যে জাতি শিক্ষা দিতে এসেছিল পৃথিবীর সকল জাতিকে, যে জাতি ছিল পূর্ণ মানবতার মুর্ত-প্রতীক, যে জাতি ছিল বিশ্ব-জনমন্ডলীর জন্য একক আদর্শ, সে জাতির অবস্থা এই যে, নিজের স্বাতন্ত্র্য, স্বকীয়তা ও বৈশিষ্ট্য হারিয়ে অপর জাতির মাঝে একাকার হয়ে বিলীন হয়ে পড়েছে। অন্য জাতির পার্থিব সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তার ভালো-মন্দ সকল বিষয়ে চক্ষু বন্ধ করে অনুকরণ করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। নিজের আচার-আচরণ, নৈতিকতা ও চরিত্র তথা লেবাস-পোশাকও নিজের কাছে অপছন্দনীয় হয়ে দেখা দিয়েছে। নিজের চোখে নিজেকে দেখেছে দীন-হীন-ক্ষীণরূপে। তাই তো এ জাতির এমন অবস্থা।
এ জাতির কাছে দুনিয়া না থাকলেও দ্বীন আছে আসল রূপে। অর্থ না থাকলেও আছে। নৈতিকতা, যা মুসলিমের অমূল্য ধন এবং মানবের আসল মানবতা। যাদের দ্বীন নেই, নৈতিকতা নেই তাদের পার্থিব সৌন্দর্য দেখে চমৎকৃত হয়ে, তাদের প্রতি মুগ্ধ হয়ে ঝুঁকে পড়া। অবশ্যই উচিত নয় কোন মুসলিমের। মহান আল্লাহ বলেন, “তোমরা সীমা লংঘনকারীদের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ো না, অন্যথায় অগ্নি তোমাদেরকে স্পর্শ করবে। আর এই অবস্থায় আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের কোন বন্ধু থাকবে না এবং তোমরা সাহায্যও পাবে না।” (সূরা হুদ ১ ১৩)
সুতরাং বিজাতীয় চাল-চলন, আচার-আচরণ ও বেশভূষায় আকৃষ্ট হয়ে বিজাতির সভ্যতার প্রতি ঝুঁকে পড়ার মানেই হল নিজের স্বরূপতা ও স্বকীয়তা বিকিয়ে সত্যকে না চিনে অথবা অপছন্দ করে অসত্যকে লুফে নেওয়া, আর তা হল দোযখবাসীদের কাজ। তাছাড়া সমাজ-বিজ্ঞানী প্রিয় নবী মুক্তি বলেন, “যে ব্যক্তি যে জাতির আনুরূপ্য অবলম্বন করে, সে ব্যক্তি সেই জাতিরই দলভুক্ত।” (আহমাদ ২/৫০, আবু দাউদ ৪০৩১, সহীহুল জামে’ ৬০২৫ নং)
ভালো-মন্দ বাচ-বিচার না করে অন্ধভাবে অপরের ভঙ্গিমা নকল করে চলা, কোন কোন অথবা সকল কাজে অপরের হুবহু অনুকরণ করা মানুষের জন্য নিন্দনীয়। কারণ, এমন স্বভাব হল বানরের। এই জাতিই কোন প্রকার বিচার না করেই চোখ বুজে অপরের অনুকরণ করে তৃপ্তি পেয়ে থাকে। কিন্তু মানুষ, বিশেষ করে কোন মুসলিম পারে না বিজাতির কোন অসভ্য ভঙ্গিমা নকল করে চলতে। কারণ, মুসলিমের আছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। আর তা বিনাশ করে অপরের বৈশিষ্ট্য গ্রহণ করার মানেই হল, নিজেকে ধ্বংস ও বিলীন করা। কবি বলেন,
‘পরের মুখে শেখা বুলি পাখীর মত কেন বলিস,
পরের ভঙ্গি নকল করে নটের মত কেন চলিস?
আপনারে যে ভেঙ্গে-চুরে গড়তে চাহে পরের ছাঁচে,
অলীক, ফাঁকি, মেকী সেজন, নামটা তার ক’দিন বাঁচে?
