শির্ক কী ও কেন? চতুর্থ পরিচ্ছেদ ড. মুহাম্মদ মুয্‌যাম্মিল আলী ১ টি

দেব-দেবীদের নামে শপথ করা :

কোন কোন দেব-দেবীদের নামকে তারা বরকতময় ও সম্মানিত মনে করতো। তাদের নামে মিথ্যা শপথ করলে শপথকারীর পরিবার ও সহায় সম্পদে ক্ষতি হবার সমূহ আশঙ্ক্ষা করতো। যার ফলে তাদের নামে কেউ মিথ্যা শপথ করতে রাজি হতো না। গায়রুল্লাহের নামে শপথ করলে এতে গায়রুল্লাহর সম্মান করা হয় বিধায়, তা শির্কের অন্তর্গত হওয়ার কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :

«مَنْ حَلَفَ بِغَيْرِ اللهِ فَقَدْ أَشْرَكَ»

‘‘যে ব্যক্তি গায়রুল্লাহর নামে শপথ করলো, সে শির্ক করলো।’’[1]

দেব-দেবীদের নামে সন্তানাদির নাম রাখা :

তারা দেব-দেবীদের বরকত প্রাপ্তির জন্য সন্তানাদির নাম ‘আব্দুল উজ্জা, ‘আব্দে শামস ইত্যাদি রাখতো।

দেব-দেবীদের নিকট সন্তানের জন্য কল্যাণ কামনা করা :

নবজাত শিশুদের নিয়ে দেব-দেবীদের কাছে গমন করে শিশুর জন্য তাদের নিকট থেকে কল্যাণ কামনা করতো।

তাদের এ-কর্মের সমালোচনা প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন :

﴿ ۞هُوَ ٱلَّذِي خَلَقَكُم مِّن نَّفۡسٖ وَٰحِدَةٖ وَجَعَلَ مِنۡهَا زَوۡجَهَا لِيَسۡكُنَ إِلَيۡهَاۖ فَلَمَّا تَغَشَّىٰهَا حَمَلَتۡ حَمۡلًا خَفِيفٗا فَمَرَّتۡ بِهِۦۖ فَلَمَّآ أَثۡقَلَت دَّعَوَا ٱللَّهَ رَبَّهُمَا لَئِنۡ ءَاتَيۡتَنَا صَٰلِحٗا لَّنَكُونَنَّ مِنَ ٱلشَّٰكِرِينَ ١٨٩ فَلَمَّآ ءَاتَىٰهُمَا صَٰلِحٗا جَعَلَا لَهُۥ شُرَكَآءَ فِيمَآ ءَاتَىٰهُمَاۚ فَتَعَٰلَى ٱللَّهُ عَمَّا يُشۡرِكُونَ ١٩٠ ﴾ [الاعراف: ١٨٩، ١٩٠]

‘‘তিনিই সেই সত্তা যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন একটিমাত্র সত্তা থেকে; আর তাত্থেকেই তৈরী করেছেন তার জোড়া, যাতে তার কাছে স্বস্তি পেতে পারে। অতঃপর পুরুষ যখন নারীকে আবৃত করলো (নারী পুরুষ উভয়ে দৈহিকভাবে মিলিত হল) তখন সে গর্ভবতী হলো অতি হালকা গর্ভে। সে তা নিয়ে চলাফেরা করতে লাগলো। এরপর যখন বোঝা হয়ে গেল তখন তারা উভয়েই তাদের প্রতিপালক আল্লাহকে ডাকলো এই বলে যে, তুমি যদি আমাদেরকে সুস্থ সন্তান দান করো, তবে আমরা তোমার শুকরিয়া জ্ঞাপন করবো। অতঃপর যখন তিনি তাদেরকে সুস্থ সন্তান দান করলেন, তখন দানকৃত সে সন্তানে তারা তাঁর অংশীদার তৈরী করতে লাগলো। বস্তুত আল্লাহ তাদের শরীক সাব্যস্ত করা থেকে বহু উর্ধ্বে।’’[2]

আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করে কোন বস্তু হালাল বা হারাম করা :

আল্লাহর হালালকৃত কোন কোন বস্তুকে তারা নিজ থেকে কারো জন্যে হালাল ও কারো জন্যে হারাম করে নিতো এবং বলতো যে, এ হালাল বা হারাম আল্লাহই করেছেন। যেমন তারা একটি উট একাধারে দশটি মাদী বাচ্চা জন্ম দিলে এ উটটিকে তারা দেবতাদের জন্য মুক্তভাবে ছেড়ে দিত, কেউ এর পিঠে আরোহণ করতো না, এর গায়ের পশমও নিত না, মেহমান ছাড়া অন্য কারো জন্যে এর দুগ্ধ পান করাকে বৈধ মনে করতো না। এ ধরনের উটকে তারা ‘সা-ইবাহ’ বলে নামকরণ করতো। এ ‘সা-ইবাহ’ উটটি পরবর্তীতে আরো একটি মাদী বাচ্চা জন্ম দিলে এ বাচ্চাটিকে ‘বহীরাহ’ নামকরণ করে এর কান ছিদ্র করে দিয়ে এটাকে তার মায়ের সাথে ছেড়ে দিত এবং এর সাথে তার মায়ের মতই আচরণ করতো।[3]

অনুরূপভাবে একটি বকরী পরপর পাঁচ বারে দশটি মাদী বাচ্চা প্রসব করলে এবং এদের সাথে কোন নর বাচ্চা না থাকলে মহিলাদের জন্য তারা সে বকরীর মাংস ভক্ষণ করা হারাম বলে গণ্য করতো। এ বকরীটি মরে গেলে তা আবার মহিলাদের পক্ষেও ভক্ষণ করা হালাল বলে মনে করতো। এ ধরনের বকরীকে ‘ওয়াসীলাহ’ বলে নামকরণ করতো।[4]

অনুরূপভাবে একটি পুরুষ উট অপর মাদী উটের সাথে রমন ক্রিয়া সম্পাদন করার ফলে কোন নর সন্তান ছাড়াই একাধারে দশটি মাদী সন্তান প্রসব করলে এ পুরুষ উটের উপর আরোহণ করা ও এর পশম আহরণ করাকে হারাম বলে গণ্য করতো। এ ধরনের উটকে তারা ‘হামী’ বলে নামকরণ করতো।[5]

আল্লাহ তা‘আলা তাদের এ জাতীয় খারাপ কাজ ও কূপ্রথা বা অভ্যাস সম্পর্কে বলেন :

﴿ مَا جَعَلَ ٱللَّهُ مِنۢ بَحِيرَةٖ وَلَا سَآئِبَةٖ وَلَا وَصِيلَةٖ وَلَا حَامٖ وَلَٰكِنَّ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ يَفۡتَرُونَ عَلَى ٱللَّهِ ٱلۡكَذِبَۖ وَأَكۡثَرُهُمۡ لَا يَعۡقِلُونَ ١٠٣ ﴾ [المائ‍دة: ١٠٣]

‘‘মহান আল্লাহ ‘বহীরাহ, সা-ইবাহ, ওয়াসীলাহ এবং হামীকে শরী‘আত সিদ্ধ করেন নি। কিন্তু যারা কাফের তারা আল্লাহর উপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে। তাদের অধিকাংশেরই বিবেক বুদ্ধি নেই।’’[6]

তারা আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করে এ সব কর্মকে ধর্মীয় আইনের মর্যাদা দান করেছিল।[7]

শির্কযুক্ত কথার মাধ্যমে ঝাড়ফুঁক দেয়া :

তারা শির্কযুক্ত কথা-বার্তা (মন্ত্রের ন্যায়) পাঠ করে রোগীদের ঝাড়ফুঁক করতো।

‘আউফ ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন :

«كُنَّا نَرْقَى فِي الْجَاهِليَّةِ ، فَقُلْنَا لِرَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم كَيْفَ تَرَى ذلِكَ؟ فَقالَ :أَعْرِضُوْا عَلَيَّ رُقَاكُمْ. لاَ بَأْسَ بِالرُّقَى مَالَمْ يَكُنْ فِيْهِ شِرْكٌ»

