শির্ক কী ও কেন? চতুর্থ পরিচ্ছেদ ড. মুহাম্মদ মুয্‌যাম্মিল আলী ১ টি
আরব জনপদে প্রচলিত উপাসনাগত শির্কী কর্ম

চন্দ্র ও সূর্যকে সেজদা করা :

তারা অন্যান্য দেবতাদের পাশাপাশি চন্দ্র ও সূর্যকেও তাদের দেবতা হিসেবে মনে করতো এবং তাদের সেজদা করতো। আল্লাহ মুশরিক ও মুসলিম নির্বিশেষে সকলের জন্য এদের সেজদা করতে নিষেধ করে বলেন :

﴿ لَا تَسۡجُدُواْ لِلشَّمۡسِ وَلَا لِلۡقَمَرِ وَٱسۡجُدُواْۤ لِلَّهِۤ ٱلَّذِي خَلَقَهُنَّ ﴾ [فصلت: ٣٧]

‘‘সূর্য ও চন্দ্রকে সেজদা করোনা, সেজদা করো কেবল সেই আল্লাহকে যিনি এদের সৃষ্টি করেছেন।’’[1]

সূর্যের উপাসনা ও এর উপাসকদের উপাসনার সাথে যাতে আল্লাহর উপাসনার কোনরূপ সাদৃশ্য না হয় সে জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় সালাত আদায় করতে মুসলিমদের নিষেধ করেছেন।

দেবতাদের যিয়ারত করতে দূর-দূরান্তে গমন করা :

তারা বিভিন্ন গৃহ ও দেবতাদের সাথে সংশ্লিষ্ট স্থানসমূহকে কা‘বা শরীফ ও এর প্রাঙ্গণের ন্যায় পবিত্র, বরকতময় ও শরীফ মনে করতো। সে জন্য পুণ্যার্জন, পবিত্রতা অর্জন ও দেবতাদের নিকটবর্তী হওয়ার মাধ্যমে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার উদ্দেশ্যে তারা কা‘বা শরীফের ন্যায় সে সব গৃহ ও দেবতাদেরকে দূর-দূরান্ত থেকে যিয়ারত করতে যেতো। মহান আল্লাহ তাদের অন্যান্য সকল গৃহ ও স্থানসমূহের পবিত্রতা বাতিল পূর্বক পবিত্রতা, পূণ্যার্জন ও তাঁর নৈকট্য লাভের জন্য সাধারণ উপাসনাদির পাশাপাশি যিয়ারতের জন্য শুধুমাত্র কা‘বা শরীফের যিয়ারতের বিষয়টিকে যথারীতি বহাল রেখে এর সাথে অতিরিক্ত হিসেবে মসজিদে নববী ও মসজিদে আকসা যিয়ারতে যাওয়ার অনুমোদন দান করেন এবং কেবলমাত্র সামর্থ্যবানদের উপরেই কা‘বা গৃহের যিয়ারত ফরয করে দিয়ে বলেন :

﴿ وَلِلَّهِ عَلَى ٱلنَّاسِ حِجُّ ٱلۡبَيۡتِ مَنِ ٱسۡتَطَاعَ إِلَيۡهِ سَبِيلٗاۚ﴾ [ال عمران: ٩٧]

‘‘যারা কা‘বা শরীফ যিয়ারতে যাওয়ার সামর্থ্য রাখে তাদের উপর আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তা যিয়ারতে যাওয়া ফরয।’’[2]

কোনো মুসলিম যাতে পুণ্যার্জন, পবিত্রতা ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে উক্ত এ তিন মসজিদ ব্যতীত অন্য কোনো মসজিদ বা অপর কোনো স্থানে দূর-দূরান্ত থেকে সফর করে না যায়, সে জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :

«لا تَشُدَّ الرِّحَالُ إِلاَّ إِلَى ثَلاَثَةِ مَسَاجِدَ: مَسْجِدِيْ هٰذَا وَالْمَسْجِدُ الْحَرَامِ وَالْمَسْجَدُ الأَقْصَى»