তবে কাফেরদের সর্ববিষয়ে সব রকম কাজেই যে অনুকরণ নিন্দনীয়, তা নয়। নিন্দনীয় হল সেই সব কাজের অনুকরণ করা, যা তাদের কল্পনা-প্রসূত, অমূলক ধারণা বা বিশ্বাসজনিত। যা তাদের অশ্লীলতাময় আচরণ ও অভ্যাস এবং যা নৈতিকতা-বর্জিত। যা তাদের মনগড়া উপাসনামূলক ধর্মীয় আচার। যা তাদের ধর্মীয় বা জাতীয় প্রতীক এবং অন্য জাতি থেকে পার্থক্য নির্বাচনকারী পৃথক বৈশিষ্ট্য। আর যে বিষয়ে আমাদের শরীয়তে রয়েছে কঠোর নিষেধাজ্ঞা। কারণ, তা করলে অসত্যকে সমর্থন করা হয়, যাতে হয় সত্যের অপলাপ।
এ ছাড়া নিছক পার্থিব জ্ঞান-বিজ্ঞান; যার সম্পর্ক মুসলিমের আকীদা, দ্বীন ও নৈতিকতার সাথে নেই, বরং পার্থিব উপকার আছে, তাতে যে কোন ব্যক্তির অনুকরণ অবৈধ নয়। কারণ, এ বৈশিষ্ট্য কোন জাতীয় বা ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য নয়। বরং মুসলিমই তার অধিক হকদার। অতএব মুসলিমকেই এ বিষয়ে অগ্রণী হওয়া উচিত। তবে তা তার প্রধান লক্ষ্য নয়, যেমন আমরা পুর্বেই জেনেছি। বিজাতির অনুকরণ নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ বিশ্লেষণ করলে আমরা জানতে পারি যে, যেহেতু তাদের প্রায় সকল কর্ম হল ভিত্তিহীন, ভ্রষ্টতাপূর্ণ ও পন্ড, সেহেতু অনুকরণে ভ্রষ্টতায় পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
দ্বিতীয়তঃ বিজাতির অনুকরণ মানেই হল, স্বজাতির আচরণকে অপছন্দ বা ঘৃণা করা অথবা মন্দ জানা। যাতে রয়েছে পথের দিশারী মহানবী , এর বিরুদ্ধাচরণ। আর মহান। আল্লাহ বলেন, “সুপথ প্রকাশিত হওয়ার পর কেউ যদি রসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মুমিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথ অনুসরণ করে, তবে যেদিকে সে ফিরে যায়, আমি সেই দিকেই তাকে ফিরিয়ে দেব এবং দোযখে তাকে নিক্ষেপ করব, আর তা কতই নিকৃষ্ট আবাস!” (সূরা নিসা ১১৫ আয়াত)
তৃতীয়তঃ অনুকরণে রয়েছে অনুকৃত জাতির প্রতি আন্তরিক আকর্ষণ ও ভালোবাসা; যা ঈমানের পরিপন্থী। চতুর্থতঃ অনুকরণ হল এক ধরনের মানসিক পরাজয় স্বীকারের নামান্তর। কারণ, অনুকরণকারী তখনই অপরের অনুকরণ করে, যখন সে অপরকে বড় ও সবল এবং নিজেকে ছোট ও দুর্বল মনে করে। আর এতে রয়েছে মুমিনের জন্য লাঞ্ছনা ও অপমান।
মুসলিম জাতি হল পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি; যে জাতির অনুকরণ করে মানুষ ধন্য হয়ে থাকে। অতএব মুসলিম কেন বিজাতির অনুকরণ করবে? যে জাতির আদর্শ হলেন নবীকুলশিরোমণি সৃষ্টির সেরা মানুষ মুহাম্মাদ (সা.) সে জাতির অনুসরণীয় আদর্শ পৃথিবীতে আর কে আছে? কিন্তু তবুও সে জাতি বিজাতির গুণে মুগ্ধ, বিজাতীয় সভ্যতা নিয়ে গর্বিত, বিজাতীয় আচরণে অভ্যস্ত, এর কারণ কি?
এর কারণ প্রথমতঃ এই যে, এ জাতি নিজের সভ্যতা বিষয়ে অজ্ঞ, নিজের কৃষ্টি ও কালচার বিষয়ে উদাসীন, দ্বীন ও তার শিক্ষা থেকে বহু দূরে। তাই তো অপরের সৌন্দর্য তার চোখে ধরেছে। দ্বিতীয়তঃ জাতির দিকে তাকালে যেন গোটা জাতিকে কাঠের গড়া একটা পুতুল মনে হয়। এ জাতি অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অন্যান্য জাতির তুলনায় বহু দুর্বল, মানসিক দিক দিয়ে আগ্রাসন ও পরাজয়ের শিকার, আর অস্ত্র-শস্ত্র ও যুদ্ধ-সামগ্রীর ব্যাপারেও বড় কমজোর। তাই বিজাতির প্রভুত্ব তার মনে-প্রাণে অনায়াসে বিস্তার লাভ করেছে এবং বিজাতীয় আচরণ প্রাধান্য পেয়েছে তার জীবনের পদে পদে।
