কবির ভাষায় যুবকের যৌবন হল, বারিদের বারিধারা, মহাগিরির প্রস্রবণ। সুতরাং এই টলটলায়মান বারিধি এবং উপচীয়মান স্রোতস্বিনীকে সঠিক গতিপথে নিয়ন্ত্রিত ও প্রবাহিত করার জন্য দুই ধারে উঁচু ও মজবুত বাঁধ চাই। চাই সর্বনাশা বন্যার কবল থেকে রক্ষার জন্য উপযুক্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। যৌবনের প্রারম্ভে মনের আঁধার কোনে কত রকম কুচিন্তা আসে। আসে কত অশুভ পরিকল্পনা। আর তা দূর করার জন্য চাই এমন সুব্যবস্থা, যাতে যুবসমাজ বিভ্রান্তি ও ভ্রষ্টতার দিকে অগ্রসর ও ধাবিত না হয়। বলা বাহুল্য, উক্ত নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা। ও সুব্যবস্থা বলতে আমরা যা বুঝি তা-ই হল ইসলামের জীবন-ব্যবস্থা। যে সর্বাঙ্গ-সুন্দর ও শ্বাশত ব্যবস্থা মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রিত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ করে। রক্ষা করে উচ্ছলতা ও ভ্রষ্টতার কবল থেকে।
কিন্তু মানুষ তো আর সকলে সমান নয়। তাই কিছু সমাজসেবী বেছে নিয়েছেন খেলাধূলার পথ। কিন্তু লুফে নিয়েছেন তাদের পথ, যারা আসলে ভোগবাদী, পরকালে অবিশ্বাসী। যাদের । শ্লোগান হল, দুনিয়াটা মস্তবড়, খাও-দাও স্ফুর্তি কর। যাদের বিশ্বাসই হল ‘নো লাইফ আফটার দি ডেথ। যাদের পরম লক্ষ্য হল, মানুষকে ধর্মের নৈতিকতা থেকে বের করে এনে মুক্ত স্বেচ্ছাচারিতার জীবনে শুধু ভোগ-বিলাস ও চিত্তবিনোদনে ব্যাপৃত রাখা। আর তার জন্যই পৃথিবীর একটা বিরাট সংখ্যক মানুষ মাঠে-ময়দানে ও খেলাধূলার আনন্দ মেলায় নিজেদের অবসর-বিনোদন ছাড়াও নিজেদের অমূল্য সময় নষ্ট করেও চিত্তবিনোদন করে থাকে।
অবশ্য এতে কোন সন্দেহ নেই যে, কিছু খেলাধূলা আছে, যাতে সত্যই মানুষ উপকৃত হয়ে। থাকে। সুস্থ শরীর গঠনে ও মানসিকভাবে মনে হৃর্তি আনতে তথা পড়াশোনায় মনোযোগিতা বাড়াতে খেলাধূলার একটা বড় ভূমিকা আছে। কিন্তু মুসলিম যুব-সমাজের জন্য তা নিয়ম-ছাড়া, বাঁধন-হারা ও সীমাহীন নয়। জীবনের একটি মাত্র লক্ষ্য ঠিক রেখে (বৈধ) উপলক্ষ্য যদি যথানিয়মে ব্যবহার করা হয়, তবেই আমাদের মঙ্গল। নচেৎ উপলক্ষ্য যদি লক্ষ্যে পরিণত হয়, তাহলেই আমাদের সর্বনাশ। নিয়মতান্ত্রিকভাবে কিছু খেলার মধ্যে উপকার থাকলেও তার অপকারিতার দিকটা ভুলে গেলে চলে না। ভুললে হয়তো এমনও হতে পারে যে, জীবনের জমা-খরচের হিসাবে কেবল নাকের বদলে নরুন’ পেয়ে সন্তুষ্ট থেকে যাব।
সাধারণভাবে প্রায় সকল খেলাতে যেমন খেলোয়াড় ও তাদের সমর্থক ও দর্শকদের মাঝে সম্প্রীতি সৃষ্টি হয়, তেমনি সৃষ্টি হয় বিদ্বেষ ও শত্রুতা। কখনো কখনো হিংসা থেকে শুরু করে মারামারি ও দাঙ্গাতে গিয়ে পৌঁছে।
এই খেলার টানে মুসলিম যুবকের কত নামায নষ্ট হয়। নামাযের জামাআত চলে যায়। অনেকে সময় পার করে কাযা পড়ে নেয়। কিন্তু মহান আল্লাহ বলেন, “দুর্ভোগ (বা ওয়াইল দোযখ) সেই নামাযীদের জন্য, যারা তাদের নামায সম্বন্ধে উদাসীন।” (সূরা মাউন ৫-৬ আয়াত) তিনি আরো বলেন, “অতঃপর তাদের পর এল অপদার্থ পরবর্তীরা; যারা নামায নষ্ট করল এবং কুপ্রবৃত্তির অনুবর্তী হল। যার ফলে তারা অচিরেই গাই’ (নামক দোযখের এক উপত্যকা) প্রত্যক্ষ করবে।” (সূরা মারয়াম ৫৯ আয়াত)
এই খেলাধূলা ও বিভিন্ন শরীর-চর্চায় মুসলিম তার লজ্জাস্থানকে নির্লজ্জভাবে উন্মুক্ত করে মহানবীর প্রকাশ্য বিরোধিতা করে থাকে।
মহিলার সর্বশরীর হল লজ্জাস্থান। কেবল গুপ্তাঙ্গ ও বক্ষঃস্থলই নয়; বরং তার দেহের অন্যান্য অঙ্গও লজ্জাস্থান; যা স্বামী বা একান্ত এগানা পুরুষ ছাড়া অন্যের সামনে প্রকাশ করতে লজ্জা হওয়া উচিত। অনুরূপ পুরুষের কেবল প্রস্রাব ও পায়খানা-দ্বারই লজ্জাস্থান নয়; বরং তার পার্শ্ববর্তী উপর দিকে নাভি পর্যন্ত এবং নিচের দিকে হাঁটু পর্যন্ত দেহ লজ্জাস্থান, যা বের করতে পুরুষকে লজ্জা করা উচিত। কিন্তু খেলোয়াড় যুবক-যুবতীরা লজ্জার মাথা খেয়ে কেবল নাম কেনার উদ্দেশ্যে নিজেদের লজ্জাস্থান খুলে দেখাতে এতটুকু সংকোচও করে না। কারণ, তাদের গোড়ার শিক্ষাই হল, সংকোচেরি বিহ্বলতায় হয়ো না মীয়মানা। অথচ দ্বীনের নবী %ি বলেন, “লজ্জা হল ঈমানের অন্যতম শাখা।” (বুখারী ৯, মুসলিম ৩৫নং)
