লাত, উয্যা ও মানাত এগুলো তিনটি নারী দেবীর নাম। এগুলো মুশরিকদের কল্যাণ ও অকল্যাণ করতে পারে এ ধারণার ভিত্তিতে তারা এদেরকে সব সময় কল্যাণার্জন এবং অকল্যাণ দূরীকরণের জন্য আহ্বান করতো। তাদের এ আহ্বান সম্পর্কে আল্লাহ বলেন :
﴿ إِن يَدۡعُونَ مِن دُونِهِۦٓ إِلَّآ إِنَٰثٗا وَإِن يَدۡعُونَ إِلَّا شَيۡطَٰنٗا مَّرِيدٗا ١١٧ ﴾ [النساء: ١١٧]
‘‘তারাতো আল্লাহকে ব্যতীত শুধু নারীদের আহ্বান করে, আসলে তারা কেবল অবাধ্য শয়তানকেই আহ্বান করে’’।[1]
এখানে ‘ইনাসান’ বলে লাত, উয্যা, মানাত ও অন্যান্য নারী নামের সকল দেবীদেরকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে।[2] এগুলোকে ‘ইনাস’ বলার পিছনে মোট তিনটি কারণ থাকতে পারে :
এক. ‘ইনাসান’ শব্দটি ‘উন্সা’ শব্দের বহুবচন। এর অর্থ নারী। লাত, উয্যা ও মানাত এ তিনটিকে নারীর নামে নামকরণ করার কারণে এদেরকে ‘ইনাসান’ বলা হয়ে থাকতে পারে। মূলত কোনো নারীদের সাথে এদের ঐতিহাসিক কোনো সম্পর্ক থাকার কারণে নয়।[3]
দুই. আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার মতে ‘ইনাস’ অর্থ ‘আওছান’ তথা প্রতিমাসমূহ। ‘আওছান’ শব্দটি ‘ওয়াসান’ শব্দের বহুবচন। আরবীতে বহুবচন জাতীয় শব্দগুলো স্ত্রীলিঙ্গ হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। যেহেতু মুশরিকরা একাধিক ‘ওয়াছান’ তথা প্রতিমাকে আহ্বান করতো, সে জন্য এগুলোকে ‘ইনাছান’ বলা হয়েছে।[4]
তিন. মুশরিকরা ফেরেশ্তাদেরকে আল্লাহর মেয়ে মনে করে এদের মাধ্যমে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার জন্য এদের উপাসনা করতো। তারা এগুলোর নারী আকৃতির মূর্তি তৈরী করে এদের পূজা-অর্চনার জন্য কিছু নিয়ম নীতি তৈরী করেছিল, এদের গলায় অলংকার ঝুলিয়ে দিয়ে বলেছিল: এরা আল্লাহর মেয়ে যাদের আমরা উপাসনা করি। বিশিষ্ট তাবেঈ দাহহাক (রহ.) থেকে এ ব্যাখ্যাটি বর্ণিত হয়েছে।[5] ‘তারা এ সব মূর্তিকে আহ্বান করে মূলত অবাধ্য শয়তানকেই সাহায্যের জন্য আহ্বান করতো’ উক্ত আয়াতে এ কথা বলার কারণ হলো : শয়তানই মূলত তাদেরকে এ সবের আহ্বান করতে প্ররোচিত করতো। উবাই ইবনে কা‘ব রাদিয়াল্লাহু আনহু এর বর্ণনা মতে এ সব মূর্তির সাথে একটি করে মহিলা জিন থাকতো।[6]
আর এ জিনরাই অদৃশ্যে থেকে তাদের আহ্বানকারীদের উপকার করে দিত। ফলে মুশরিকরা এ উপকারকে এ সব মূর্তির কাজ বলেই মনে করতো। তাদের ধারণা মতে ফেরেশ্তারা আল্লাহর মেয়ে হওয়ার কারণে তারা আল্লাহর অতীব নিকটতম ও প্রিয়ভাজন। তাদের সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারলে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া সম্ভব। সে জন্যেই তারা তাদের উপাসনা করতো এবং বলতো: ‘‘তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেবে, এ উদ্দেশ্যেই আমরা তাদের উপাসনা করছি’’।[7] আরো বলতো : ‘‘এরা আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য শাফা‘আতকারী।’’[8]