পাশ্চাত্য-সভ্যতার ছোয়া লাগা মানুষ হীনম্মন্যতার শিকার হয়ে পশ্চিমা-বিশ্বের অনুকরণ করে। কাফেরদের বিভিন্নমুখী বিভব ও প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং পার্থিব উন্নয়ন দেখে মুসলিম। নিজেদেরকে হেয় ও তুচ্ছজ্ঞান করে বসেছে। ভেবেছে, দুনিয়ায় ওরা যখন এত উন্নত, তখন ওদের সভ্যতাই হল প্রকৃত সভ্যতা। সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণে এটাই ধরে নিয়েছে যে, ওরা যেটা করে, সেটাই উত্তম ও অনুসরণীয়। ওদের মত করতে পারলে তারাও ঐরূপ উন্নতির পরশমণি হাতে পেয়ে যাবে। মনে করেছে যে, ওদের ঐ ছন্নছাড়া, লাগামছাড়া, বাধনহারা যৌন-স্বাধীনতাপূর্ণ জীবনই হল ওদের উন্নতির মূল কারণ এবং প্রগতির মূল রহস্য।
তৃতীয়তঃ ইসলামকে দুনিয়ার বুক থেকে মুছে দেওয়ার জন্য বিশ্বজুড়ে পরিকল্পিত প্রচেষ্টার যে কুফল, তা বহু সংখ্যক মুসলিমদের মাঝে প্রকাশ পেয়েছে। অর্থ ও নারী পেয়ে মানুষ মনুষ্যত্ব ভুলে যায় এবং পশুত্ব বরণ করে পশুবৃত্তি চালিয়ে যেতে এতটুকুও দ্বিধা করে। মুর্তাদ্দ, মুনাফিক, ও ফাসিক মুসলিমদল সে জালে ফেঁসে কাফেরদেরকে সর্বতোভাবে সহায়তা করছে। অর্থ ও নারী তথা যৌন-স্বাধীনতার স্বর্গে বসে অপরকেও ঐ স্বর্গগামী রথে চড়ে বসতে আহ্বান জানাচ্ছে। মানবতার নামে পশুত্বের পূজারীরা পশুবৃত্তিকে সুশোভিত করে সমাজে উচ্ছলতার বন্যা আনয়ন করছে। আর তৃপ্তি সহকারে ধৃষ্টতা ও গর্বের সাথে ঐ অধোগতিকে প্রগতি’ বলে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। কাফেররা এ কথা খুব ভালোভাবে জানে যে, ইসলাম তাদের তথাকথিত ঐ প্রগতির পথে বাধ সাধবে।
তাই মুসলিমের জীবন থেকে ইসলামের আদর্শকে অথবা ইসলামের পরশ থেকে মুসলিম ও সারা বিশ্বকে পাকেপ্রকারে দুরে সরাতে না পারলে কোন শান্তি নেই, স্বস্তি নেই। তাই তো ঐ প্রচেষ্টায় ওদের এক দক্ষ নেতার দুরভিসন্ধিমূলক বক্তব্য হল, শারাবের পেয়ালা ও নারী মহামেডানদের মাঝে সেই কাজ করবে যা এক হাজার তোপেও করতে পারে না। অতএব ওদেরকে অর্থলোলুপতা ও যৌনচারিতার সাগরে ডুবিয়ে দাও। চরিত্রবিনাশী ইয়াহুদী প্রটোকল সংকল্পবদ্ধ যে, আমরা ওদেরকে নানা প্রকার মনমাতানো বিষয়-বস্তু ও খেলাধুলা দ্বারা বিভোর করে রাখব। ----আমাদের সবচেয়ে বড় কর্তব্য হল, নৈতিকতা ধ্বংস করা। যৌন-সম্পর্ক সূর্যের আলোতে প্রকাশ পাবে।
যাতে যুবকের মনে পবিত্রতা ও সচ্চরিত্রতা বলে কিছু অবশিষ্ট না থাকে এবং তার যেন প্রধান চিন্তা ও লক্ষ্য হয়, কেবল যৌনক্ষুধা নিবারণ করা। এইভাবে আমরা নৈতিকতা বিনাশ সাধনে সমর্থ হব।' (আলইফফাহ ৬২প দ্রঃ)
ওদের প্রধান লক্ষ্য হল, যাতে মুসলিম ইয়াহুদী, খ্রীষ্টান অথবা অন্য কোন ধর্মে ধর্মান্তরিত হোক। আর তা না হলেও অন্ততঃপক্ষে সে যেন ইসলাম থেকে বহু দুরে সরে যায়। দ্বীনী তা'লীমের ব্যাপারে তার যেন বিতৃষ্ণা জন্মে। যথাসম্ভব সে যেন পাশ্চাত্য সভ্যতাগ্রহণে উদ্বুদ্ধ হয়। মগজ ধোলাই করার উদ্দেশ্যে সে যেন পশ্চিমে পড়াশোনা বা চাকুরীর সুযোগ পায়।