মহানবী (সা.) আরো বলেন, “নারী হল সবটাই লজ্জার জিনিস।” (তিরমিযী, সহীহুল জামে ৬৬৯০নং) “(পুরুষের) নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত স্থান হল লজ্জাস্থান।” (হ্যমে সহীহুল জামে’ ৫৫৮৩ নং) তিনি আরো বলেন, “তুমি তোমার উরু খুলে রেখো না এবং কোন জীবিত অথবা মৃতের উরুর দিকে তাকিয়ে দেখো না।” (আবু দাউদ, সহীহুল জামে” ৭৪৪০ নং)
অন্যত্র বলেন, “তুমি তোমার জাং ঢেকে নাও। কারণ, জাং হল লজ্জাস্থান।” (আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযী হাকেম, ইবনে হিব্বান, সহীহুল জামে ৭৯০৬ নং)
কয়েক প্রকার খেলার মাঝে রয়েছে যৌনচারিতা, চোখ ও হাতের ব্যভিচার। যে খেলায় সুপ্ত যৌন অনুভূতিকে সুড়সুড়ি দিয়ে জাগ্রত করা হয়। আর এটা তখন হয়, যখন প্রতিযোগিতায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে কোন কিশোরী বা যুবতী দল! যখন শুধুমাত্র নাম নেওয়ার উদ্দেশ্যে নারী প্রগতিবাদের দোহাই দিয়ে নারীবাদী স্বার্থপর পুরুষ উদ্যোক্তা ও দর্শকদের সামনে কতক যুবককে উষ্ণ ছোয়া দিয়ে থাকে এবং গরম পরশ খেয়ে থাকে।
যুবক বন্ধু! এ কথা বলো না যে, ঐ সময় খেলোয়াড়রা ঐ দিকে মন দেয় না। তুমি তোমার মনে ভালো করে চিন্তা করে দেখো। নচেৎ তার কোন এমন বন্ধুর মুখ হতে শুনো, যে হাডুডু খেলায় কোন মহিলা টিমের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। আর খেলা চলা কালে দর্শকদের টিপ্পনী ও শিস কাটার কথা তো অবশ্যই শুনে থাকবে।
বন্ধু আমার! যুবক হয়ে তুমি নিশ্চয় জান যে, ঘর্ষণ ছাড়া শুধুমাত্র দর্শনেই কত বড় আকর্ষণ আছে। বাধা সত্ত্বেও ঐ নারী-সৌন্দর্যের দর্শনই কেবল মিলন ঘটাতে বাধ্য করে। পূর্ণিমার চাদের ঝলমলে রূপ দেখে সমুদ্রে জোয়ার আসে। যুবতীর যৌবনভরা রূপ-লাবণ্য দেখেই যুবকের তরঙ্গায়িত যৌবনের জোয়ার উত্তাল হয়ে ছুটে আসে।
বন্ধু একটি অভিজ্ঞতার কথা শোন, এক ব্যক্তি নিজের উপরে স্ত্রী হারাম (যিহার) করেছিল। যিহার করলে কাফফারা লাগে। একে অপরকে স্পর্শ করার পূর্বে তাকে একটি দাস মুক্ত করতে হবে। ক্রীতদাস পাওয়া না গেলে বা তা ক্রয় করে স্বাধীন করার ক্ষমতা না থাকলে
স্পর্শ করার পূর্বে একটানা দুই মাস রোযা রাখতে হবে। এতেও অসমর্থ হলে ষাটজন মিসকীনকে আহার করাতে হবে। (সূরা মুজাদালাহ ৩-৪ আয়াত দ্রঃ) কিন্তু এ ব্যক্তি কাফফারা আদায়ের পূর্বেই স্ত্রী-মিলন করে ফেলে মহানবীর দরবারে উপস্থিত হয়ে নিজের অবস্থার কথা। খুলে বললে তিনি তাকে এ কাজের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। লোকটি বলল, 'জ্যোৎস্নার আলোতে আমি তার পায়ের মল বা নূপুর দেখে ধৈর্য রাখতে পারিনি!' (আবু দাউদ ২২২৩, সহীহ তিরমিযী ৯৫৮, নাসাঈ ৩৪৫৭, ইবনে মাজাহ ২০৬৫ নং)
হ্যাঁ বন্ধু! এটাই অক্লীব মানুষের প্রকৃতি। যুবকের যৌবনের উপচীয়মান জোয়ারের বেসামাল। আক্রমণ। অতএব এবার বল তো, পায়ের অলঙ্কার দেখে অথবা পায়ের রলার নিম্নাংশ চাদের আলোতে দেখে যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে পায়ের রলার উপরের অংশ, বরং তারও উপরের অংশ জাং সূর্যের আলোতে দেখলে যুবকের মনের অবস্থা কি হতে পারে? আবার দর্শনের সাথে সাথে যদি তা স্পর্শ করে, বরং শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে নিজের দিকে আকর্ষণ করে, তাহলে অবস্থা কোন পর্যায়ে পৌঁছতে পারে তার অনুমান অবশ্যই করতে পারবে।
পক্ষান্তরে প্রিয় নবী বলেন, “যে মহিলা স্পর্শ করা হালাল নয় তাকে স্পর্শ করার চেয়ে তোমাদের কারো মাথায় লোহার উঁচ গেঁথে যাওয়া অনেক ভালো!” (তাবরানী সহীহুল জামে' ৫০৪৫ নং)