‘‘আমরা জাহেলী যুগে ঝাড়ফুঁক দান করতাম। আমরা রাসূলুল্লা্হ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললাম : আপনি এগুলো কী মনে করেন? তিনি বলেন : ‘‘তোমরা যা বলে ঝাড়ফুঁক দিয়ে থাকো তা আমাকে পড়ে শুনাও, ঝাড়ফুঁকে কোন দোষ নেই, যদি তা শির্ক মুক্ত হয়।’’[8] এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, তারা শির্কযুক্ত কথা-বার্তা মন্ত্রের ন্যায় পাঠ করে বিভিন্ন রোগ ব্যাধিতে ঝাড়ফুঁক দান করতো।

শিশুদের তা‘বীজ পরানো:

চোখের অশুভ দৃষ্টি (নজর লাগা) থেকে শিশুদের রক্ষা করার জন্য তারা বাচ্চাদের গায়ে তা‘বীজ ব্যবহার করতো। একই উদ্দেশ্যে তারা উটের গলায় ধাতু নির্মিত তারের মালা ঝুলিয়ে রাখতো। তা‘বীজ বা ধাতু নির্মিত তারের মালা আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল বিনষ্টকারী হওয়ায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«مَنْ عَلَّقَ تَمِيْمَةً فَقَدْ أَشْرَكَ»

“যে তা‘বীজ ঝুলালো সে শির্ক করলো।’’[9]

কোনো উটের গলায় তার বা হার ঝুলানো দেখলে তা কেটে দেয়ার নির্দেশ দিয়ে তিনি আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বলেছিলেন:

«لاَيَبْقَيَنَّ فِيْ رَقَبَةِ بَعِيْرٍ قِلاَدَةً مِنْ وَتَرٍ ، وَ لاَ قِلاَدَةً إِلاَّ قُطِعَتْ»

‘‘কোনো উটের গলায় ধাতব দ্রব্য দ্বারা নির্মিত তারের হার অবশিষ্ট রাখবে না, গলায় ঝুলানো হার পেলেই তা কেটে দিবে।’’[10]

তিনি আরো বলেন :

«إِنَّ الرُّقَى وَ التَّمَائِمَ وَالتِّوْلَةَ شِرْكٌ»

“(শির্ক যুক্ত) ঝাড়ফুঁক, তা‘বীজ ও জাদু শির্ক।’’[11]

শিশুদের গলায় ঝিনুকের মুক্তা ঝুলিয়ে রাখা :

শিশুরা যাতে অশুভ দৃষ্টির হাত থেকে মুক্ত হয়ে শান্ত-শিষ্ট হয়, সে-জন্য তাদের গলায় ঝিনুক থেকে আহরিত মুক্তা ঝুলিয়ে রাখতো। যারা উক্ত উদ্দেশ্যে তা ঝুলায় তাদের জন্য বদ দু‘আ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :

«مَنْ عَلَّقَ وَدَعَةً فَلاَ وَدَعَ اللهُ لَهُ»

‘‘যে (কোন কিছুর অশুভ দৃষ্টি থেকে রক্ষার জন্য) ঝিনুক থেকে আহরিত মুক্তা শরীরে ঝুলায় আল্লাহ যেন তার সে অকল্যাণ দূর না করেন।’’ [12]

রোগ নিরাময়ের জন্য ধাতব দ্রব্য নির্মিত বালা ব্যবহার করা:

তারা বাত রোগ নিরাময়ের জন্য খণিজ (ধাতব) দ্রব্য দ্বারা নির্মিত বালা হাতে পরিধান করতো। ইমরান ইবন হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে হাতে স্বর্ণের বালা পরিধান করা অবস্থায় দেখতে পেয়ে বললেন : ‘‘ওটা কী? লোকটি বললো : ‘ওয়াহিনা’ নামক রোগ থেকে (যা স্কন্ধ বা হাতের শিরায় হয়ে থাকে) আরোগ্য লাভের জন্য এটি পরেছি। রাসূহুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন :

«أَنْزِعْهَا فَإِنَّهَا لاَ تَزِيْدُكَ إِلاَّ وَهْناً، فَإِنَّكَ لَوْ مِتَّ وَهِيَ عَلَيْكَ مَا أَفْلَحْتَ أَبَداً»

‘‘তুমি এটি খুলে ফেল, কারণ এটি তোমার রোগ বৃদ্ধি ছাড়া কোন উপকার করবে না, তুমি যদি এটি হাতে পরিধান করা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করো, তা হলে কস্মিনকালেও তুমি সফল হতে পারবে না, অর্থাৎ জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে না।’’[13]

মূর্তি ও প্রতিমার স্থলে মেলা বসানো :[14]

তারা তাদের মূর্তি ও প্রতিমাসমূহের স্থলে বার্ষিক মেলা বসাতো। এ উপলক্ষে লোকেরা দূর-দূরান্ত থেকে নিজেদের নানাবিধ প্রয়োজন দেব-দেবীদের কাছে উপস্থাপন করার জন্য আগমন করতো। তাদের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য নানা রকম নজর, নিয়াজ ও হাদিয়া তুহফা দান করতো। আমাদের রাসূল বা অপর কারো কবর, কিংবা কোন স্থান ও সময়কে কেন্দ্র করে মুসলিমদের মাঝে যাতে এমন কোনো মেলার প্রচলন না হয়, সে জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :

«لاَتَجْعَلُوْا قَبْرِيْ عِيْداً»

‘‘তোমরা আমার কবরকে ঈদ তথা মেলার স্থানে পরিণত করো না।’’[15]

নবী ও অলিদের কবরে মসজিদ নির্মাণ করা :

ইয়াহূদী ও খ্রিষ্টানরা তাদের নবী ও অলিদের মর্যাদা প্রদানের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করেছিল। তাঁদের কবরের উপর মসজিদ নির্মাণ করেছিল। সে জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের উপর অভিসম্পাত করে বলেন :

«لَعَنَ اللهُ الْيَهُوْدَ وَالنَّصَارَى اتَّخَذُوْا قُبُوْرَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِد»

“আল্লাহ তা‘আলা ইয়াহূদী ও খ্রিষ্টানদের উপর অভিসম্পাত করেছেন, তারা তাদের নবীদের কবরগুলোকে মসজিদে রূপান্তরিত করেছে।”[16]

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা এ হাদীসটি বর্ণনা করার পর বলেন :

«فَلَوْ لاَ ذلِكَ لأَبْرَزَ قَبْرَهُ غَيْرَ أَنَّه خَشِيَ أَنْ يَتَّخَذَ مَسْجِداً»

“লোকেরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কবরকে ভবিষ্যতে মসজিদ বানানোর ভয় না থাকলে তাঁর কবর ঘরের বাইরে প্রকাশ্য স্থানেই প্রদান করা হতো।”[17]

পাখি উড়িয়ে ভাগ্য পরীক্ষা করা :

তারা পশু ও পাখিকে নিজ স্থান থেকে ধমক দিয়ে সরিয়ে বা উড়িয়ে ভাগ্য পরীক্ষা করতো। পশু বা পাখি ডান দিকে উড়ে গেলে এটাকে শুভ লক্ষণ হিসেবে গণ্য করতো। আর বাম দিকে গেলে এটাকে অশুভ লক্ষণ বলে মনে করতো।[18] এ জাতীয় কর্ম শির্কের অন্তর্গত হওয়ায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :

«الطِّيَرَةُ شِرْكٌ الطِّيَرَةُ شِرْكٌ ثَلاَثاً»

‘‘পাখি উড়িয়ে দেয়া থেকে ভাগ্যের শুভ বা অশুভ নির্ধারণ করা শির্ক। (এ কর্মটি যে শির্ক তা গুরুত্বের সাথে বুঝাবার জন্য) এ কথাটি তিনি তিন বার বলেন।’’[19]