ইসলামী সংস্কৃতি ধ্বংস করার সবচাইতে বড় উপায় হল যৌনতা এবং প্রধান মাধ্যম হল নারী-দেহ। অতএব প্রচারমাধ্যমগুলোর সিংহভাগ বিষয়বস্তু হোক নারী, প্রেম ও যৌনতা। নারীকে পুরুষের পাশাপাশি বসিয়ে দেওয়া হোক। বেশ্যালয়গুলো সরকারী অনুমোদন পাক।
বেশ্যাদেরকে ‘বেশ্যা’ না বলে ‘যৌনকর্মী’ (?) বলা হোক। বিভিন্ন নারী-আন্দোলনমূলক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হোক, সে সংগঠনগুলো নারী-স্বাধীনতার দাবী নিয়ে যৌন-স্বাধীনতার কাজ চালিয়ে যাক। চাকুরী দেওয়ার লোভ দেখিয়ে নারীকে বাইরে বের করে আনা হোক। সভ্য লেবাসের অন্তরাল থেকে বের করে এনে তাদেরকে ‘আলোকপ্রাপ্তা করা হোক। যাতে যুবকদল লালায়িত হয়ে নৈতিকতার বাধ ও বেড়া ভেঙ্গে যৌনতার তুফান নিয়ে আসে।
বিভিন্ন নাইট ক্লাব’ তৈরী হোক। অবাধ মিলামিশার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন বিলাসকেন্দ্র ও মিলনক্ষেত্র নির্মিত হোক। সুন্দরী-প্রতিযোগিতা এবং ফ্যাশন-ডিজাইনের বিভিন্ন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হোক। যুবক-যুবতীর সকল পার্থক্য দুরীভূত হোক। দূর হোক গতানুগতিক সামাজিক বিবাহ-প্ৰথা। নারীকে সুযোগ দেওয়া হোক তার ইচ্ছামত মডেল ও সংখ্যার জীবনসঙ্গী খুঁজে ও বেছে নিতে। গর্ভপাত আইনতঃ বৈধ করা হোক এবং তার সকল উপায়-উপকরণ সহজ ও সুলভ করা হোক; যাতে ব্যভিচার করতে যেন কেউ মান যাওয়া বা অযাচিত সন্তান নেওয়ার ভয় না করে।
ভাই যুবক! আর কত উল্লেখ করব? তুমি জ্ঞানী ছেলে, পৃথিবীর দিকে একবার জ্ঞানচক্ষু খুলে তাকিয়ে দেখ, তোমার পশ্চাতে কত শত্রু লেগে আছে, তা অনায়াসে বুঝতে পারবে। কিন্তু তখনও কি তুমি সচেতন হবে?
আজ যেন মহানবীর মহাবাণী বাস্তব রূপ নিতে চলেছে। তিনি বলেন, “অবশ্যই তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তী জাতির পথ অনুসরণ করবে বিঘত-বিঘত এবং হাত-হাত (সম) পরিমাণ। এমনকি তারা যদি গো-সাপের (সান্ডা)র গর্তে প্রবেশ করে, তাহলে তোমরাও তাদের পিছনে পিছনে যাবে। (এবং তাদের কেউ যদি রাস্তার উপর প্রকাশ্যে সঙ্গম করে, তাহলে তোমরাও তা করবে!)” সাহাবাগণ বললেন, হে আল্লাহর রসূল! আপনি কি ইয়াহুদ ও নাসারার অনুকরণ করার কথা বলছেন? তিনি বললেন, “তবে আবার কার?” (বুখারী, মুসলিম ২৬৬৯, হাকেম, আহমাদ, সহীহুল জামে ৫০৬৭ নং) সাহাবী হুযাইফা বিন ইয়ামান বলেন, 'তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তী জাতির পথ অবলম্বন করবে জুতার মাপের মত (সম্পূর্ণভাবে)। তোমরা তাদের পথে চলতে ভুল করবে এবং তারাও তোমাদেরকে সঙ্গে নিয়ে চলতে ভুল করবে না। এমন কি তাদের কেউ যদি শুকনো অথবা নরম পায়খানা খায়, তাহলে তোমরাও (তাদের অনুকরণে) তা খেতে লাগবে!' (আল-বিদাউ অন-নাহয়ু আনহা, ইবনে অযযাহ ৭ ১পৃঃ)।