আর মহান আল্লাহর মহাঘোষণা শোন, “যারা আল্লাহ ও তদীয় রসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা অপদস্থ হবে; যেমন অপদস্থ হয়েছে তাদের পূর্ববর্তীরা।” (সূরা মুজাদালাহ ৫ আয়াত)
এই খেলায় হয় অর্থের অপচয়। জুয়া ও জুয়া-জাতীয় খেলায় কারো পৌষমাস, কারো সর্বনাশ হয়। একটি টুর্নামেন্ট চালাতে, বাইরের টিম আনতে, খেলার বিভিন্ন সাজসরঞ্জাম। ও পুরস্কারাদি সহ আরো অন্যান্য খাতে অপব্যয় হয় লক্ষ-লক্ষ ডলারের। এক দিকে দেশের এক শ্রেণীর মানুষ দারিদ্রের কারণে না খেয়ে মরে, আর অন্য দিকে অন্য এক শ্রেণীর বিলাসী মানুষ ৫ টাকার টিকিট ৫০০ টাকায় কিনে খেলা দেখতে দূর-দূরান্তে সফর করে। একদিকে সরকারের বিশেষ খাতে ঘাটতি পূরণের জন্য জনগণের উপর ট্যাক্স ইত্যাদি বাড়ানো হয়, কোন কোন জিনিসের দামও বাড়িয়ে দেওয়া হয়। আর অপরদিকে খেলার পেছনে ব্যয় করা হয় তার চেয়ে আরো অনেকগুণ বেশী বেশী টাকা।
ভাবতে আরো অবাক লাগে যে, একটা কাঠের ব্যাট বিক্রয় হয় কয়েক লক্ষ টাকায়। আর তা এ জন্য যে, ঐ ব্যাট বিশ্বকাপ জিতে জাতির মান রক্ষা করেছে এবং এই ক্রয়ের ফলে ক্রেতার নাম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যাবে। খেলার পাগল বন্ধু আমার! মহান প্রতিপালক আল্লাহ বলেন, “আর তোমরা কিছুতেই অপব্যয় করো না। নিশ্চয় অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই এবং শয়তান তার প্রতিপালকের প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ।” (সূরা ইসরা ২৬-২৭ আয়াত) মহানবী (সা.) বলেন, “পাঁচটি বিষয়ে কৈফিয়ত না দেওয়ার পূর্বে কিয়ামতের দিন কোন মানুষের পা সরবে না--- (তন্মধ্যে একটি বিষয় হল এই যে,) সে তার ধন-সম্পদ কোন উপায়ে অর্জন করেছে এবং কোন্ পথে তা ব্যয় করেছে?” (তিরমিযী, সহীহ তারগীব ১২১ নং)
খেলা তার খেলোয়াড় ও দর্শকদেরকে মানসিক বিকারগ্রস্ত করে ছাড়ে। খেলার নেশা খেলাপ্রিয়দেরকে হার-জিতের সময় এক প্রকার মাতাল করে তোলে। জিতার খবর শোনা মাত্র কেউ কেউ খুশীতে কেঁদে ফেলে! বিজয়-উল্লাসে যুবক-যুবতীর দল কাপ মাথায় নাচতে শুরু করে। যেন মাথায় তাদের ব্রঞ্জ বা স্টেইনলেশ স্টিলের কাপ নয়, বরং ‘সাত রাজার ধন মানিক’ পেয়ে তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে ডিস্কো ড্যান্স প্রদর্শন করে। অনেকে অনেকের মুখ-মিষ্টিও করায়।
পক্ষান্তরে হারার খবর শোনা মাত্র কেউ কেউ মুছা যায়! কেউ বা ক্ষোভ ও দুঃখে ফেটে পড়ে নিজের রেডিও-টিভি ভেঙ্গে ফেলে। কেউ কেউ খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়। মনের বিষন্নতায় অনেকের ঘুম আসে না কয়েক রাত! কেউ বা আত্মহত্যা করে খেলার মস্তান’ বা খেলার শহীদ’ হয়ে খেলাধূলার ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নজীর সৃষ্টি করে!!
আর এইভাবে খেলা যেন আমাদের জীবনের একটি লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়ে পড়েছে। যার দরুন তার উন্নতি-অবনতিও আমাদের জীবনে বিরাট আন্দোলন ও পরিবর্তনের তুফান ডেকে আনে। অথচ দ্বীন বা ইসলাম মুসলিমের প্রাণ হওয়া সত্ত্বেও তার পরাজয়ে বিষন্ন হতে এবং বিজয়ে আনন্দিত হতে খুব কম সংখ্যক লোকই পরিদৃষ্ট হয়। সাহায্য-সহানুভূতিতে যে জাতির উপমা হল একটি দেহের মত; যার একটি অঙ্গ ব্যথিত হলে বাকী সকল অঙ্গ সমানভাবে ব্যথিত হয়। কিন্তু সেই জাতির দেহাঙ্গের বহু স্থান ব্যথিত হওয়া সত্ত্বেও সে ব্যাপারে বহু কম সংখ্যক মুসলিমেরই মাথা-ব্যথা দেখা যায়।
বহু খেলা এমন আছে, যাতে খেলোয়াড় বা দর্শকের প্রাণহানি বা অঙ্গহানি ঘটে। কেবলমাত্র নাম কেনার জন্য উচু উচু পর্বতমালায় চড়তে গিয়ে, দুরন্ত ষাড়ের সঙ্গে লড়তে গিয়ে, মোটর সাইকেল বা কার রেসে প্রথম স্থান অধিকার করতে অথবা বিশ্বরেকর্ড ভাঙ্গতে গিয়ে কত ‘বীর-বাহাদুর’দের জীবন ক্ষয় হয়ে যায়। কত দর্শক খেলা দেখতে গিয়ে ভিড়ের চাপেও জান কুরবানী দেয়!