‘‘(পুণ্যার্জনের জন্য) তিন মসজিদ ব্যতীত অপর কোথাও সফর করা বৈধ নয়: (সেই মসজিদ তিনটি হচ্ছে:) আমার মসজিদ, মসজিদুল হারাম ও মসজিদে আকসা।’’[3]

দেবতাদের চারপার্শ্বে প্রদক্ষিণ করা :

তারা তাদের তৈরী গৃহ, পবিত্র স্থান ও দেবতাদের শরীফ মনে করে এর চার পার্শ্বে কা‘বা শরীফের ন্যায় ত্বওয়াফ করতো।[4] মহান আল্লাহ তাদের অন্যান্য সব কিছুর ত্বওয়াফ বাতিল করে দিয়ে কেবলমাত্র কা‘বা শরীফের ত্বওয়াফ করাকে যথারীতি বহাল রেখে বলেন :

وَلۡيَطَّوَّفُواْ بِٱلۡبَيۡتِ ٱلۡعَتِيقِ [الحج: ٢٩]

‘‘তারা যেন প্রাচীন পবিত্র গৃহের ত্বওয়াফ করে।’’[5]

দেবতাদের পার্শ্বে অবস্থান করা (العكوف عند الأصنام) :

তারা দেবতাদের সন্তুষ্টি ও নিজেদের মানসিক প্রশান্তি লাভের জন্য নূহ আলাইহিস সালাম-এর জাতির লোকদের ন্যায় দেবতাদের পার্শ্বে বসে সময় কাটাতো। দেবতাদের পার্শ্বে এভাবে অবস্থান গ্রহণের ব্যাপারে আমাদের আদি পিতা ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম-এর জাতির লোকেরাও অভ্যস্ত ছিল। কুরাইশগণ ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম এর ধর্মের অনুসারী বলে দাবীদার হওয়াতে এ জাতীয় অবস্থানের ফলে ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম তাঁর জাতির লোকদেরকে যা বলে তিরস্কার করেছিলেন, তা বর্ণনা করার মাধ্যমে মহান আল্লাহ তাদের এ অবস্থানের সমালোচনা করেন। ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম তাঁর পিতা ও জাতির লোকদের বলেছিলেন :

﴿مَا هَٰذِهِ ٱلتَّمَاثِيلُ ٱلَّتِيٓ أَنتُمۡ لَهَا عَٰكِفُونَ ٥٢ ﴾ [الانبياء: ٥٢]

‘‘এ মূর্তিগুলো কী, যাদের পার্শ্বে তোমরা অবস্থান গ্রহণ করো।’’[6] উল্লেখ্য যে, আল্লাহর তা‘আলার সন্তুষ্টি বিধানের উদ্দেশ্যে কিছু দিন নির্জনে একাগ্রচিত্তে অবস্থান করে আল্লাহ তা‘আলার যিকির ও ধ্যান করা একটি উত্তম কাজ। ইসলামী পরিভাষায় এ কাজকে এ‘তেকাফ(اعتكاف) বলা হয়। তবে ইসলামে বৈরাগ্যপনা স্বীকৃত নয় বলে এ কাজটি শুধুমাত্র রমাযান মাসের শেষ দশ দিনে মসজিদে করার বিধান রয়েছে। কোন কবর, মাযার বা দরগাহে রমাযান মাসে বা অন্য সময়েও তা করা বৈধ নয়।[7]

দেবতাদের নিকট প্রার্থনা করা :

তারা পার্থিব কল্যাণার্জন ও অকল্যাণ দূরীকরণের জন্য সরাসরি আল্লাহর নিকট তা প্রার্থনা না করে লাত, উয্যা ও মানাতের নিকট প্রার্থনা করতো এবং তারা আল্লাহর নিকট থেকে শাফা‘আত করে তা এনে দিতে পারে বলে মনে করতো। মুসলিম ও মুশরিক নির্বিশেষে কেউ যাতে প্রার্থনা করার জন্য অন্য কারো শরণাপন্ন না হয় সে জন্য আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