প্রিয় নবী (সা.) বলেন, “পূর্ববর্তী জাতির সকল আচরণ এই উম্মত গ্রহণ করে নেবে।” (সহীহুল জামে ৭২১৯ নং) কিন্তু তিনি মুসলিম জাতিকে সতর্ক করে বলেন, “সে ব্যক্তি আমার দলভুক্ত নয়, যে ব্যক্তি আমাদেরকে ছেড়ে অন্য কারো সাদৃশ্য অবলম্বন করে। তোমরা ইয়াহুদীদের সাদৃশ্য অবলম্বন করো না, আর খ্রীষ্টানদেরও সাদৃশ্য অবলম্বন করো না।” (তিরমিযী, সহীহুল জামে ৫৪৩৪নং) যে ইয়াহুদী ও খ্রীষ্টান তথা পশ্চিমা বিশ্বকে আমরা উন্নত-বিশ্ব বলি, যাদের হাতে আজ বিশ্বের নেতৃত্ব-ডোের রয়েছে, যাদেরকে নিয়ে ও যাদের মত হতে পেরে অনেকে গর্ববোধ করে থাকে, তাদের সেই বিশ্বের মানুষকে চরম যৌন ও জরায়ু-স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, আইন করে ব্যভিচার, সমকামিতা ও বেশ্যাবৃত্তিকে বৈধ করা হয়েছে। যে বিশ্বে পয়দা হয় লাখোলাখো জারজ সন্তান, হত্যা করা হয় লাখো-লাখো জ্বণ। যেখানে লাখো-লাখো রয়েছে কুমারী মাতা। যৌবন আসার পূর্বেই বা প্রারম্ভেই যেখানে নারীর মূলধন সতীত্ব ও পবিত্রতাকে বিলিয়ে দেওয়া হয়। যেখানে পশুর মত পথে-ঘাটে চোখের সামনে মানুষের যৌন-মিলন। ঘটতে দেখা যায়। যেখানে অসভ্য যৌন-স্বাধীনতাই হল প্রকৃত সভ্যতা।
যে পাশ্চাত্য ভোগবাদী পরিবেশের অবস্থা এই যে, ডানা বের হলেই বাচ্চা (ছেলে-মেয়ে) উড়ে যায় বাসা ছেড়ে, মা-বাপ ছেড়ে। বুড়ো-বুড়ী একাকীই মরে বাড়িতে। কেউ বা বাস করে কুকুর বা বিড়াল নিয়ে। পরিশেষে অনেকে বাড়ি-ঘর, টাকা-পয়সা উইল করে যায় কুকুর বা বিড়ালের নামে! মালিক হয় কুকুর বা বিড়ালের খাদেমরা। অবিশ্বাস্য মনে হলেও বাস্তব এ কথা।
যে বিশ্বের সংসারে আত্মীয়তার বেহেস্তী পরিবেশ বিলীনা বংশ-পরিচয়ের সূত্র নিখোঁজ। নেই স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র বন্ধন। নেই পিতা-মাতার সহিত শালীনতাপূর্ণ আচরণ এবং আমরণ সহাবস্থান। হৃদয়ে-হৃদয়ে যৌন ছাড়া পবিত্র প্রেমের যোগসুত্র বিরল। যেখানে পবিত্রতাকামীদেরকে রক্ষণশীল ও সেকেলে এবং যৌনতাকামী অশ্লীল মানুষদেরকে সংস্কারপন্থী ও প্রগতিশীল বলে আখ্যায়ন করা হয়। যেখানে পর্দা ও সতীত্ব হল উপহসনীয়।
এই হইল পাশ্চাত্য সমাজের সামান্যতম প্রতিচ্ছবি। এই হইল ধর্মহীন সমাজ ও বিকৃত যৌনাচারের অবাধ মিলামিশার ফসল। নৈতিক মূল্যবোধের এহেন অবস্থায় উগ্র যৌনস্বাধীনতাকামীদের কাছে Wife হইতেছে Wonderful instrument for enjoyments অর্থাৎ, উপভোগের এক বিস্ময়কর যন্ত্রবিশেষ। ফলে আজ তাহাদের প্রাসাদ আছে, কিন্তু গৃহ নাই। জন্মদাতা আছে, কিন্তু পিতা নাই। পরিধান আছে, কিন্তু আব্র নাই। বুদ্ধি আছে, কিন্তু বিবেক নাই। মানুষের আকৃতি আছে, কিন্তু মনুষ্যত্ব নাই।' (গণতন্ত্র কি একটি শিরকী ও কুফরী মতবাদ? মাজহারুল আনোয়ার ২২পৃঃ দ্রঃ) ।
এখানেই শেষ নয়, কুমারী মায়ের হারাম সন্তানরা আবার বাপের পরিচয় না থাকার ফলে গর্ববোধও করে থাকে। কারণ, তাদের মত যীশু খ্রীষ্টেরও পিতা পরিচিত ছিল না তাই!! তবুও ঐ সমাজকে নিয়েই আমরা গর্ব করি। তাদের চরিত্রেই আমরা মুগ্ধ হই। বলা বাহুল্য, ঐ সমাজেরই জীবাণু আমাদের দেশেরও তথাকথিত বহু বুদ্ধিজীবী, চিন্তাবিদ ও কবিসাহিত্যিকদের মাঝে সংক্রমণ করেছে। বরং বহুলাংশে তা আমদানী করেই আনা হয়েছে। পাশ্চাত্যের শিক্ষা-পদ্ধতি, রেডিও-টিভি, পত্র-পত্রিকা প্রভৃতিতেও প্রভাবান্বিত হয়ে সকলের ক্ষেত্রে যৌনসুখ ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান করে যে যৌন-বিপ্লব এ শ্রেণীর মানুষেরা আনতে চায়, তা তাদের ছেলে-মেয়েদের লেবাসে-পোশাকে, আচার ও আচরণে প্রকাশ পায়। যার চরম সহযোগিতা করে দেশে নির্মিত ও প্রদর্শিত বিভিন্ন ফিল্ম। যাতে পশ্চিমী অবাধ যৌন-সংসর্গ ও অবৈধ প্রেম ছাড়া অন্য কোন বিষয় স্থান পায় না। আর তাতে উদ্বুদ্ধ করে পশ্চিমের ঐ ইন্দ্রিয়পরায়ণ ভোগবাদীরা। ওরা এদেরকে সংস্কারপন্থী বলে প্রশংসা করে! কিন্তু আসলে যে ওরা অপসংস্কার ও বিনাশপন্থী তা হয়তো বুঝেও বুঝে না।
