যেই সাধারণ মানুষের মাঝে তাদের সম্পর্কে উক্ত ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। জিনসাধকদের কোনো কোন কথার সত্যতা বাস্তবে প্রমাণিত হলেও এর দ্বারা তারা গায়েব সম্পর্কে জানে বা জানতে পারে, এ কথা বলার কোনো যৌক্তিকতা নেই; কেননা, জিনসাধকেরা বাড়ীতে বসে থাকলেও তারা জিনের সহযোগিতায়ই তাদের অসাক্ষাতে ঘটিত ঘটনা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। তারা তাদের বশ্যতা স্বীকারকারী বন্ধু জিনকে সর্বাগ্রে এ কাজে ব্যবহার করে।
যে সব বিষয়াদি তাদের কাছে আসে তা যদি তাদের বন্ধু জিনের উপস্থিতিতে ঘটে থাকে, তা হলে সে তার নিজের দেখানুযায়ী এ ঘটনা সম্পর্কে তথ্য দান করে। আর তার অসাক্ষাতে ঘটে থাকলে ঘটনাস্থলে গিয়ে সেখানকার জিনদের সহযোগিতা নিয়ে ঘটনা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে ফিরে এসে তার বন্ধুকে সংবাদ দান করে। অনেক সময় কোনো সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে না পারলে আন্দাজ ও অনুমান করে কিছু বলে দেয়। ইসলাম পূর্ব যুগেও এ ধরনের জিনসাধকরা ছিল। তখন তাদেরকে ‘কাহিন’ বলা হতো। জিনদের সহযোগিতায়ই তারা জনগণকে বিভিন্ন তথ্য ও পথ্য দিতো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে উক্ত বিশ্বাসের আলোকে লোকেরা জিনসাধক ‘কাহিনদের’ কাছে যেতো, সে জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বিশ্বাস করতে নিষেধ করেছিলেন।
এ নিষেধ সংক্রান্ত দলীল আমরা প্রথম অধ্যায়ে বর্ণনা করেছি। জিনরা যে অদৃশ্য বা গায়েব সম্পর্কে কিছুই জানতে পারে না, তাও কুরআনুল কারীম দ্বারা প্রমাণিত। সুলায়মান (আ.) বায়তুল মাক্বদিস নির্মাণের সময় জিনদেরকে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজে লাগিয়েছিলেন। গৃহ নির্মাণ শেষ হওয়ার পূর্বে লাঠির উপর নির্ভর করে দাড়িয়ে থাকা অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়ে গেলে জিনরা তাঁর মৃত্যুর কথা বুঝতে না পেরে যথারীতি নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল, নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর ঘুণ পোকায় লাঠি খেয়ে ফেলার ফলে তিনি পড়ে গেলে তারা বুঝতে পারলো যে, তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। তখন তারা আফসোসের সাথে বলেছিল যে, যদি তারা তা পূর্বে বুঝতে পারতো তা হলে এ কঠিন কাজে তারা এতদিন লেগে থাকতো না। এ ঘটনা বর্ণনা প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿فَلَمَّا قَضَيۡنَا عَلَيۡهِ ٱلۡمَوۡتَ مَا دَلَّهُمۡ عَلَىٰ مَوۡتِهِۦٓ إِلَّا دَآبَّةُ ٱلۡأَرۡضِ تَأۡكُلُ مِنسَأَتَهُۥۖ فَلَمَّا خَرَّ تَبَيَّنَتِ ٱلۡجِنُّ أَن لَّوۡ كَانُواْ يَعۡلَمُونَ ٱلۡغَيۡبَ مَا لَبِثُواْ فِي ٱلۡعَذَابِ ٱلۡمُهِينِ ١٤ ﴾ [سبا: ١٤]
‘‘যখন আমি সুলায়মানের মৃত্যু ঘটালাম, তখন ঘুণ পোকাই জিনদেরকে তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে অবহিত করল। সোলায়মানের লাঠি খেয়ে যাচ্ছিল। যখন তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন, তখন জিনেরা বুঝতে পারল যে, অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান থাকলে তারা এই লাঞ্ছনাপূর্ণ শাস্তিতে আবদ্ধ থাকতো না।’’[2]
আজও যারা জিন সাধক ও জিনরা গায়েব জানে, এ বিশ্বাসের ভিত্তিতে তাদের কাছে যাবে, তাদের পরিণতিও ইসলাম পূর্ববর্তী সময়ের লোকদের মতই হবে।
৪. পাখি বা বানরের মাধ্যমে ভাগ্য জানার চেষ্টা করা :
ঢাকা শহরের গুলিস্তান এলাকার ফুটপাতে বসে কোনো কোন ব্যক্তিকে একটি টিয়া (Parot) বা বানরের মাধ্যমে ভাগ্যাহত মানুষের ভাগ্যের ভাল-মন্দ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে দেখা যায়। তারা তাদের সম্মুখে সাজিয়ে রাখেন কিছু খাম। খামের ভিতরে থাকে ভবিষ্যৎ জীবনে ভাগ্যের ভাল-মন্দ সম্পর্কে বিভিন্ন কথা। ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার হয়ে কেউ তাদের কাছে ভাগ্য সম্পর্কে জানতে গেলে লোকটির নির্দেশে সে টিয়া পাখি বা বানর তার সামনে সাজিয়ে রাখা খামগুলো থেকে একটি খাম উত্তোলন করে লোকটির হাতে তুলে দেয়। এবার লোকটি খামের ভিতরের কাগজটি বের করে তাতে যা লিখা রয়েছে তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে পড়ে শুনায় বা তাকে পড়তে দেয়।
