মানব সমাজে অতীত কাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত এমন কিছু অভ্যাস প্রচলিত রয়েছে, যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দৃষ্টিতে শির্কের অন্তর্ভুক্ত। কুরআনুল কারীম ও হাদীসে জাহেলী যুগের যে সব শির্কী অভ্যাসের সমালোচনা বর্ণিত হয়েছে, সে সব অভ্যাসের মধ্যে ছিল :
১. কোনো উপত্যকায় অবতরণ করলে সেখানকার জিনের উপদ্রব থেকে আত্মরক্ষার জন্য সে উপত্যকার জিনদের মহিলা সরদারকে আহ্বান করে তার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করা।
২. দেবতাদের উদ্দেশ্যে চতুষ্পদ জন্তু উৎসর্গ করা এবং তা উৎসর্গ করা হয়েছে বুঝানোর জন্যে এর কান কাটা, শরীর বিকৃত করা ও ঘাড়ে কাপড় ঝুলিয়ে রাখা। এ সকল উৎসর্গকৃত জন্তুর মধ্যে ‘বাহীরা’, ‘সা-ইবা’, ‘ওয়াসীলা’ ও ‘হামী’ ছিল অন্যতম।
৩. দেবতাদের জন্য শস্য ও চতুষ্পদ জন্তুতে অংশ নির্ধারণ করা।
৪. সন্তানাদিকে অকল্যাণের হাত থেকে রক্ষার জন্য দেবতাদের নিকট নিয়ে যাওয়া।
৫. তারকার প্রভাবে বৃষ্টি অবতীর্ণ হয় বলে বিশ্বাস করা।
৬. জ্যোতিষ, গণক ও কাহিনদের নিকট ভাগ্যের ভাল-মন্দ অবগতির জন্য গমন করা।
৭. কোন কোন রোগ আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা ব্যতীত নিজ থেকে সংক্রমিত হয় বলে মনে করা।
৮. পাখি উড়িয়ে ভাগ্য পরীক্ষা করা। পাখি ডান দিকে উড়ে গেলে এটাকে শুভ লক্ষণ এবং বাম দিকে উড়ে গেলে এটাকে অশুভ লক্ষণ বলে মনে করা।
৯. কোন কোন দিন ও মাসকে অশুভ মনে করা।
১০. গায়রুল্লাহর নামে শপথ করা।
১১. শিশুদের গায়ে তাবীজ ঝুলানো, ইত্যাদি।
ইসলাম পরবর্তী যুগে এ সব শির্কী অভ্যাসের অপনোদন করা হলেও অজ্ঞতাবশত মুসলিমদের মাঝে শির্কে আসগারের পর্যায়ে পড়ে এমন কিছু কথা-বার্তার প্রচলন ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন রাসূল এর ইচ্ছাকে আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছার সাথে সংযুক্ত করে একদা এক সাহাবী বলেছিলেন :
«مَاشَاءَ اللهُ وَشِئْتَ»
‘‘আপনি এবং আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন।’’
লোকটির কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«أَجَعَلْتَنِيْ للهِ عَدْلاً»
‘‘তুমি কি আমাকে আল্লাহর সমকক্ষ করে নিলে?’’[1]
অনুরূপভাবে অপর এক সাহাবী বলেছিলেন :
«نَسْتَشْفَعُ بِاللهٍ عَلَيْك»
‘‘আল্লাহর শাফা‘আতের ওসীলায় আমি আপনার নিকট কামনা করছি’’। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যক্তিকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন: আল্লাহকে মাধ্যম করে কারো কাছে কিছু চাওয়া যায়না; কারণ, আল্লাহ সুমহান মর্যাদার অধিকারী।[2]
এ অধ্যায়ের চতুর্থ পরিচ্ছেদে এ জাতীয় অভ্যাস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে বিধায়, এখানে এ সবের প্রমাণাদি ও তথ্যসূত্র সম্পর্কে কোনো আলোচনা করা হলো না।
সারকথা :
আলোচ্য পরিচ্ছেদের উপসংহারে যে কথাটি বলতে চাই তা হলো : শির্ক মূলত আল্লাহ তা‘আলার উলূহিয়্যাত ও রুবূবিয়্যাতকে কেন্দ্র করেই সংঘটিত হয়ে থাকে। শির্ককে প্রথমে যে দু’প্রকারে বিভক্ত করা হয়েছে, তন্মধ্যে শির্কে আকবর হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার উলূহিয়্যাত ও রুবূবিয়্যাত উভয় কেন্দ্রিক। আবার শির্কে আকবরকে যে চার ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে তন্মধ্যে জ্ঞানগত, পরিচালনাগত ও অভ্যাসগত[3] এ তিন প্রকারের শির্কের সম্পর্ক হচ্ছে আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের সাথে। অর্থাৎ- যারা এ তিন প্রকারের শির্কে নিমজ্জিত হবে তারা আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের সাথে শির্ক করবে। আর উপাসনাগত অবশিষ্ট যে প্রকারটি রয়েছে এটি আবার দু’ভাগে বিভক্ত।
শরীরের বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাথে সম্পর্কিত বাহ্যিক যে সব উপাসনার বর্ণনা করা হয়েছে, সেগুলোর সম্পর্ক হচ্ছে আল্লাহর উলূহিয়্যাতের সাথে, আর শরীরের গোপন অঙ্গ অন্তরের সাথে সম্পর্কিত যে সব উপাসনার বর্ণনা করা হয়েছে, সেগুলোর সম্পর্ক হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার রুবুবিয়্যাতের সাথে। অর্থাৎ- যারা শরীরের বাহ্যিক উপাসনায় শির্ক করবে তারা আল্লাহর উলূহিয়্যাতে শির্ক করবে, আর যারা অন্তরের উপাসনায় শির্ক করবে তারা আল্লাহর রুবূবিয়্যাতে শির্ক করবে[4]।
আলোচ্য পরিচ্ছেদে শির্কের আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থ, এর প্রকারাদি এবং এর পরিচিতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার পর সামনের পরিচ্ছেদে আমরা যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবো তা হলো- মানুষ আল্লাহর সৃষ্ট জীব হওয়া সত্ত্বেও তাদের মাঝে আদি থেকে কি তাওহীদী চিন্তা ও চেতনা বিরাজমান ছিল, না কি তাদের মাঝে শির্কী চিন্তা ও চেতনা বিরাজমান ছিল?
>[1].ইমাম আহমদ, প্রাগুক্ত; ১/২১৪।
[2]. আবু দাউদ, প্রাগুক্ত; কিতাবুস সুন্নাহ, বাব নং- ১৮; ৫/৯৫। (তবে হাদীসটির সনদ দুর্বল। [সম্পাদক])
[3] আমরা আগেই বলেছি, লেখক এখানে অভ্যাসগত যে সকল শির্কের উদাহরণ দিয়েছেন তা হয় রুবুবিয়্যাত, নতুবা উলুহিয়্যাতের সাথে সম্পৃক্ত। সেটাকে শুধু রুবুবিয়্যাতের সাথে সম্পৃ্ক্ত বলার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। [সম্পাদক]
[4] এখানেও বিশুদ্ধ মতটি আমরা লেখকের কথার বাইরে দেখতে পাই। কারণ, অন্তরের উপাসনার বিষয়টিও উলুহিয়্যাতের সাথেই সম্পৃক্ত। তবে কোনো কোনো সময় সেটা রুবুবিয়্যাতে শির্ক করা পর্যন্ত গড়ায়। [সম্পাদক]