খেলা এমন জিনিস, যা অনর্থক সময় নষ্ট করে। অথচ মুসলিম যুবকের উচিত, সময়ের যথােচিত কদর করা, সময়ের যথার্থ মূল্যায়ন করা। কারণ, সময়ই হল জীবন। অতএব যে ব্যক্তি নিজের জীবনকে ভালোবাসে, সে ব্যক্তির উচিত, সময়ের অপচয় না করা। হাসান বসরী (রঃ) বলেন, 'হে আদম সন্তান! তুমি আসলে কতকগুলি দিনের সমষ্টি।
সুতরাং যখনই তোমার একটি দিন চলে যায়, তখনই তোমার (জীবনের) একটা অংশ ধ্বংস হয়ে যায়।” সময়ের গুরুত্ব বর্ণনা করে মহানবী বলেন, “পাচটি জিনিসের পূর্বে পাঁচটি জিনিসের যথার্থ সদ্ব্যবহার করো; তোমার মরণের পুর্বে তোমার জীবনকে, তোমার অসুস্থতার পুর্বে তোমার সুস্থতাকে, ব্যস্ততার পুর্বে তোমার অবসর সময়কে, বার্ধক্যের পূর্বে তোমার যৌবনকালকে এবং দরিদ্রতার পূর্বে তোমার ধনবত্তাকে।” (হাকেম কইহাকী সহীহুল জামে' ১০৭৭৭ নং)
বহু মানুষ আছে, যারা সময়ের কদর বোঝে। আমরা ট্রেনে, বাসে, লঞ্চে, প্লেনে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে লম্বা সফর করলে সে সময়ে রাজনৈতিক ভুয়ো গল্প বা খেলাধূলা নিয়ে বিভিন্ন আস্ফালনমূলক কথাবার্তা আলোচনা করে থাকি। কেউ বা তাস ইত্যাদি খেলে সময় কাটিয়ে থাকে। কিন্তু ওরা সে সময় কিছু না কিছু পড়ে থাকে। এমন কি ২০/৩০ মিনিটের সফর হলেও সঙ্গে রাখা বই অথবা ম্যাগাজিন খুলে পড়তে শুরু করে। পৃথিবীতে এমন মানুষরাই হল উন্নত ও কাজের মানুষ। আর তারাই হল শিক্ষিত জাতির জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
মুসলিম যুবককেও অনুরূপ দৃষ্টান্ত হওয়া উচিত। জাতির হারিয়ে যাওয়া গৌরব ফিরিয়ে আনতে শিক্ষিত যুব-সমাজকেই আগুয়ান হতে হবে। জীবন্ত সময়কে হত্যা করে নয়, বরং সে সময়কে আরো তরোতাজারূপে প্রাণবন্ত রাখতে তার উচিত হল, তা যথা কাজে, কাজের মত কাজে, যথারীতি ব্যয় করা।
পরন্তু বাস্তব কথা হল এই যে, ইসলামী অভিধানে ‘অবসর’ বা ‘অবকাশ’ বলে কোন শব্দ নেই। কারণ, মুসলিমের জীবন হল কাজে-কাজে পরিপূর্ণ। দুনিয়ার কাজ না থাকলে দ্বীনের কাজে, সংসারের ব্যস্ততা না থাকলে পরকালের চিন্তায় সে সব সময় ব্যস্ত থাকে। মহান আল্লাহ বলেন, “অতএব যখন তুমি অবসর পাও তখন পরিশ্রম কর এবং তোমার প্রতিপালকের প্রতি মনোনিবেশ কর।” (সরা ইনশিরাহ ৭-৮) আর মহানবী (সা.) বলেন, “মানুষ মারা গেলে তার (সকল)। আমল বন্ধ হয়ে যায়।------।” (মুসলিম ১৬৩১ নং) অর্থাৎ, মরণের পূর্ব পর্যন্ত তার কর্ম বন্ধ হয় না। অতএব যে জাতির কোন অবসর নেই, তার আবার অবসর-বিনোদন’ কি? মুসলিমের জীবনের মূল্য আছে, লক্ষ্য আছে। যাদের জীবনের কোন লক্ষ্য নেই, কেবল তাদের কাছেই সময়ের কোন কদর নেই। সুতরাং মুসলিম খেল-তামাশায় তার জীবন ও সময় অপচয় করতে পারে না।
মুসলিম স্রষ্টায় বিশ্বাসী। অতএব তাকে এ কথা বিশ্বাস করতেই হবে যে, তাকে বেকার সৃষ্টি করা হয়নি। তাকে সৃষ্টি করার পশ্চাতে এক মহৎ উদ্দেশ্য ও গুরুত্বপূর্ণ রহস্য আছে।
সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ বলেন, “তোমরা কি মনে কর যে, আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি। এবং তোমরা আমার নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে না?” (সূরা মু'মিনুন ১১৫ আয়াত)
“আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী এবং ওদের মধ্যে যা কিছু আছে তার কোনটাই আমি ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করিনি; আমি এ দু’টিকে বৃথা সৃষ্টি করিনি। কিন্তু ওদের অধিকাংশই তা জানে না। সকলের জন্য নির্ধারিত আছে ওদের বিচার দিবস।” (সূরা দুখান ৩৮-৪০ আয়াত) “আসমান ও জমিন এবং এতদুভয়ের মাঝে যা কিছু আছে তা আমি ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করিনি। আমি যদি চিত্তবিনোদনের উপকরণ সৃষ্টি করতে চাইতাম, তবে আমি আমার নিকট যা আছে তা নিয়েই করতাম; যদি আমাকে করতেই হত তাহলে।” (সূরা আম্বিয়া ১৬-১৭ আয়াত)
তার অগণিত সৃষ্টির মাঝে রয়েছে হাজারো রহস্য। তাঁর তওহীদ ও একত্ববাদের নিদর্শন। পক্ষান্তরে সৃষ্টির পশ্চাতে তার উদ্দেশ্যের কথা ঘোষণা করে তিনি বলেন, “আমি জিন ও ইনসানকে কেবল আমার ইবাদত করার জন্যই সৃষ্টি করেছি।” (সূরা যারিয়াত ৫৬ আয়াত) সুতরাং যে জীবন ও সময় আল্লাহর ইবাদতের জন্য এবং তার ইবাদতের সহায়ক দুনিয়াদারী করার জন্য সৃষ্ট, তা মুসলিম খেলায় ও হেলায় নষ্ট করতে পারে না।
যে দেহ ও তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আল্লাহর সৃষ্টি এবং আমাদের নিকট যা আমানত, সে দেহ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কাজে কিরূপে ব্যয় করতে সাহস করতে পারি? তিনি আমাদেরকে, আমাদের হায়াত ও মওতকে খেলার জন্য নয়, বরং কাজের জন্য সৃষ্টি করেছেন। মহান আল্লাহর ঘোষণা হল, “যিনি তোমাদেরকে এই পরীক্ষা করার জন্য জীবন ও মৃত্যু সৃষ্টি করেছেন যে, কে তোমাদের মধ্যে কর্মে সবচেয়ে উত্তম।” (সূরা মুল্কঃ ২আয়াত)।
যুবক ভাই আমার! তোমার এ শক্তিমত্তার জীবন খেলার জন্য নয়। এ জীবন তোমাকে দেওয়া হয়েছে, যাতে তুমি পৃথিবীতে আল্লাহর দেওয়া খেলাফতের দায়িত্ব পালন করতে পার। যাতে তুমি জীবনদাতার জন্য জীবন ও সময় কুরবানী দিতে পার। আর মনে রেখো যে, তোমার জীবনের সাথে ওদের জীবনের কোন তুলনাই হয় না, যারা জানে না যে, তারা কেন সৃষ্ট হয়েছে। যাদের জীবনের লক্ষ্যবস্তু কোন কিছু নেই। যাদের জীবন হল, পার্থিব জীবন ও বা। অতএব তাদের খেলাধুলার বিরাট উন্নতি ও অগ্রগতি (?) দেখে তোমার ঈর্ষা হবে। কেন? জীবন সফরে তুমি আছ ঘোড়ার পিঠে। সুতরাং ওরা মরা গাধা নিয়ে বিশাল উন্নত বলে প্রচার-যন্ত্রে প্রচার চালালে তোমার তাতে ঈর্ষার কি আছে? ঘোড়া থাকতে মৃত গাধার জন্য হিংসা কিসের?