এভাবেই সাধারণ লোকেরা টিয়া পাখি বা বানরের মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য সম্পর্কে জানার চেষ্টা করে। খামের লিখা ভাল হলে এর দ্বারা তারা সাময়িকের জন্য হলেও আনন্দ উপভোগ করে, আর খারাপ হলে আরো হতাশাগ্রস্ত হয়। টিয়া পাখি বা বানরের মাধ্যমে সাধারণ লোকেরা নিজেদের ভাগ্য সম্পর্কে জানতে চাওয়ার কারণ হলো- তারা এদের ব্যাপারে এ ধারণা পোষণ করে যে, এরা অদৃশ্য সম্পর্কে অবগত থাকে। জাহেলী যুগে আরবের মুশরিকদের মাঝেও পাখির ডানে বা বামে উড়ে যাওয়া থেকে কোথাও ভ্রমণে যাওয়ার শুভ অশুভ জানার রেওয়াজ ছিল। এটি একটি শির্কী চিন্তাধারা হওয়াতে রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- তা এই বলে রহিত করেন যে, [.. وَلاَ طِيَرَةَ ..] ‘‘...পাখি ডানে বা বামে উড়ে যাওয়ার সাথে ভাগ্যের ভাল বা মন্দের কোনো সম্পর্ক নেই...’’।[3] অপর হাদীসে তিনি বলেন: [ الطِّيَرَةُ شِرْكٌ الطِّيَرَةُ شِرْكٌ ثَلاَثاً.]‘‘পাখি উড়িয়ে বা উড়ে যাওয়া থেকে ভাগ্যের শুভ বা অশুভ নির্ধারণ করা শির্ক। (এ কর্মটি যে শির্ক তা গুরুত্বের সাথে বুঝাবার জন্য) তিনি এ কথাটি তিন বার বলেন’’।[4]
১. আল্লাহর ওলিগণ গায়েব সম্পর্কে জানেন :
আমাদের দেশের সাধারণ মানুষদের মাঝে বিশেষ করে পীর ভক্তদের মাঝে এ ধারণা বদ্ধমূল হয়ে রয়েছে যে, পৃথিবীতে যা কিছু ঘটছে তা আল্লাহর ওলিগণ তাঁদের রূহানী শক্তিবলে জানতে পারেন। এ ধারণার ভিত্তিতেই তারা দূর-দূরান্ত থেকে ওলিগণ কে ‘ইয়া গাউস’ ‘ইয়া খাজা’ ইত্যাদি বলে সাহায্যের জন্য আহ্বান করে থাকেন। এমনকি ভক্তির আতিশয্যে তাদের কাউকে আল্লাহর যাবতীয় গুলাবলী দ্বারা খাজা মঈনুদ্দিন চিশতীকে গুণান্বিত করতেও দেখা যায়। যেমন এক ব্যক্তি খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহ.)-কে গুণান্বিত করতে গিয়ে বলেছে : সাত্তারুন মঈনুদ্দিন, ওয়াহিদুন মঈনুদ্দিন, সামী‘উন মঈনুদ্দিন, আলীমুন মঈনুদ্দিন, আন-নাজিরু মঈনুদ্দিন ইত্যাদি।[5] যার অর্থ হচ্ছে : মঈনুদ্দিন একাধারে মানুষের সকল দোষ-ত্রুটি গোপনকারী, একক, সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ ও সর্বদ্রষ্টা। না‘উজু বিল্লাহ
খাজা মঈনুদ্দিন চিশতীকে এভাবে গুণান্বিত করার অর্থ দাঁড়ায়-তিনি যেন আল্লাহর অবতার ছিলেন। সে জন্যই তিনি তাঁর ভক্তদের যাবতীয় বিষয়ের ব্যাপারে সম্যক অবহিত রয়েছেন। তিনি তাদের আহ্বান শ্রবণ করে থাকেন। এ সব ধারণার ভিত্তিতেই বিপদের সময়ে হোক আর স্বাভাবিক সময়ে হোক সর্বাবস্থায়ই তারা তাঁদেরকে এ সব নামে আহ্বান করে থাকেন। এমনকি নামাযের মুসল্লায় দাঁড়িয়েও তাদেরকে ‘ইয়া গাউছ’ বলে বড়পীর আব্দুল কাদির জীলানী (রহ.)-কে আহ্বান করতে দেখা যায়।[6]
[2]. আল-কুরআন, সূরা সাবা : ১৪।
[3]. বুখারী, প্রাগুক্ত, ৫/২২৭৭, মুসলিম, প্রাগুক্ত; ৪/১৭৪২।
[4]. আবু দাউদ, প্রাগুক্ত; কিতাবুত ত্বিব, বাব : পাখি উড়িয়ে ভাগ্য যাচাই করার বর্ণনা; ৪/২৩০।
[5]. এ কথাগুলো মঈনুদ্দিন চিশতী (রহ.)-এর বার্ষিক ওরস উপলক্ষে তাঁর জনৈক ভক্তের দ্বারা প্রচারিত একটি দাওয়াতী হ্যান্ডবিল থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
[6]. মাদ্রাসা-ই-আলীয়া, ঢাকাতে কামিল মুহাদ্দিস শ্রেণীতে ১৯৭৯-১৯৮১ সালে অধ্যয়ন করার সময় মোঃ আব্দুল মান্নান আ‘জমী নামে চট্রগ্রাম জেলার আমার এক সহপাঠি ছিল। একদিন যোহরের সালাতের জন্য মুসল্লায় দাঁড়িয়ে ‘ইয়া গাউস’ বলে বড়পীর আব্দুল কাদির জীলানীকে আহবান করতে শুনলাম। তাকে বললাম- নামাযের মুসল্লায় দাঁড়িয়ে গাউসকে আহবান করছো? জবাবে সে বললো- গাউস আমার আহ্বান শ্রবণ করতে পারেন, তাই তাঁকে আহ্বান করলাম।