গায়েবের জ্ঞান সম্পর্কিত উপর্যুক্ত আলোচনার মাধ্যমে যখন আমরা এ কথা অবগত হতে পারলাম যে, গায়েব সম্পর্কে অবহিত হওয়ার বিষয়টি আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের বৈশিষ্ট্যের অন্তর্গত বিষয়। তিনি তাঁর সৃষ্টির মধ্যকার কাউকে এ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী করেন না। অনুগ্রহপূর্বক যদি তিনি কাউকে এ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী করতেন, তবে তাঁর প্রিয়ভাজন শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এর অধিকারী করতেন। কিন্তু আমরা উপরের আলোচনায় দেখতে পেলাম যে, তাঁকেও তিনি এ গুণের অধিকারী করেন নি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-নিজ থেকেও এ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন না। আল্লাহ তা‘আলা নিজ অনুগ্রহে তাঁকে দুনিয়া-আখেরাতের গায়েব সম্পর্কিত যা কিছু অবহিত করেছিলেন তাও কেবল তাঁর রেসালত ও এর সাথে সম্পর্কিত বিষয় এবং জনগণের নিকট তাঁর গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যের সাথে সম্পর্কিত ছিল।
আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হয়ে তিনি যদি অদৃশ্য সম্পর্কে নিজ থেকে কিছুই জানতে না পারেন, তবে তাঁর উম্মতের মধ্যে এমন কোন্ অলি, গউছ ও কুতুব[1] থাকতে পারেন, যারা নিজ থেকে গায়েব সম্পর্কে কিছু জানতে পারেন। মানুষ আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হয়ে যদি গায়েব সম্পর্কে কিছুই জানতে না পারে, তবে আল্লাহর অন্যান্য সৃষ্টির মধ্যকার কেউ যে নিজ থেকে এ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে পারবে না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। গায়েব সম্পর্কিত জ্ঞানের বিষয়টি যখন সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ তা‘আলার রুবূবিয়্যাতের আওতাভুক্ত বিষয়, তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ব্যাপারে কস্মিনকালেও এ ধারণা পোষণ করা যাবে না যে, তাঁর সত্তার মধ্যে জন্মগতভাবে এমন কোনো যোগ্যতা ছিল যার দ্বারা তিনি অদৃশ্য সম্পর্কে জ্ঞাত হতেন, অথবা জন্মগত না হোক নবুওত পরবর্তী সময়ে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মধ্যে গায়েব সম্পর্কে অবহিত হওয়ার বৈশিষ্ট্য দান করেছিলেন, যার ফলে তিনি যখন ইচ্ছা গায়েব সম্পর্কে অবহিত হতে পারতেন[2]! একইভাবে আল্লাহর অলিদের ব্যপারেও এমন ধারণা কোনো অবস্থাতেই পোষণ করা যাবে না।
আল্লাহর অন্যান্য সৃষ্টির বেলায় তো তা কল্পনাই করা যায় না। কেউ যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, কোনো অলি, দরবেশ ও ফকীর অথবা কোনো পশু ও পাখির মধ্যে এমন বৈশিষ্ট্য রয়েছে বলে মনে করে, তা হলে বুঝতে হবে যে, সে শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে পথভ্রষ্টতার মধ্যে পড়ে রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলার দৃষ্টিতে সে মুশরিকদের দলভুক্ত হয়ে গেছে। এমন ধারণা পোষণকারীর জানা আবশ্যক যে, এ জাতীয় শির্কী ধারণা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নবী হয়ে প্রেরিত হওয়ার প্রাক্কালে সমগ্র আরব জাহানব্যাপী প্রচলিত ছিল।[3] মুশরিকরা তাদের দেবতাদের ব্যাপারে অনুরূপ ধারণা পোষণ করতো। এ ধারণার বশবর্তী হয়েই তারা তাদের ‘হুবল’ দেবতার নিকটে গিয়ে তীর দ্বারা ভাগ্য যাচাই করতো।[4] কুরআনুল কারীমে তাদের এ জাতীয় কর্মকে শয়তানের অপবিত্র কর্ম বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।[5] এ ছাড়াও তাদের মাঝে এ বিশ্বাসও ছিল যে, কাহিন ও গণকরা গায়েব বা অদৃশ্য সম্পর্কে জ্ঞান রাখে, সে জন্যেই তারা তাদের বিবিধ রকমের বিষয়াদির ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ জানার জন্য গণকদের কাছে যেতো। আরব সমাজের প্রচলিত শির্ক সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে ইন-শাআল্লাহ আমরা কুরআন ও হাদীস দ্বারা তা প্রমাণের প্রয়াস পাব।