﴿ وَقَالَ رَبُّكُمُ ٱدۡعُونِيٓ أَسۡتَجِبۡ لَكُمۡۚ إِنَّ ٱلَّذِينَ يَسۡتَكۡبِرُونَ عَنۡ عِبَادَتِي سَيَدۡخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ ٦٠ ﴾ [غافر: ٦٠]

‘‘তোমরা আমাকে আহ্বান কর, আমি তোমাদের আহ্বানে জবাব দেব। যারা (আহ্বানগত) আমার উপাসনা থেকে মুখ ফিরাবে, তারা অচিরেই লাঞ্ছিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’’[8]

দেবতাদের উদ্দেশ্যে হাদিয়া ও মানত দেওয়া :

তারা দেবতাদের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য তাদের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন রকমের বস্তু হাদিয়া ও মানত দিত। মানতের জন্তুসমূহ প্রতিমাদের উপর যবাই করে এর মাংস ভাগাভাগি করে নিতো। আল্লাহ তাদের এ জাতীয় মাংস হারাম করে দিয়ে বলেন :

﴿ وَمَا ذُبِحَ عَلَى ٱلنُّصُبِ ﴾ [المائ‍دة: ٣]

‘‘যে জন্তু যজ্ঞবেদীতে (পাথরের প্রতিমার উপর) যবাই করা হয় (তা তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে)।’’[9]

এ ছাড়াও দেবতাদের সন্তুষ্টি বিধানের উদ্দেশ্যে তারা কোনো কোনো খাদ্য ও পানীয় দ্রব্যাদি এবং ক্ষেত ও চতুষ্পদ জন্তুতে দেবতাদের অংশ নির্ধারণ করতো। তাদের এ জাতীয় কর্মের সমালোচনাপূর্বক আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ وَجَعَلُواْ لِلَّهِ مِمَّا ذَرَأَ مِنَ ٱلۡحَرۡثِ وَٱلۡأَنۡعَٰمِ نَصِيبٗا فَقَالُواْ هَٰذَا لِلَّهِ بِزَعۡمِهِمۡ وَهَٰذَا لِشُرَكَآئِنَاۖ﴾ [الانعام: ١٣٦]

‘‘আল্লাহ যে সব শস্যক্ষেত্র ও জীবজন্তু সৃষ্টি করেছেন, সেগুলো থেকে তারা এক অংশ আল্লাহর জন্য নির্ধারণ করে, অতঃপর নিজ ধারণা অনুসারে বলে: এটা আল্লাহর এবং এটা আমাদের অংশীদারদের।’’[10]

তাদের এ জাতীয় কর্মের সমালোচনা প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ আরো বলেন,

﴿وَقَالُواْ هَٰذِهِۦٓ أَنۡعَٰمٞ وَحَرۡثٌ حِجۡرٞ لَّا يَطۡعَمُهَآ إِلَّا مَن نَّشَآءُ بِزَعۡمِهِمۡ وَأَنۡعَٰمٌ حُرِّمَتۡ ظُهُورُهَا وَأَنۡعَٰمٞ لَّا يَذۡكُرُونَ ٱسۡمَ ٱللَّهِ عَلَيۡهَا ٱفۡتِرَآءً عَلَيۡهِۚ﴾ [الانعام: ١٣٨]

‘‘তারা বলে- এ সব চতুষ্পদ জন্তু, শস্যক্ষেত্র ও নিষিদ্ধ বস্তুসমূহ তাদের ধারণামতে আমরা যাকে ইচ্ছা করি কেবল সে ছাড়া অন্য কেউ তা খেতে পারবে না। আর কিছু সংখ্যক চতুষ্পদ জন্তুর পিঠে আরোহণ হারাম করা হয়েছে এবং কিছু সংখ্যক চতুষ্পদ জন্তুর উপর তারা ভ্রান্ত ধারণাবশত আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে না।’’[11]

