যুব-সমাজের চরিত্রহীনতা ও ভ্রষ্টতার অন্যতম কারণ হল বিবাহ-সমস্যা। বিবাহের বয়স হওয়া সত্ত্বেও বিবাহ না হলে, চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বিবাহ না করলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেতে বাধ্য। প্রত্যেক জিনিসের নির্দিষ্ট সীমা আছে; ধৈর্যেরও একটা সীমা আছে। সে সীমা অতিক্রান্ত হলে বিপদ অনিবার্য। পক্ষান্তরে বিবাহে আছে জীবনের পবিত্রতা ও সচ্চরিত্রতা। বিবাহে আছে চরিত্রহীনতার বিভ্রান্তি-জাল থেকে মুক্তির উপায়। আর এ জন্যই সমাজবিজ্ঞানী নবী ও যুব-সমাজকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, “হে যুবকের দল! তোমাদের মধ্যে যার সঙ্গম ও ভরণপোষণ করার ক্ষমতা রয়েছে, সে যেন বিবাহ করে নেয়। কারণ, বিবাহ অধিকরূপে দৃষ্টিকে (হারাম থেকে) সংযত করে এবং লজ্জাস্থানকে অধিকরূপে (হারাম। থেকে রক্ষা করে। আর যার এ সামর্থ্য নেই, সে যেন রোযা পালন করে। কারণ, তা হল যৌন উত্তেজনা দমনকারী। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৩০৮০ নং)
মহানবী (সা.) বলেন, “বান্দা যখন বিবাহ করে তখন সে তার অর্ধেক দ্বীন পূর্ণ করে নেয়। অতএব তাকে তার অবশিষ্ট অর্ধেক দ্বীনের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করা উচিত।” (বাইহাকীর শুল ঈমান সহীহুল জামে’ ৪৩০ নং) বলা বাহুল্য, যুবক যথাসময়ে বিবাহ করলে তার দ্বারা অপকর্ম ঘটার আশঙ্কা থাকে না। হালাল পেয়ে হারামের পথে পা বাড়ায় না। জীবন-সঙ্গিনী পেয়ে তার চক্ষু শীতল হয়। ফলে। অবৈধ সৌন্দর্যের প্রতি আর দৃকপাত করে না। আল্লাহ তার ঐ দাম্পত্যে তাকে স্থিরচিত্ত করে দেন। বিবাহে রয়েছে জ্বালাময়তার স্থলে মানসিক শান্তি এবং চিত্তচাঞ্চল্যের স্থলে হৃদয়ের স্থিরতা। সৃষ্টিকর্তা নারীকে পুরুষের জন্য শান্তিদায়িনীরূপে সৃষ্টি করেছেন। তিনি বলেন, “তার নিদর্শনাবলীর মধ্যে আর একটি নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হতেই তোমাদের সঙ্গিনীদেরকে সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা ওদের নিকট শান্তি পাও এবং তোমাদের মাঝে পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও স্নেহ সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা রূম ২১ আয়াত)
অতএব আল্লাহর চিরন্তন এ বিধানের কাছে কোন সমস্যাকে সমস্যা মনে করা উচিত নয়। প্রথম যৌবনে বিবাহ করলে অধ্যয়ন ও বিদ্যার্জনের পথে বাধা পড়ে –এ কথা যুক্তিযুক্ত নয়। বরং এর বিপরীতটাই সঠিক। যেহেতু বিবাহের পর যৌনক্ষুধা নিবৃত্ত হলে, চক্ষুদ্বয় শীতল হলে, মানসিক শান্তি ও প্রবোধ লাভ হলে তো তাতে শিক্ষার্থী শিক্ষায় অধিক সহায়তা পাবে। কারণ, মস্তিষ্ক যখন প্রশান্ত থাকবে, কুচিন্তা থেকে মন যখন পরিষ্কার থাকবে, তখন তো অতি সহজভাবে পাঠ উপলব্ধ হবে, কঠিন পড়া অনায়াসে বুঝে আসবে এবং অধ্যয়নে অধিক। অভিনিবেশ করা সম্ভবপর হবে। বৈষয়িক কোন কাজকর্মে মনে ব্যাকুলতা সৃষ্টি হলে স্ত্রী তা দুরীকরণে সহায়িকা হবে, শোকে-দুঃখে সান্ত্বনা দান করবে এবং অধিক উত্তমরূপে অধ্যয়নরত হওয়ার ব্যাপারে স্বামীকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করবে।
‘পুরুষে এনেছে দিবসের জ্বালা তপ্ত রৌদ্রদাহ,
কামিনী এনেছে যামিনী-শান্তি, সমীরণ, বারিবাহ।
দিবসে দিয়াছে শক্তি-সাহস, নিশীথে হয়েছে বধু,
পুরুষ এসেছে মরুতৃষা লয়ে -নারী যোগায়েছে মধু।