যে উন্নতির মাঝে আল্লাহর সম্মতি ও সন্তুষ্টি নেই, তা তো আসলে উন্নতি নয়; বরং সেটাই হল অবনতি। যে প্রগতির সম্মুখে উজ্জ্বল লক্ষ্যপথ নেই, তা আসলে অধোগতি। অতএব এমন দুর্গতিকে প্রগতি মনে করার কোন কারণ নেই বন্ধু। খেলাধুলায় কাপ’ জিতে জাতির নাম ও মান রক্ষা হয় না ভাই! জাতির নাম ও মান রক্ষা হয়, জাতির জন্য কাজ করলে। আর খেলা কোনদিন কাজ নয়। কাজ না করে খেলা করলে বকুনি বা মার খেতে হয়েছে শিশুবেলায় অভিভাবকদের কাছে। অতএব সে খেলায় নাম কেন হবে? জাতির হেদায়াত-উজ্জ্বল জীবন গড়তে, আদর্শ-ভিত্তিক পরিবেশ গড়তে, জাতির জন্য শান্তি ও নিরাপত্তা বিধান করতে যে সাধনার দরকার, সে সাধনার মাঝেই আছে জাতির নাম ও মান।
খেলোয়াড় বন্ধু আমার! সে শরীরের গঠন-আকৃতি সুঠাম ও মজবুত করে কি লাভ, যে শরীরের হৃদয় হল মৃত? সে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে লৌহসদৃশ কঠিন করে কি ফল, যে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কোন নৈতিকতা নেই, সত্য পথে জিহাদের কোন প্রস্তুতি নেই?
শরীরচর্চাকারী খেলোয়ার বন্ধু! তুমি হয়তো আয়নার সামনে দাড়িয়ে তোমার কাধে ওঠা শক্ত পেশী দেখেছ, বুক ও বাহুর মজবুত মাশুল দেখেছ, কিন্তু এ সুঠাম দেহ ও সুডৌল শরীরকে সেই দোযখের লেলিহান আগুন থেকে রক্ষা করার উপায় দেখেছ কি, যে দোযখের ইন্ধন হল মানুষ ও পাথর; যার নিয়ন্ত্রণভার অর্পিত আছে এমন কঠোর-হৃদয় ফিরিস্তাদের উপর, যারা আল্লাহর আদেশের অন্যথাচরণ করেন না এবং তাই করেন, যা করতে
তাদেরকে আদেশ দেওয়া হয়? আল্লাহর পানাহ, যাতে তোমার এ সৌষ্ঠবসম্পন্ন লোহার দেহ দোযখের ইন্ধন না হয়।
এক শ্রেণীর খেল-তামাশায় উন্মত্ত মানুষদের জন্য আল্লাহ বলেন, “(হে নবী!) তুমি তাদের সঙ্গ ত্যাগ কর, যারা তাদের দ্বীনকে ক্রীড়া-কৌতুকরূপে গ্রহণ করে এবং পার্থিব জীবন যাদেরকে প্রতারিত করে। আর এর দ্বারা তাদেরকে উপদেশ দাও, যাতে কেউ নিজ কৃতকার্যের জন্য ধংস না হয়। যখন আল্লাহ ব্যতীত তার কোন অভিভাবক ও সুপারিশকারী থাকবে না এবং বিনিময়ে সবকিছু দিলেও গৃহীত হবে না। এরাই স্বীয় কৃতকার্যের জন্য ধ্বংস হবে। তাদের অবিশ্বাস হেতু পানীয়ের জন্য উত্তপ্ত পানি ও যন্ত্রণাপ্রদ শাস্তি আছে।” (সূরা আনআম ৭০ আয়াত)। তিনি আরো বলেন, “জনপদসমুহের অধিবাসীরা কি ভয় করে না যে, আমার শাস্তি তাদের উপর আসবে চাশতের সময়, যখন তারা ক্রীড়ারত থাকবে?” (সূরা আরাফ ৯৮ আয়াত)
সমাজবিজ্ঞানী নবী (সা.) বলেন, “আমার উম্মতের মধ্যে কিছু সম্প্রদায় এমন হবে, যারা পান-ভোজন ও খেল-তামাশার মাধ্যমে রাত্রিযাপন করবে। অতঃপর সকাল হলে তারা বানর ও শুকরদলে রূপান্তরিত হয়ে যাবে।” (ত্বাবারানী, সহীহুল জামে’ ৫৩৫৪ নং)
যে সব খেলায় একতরফাভাবে আর্থিক ক্ষতি বিদ্যমান, ইসলামে সে সব খেলাকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। যেমন মদ ও মূর্তিপূজার পাশাপাশি জুয়া খেলাকে করা হয়েছে অবৈধ। মহান আল্লাহ বলেন, “হে ঈমানদারগণ! মদ, জুয়া, মুর্তিপূজার বেদী ও ভাগ্য-নিৰ্ণায়ক শর ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা থেকে দূরে থাক, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। শয়তান তো মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে চায় এবং তোমাদেরকে আল্লাহর সারন ও নামায থেকে বিরত রাখতে চায়। অতএব তোমরা কি নিবত্ত হবে না?” (সূরা মাইদাহ ৯০-৯১ আয়াত)
আর এই আইনের আওতায় পড়ে সেই সকল খেলা, যাতে আছে অনুরূপ একতরফা আর্থিক ক্ষতি এবং একপক্ষের বিনা মেহনতে অসঙ্গতভাবে অর্থলাভ। যেমন লটারী, ডাইস, বিমা, বাজি রেখে তাস খেলা ইত্যাদি।
যে সব খেলায় আছে বৈষয়িক, সাংসারিক, ও দৈহিক ক্ষতি এবং যা অনর্থক সময় নষ্ট করে, সে সব খেলাও ইসলামে বৈধ নয়। যেমন দাবা ও পাশা জাতীয় সকল খেলা মুসলিমের জন্য হারাম। আল্লাহর নবী (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি পাশা-জাতীয় খেলা খেলল, সে যেন নিজ হাতকে শুয়োরের রক্তে রঞ্জিত করল।” (আহমাদ, মুসলিম ২২৬০, আবু দাউদ ৪৯৩৯ ইবনে মাজাহ ৩৭৬৩ নং)