অশুভ ধারণা :

তারা কোনো কোনো দিবস, মাস, কোনো পশু-পাখি, গৃহ ও মহিলাদেরকে অশুভ ও মন্দ বলে ধারণা করতো।[20]

উপত্যকার জিনের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করা :

সফরে গিয়ে কোনো উপত্যকায় অবতরণ করলে সে উপত্যকার জিন সরদারের নিকট তারা আশ্রয় প্রার্থনা করে বলতো :

«أَعُوْذُ بَسَيِّدِ هَذَا الْوَادِيْ مِنْ شَرِّ سُفَهَاءِ قَوْمِهِ»

‘‘এই উপত্যকার সরদারের নিকট তার জাতির দুষ্টদের অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য আশ্রয় প্রার্থনা করছি।’’[21] কুরআনুল কারীমে তাদের এ জাতীয় প্রার্থনা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন :

﴿ وَأَنَّهُۥ كَانَ رِجَالٞ مِّنَ ٱلۡإِنسِ يَعُوذُونَ بِرِجَالٖ مِّنَ ٱلۡجِنِّ فَزَادُوهُمۡ رَهَقٗا ٦ ﴾ [الجن: ٦]

‘‘মানুষের মধ্যকার কিছু লোকেরা জিনদের মধ্যকার কিছু জিনের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করতো, ফলে আশ্রিত জিনেরা তাদের নিকট আশ্রয় প্রার্থনাকারীদের ভয় আরো বাড়িয়ে দিতো।’’[22]

বরই গাছ দ্বারা বরকত গ্রহণ করা :

তারা ‘যাতে আনওয়াত্ব’ নামের একটি বরই গাছ দ্বারা বরকত অর্জন করতো। এ গাছে তারা তাদের অস্ত্র ও মালপত্র ইত্যাদি বেধে ঝুলিয়ে রাখতো। এ গাছের সম্মান করতো, এর উদ্দেশ্যে মানত করতো ও এর নিচে অবস্থান গ্রহণ করতো। একটি গাছকে কেন্দ্র করে এ ধরনের কাজ করা শির্ক, এ বিষয়টি না জানার কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবীগণ সে গাছটি দেখে তাঁকে বলেছিলেন: হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের জন্য অনুরূপ একটি গাছ নির্বাচন করে দিন। তখন তিনি তাদেরকে এই বলে ধমক দিয়েছিলেন :

«إِنَّكُمْ طَلَبْتُمْ مِثْل مَا طَلَبَ بَنُوْاإِسْرَائِيْلُ مِنْ مُوْسَى اجْعَلْ لَنَا إِلَهاً كَمَا لَهُمْ آلِهَةٌ»

‘‘তোমরা ঠিক সে রকমই আবেদন করেছো যেমন বনী ইস্রাঈলরা মূসা আলাইহিস সালাম-এর নিকট তাদের শত্রুদের দেবতাদের অনুরূপ একটি দেবতা নির্ধারণ করে দেয়ার জন্য আবেদন করেছিল।’’[23]

কুরায়শ ও আরবদের দাবী :