তবে দুর্ভাগ্যক্রমে যদি স্ত্রী তেমন না হয়, অথবা স্বামীর মনে যদি অঞ্চল-প্রভাব পড়ে, অথবা উভয়ের মধ্যে কেউ যদি ইন্দ্রিয়পরায়ণ হয়, তবে নিশ্চয় সে আশা করা যায় না। এমন যুবক সত্যই যে দুর্বল, তাতে সন্দেহ নেই। আর আল্লাহর নিকট দুর্বল অপেক্ষা সবল মু’মিনই অধিকতর পছন্দনীয়া যুবকের মনে স্বামীত্ব ও কর্তব্য-জ্ঞান না জন্মালে পদস্থলনের আশঙ্কাই বেশী থাকে। স্ত্রী ও সংসারের ভারসাম্য রক্ষা করে পড়াশোনা করা কোন কর্তব্যপরায়ণ ও উন্নয়নাভিলাষী যুবকের নিকট কঠিন নয়।
চরিত্রহীন দেশে চরিত্রহীনরা ইচ্ছামত অবৈধ প্রেম করে তারই জোয়ার-ভাটার মাঝে দোটানায় পড়েও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে। অথচ তুমি বৈধভাবে একজন পবিত্রা নারীকে ভালোবেসে তার নির্মল প্রেম-নিঝরে নিমজ্জিত থেকে তা পারবে না কেন? অবশ্য সংসারের দায়িত্ব ও বোঝা এসে যাওয়ার যদি ভয় কর, তাহলে ভেবে দেখ, পাপের ভয় তদপেক্ষা অধিক কি না? ‘চাকরী না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে করব না, বাড়ি না করে বিয়ে করব না, নিজের পায়ে না দাড়িয়ে বিয়ে করব না, বিয়ে করলে খাওয়াব কি? ইত্যাদি ওজরও খোড়া ওজর। ভেবে দেখ, তুমি কি খাও? তাছাড়া তুমি যে পজিশনের ঠিক সেই পজিশনের মেয়ে বিয়ে কর।
পরন্তু রুযীর ভার আল্লাহর উপর ছেড়ে দাও তদবীর করে যাওয়া তোমার কাজ, রযী দান করা। তার কাজ। আর বিশেষ করে বিবাহ মঙ্গল বয়ে আনে। কারণ, তা হল আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য। এ আনুগত্যে আছে তোমার বহু সমস্যার সমাধানের পথ। মহান আল্লাহ বলেন, “তোমাদের মধ্যে যারা অবিবাহিত (নরনারী), তাদের বিবাহ সম্পাদন কর এবং তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা সৎ -তাদেরও। তারা অভাবগ্রস্ত হলে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে অভাবমুক্ত করে দেবেন। আল্লাহ তো প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।” (সূরা নুর ৩২ আয়াত)।
আর মহানবী (সা.) বলেন, “তিন ব্যক্তিকে সাহায্য করা আল্লাহর দায়িত্ব; আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী মুজাহিদ, সেই ক্রীতদাস যে নিজেকে স্বাধীন করার জন্য তার প্রভুকে কিস্তিতে নির্দিষ্ট অর্থ দেওয়ার চুক্তি লিখে সেই অর্থ আদায় করার ইচ্ছা করে এবং সেই বিবাহকারী যে বিবাহের মাধ্যমে (অবৈধ যৌনাচার হতে) নিজের চরিত্রের পবিত্রতা কামনা করে।” (আহমদ, তিরমিযী, নাসাঈ, বাইহাকী, হাকেম, সহীহুল জামে ৩০৫০ নং)।
বিবাহের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল পিতামাতার অসম্মতি যুবকের বিবাহ-সামর্থ্য আছে, আল্লাহর উপর ভরসা আছে, রযীর যথেষ্ট ব্যবস্থা আছে এবং তার সঙ্গিনীর একান্ত প্রয়োজন আছে, তা সত্ত্বেও কোন স্বার্থবশে অভিভাবক বিবাহ দিতে রাজী নয়। অথবা মন মত পণ না পাওয়ার ফলে বিবাহে দেরী করে। অথবা ছেলের বিয়ে দিলে সংসারের কাজ ঠিক মত দেখবে
অথবা সংসার থেকে পৃথক হয়ে যাবে এই আশঙ্কায় তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে চায় না। এ সব ক্ষেত্রে অভিভাবকের উচিত, আল্লাহকে ভয় করা এবং ছেলের নৈতিকতা ও সৎ পথে প্রতিবন্ধক তথা তার পাপকাজের কারণ না হয়ে বসা। আর জেনে রাখা উচিত যে, তাদের এ বাধার ফলে ছেলে যদি পাপ করে বসে, তাহলে ঐ পাপের জন্য তারাও পাপী হবে এবং আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তাছাড়া বিবাহ-কার্যে এইভাবে বাধ সাধলে সমাজ, পরিবেশ ও পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। ফাসাদ ও চরিত্রহীনতা ছড়িয়ে পড়বে।