তিনি আরো বলেন, “যে ব্যক্তি পাশা-জাতীয় খেলা খেলল, সে আল্লাহ ও তার রসুলের নাফরমানী করল।” (মালেক, আবু দাউদ ৪৯৩৮, ইবনে মাজাহ ৩৭৭৬২, হাকেম ১/৫০, সহীহুল জামে’ ৬৫২৯ নং)
আর এ পর্যায়ের খেলা হল, তাস, লুডু কেরামবোর্ড ও গুটি খেলা, পায়রা উড়িয়ে খেলা। ইত্যাদি। এ সব খেলায় অযথা সময় নষ্ট হয় এবং তাতে শারীরিক কোন উপকার লাভ তো হয়ই না, বরং অপকার হয়ে থাকে। এ সবে মানুষকে কুঁড়ে, অলস ও অকর্মণ্য করে তোলে। পক্ষান্তরে এ সবে কিছু বাজি থাকলে জুয়াতে পরিণত হয়ে থাকে। পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগবে যে, তাহলে ইসলামে কি খেলার নাম-গন্ধই নেই? জবাবে বলা যায় যে, হ্যাঁ, ইসলামে কোন খেলার গন্ধই নেই। কারণ মুসলিমদের খেলা খেলার কোন সময়ই নেই। খেলা হল প্রত্যেক লক্ষ্যহীন কাজের নাম; যে কাজের পিছনে শুদ্ধ বা অশুদ্ধ। কোন লক্ষ্যই থাকে না, নিছক সময় কাটানোর উদ্দেশ্যে করা হয়। আর মুমিনের প্রত্যেক কাজের পিছনে লক্ষ্য আছে। তার এমন কোন সময় নেই, যা কাটাতে হয়। তার প্রতিটি মুহূর্ত হয় ইবাদতে কাটে, নচেৎ ইবাদতে সহায়ক কোন পার্থিব কাজে।
অতএব তার সময় কাটে না। নয়, বরং সে সময়ই পায় না। সুতরাং মুসলিম যদি কোন নির্দিষ্ট কাজ থেকে কিছু ফুরসৎ পায় এবং তাকে সে অবকাশ বলে। মনে করে, তবে সেই অবকাশকেও কাজে লাগিয়ে ‘অবসর-বিনোদন’-এর কাজ নিতে পারে। এতে কাজের একঘেয়েমি কেটে যাবে এবং নতুনভাবে ঐ কাজে মনের উদ্যম ফিরে পাবে। এর জন্য ঐ অবসর সময়ে গঠনমূলক সবান্ধব বৈঠক করে এবং যুবশিবির স্থাপন করে দ্বীনী ও সাধারণ জ্ঞানভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করে তার মাধ্যমে সময় কাটাতে পারে।
পক্ষান্তরে যে খেলায় মুসলিমের উপকার আছে, যা উদ্দেশ্যপ্রণােদিত, যাতে আছে দ্বীন, প্রাণ ও স্বাস্থ্য রক্ষার অনুশীলন, সংসার ও স্বামী-স্ত্রীর প্রেম-বন্ধন দৃঢ় করার উপায়, যে খেলায় অর্থের অপচয় নেই, সময়ের অপব্যয় নেই, যাতে কোন প্রকার শরীয়ত-বিরোধী কর্ম করতে হয় না, এমন খেলা মুসলিমের জন্য অবশ্যই বৈধ। শরীয়তে এ বিষয়ে সংকীর্ণতা নেই। (সিলসিলাহ সহীহাহ ১৮২৯ নং দ্রঃ)।
যেমন দৌড়-প্রতিযোগিতা, বিশেষ করে নিরালায় স্ত্রীর সাথে দৌড়-প্রতিযোগিতা করা ইসলামের এক সাংসারিক আদব। মহানবী (সা.) স্বয়ং নিজ স্ত্রী আয়েশা (রাঃ) এর সহিত এমন। প্রতিযোগিতা করে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে প্রেম ও আনন্দ প্রকাশের এক সুন্দর নজীর রেখে গেছেন। (আবু দাউদ, নাসাঈ, ত্বাবারানী, ইবনে মাজাহ, ইরওয়াউল গালীল ১৪৯৭ নং দ্রঃ)।
স্বামী-স্ত্রীর উভয়ের প্রেমকেলি করা, মিলনের পূর্বে ভূমিকা স্বরূপ বিভিন্ন আচার ও শৃঙ্গার ইসলামে বৈধ। এতে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক মধুর থেকে মধুরতম হয় এবং উভয়ে ব্যভিচার থেকে বাচতে পারে। ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা বৈধ। যেমন বৈধ তীরন্দাজি খেলা। কারণ, এতে মুসলিমের ঈমান, জান, ধন ও মান রক্ষার উদ্দেশ্যে জিহাদী অনুশীলন হয়। আর জান রক্ষার তাকীদেই সঁতার খেলাও ইসলামে বৈধ। (নাসাঈ, ত্বাবারানী, সিলসিলাহ সহীহাহ ৩১৫নং দ্রঃ)
আধুনিক বিশ্বের ফুটবল, হাডুডু ইত্যাদি স্বাস্থ্যরক্ষামূলক খেলাধূলাও কিছু শর্তের সাথে বৈধ। যেমন এই খেলা খেলতে গিয়ে যেন জাং বের না হয়। কারণ, জাং হল লজ্জাস্থানের অংশ। এ খেলা যেন যথাসময়ে জামাআতে নামায বা অন্যান্য ইবাদত থেকে উদাসীন ও গাফেল করে না রাখে এবং এতে যেন শরীয়ত-বিরোধী কোন বিষয় বা বস্তু শামিল না থাকে। বলা বাহুল্য, ইসলাম যে খুশী ও আনন্দ প্রকাশকে হারাম করেছে তা নয়। তবে ইসলামের প্রত্যেক কাজ হল সীমাবদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত। লাগামছাড়া ও বাঁধনহারা নয়। যে খুশীতে আল্লাহ খুশী, সে খুশী ইসলামের কাম্য। যে আনন্দে আল্লাহ সন্তুষ্ট, সে আনন্দ মুসলিমের কর্ম ও ধর্ম। শুধু নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধি ও প্রবৃত্তিপুজার জন্য নয়, বরং যে আনন্দে সৃষ্টির মনে আনন্দের ঢেউ আনা যায়, সেই আনন্দই মুসলিমের পরম আনন্দ। তাই তো সে পোলাও নিজে খেয়ে যে আনন্দ পায়, তার চেয়ে বেশী আনন্দ পায় তা অপরকে খাইয়ে। নিজে ভালো পরে যে খুশী। অনুভব করে, অপরকে তা পরিয়ে অনুভব করে তার চাইতে বেশী খুশী। যে আনন্দের মাঝে। বেদনা লুকিয়ে থাকে, তা মুসলিমের কাম্য নয়।