বরকত হাসিলের জন্য দেবতাদের গায়ে হাত বুলানো :

তারা বরকত ও কল্যাণ হাসিলের জন্য মূর্তির গায়ে হাত বুলাতো। কোথাও সফরে যাওয়ার পূর্বে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় তাদের সর্বশেষ কাজই হতো মূর্তির গায়ে হাত বুলানো এবং সফর শেষে বাড়ী ফিরলে ঘরে প্রবেশ করে প্রথম কাজই হতো মূর্তির গায়ে হাত বুলানো। তাদের এ জাতীয় বরকত হাসিলের কর্ম নিষিদ্ধ করে দিয়ে কেবল কা‘বা শরীফের ডান পার্শ্ব, কৃষ্ণ পাথর (الحجر الأسود) ও কা‘বা শরীফের দরজা থেকে হাত্বীম পর্যন্ত দেয়ালকে বরকত হাসিলের জন্য স্পর্শ বা চুম্বন করার অনুমতি প্রদান করা হয়[12]। যার প্রমাণ পূর্বে বর্ণিত হয়েছে।

[1]. আল-কুরআন, সূরা ফুসসিলাত : ৩৭।

[2]. আল-কুরআন, সূরা আলে ইমরান : ৯৭।

[3]. মুসলিম, প্রাগুক্ত; কিতাবুল হজ্জ, বাব নং ৭৪, হাদীস নং ১৩৩৯; ২/৯৭৫; ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, প্রাগুক্ত; ২/১৩৪। এ তিন মসজিদ ছাড়া পৃথিবীর সকল মসজিদই আল্লাহর গৃহ হওয়া সত্ত্বেও যদি পুণ্যার্জনের উদ্দেশ্যে অপর কোন মসজিদে দূর থেকে ভ্রমণ করে যাওয়া বৈধ না হয়, তবে দূর-দূরান্তে অবস্থিত কোন পীর বা আউলিয়াদের মাযারে পুণ্যার্জনের জন্য ভ্রমণ করে যাওয়া কোন ভাবেই বৈধ হতে পারে না।– লেখক।

[4]. কুরাইশগণ কা‘বা গৃহের চার পার্শ্বে ত্বওয়াফ করার সময় বলতো :

واللات والعزى ومناة الثالثة الآخرى فإنهن الغرانيق العلى وإن شفاعتهن لترتجى

লাত, উয্যা ও তৃতীয় মানাত নামের দেবতা, তারা অত্যন্ত শক্তিধর, তাদের শাফা‘আত কামনা করা যায়।’’ দেখুন : ড. হাসান ইব্রাহীম হাসান, প্রাগুক্ত; পৃ. ৬২।

[5]. আল-কুরআন, সূরা হাজ্জ : ২৯।

[6]. আল-কুরআন, সূরা আম্বিয়া : ৫২।

[7]. তবে এ উপাসনা কোন কবর, মাযার, দরবার, দরগাহ বা মানুষের দ্বারা গৃহীত কোনো পবিত্র স্থানে আল্লাহর উদ্দেশ্যে করা বেদ‘আত। এর মাধ্যমে কবরস্থ অলির দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাঁর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে চাইলে তাতে শির্ক হবে।- লেখক

[8]. আল-কুরআন, সূরা গাফির : ৬০।

[9]. আল-কুরআন, সূরা মায়েদাহ্‌ : ৩।

[10]. আল-কুরআন, সূরা আন‘আম : ১৩৬।

[11]. আল-কুরআন, সূরা আন‘আম : ১৩৮।

[12] আমরা আগেই জেনেছি যে কৃষ্ণ পাথর ও কাবার ডান পার্শ্ব ব্যতীত আর কোনো অংশ ধরা বা ছোয়ার ব্যাপারে সহীহ হাদীস নেই। [সম্পাদক]