উপর্যুক্ত ধারণা পোষণকারীর আরো জানা আবশ্যক যে, তার এ জাতীয় চিন্তা ‘আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ এর ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত মূলনীতি বহির্ভূত চিন্তা।[6] এ কারণেই ইসলামী বিশেষজ্ঞগণ এ মর্মে ফতোয়া প্রদান করেছেন যে, যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ’ বলে এ বিশ্বাসের ভিত্তিতে আহ্বান করবে যে, তিনি অদৃশ্য বা গায়েব সম্পর্কে জ্ঞাত থাকার ফলে দূর থেকে তার আহ্বানকে শ্রবণ করে থাকবেন, সে ব্যক্তি কাফির হয়ে যাবে।[7] অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি কোনো অলিকে এ বিশ্বাসের ভিত্তিতে আহ্বান করবে সেও কাফির হয়ে যাবে।[8] অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি এ ধারণা পোষণ করবে যে, আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর গায়েবী বা অদৃশ্য জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য এতটুকু যে, আল্লাহ তা‘আলার গায়েবী বা অদৃশ্য জ্ঞান হলো তাঁর সত্তাগত (ذاتي) জ্ঞান, আর রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর গায়েবী বা অদৃশ্য জ্ঞান হলো আল্লাহ তা‘আলার দান, অর্থাৎ- আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে গায়েবী অদৃশ্য জ্ঞানের যোগ্যতা দান করেছেন, তাই তিনি সে যোগ্যতা বলে গায়েবী বা অদৃশ্য সম্পর্কে অবগত হতেন, তা হলে সে ব্যক্তিও নিঃসন্দেহে কাফের ও মুশরিক হয়ে যাবে[9] কারণ; গায়েব সম্পর্কে অবগত হওয়ার একচ্ছত্র অধিকার হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার। তাঁর অহী অথবা ইলহাম ছাড়া জাগ্রত অবস্থায় তাঁর বান্দাদের পক্ষে তা অবগত হওয়ার বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেই।[10]
>[2] বস্তুত এ ধরণের ধারনা পোষণ করা সরাসরি শির্ক। [সম্পাদক]
[3].মাওলানা মুহাম্মদ ‘আরিফ সম্বহলী, ব্রেলভী ফিৎনা কী নয়া রূপ; (উর্দ্দূ ভাষায়), (লাহুর : আশ্রাফ ব্রাদার্স , ২য় সংস্করণ, ১৯৭৮ খ্রি.), পৃ. ৮৬।
[4]. ইবনু কাইয়্যিম আল-জাউযিয়্যাহ, এগাছাতুল লাহফান; (কায়রো : দারুত তুরাছিল ‘আরাবী, ২য় সংস্করণ, ১৯৮৩ খ্রি.), পৃ.১৬৯।
[5]. বলা হয়েছে :
﴿إِنَّمَا ٱلۡخَمۡرُ وَٱلۡمَيۡسِرُ وَٱلۡأَنصَابُ وَٱلۡأَزۡلَٰمُ رِجۡسٞ مِّنۡ عَمَلِ ٱلشَّيۡطَٰنِ فَٱجۡتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُونَ ٩٠ ﴾ [المائدة: ٩٠]
‘‘নিশ্চয় মদ, জুয়া, প্রতিমা ও ভাগ্য নির্ধারক তীরসমূহ শয়তানের অপবিত্র কর্ম বৈ আর কিছুই নয়, সুতরাং তোমরা এগুলো থেকে বিরত থাকো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার’’। আল-কুরআন, সূরা আল-মায়েদাহ : ৯০।
[6]. আবু বকর জাবির আল-জাযাইরী, ওয়া জাউ ইয়ারকুদুন!!! মাহলান ইয়া দু‘আতাত দালালাঃ; (وجاءوا يركضون !!! مهلا يا دعاة الضلالة) (স্থান বিহীন: মিন ওয়াছাইলিদ দাওয়াঃ, ১৪০৬হিজরী), পৃ. ৪৫; ক্বাযী ছানাউল্লাহ পানিপতী, ইরশাদুত ত্বালিবীন; ৩/১৯; মুল্লা ‘আলী আল- ক্বারী আল- হানাফী, শরহু কিতাবিল ফিকহিল আকবার; পৃ. ২২৫।
[7]. ক্বাযী ছানাউল্লাহ পানিপথি, প্রাগুক্ত; ৩/৬-৮।
[8]. মাওলানা মুহাম্মদ নূর কেলীম, ব্রেলভী মাযহাব আওর ইসলাম; (ফয়সল আবাদ : মাকতাবাতু দ্বারুল ‘উলূম ফয়দে মুহাম্মদী, সংস্করণ বিহীন, সন বিহীন), পৃ. ৭৬।
[9]. তদেব।
[10]. আল-হানাফী, মুল্লা ‘আলী আল-কারী, শরহু কিতাবিল ফেকহিল আকবার;প্রাগুক্ত; পৃ.২২৫।