কাম্য হল নির্মল আনন্দ। বরং যে বেদনার মাঝে আনন্দ লুকিয়ে আছে, তাও তার কাম্য। সুতরাং যুবক বন্ধু! খেল, খুশী কর। কিন্তু তাতে তোমার মহান প্রভুকে নাখোশ করো না। এতো গেল খেলোয়াড়দের কথা। এবার দর্শকদের কথায় আসা যাক। যে খেলার পাগলরা খেলা দর্শন করে, তারাও আসলে তাদের মনের মাঠে হাত-পা নেড়ে খেলে থাকে। মনেমগজে খেলার বিভিন্ন দিক বিচার করে, ভুল ধরে, কখনো খেলোয়াড়কে আবার কখনো বা রেফারীকে ভৎসনা ও গালিমন্দ করে থাকে। অথচ তারা জানে যে, কল্পনা করা ও মুখে বলা যত সহজ, কাজে পরিণত করা তত সহজ নয়।
কিন্তু এতে লাভ কি হয়? মনে মনে এক প্রকার তৃপ্তিকর আনন্দ অনুভব ও সময় কাটানো ছাড়া আর কিছু হয় কি? এতে শারীরিক কোন উপকার হয় কি? বিধায় তা বৈধ কি?
বৈধ কি দূর-দূরান্তে সফর করে টিকিট কিনে, কখনো ৫ টাকার টিকিট ৫০০ টাকায় কিনে ঘন্টার পর ঘন্টা রৌদ্রতাপে অথবা বৃষ্টির নিচে অথবা কনে শীতে বসে থেকে হাততালি দেওয়া অথবা দাঁড়িয়ে ড্যান্স করতে করতে মুখে নানা মন্তব্য করা?
অনুরূপ বৈধ কি ঐ খেলা টিভির পর্দায় ঘন্টার পর ঘন্টা দেখে যাওয়া? তদ্রুপ কানের গোড়ায় রেডিও লাগিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে কেবল খেলার হৈচৈ ও ফলাফল শুনে যাওয়া?! সংসারের কাজ, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা ইত্যাদি কর্তব্য ছেড়ে সময় নষ্ট করে চিত্তবিনোদনে কি ইসলাম অনুমতি দেয়?
যদি কেউ বলেন, বৈধ খেলা দেখা বৈধ। কারণ স্বয়ং আল্লাহর নবী , এবং তার অল্প বয়স্কা পত্নী হযরত আয়েশা (রাঃ) তার পশ্চাতে পর্দায় থেকে মসজিদে হাবশীদের যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে খেলা দেখেছেন। তাহলেও এ শর্ত স্বীকার করতেই হবে যে, তা যেন অধিক সময় নষ্ট
করে, নামায ও তার জামাআত নষ্ট না করে। কারো উরর দিকে যেন তাকানো না হয়। (পুরুষ দেখলে) সে খেলা যেন কোন মহিলার না হয়। তাতে যেন কোন প্রকার অর্থের অপচয় ঘটে। ইত্যাদি। আমাদের দেশে মেলা হল নানা খেলার আখড়া। কোন কোন মেলা আবার শির্কের (মুর্তি বা কবরপূজা ও উরসের) উৎসব-কেন্দ্র। এ সব উৎসবে কোন মুসলিমের অংশগ্রহণ করা নিশ্চয়ই বৈধ নয়। তাছাড়া মেলা হল প্রেমিক-প্রেমিকার মিলন-ক্ষেত্র, 'চুম্মা কা ওয়াদা পূরণের স্থান। রঙ-তামাশার রঙ্গমঞ্চ। সাধারণতঃ জুয়ারী, শারাবী, লম্পট ও অসদাচারীদের সমাবেশস্থল। এখানে কোন চরিত্রবান যুবক-যুবতীর যাওয়ার অর্থই হল অসৎচরিত্রতাকে পছন্দ করা এবং নিজের সচ্চরিত্রতাকে বিনষ্ট করা।
খেলার নেশায় অনেকে আবার খেলার খবর রাখতেও এত অতিরঞ্জন করে যে, শুধু খেলার খবর নেওয়ার জন্যই রেডিও-টিভি বা পত্রিকা ক্রয় করে। যেমন এই শ্রেণীর যুবকদের মন যোগাতে ঐ সব প্রচারমাধ্যমে খবরের একটা বড় অংশ খেলার জন্য নির্ধারিত করা হয়; বরং শুধু খেলাধুলা নিয়েই বিশেষ পত্রিকা বাজারে প্রকাশিত হয়ে থাকে। আর খেলার পাগল যুবকরা কেবল মাত্র খেলার খবরটি শোনার জন্য উদ্বিগ্ন থাকে এবং পত্র-পত্রিকার পাতা উল্টে খেলার খবরই আগে পড়ে থাকে! কত যুবক-যুবতী তো তার দেশে বিশ্বকাপ হবে অথবা তার দেশ তাতে খেলতে সুযোগ পাবে শুনে আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে কয়েক দিন ধরে এ নিয়ে খুশী ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রোড জাম করে, সাধারণ মানুষকে কষ্ট দিয়ে নেচে-গেয়ে বেড়ায়!!