যে দেশের সুখ ও সংস্কৃতি দেখে আমরা অবাক হই, তা কি আসলেই সংস্কৃতি? যুগ পাল্টে গেছে, পাল্টে গেছে মানুষের পরিবেশ ও ধ্যান-ধারণা। যুগের চাহিদা অনুযায়ী অপসংস্কৃতি সংস্কৃতির আকার ধারণ করেছে। কিন্তু যুগ কোন চিড়িয়ার নাম নয়। যুগ সৃষ্টি করে মানুষ। মানুষ যেমন হবে, ঠিক তেমনি হবে যুগ। মানুষ যদি নোংরা অপসংস্কৃতির চাহিদা সৃষ্টি না করে, তাহলে যুগের চাহিদার কোন প্রশ্নই ওঠে না। মানুষের মনে চিত্তজ্বালা সৃষ্টি হয়েছে। ভোগের নেশা তীব্র থেকে তীব্র হওয়ার কারণে। যেখানে ভোগের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, সেখানে চিত্তবিনোদনের উপায়-উপকরণের সীমাই বা কি করে থাকে? ভোগের নেশা যত বেড়ে চলে, ততই বেড়ে চলে আরো ভোগের আকাঙ্খা। উদ্ভব হয় নতুন নতুন বিনোদনের কেন্দ্র, উপাদান ও যন্ত্র।
যারা যত বেশী চিত্তজ্বালায় জ্বলে, তারা তত বেশী চিত্তবিনোদনের প্রয়োজন বোধ করে থাকে। তাই বিনোদনের উপাদান-উপকরণ তালাশ করে এবং বিনোদনের নতুন নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি করে। অভাব যেখানে যত তীব্র, প্রাপ্তির হাহাকারও তত বেশী। পশ্চিমা সমাজে সেই চিত্তজ্বালা প্রায় প্রতি জনে, প্রতি ঘরে, প্রতি পরিবারে প্রবেশ করে অগ্নিজ্বালার দাবদাহ সৃষ্টি করেছে। তাই তো এত অস্থিরতা। এই অস্থিরতা দুর করার জন্যই চিত্তবিনোদনের এত বৈচিত্র সৃষ্টি করা হয়। মাজা-ঘষা, পালিশ আর বার্ণিশ করা তাদের সমাজের বহিদৃশ্য নয়ন জুড়ায়; কিন্তু মাকাল ফলের মত অন্তর বিস্বাদ। যে সমাজে আমাদের মত সামাজিকতা নেই। স্বামী-স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোন, চাচা-চাচী, দাদা-দাদী নিয়ে সেই সমাজে কোন পরিবার গড়ে ওঠে না। স্বনির্ভরতার পাখনা উঠলেই কে কোথায় উড়ে যায় কেউ কারো খবর রাখে না। যেখানে দুই বিয়াই-এ কখনো খোশ আলাপ হয় না। যে সমাজের কোন মা পিঠা তৈরী করে মেয়ের বাড়ি পাঠান না। ----- যেখানে লায়েক সন্তানেরা বুড়ো মা-বাবাকে 'ওল্ড এজ হোম’ নামক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বন্দি খোয়াড়ে’ পাঠিয়ে দেয় অথবা নিজ বাড়িতে বুড়া-বুড়ী সরকারী চেরিটি বা লিল্লাহ খেয়ে নিঃসঙ্গ অবস্থায় ধুকেধুকে মরেন। মৃত্যুর সময় স্বজনদের কেউ পাশে থাকে না।
এই যে জীবন-জ্বালা, সামাজিকতা-বিহীন এই যে সমাজ, আর রক্তের মায়া-মমতাশূন্য এই যে যান্ত্রিক জীবন, সেই জীবনকে, সেই শূন্যতাকে, সেই একাকীত্বকে দূর করার জন্য তারা বিনোদন-বৈচিত্র সৃষ্টি করে জীবনকে ভরে তুলতে চায়। ভালো-মন্দ বাছ-বিচার করে দেখার ফুরসৎ তাদের নেই, সেই প্রয়োজন আছে বলেও তারা মনে করে না। ভোগের জন্যই তাদের চিত্তের প্রয়োজন। তাই চিত্ত আর ভোগের পিছনেই তারা ছুটে। এই বিত্ত দিয়ে তারা চিত্তকে সব সময় আনন্দে ডুবিয়ে রাখার চেষ্টা করে থাকে। ওদের বিত্ত আছে, আর আছে বিত্তকে চিত্তবিনোদনের জন্য ব্যবহারের মনটাও। দৃষ্টি আকর্ষণ করার মত দৌলত আছে তাদের। দেহের রঙটাও লালচে সফেদ।