সমাজ-বিজ্ঞানী নবী (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তির দ্বীন ও চরিত্রে তোমরা সন্তুষ্ট, সে ব্যক্তি তোমাদের কাছে বিবাহের পয়গাম দিলে, তার বিবাহ দাও। এমন না করলে পৃথিবীর বুকে ফিতনা ও ব্যাপক ফাসাদ ছড়িয়ে পড়বে।” (তিরমিযী, মিশকাত ৩০৯০ নং) কিন্তু যুবকের সকল সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও এবং পছন্দ মত দ্বীনদার পাত্রী পাওয়া সত্ত্বেও যদি অভিভাবক বিবাহে খামাখা বাধা দেয় এবং সে বিবাহ না করলে ব্যভিচার বা অন্য পাপে লিপ্ত হয়ে পড়ার সত্যই আশঙ্কা করে, তাহলে সে ক্ষেত্রে অভিভাবকের মনমত চলা বৈধ নয়। এমন সংকট মহর্তে আল্লাহর উপর ভরসা করে বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে বিবাহ করে ফেলা একান্ত জরুরী।
পরন্তু তোমার মন যদি খোদ লোভাতুর হয় এবং মোহর দিয়ে বিয়ে করার বদলে মোটা টাকা নিয়ে বিয়ে করার পরিকল্পনা থাকে, অথবা কোন এমন ঘরের খোজে থাক, যেখানে ফারাযী অংশ বেশী পাবে বলে নিশ্চয়তা আছে, আর এর কারণে বিয়ে করতে দেরীও কর, আবার পাপ থেকেও বাঁচতে পার না, তাহলে জেনে রেখো যে, এ ডবল পাপের সাজা তোমার। জন্য অপেক্ষা করছে। আখেরাতে তো আছেই, পরন্তু দুনিয়াতেও তুমি তার কিছু প্রত্যক্ষ করতে পার। অর্থলালসার এ পাপ হল কুরআন-বিরোধী মহাপাপ। এমন পণ বা যৌতুক নেওয়ার মত পাপ ও যুলুম অন্ততঃ একজন ন্যায়পরায়ণ মুসলিম যুবক করতে পারে না। ইসলাম যে মর্যাদা একজন নারীকে দিয়েছে, সে মর্যাদা যৌতুক দাবী করে, বধুনির্যাতন, বিবাহ-বিচ্ছেদ, এমন কি পিটিয়ে খুন পর্যন্ত করে কোন মুসলিম ক্ষুন্ন করতে পারে না।
সমাজে প্রচলিত আরো একটি বিবাহ-সমস্যা হল, বড় থাকতে ছোটর বিয়ে, অথবা বোন থাকতে ভায়ের বিয়ে। বড়র বিয়ে করতে যদি কোন অসুবিধা বা বাধা থাকে, অথবা বোনের বিবাহ-প্রস্তাব আসতে যদি দেরী হয়, অথবা তার জন্য উপযুক্ত ঘর-বর না পাওয়া যায়, তাহলে যার বিবাহের প্রয়োজন আছে এবং উপযুক্ত পাত্রীও আছে, তার বিবাহে অভিভাবক বা অন্য কারো বাধা দেওয়ার অধিকার নেই। বোনের যদি পাঁচ বছর বিবাহ ঠিক না হয়ে ওঠে, তা বলে কি তার থেকে বয়সে বড় ভাইকে।
তারই জন্য অপেক্ষা করতে হবে? তাছাড়া এ আশঙ্কাও উচিত নয় যে, ছেলের বিয়ে দিয়ে দিলে ছেলে হয়তো পৃথক হয়ে যাবে, অথবা তার মতিগতি ভিন্ন হয়ে যাবে এবং তখন সে আর মেয়ের বিয়েতে সহায়তা করবে না। কিন্তু মেয়ে যদি বয়সে আরো ছোট হয়, তাহলে কি এ আশঙ্কা থাকে না? আর তা যদি সঙ্গত হয় তাহলে পাঁচ বছরের মেয়েটি বড় হয়ে বিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত কোন অভিভাবকের ২০/২৫ বছর বয়সী ছেলের বিয়ে দেওয়া উচিত নয়। কিন্তু কৈ, তা তো কেউ করে না। তা করলে তো, মেয়ের বিয়ের সময় হতে হতে ছেলে বুড়িয়ে যাবে!
অতএব এমন ওজর একটি খোঁড়া ওজর। এ ওজুহাতে উপযুক্ত ছেলের বিয়ে পিছিয়ে দিয়ে তাকে পাপের পথে ঠেলে দেওয়া অভিভাবকের জন্য আদৌ উচিত ও বৈধ নয়। যুবক বন্ধু আমার বয়স হলে বিবাহ কর এবং স্ত্রীর সাথে প্রেম কর। তাকে দাও। ভালোবাসার ডালি খালি করে প্রণয়ের রাশিরাশি ফুল। তাকেই লিখ ভাবের আবেগে লিখা প্রেমপত্র। বিবাহের প্রেম-বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে উভয়ে চিরসুখী হও। আর হ্যা, বউ-পাগলা’ বা ‘আঁচল-ধরা’ স্ত্রৈণ হয়ে পড়ো না। নচেৎ বহু কল্যাণ থেকে তুমি চিরবঞ্চিত রয়ে যাবে।