কি জানি এতে তারা কি লাভ বা তৃপ্তি পায়? শুধু যুব-সমাজই নয় বরং দেশের বৃদ্ধ নেতা-নেত্রীরাও তাতে গর্ববোধ করে থাকে। কারণ, খেলাধুলার উন্নয়নে নাকি জাতির মর্যাদা ও অম্লন গৌরব আছে!!! একদা আমার এক বন্ধু এক মজলিসে খেলার কথা চলতে চলতে বিশ্বকাপের সেমিফাইন্যালে কোন্ কোন্ দেশ উঠল তা বলতে না পারলে আমাকে বলে ফেলল, তুমি দেখছি কিছুরই খবর রাখ না! আমি অন্য কিছু না বলে তাকে শুধু বললাম যে, আল্লাহুম্মা ইন্নী আউযু বিকা মিন ইলমিল লায়্যানফা।' (অর্থাৎ, হে আল্লাহ! আমি সেই জ্ঞান থেকে তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যা কোন উপকার সাধন করে না।)
পরিশেষে যুবক বন্ধুদেরকে এই অনুরোধ করি যে, ক্লাবগুলোকে শুধুমাত্র হৈচৈ ও খেলার জন্য ‘কিলাব’-ঘর করে রেখো না। বরং ঐ ক্লাবকে জাতির কূলব’ ও প্রাণকেন্দ্র করে গড়ে তোল। যুবশক্তি ‘মেন-পাওয়ার’-এ পরিণত হোক ইসলামের স্বার্থে, মুসলিম জাতির স্বার্থে।
উপসংহারে যুবক বন্ধুর জন্য এক আধ্যাত্মিক ব্যায়ামের কথা বলি, যাতে তার ঈমান ও দ্বীন মজবুত হতে পারে। পূর্ণ মু'মিন যুবকের নিজ মন ও প্রবৃত্তির সহিত সাত পর্যায়ের নিয়মিত ব্যায়াম ও অনুশীলন হওয়া উচিতঃ
প্রথমতঃ নিজের আত্মার সহিত এই পরামর্শ হওয়া উচিত যে, সে আগামীতে কোন্ ধরনের নেক কাজ করবে? যে কাজ তার ভবিষ্যতে কাজে দেবে সে কাজের পরিকল্পনা করবে, ক্ষয়শীল আয়ু ও লয়শীল জীবনের কয়টা দিনে আল্লাহর কোন অবাধ্যতা করবে না। হেলায় সুযোগ না হারিয়ে পরবর্তীতে লাঞ্ছিত হওয়ার কাজ কখনই করবে না।
দ্বিতীয়তঃ খুব সতর্কতার সহিত লক্ষ্য ও খেয়াল রাখবে, যাতে কোন প্রকার পাপ ও ত্রুটি ঘটে বসে। প্রবৃত্তি যেন কোন প্রকার কু’-এর দিকে ঝুঁকে না বসে। সর্বদা মনের মাঝে এই অনুভুতি রাখবে যে, আল্লাহ তাআলা সুক্ষদর্শী, সর্বদ্রষ্টা। তিনি তার সকল কাজ সুক্ষভাবে দর্শন করছেন। তাঁর ফিরিস্তা সকল ভালোমন্দ নোট করে রাখছেন। যার আলোকে তার সামনে একদিন জবাবদিহি করতে হবে।
তৃতীয়তঃ আত্মার কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করবে। মানুষের মন অধিকাংশ মন্দপ্রবণ, মনের প্রকৃতি হল দেহের আরাম-প্রিয়তা, আলস্য ও স্বেচ্ছাচারিতা। কারো বাধ্য হয়ে থাকা মনের প্রকৃতি নয়, কোন শক্ত কাজ করা মনের স্বভাব নয়। অতএব মনের এই স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে লড়তে হবে। কারণ, এমনও হতে পারে যে, প্রবৃত্তিবশে “তোমরা যা পছন্দ কর না, তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর এবং তোমরা যা পছন্দ কর, তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আর (কোটা তোমাদের জন্য কল্যাণকর তা) আল্লাহই জানেন, তোমরা জান না।” (সূরা বাক্বারাহ ২১৬ আয়াত)
এ জিহাদে বিজয় লাভ করলে মানুষ প্রকৃত মানুষ’ ও ‘মানব’ হতে পারে। নচেৎ মনের কাছে পরাজিত হলে সে পশুত্বে অবতরণ করে। আল্লাহর ওয়াদা হল, “যারা আমার উদ্দেশ্যে সংগ্রাম করে তাদেরকে আমি আমার পথে পরিচালিত করে থাকি। আর নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের সাথে থাকেন।” (সূরা আনকাবুত ৬৯ আয়াত)
চতুর্থতঃ আত্মসমালোচনা করবে। সারা দিনের কৃত আমলের উপর নিজ আত্মার হিসাব নেবে। ভালো কাজ করে থাকলে আল্লাহর শুকর করবে এবং মন্দ কাজ করে থাকলে লজ্জিত হয়ে অনুতাপের সাথে তার নিকট তওবা করবে। আর আগামীতে যেন সে ত্রুটি না হয় তার জন্য যথার্থ খেয়াল রাখবে।
পঞ্চমতঃ ত্রুটি হলে নিজের মন ও আত্মাকে ভৎসনা ও তিরস্কার করবে। ঔদাস্য ও অবজ্ঞার জন্য নিজেকে ধিক্কার জানাবে। কৃত ভুলের জন্য মনকে আক্ষেপ-জ্বালায় দগ্ধীভূত করবে।
ষষ্ঠতঃ কৃত পাপের জন্য নিজের মনকে শাস্তি প্রদান করবে। মনের পছন্দনীয় কিছু জিনিস ত্যাগ করে শাস্তির কথা নিজের মনের মণিকোঠায় আন্দোলিত করে রাখবে।
আর সপ্তমতঃ ভালো কাজ করে থাকলে তার জন্য মনকে উত্তম প্রতিদান প্রদান করবে। ভালো কাজ করলে এমনিতেই মুমিনের হৃদয় হর্ষোৎফুল্ল হয়ে ওঠে। তা সত্ত্বেও বৈধ কোন উপায়ে মনকে আরো চাঙ্গা করা, মনের মাঝে একঘেয়েমি দূরীভূত করা এবং পুনঃপুনঃ মনের উদ্যম ফিরিয়ে আনা কর্তব্য। যাতে ইহকালের বৈধ খুশী ব্যবহার করে পরকালের পরম খুশী লাভের অধিক সুযোগ লাভ হয়। আল্লাহর আনুগত্য ও ছাত্র-জীবনে এমন আত্মসমীক্ষা বড় ফলপ্রসূ।