লাত, উয্যা ও মানাত এ তিনটি দেবীকে নারীর নামে নামকরণ করার কারণ হিসেবে যে তিনটি কারণ বর্ণনা করা হয়েছে, এর যে কোনটির কারণে এগুলোর উপর্যুক্ত নামকরণ হয়ে থাকতে পারে। তৃতীয় সম্ভাবনাটির কথা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত না হলেও মুশরিকরা যে ফেরেশ্তাদেরকে আল্লাহর মেয়ে মনে করতো এবং ফেরেশ্তাদেরকে উদ্দেশ্য করেই যে তারা এ তিনটি দেবীকে উপর্যুক্ত নামে নামকরণ করেছিল, তা স্বয়ং কুরআন দ্বারাই প্রমাণিত। তারা যে ফেরেশ্তাদেরকে নারী মনে করতো সে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَجَعَلُواْ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةَ ٱلَّذِينَ هُمۡ عِبَٰدُ ٱلرَّحۡمَٰنِ إِنَٰثًاۚ﴾ [الزخرف: ١٩]
‘‘তারা ফেরেশ্তাদেরকে, যারা আল্লাহর বান্দা, তাদেরকে নারী বলে স্থির করেছে’’।[9] আবার ফেরেশ্তাদেরকে যে তারা আল্লাহর মেয়ে মনে করতো, সে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿أَفَرَءَيۡتُمُ ٱللَّٰتَ وَٱلۡعُزَّىٰ ١٩ وَمَنَوٰةَ ٱلثَّالِثَةَ ٱلۡأُخۡرَىٰٓ ٢٠ أَلَكُمُ ٱلذَّكَرُ وَلَهُ ٱلۡأُنثَىٰ ٢١ تِلۡكَ إِذٗا قِسۡمَةٞ ضِيزَىٰٓ ٢٢ إِنۡ هِيَ إِلَّآ أَسۡمَآءٞ سَمَّيۡتُمُوهَآ أَنتُمۡ وَءَابَآؤُكُم مَّآ أَنزَلَ ٱللَّهُ بِهَا مِن سُلۡطَٰنٍۚ﴾ [النجم: ١٩، ٢٣]
‘‘তোমরা কি ভেবে দেখেছ লাত, উয্যা ও তৃতীয় আরেকটি মানাত সম্পর্কে? পুত্র-সন্তান কি তোমাদের জন্যে আর কন্যা-সন্তান আল্লাহর জন্যে। এটা হবে খুব অন্যায় বন্টন। এগুলো কতকগুলো নাম বৈ আর কিছুই নয়, যা তোমরা ও তোমাদের পূর্বপুরুষেরা রেখেছো, এসবের কোনো প্রমাণ আল্লাহ অবতীর্ণ করেন নি।’’[10]উক্ত আয়াত দু’টির দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, তারা ফেরেশ্তাদেরকে আল্লাহর মেয়ে মনে করেই তাদের উপাসনার মাধ্যমে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার উদ্দেশ্যে লাত, উয্যা ও মানাত নামের এ তিনটি দেবীকে নারীর নামে নামকরণ করেছিল। সে জন্যে ইমাম ইবনে কাছীরও তাঁর তাফসীরে দাহহাক কর্তৃক বর্ণিত ব্যাখ্যাকে أَفَرَأَيْتُمُ اللاَّتَ...الآية এর সাথে সামঞ্জস্যশীল বলে মন্তব্য করেছেন।[11]
>[2]. আল-কুরত্বুবী, আবু ‘আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবন আহমদ আল-আনসারী, আহকামুল কুরআন; (মিশর : আল-হাইআতুল মিশরিয়্যাতু লিল কুত্তাব, ৩য় সংস্করণ, ১৯৮৭ খ্রি.), ১০/৭৮।
[3]. তদেব।
[4]. ইবনে কাছীর, তাফছীরুল কুরআনিল ‘আযীম; ১/৫৬৮।
[5]. ইবনে জারীর ত্ববারী দাহহাক থেকে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন :
قال جرير عن الضحاك في الآية : قال المشركون للملائكة بنات الله وإنما نعبدهم ليقربونا إلى الله زلفى .قال فاتخذوهن أربابا وصوروهن جواري ، فحكموا وقلدوا وقالوا هؤلاء بنات الله الذي نعبده يعنون الملائكة .قال ابن كثير : هذا التفسير شبيه بقول الله تعالى :[ أفرأيتم اللات والعزى ] الآيات. –
দেখুন : ইবনে কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম; ১/৫৬৮।
[6]. তদেব।
[7].আল-কুরআন, সূরা যুমার : ৩।
[8]. আল-কুরআন, সূরা ইউনুস : ১৮।
[9].আল-কুরআন, সূরা যুখরূফ : ১৯।
[10]. আল-কুরআন, সূরা নাজম : ১৯।
[11].ইবনে কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম; ১/৫৬৮।