আমাদের মত কালো আদমীর মুগ্ধ হওয়ার, বিমোহিত হওয়ার, এমন কি সম্মােহিত হওয়ার জন্য যা কিছু তাদের থাকা দরকার, সবই আছে। তারা যা করে তাই আমাদের ভালো লাগে। ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত এই সাদা চামড়ার মানুষদের প্রভু জ্ঞান করে আমরা ধন্য হয়েছি। এ জন্য রাজনৈতিক দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করলেও সাংস্কৃতিক দাসত্ব থেকে মুক্তির কখনো চেষ্টা করিনি। কারণ, জাতে ওঠার জন্য এই বন্ধনকে কখনো ছিন্ন করিনি। বরং আরো বেশী মজবুত করেছি। তাদের জাত-গোষ্ঠী সবাইকে আমরা আমাদের সাংস্কৃতিক প্রভু বলে স্বীকার করে নিয়েছি।' (দেখুন, অপসংস্কৃতির বিভীষিকা, জহুরী ১৪- ১৬পৃঃ)
আমরা আমাদের অজান্তেই পশ্চিমের পদলেহী গোলাম হয়ে পড়েছি। আজ তাদের সামান্য অনুগ্রহ লাভ করার জন্য আমরা আমাদের হাব-ভাবে ফুটিয়ে তুলছি যে, আমরা তাদেরকে মন থেকে ভালোবাসি। তাই স্বকীয়তা বিকিয়ে, স্বাতন্ত্র্য বিলীন করে চেষ্টা করি তাদের পদসেবা করার।
ইসলামে তুমি দিয়ে কবর
মুসলিম বলে কর ফখর
মুনাফিক তুমি সেরা বেদ্বীন,
ইসলামে যারা করে যবেহ
তুমি তাহাদের হও তাবে’
তুমি জুতা-বহা তারও অধীন।
তবে হ্যা, বেদ্বীন প্রতিবেশী ও জাতির সহিত দেশীয় মিল থাকতে পারে, পার্থিব লেনদেনে যোগাযোগ থাকতে পারে, সদাচার ও সদ্ব্যবহার থাকতে পারে। তা বলে নিজের স্বাতন্ত্র বিকিয়ে দিয়ে একাকার হওয়া চলে না।
আমাদের দ্বীন ও শরীয়ত যে সব বিষয়ে বিজাতির অনুকরণ করতে নিষেধ করে, তার মধ্যে একটি বিষয় হল, আকীদা ও বিশ্বাসগত বিষয়। অর্থাৎ, তারা যে শিকী ও কুফরী বিশ্বাস রাখে, সে বিশ্বাস কোন মুসলিম রাখতে পারে না। যে কুফরী মতবাদে তারা বিশ্বাসী সে মতবাদে কোন মুসলিম বিশ্বাসী হতে পারে না। দ্বিতীয়তঃ ঈদ ও পাল-পার্বণ উৎসব উদ্যাপন ও অনুষ্ঠানগত বিভিন্ন বিষয়। অর্থাৎ, দুই ঈদ ছাড়া কোন মুসলিম ওদের দেখাদেখি আর কোন তৃতীয় ঈদ আবিষ্কার করতে পারে না; চাহে তা কোন দুর্বল বা জাল হাদীস-ভিত্তিক হোক, অথবা নিছক মনগড়া। বলাবাহুল্য, শবে মিরাজ, শবে বরাত, মুহরম, নবীদিবস বা ঈদে-মীলাদুন্নবী ফাতেহা ইয়াযদহম, ফাতেহা দোয়াযদহম, আখেরী চাহারশোম্বা, পৌষপার্বণ, সিলভার জুবিলি, গোল্ডেন জুবিলি, জাতীয় দিবস, মসজিদ সপ্তাহ, জন্মদিন বা হ্যাপি বার্থ ডে’ উৎসব, হানিমুন, বিবাহবার্ষিকী, মৃত্যুবার্ষিকী, উরস-উৎসব, এপ্রিল ফুল, হ্যালোইন উৎসব, নতুন খাতা বা নববর্ষ প্রভৃতি অনুষ্ঠান উদ্যাপন ইসলামে ভিত্তিহীন এবং পরের দেখাদেখি আনন্দে ফুর্তি করার মাধ্যম মাত্র।
এ সব ঈদ বা পরব পালন কোন মুসলিম করতে পারে না। যেমন ঐ শ্রেণীর কোন উৎসবে অথবা বিজাতির কোন পাল-পার্বণে কোন মুসলিম অংশগ্রহণ করে খুশী করতে পারে না। কারণ, বিজাতির সকল ঈদ ও ইবাদত বাতিলকে ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। আর তাদের সেই ঈদের খুশীতে শরীক হওয়া বা সে উপলক্ষ্যে তাদেরকে ‘মোবারকবাদ’ পেশ করার অর্থই হল তাদের বাতিলকে স্বীকৃতি দেওয়া ও সমর্থন করা এবং আসল সত্যের অপলাপ করা। বর্তমানে বিজাতির অনুকরণে মুসলিমদেরও পরব সংখ্যা এত বেশী হয়েছে যে, তা পালন করে মনে না রাখলেও অনেক সময় ঠকতে হয়। ধর, পাড়া-গ্রাম থেকে