ক্বুরায়শ ও আরব জনগণের ধর্মীয় অজ্ঞতার সুযোগে শয়তান তাদের বিশ্বাস, কর্ম ও অভ্যাসের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শির্ক প্রবেশ করিয়ে দিয়ে থাকলেও তারা নিজেদেরকে দ্বীনে ইব্রাহীমের যথার্থ অনুসারী বলে দাবী করতো। কার্যত তাদের মাঝে দ্বীনে ইব্রাহীমের কিছু উপাসনা ও আচার-অনুষ্ঠান যেমন : কা‘বা শরীফের সম্মান করা, এর ত্বওয়াফ করা, হজ্জ ও ‘উমরা করা, আরাফা, মিনা ও মুযদালিফায় অবস্থান করা এবং সেখানে উট উৎসর্গ করা ইত্যাদি ব্যতীত আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। এ সব অনুষ্ঠান সম্পাদনের ক্ষেত্রেও তারা নিজেদের পক্ষ থেকে কিছু বেদ‘আতী কর্মকাণ্ডও সংযোজন করেছিল। সে সকল বেদ‘আতের মধ্যকার একটি বেদ‘আত এমন ছিল যে, কুরায়শগণ মনে করতো অন্যান্য লোকদের চেয়ে তাদের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে, আরবের অপর কোনো গোত্রই তাদের সাথে সে বৈশিষ্ট্যে শরীক হতে পারে না। এ বৈশিষ্ট্যের কথা ভেবে তারা অন্যান্য মানুষের সাথে আরাফায় অবস্থান করা থেকে বিরত থাকতো। এর বদলে তারা মুযদালিফায় অবস্থান গ্রহণ করতো এবং সেখান থেকেই মক্কায় ফিরে আসতো। আল্লাহ তা‘আলা তাদের এ কর্মকে অপছন্দ করেন এবং কাফির ও মুসলিম নির্বিশেষে সকলকে সাধারণ মানুষদের ন্যায় আরাফা থেকে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করার নির্দেশ দান করে বলেন : [24]

﴿ثُمَّ أَفِيضُواْ مِنۡ حَيۡثُ أَفَاضَ ٱلنَّاسُ﴾ [البقرة: ١٩٩]

‘‘অতঃপর তোমরা (মক্কায়) ফিরে এসো যেখান থেকে (সাধারণ) লোকেরা ফিরে আসে।’’[25]

তাদের অপর একটি বেদ‘আত ছিল যে, তারা বলতো হরমের বাইরের লোকজন হজ্জ বা ‘উমরা পালনার্থে হরমে আগমন করলে তারা তাদের সাথে নিয়ে আসা খাবার হরমের মধ্যে খেতে পারবে না।[26]

তাদের অপর একটি বেদ‘আত এমন ছিল যে, তারা হারামের বাইরের জনগণের প্রতি এ নির্দেশ জারী করেছিল যে, তারা হরমে আসলে বিশেষ ধরনের বস্ত্র ছাড়া কা‘বা শরীফের প্রথম ত্বওয়াফ করতে পারবে না। সে কারণে উক্ত বস্ত্র কেউ সংগ্রহ করতে অপারগ হলে উলঙ্গ অবস্থায়ই তাকে ত্বওয়াফ করতে হতো। মহিলারা সে কাপড় সংগ্রহ করতে না পারলে বুক খোলা রেখে ত্বওয়াফ করতো এবং বলতো :

‘‘আজ শরীরের পূর্ণ বা অংশবিশেষ অনাবৃত থেকে যাচ্ছে, যা অনাবৃত থেকে যাচ্ছে তা অনাবৃত রাখাকে আমি হালাল মনে করি না।’’[27]

তাদেরকে এভাবে উলঙ্গ অবস্থায় কা‘বা শরীফের ত্বওয়াফ করা থেকে বারণ করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

﴿ ۞يَٰبَنِيٓ ءَادَمَ خُذُواْ زِينَتَكُمۡ عِندَ كُلِّ مَسۡجِدٖ﴾ [الاعراف: ٣١]

‘‘হে আদম সন্তানরা! মসজিদে আগমনের সময় তোমরা পোশাকাদি পরিধান করে সৌন্দর্য গ্রহণ করো।’’[28]

অনুরূপভাবে তারা ইহরাম পরিহিত অবস্থায় তাদের বাসগৃহের দরজা দিয়ে প্রবেশ করাকে জায়েয মনে করতো না। তাই গৃহে প্রবেশের জন্য তারা ঘরের পিছনের দেওয়ালে একটি ছিদ্র করে তা দিয়ে প্রবেশ করতো এবং এ কাজকে তারা একটি পুণ্যের কাজ হিসেবে মনে করতো। তাদের এ কর্মের সমালোচনা করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَلَيۡسَ ٱلۡبِرُّ بِأَن تَأۡتُواْ ٱلۡبُيُوتَ مِن ظُهُورِهَا وَلَٰكِنَّ ٱلۡبِرَّ مَنِ ٱتَّقَىٰۗ وَأۡتُواْ ٱلۡبُيُوتَ مِنۡ أَبۡوَٰبِهَاۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ لَعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُونَ ١٨٩ ﴾ [البقرة: ١٨٩]

‘‘ঘরের পিছন দিয়ে গৃহে প্রবেশ করা কোনো কল্যাণের কাজ নয়, কল্যাণের কাজতো তা-ই যে তাকওয়া অর্জন করলো। কাজেই তোমরা দরজা দিয়েই ঘরে প্রবেশ করো এবং আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা নিজেদের বাসনায় কৃতকার্য হতে পার।’’[29]

মোদ্দাকথা : উপরে মূর্তি, প্রতিমা পূজা এবং শির্ক ও কুসংস্কারে পরিপূর্ণ যে ধর্মের কথা আলোচিত হলো তা ছিল প্রায় সকল আরবদেরই ধর্ম। এ আলোচনার মাধ্যমে প্রমাণিত হলো যে, কুরায়শ ও আরবগণ ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম-এর ধর্মের ক্ষেত্রে যে বিকৃতি আনয়ন করেছিল, তা শির্কের সকল প্রকারকেই শামিল করেছিল। অনুরূপভাবে তারা আল্লাহর উপাসনার ক্ষেত্রেও বিকৃতি সাধন করেছিল, যা তাদের নিকট উত্তম বেদ‘আত হিসেবে গণ্য ছিল। তাদের যাবতীয় শির্কী ও বেদ‘আতী বিশ্বাস ও কর্মই তাদেরকে ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম-এর দ্বীন থেকে সম্পূর্ণভাবে বের করে দিয়েছিল।

আল্লাহ তা‘আলাকে একক সৃষ্টিকর্তা হিসেবে স্বীকৃতি দান এবং দ্বীনে ইব্রাহীমের কিছু কর্ম করে এর অনুসারী বলে তাদের শত দাবী থাকা সত্ত্বেও মহান আল্লাহ তাদেরকে কাফির ও মুশরিক বলে আখ্যায়িত করেন। আল্লাহর স্বীকৃতি, কা‘বা শরীফের ত্বওয়াফ ও সম্মান প্রদর্শন ইত্যাদি ভাল কর্ম করা সত্ত্বেও মহান আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দৃষ্টিতে তারা মুসলিম থাকতে পারে নি। এতে প্রমাণিত হয় যে, যুগে যুগে দ্বীনে মুহাম্মদীর অনুসারীদের মধ্যে যারা ক্বুরায়শ ও আরব জনগণের অনুরূপ হবে, তারাও দ্বীনে মুহাম্মদীর অনুসারী হওয়ার শত দাবী করে থাকলেও আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দৃষ্টিতে তারা মুসলিম থাকতে পারবে না।

[1]. তিরমিযী, প্রাগুক্ত; কিতাবুল আইমান ওয়ান নুজুর, বাব : গায়রুল্লাহের নামে শপথ করা মকরূহ; ৪/১১০; আবু দাউদ, প্রাগুক্ত; কিতাবুল আইমান ওয়ান নুজূর, বাব নং ৪, হাদীস নং ৩২৫১; ৩/২২৩; ইমাম আহমদ, প্রাগুক্ত; ১/৪৭।

[2]. আল-কুরআন, সূরা আ‘রাফ : ১৮৯-১৯০।

[3]. সফিয়্যুর রহমান মুবারকপুরী, প্রাগুক্ত; পৃ. ৩৬।

[4]. তদেব।

[5]. তদেব।

[6]. আল-কুরআন, সূরা মায়েদাহ্‌ : ১০৩।

[7]. মুফতী মুহাম্মদ শফী‘, মা‘আরেফুল ক্বুরআন; অনুবাদ ও সম্পাদনা : মাওলানা মহিউদ্দীন খান, (মদিনা : সৌদি আরব, সংস্করণ বিহীন, সন বিহীন), পৃ.৪১৬।

[8].মুসলিম, প্রাগুক্ত; কিতাবুস সালাম, বাব নং ২২ (শির্কমুক্ত ঝাড়ফুক বৈধ হওয়ার বর্ণনা) হাদীস নং ২২০০; ৪/১৭২৬; আবু দাউদ, প্রাগুক্ত; কিতাবুত ত্বিব, বাব : মা জা-আ ফির রুক্বা; ৪/২১৪; আবু জা‘ফর ত্বহাবী, আহমদ ইবন মুহাম্মদ, শরহে মা‘আনী আল-আ-ছার; সম্পাদনা : মুহাম্মদ যুহরী আন-নাজ্জার, (বৈরুত : দ্বারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম সংস্করণ, ১৩৯৯হি.), ৪/৩২৮।

[9]. ইমাম আহমদ. প্রাগুক্ত; ৪/১৫৬।

[10]. বুখারী, প্রাগুক্ত; কিতাবুল জিহাদ, বাব নং ১৩৯; ২/৪/১৪৩; আবু দাউদ, প্রাগুক্ত; ৩/৫২।

[11].আবু দাউদ, প্রাগুক্ত; কিতাবুত ত্বিব, বাব নং ১৭, (তা‘লীকিত তামাইম), হাদীস নং ৩৮৮৩; ৪/৯; বায়হাক্বী, প্রাগুক্ত; ৯/৩৫০।

[12]. ইমাম আহমদ, প্রাগুক্ত; ৪/১৫৪।

[13]. ইবন মাজাহ; কিতাবুত ত্বিব, বাব : যিয়ারতিল কবরি; ২/৫৩৪।

[14]. মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব, প্রাগুক্ত; পৃ. ১২৩।

[15]. টীকা নং ১৬২ দ্রষ্টাব্য।

[16]. বুখারী, প্রাগুক্ত; কিতাবুল জানাইয, বাব : বয়ান কারাহাতি ইত্তেখাজিল মাসাজিদি ‘আলাল কাবরি; ১/৩/১৮৮; মুসলিম, প্রাগুক্ত; কিতাবুল মসজিদ, বাব নং ৩; ১/৩৭৭।

[17]. তদেব।

[18]. সফিয়্যুর রহমান মুবারকপুরী, প্রাগুক্ত; পৃ. ৩৮।

[19]. আবু দাউদ, প্রাগুক্ত; কিতাব নং ২৩ (কিতাবুন রাআহু), বাব নং ২৪, হাদীস নং ৩৯১০, ৪/১৭।

[20]. সফিয়্যুর রহমান মুবারকপুরী, প্রাগুক্ত; পৃ. ৩৮; ইবনে হাজার, ফাতহুলবারী; ৬/৬১।

[21]. ইকনে কাছীর, তাফছীরুল ক্বুরআনিল ‘আযীম; ২/১২৮ ও ৪/৪৫৭।

[22]. আল-কুরআন, সূরা জিন : ৬।

[23]. তিরমিযী, প্রাগুক্ত; কিতাবুল ফিতন..., বাব নং ১৮, হাদীস নং ২১৮০; ৪/৪৭৫।

[24].বুখারী, প্রাগুক্ত; কিতাবুত তাফসীর, বাব নং ৩৭, হাদীস নং ৪২৪৮, ৪/১৬৪৩; ইবনে হিশাম, প্রাগুক্ত; ১/১১৯।

[25]. আল-কুরআন, সূরা বাক্বারাহ : ১৯৯।

[26]. সফিয়্যুর রহমান মুবারকপুরী, প্রাগুক্ত; পৃ. ৩৯।

[27]. তারা বলতো : اليوم يبدو بعضه أو كله ** و ما بدا منه فلا أحله" দেখুন : ইবনে হিশাম, প্রাগুক্ত; ১/২০২, ২০৩; মুসলিম, প্রাগুক্ত; কিতাবুত তাফসীর, বাব নং ১, হাদীস নং ৩০২৮, ৪/২৩২০।

[28]. আল-কুরআন, সূরা আ‘রাফ : ৩১।

[29] . আল-কুরআন, সূরা বাক্বারাহ : ১৮৯।