শহরে গেলে কোন অফিসের কাজে অথবা ব্যাংকে লেনদেনের কাজে। হঠাৎ দেখলে, সে অফিসে বা ব্যাংকে তালা ঝুলছে। সুতরাং এত কষ্ট করে এসে তোমাকে ঠকতে হল। এ ছাড়া ঠকানির পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পাবে তখন, যখন পাশের কোন পরব-মানা মুসলিমকে এ বন্ধের কারণ জিজ্ঞাসা করবে এবং সে অবাক হয়ে বিদ্রুপের আগ্ন জিভে তোমাকে বলবে, 'ওঃ! মুসলিম হয়ে দাড়ি রেখে নিয়েছ বেশ। আর পবিত্র ও পরবের দিনের খবর রাখ না!' ইত্যাদি।
একদিন এক শহরের বাসস্ট্যান্ডে বাসে বসে ছিলাম। পাশের সিট ছিল খালি। এমন সময় আমার পরিচিত এক হাই-স্কুলের শিক্ষক মহাশয় বাসে উঠলেন। সালাম জানালে আমি উত্তর দিয়ে তাকে সাদরে পাশের সিটে বসতে অনুরোধ করলাম। তিনি খুশীর সাথে বসলেন। এরপর হঠাৎ করেই আমি তাকে জিজ্ঞাসা করে বসলাম, মার্কেট এসেছিলেন, আপনার আজ স্কুল নেই নাকি? তিনি অবাক হয়ে বললেন, 'আপনি জানেন না; আজকে ফাতেহা ইয়াযদহম, স্কুলের ছুটি?' আমি খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েই বললাম, 'ও তাই বুঝি? আচ্ছা এই ফাতেহা ইয়াযদহম’টা কি?
তিনি যেন আরো অবাক হলেন। আসল প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে বড় আফশোসের সাথে বললেন, এই তো মুসলমানদের অবস্থা! নিজেদের পালপার্বণেরও খবর রাখে না। আজ তো হযরত বড় পীরের মৃত্যু-দিবস।
এরপর অবশ্য প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলেছিলাম, 'মুসলমানরা যদি নিজেদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সঠিক মতে জানত, তাহলে সত্যই তাদের এ দুরবস্থা হতো না। কিন্তু আজকাল আসল ছেড়ে দিয়ে নকল হীরা নিয়েই টানাটানি বেশী। মনে মনে ভাবলাম, কুঁড়ে চাষীই অমাবশ্যা খুঁজে বেশী। আর কাজ-চোর বউই ভাশুর মানে অধিক। নিজের ফরয আদায় থেকে যারা যত বেশী রেহাই পেতে চায়, তাদেরই এসব নকল পালপার্বণের খোঁজে ছুটি পাওয়াটা অধিক আকাংখিত। তাছাড়া যারা নামাযে ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পড়ে না, বরং নামাযই পড়ে না, তাদেরই ফাতেহা বা ফয়তা নিয়ে বেশী খোঁজখবর ও বাড়াবাড়ি। বিজাতির অনুকরণের ফসল এই বারো মাসে তেরো পরব।' বাপকে জীবনে চোখে না দেখতে পেরে অথবা তার অবাধ্য সন্তান হিসাবে জীবন অতিবাহিত করে অথবা জীবিত অবস্থায় তার বিরোধিতা করে তার মৃত্যুর পর তার নামে ফয়তা দেওয়া হাস্যকর নয় কি?
পরন্তু আসল কথা এই যে, দ্বীনের মূল কর্মকর্তব্য বর্জন করে এই সমস্ত নকল পালপার্বণ সৃষ্টি করে একটু আনন্দ উপভোগ করাই হল এক শ্রেণীর স্বার্থপর মানুষদের উদ্দেশ্য। তাই দেখা যায় উহুদ-যুদ্ধের দিনকে স্মরণ করে অনেকে হালোয়া বানিয়ে খায়। কারণ, ঐ দিনে মহানবী রঃ এর দাত-মুবারক শহীদ হয়েছিল এবং মা-ফাতেমা তাঁকে হালোয়া বানিয়ে খেতে দিয়েছিলেন। অতএব ঐ দিনে হালোয়া খাওয়া সুন্নত। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় যে, ঐ শ্রেণীর মানুষরা দাত ভাঙ্গা (জিহাদ) কে (ফরয তো দুরের কথা) সুন্নত মনে করে না। অথচ অক্ষত দাতে হালোয়া খাওয়াকে সুন্নত মনে করে। এটা স্বার্থপরতা নয় তো কি?
দুঃখের বিষয় যে, বিজাতির দেখাদেখি এক শ্রেণীর মুসলিম যুবক; যাদের বাপের পকেটে পয়সা নেই, তারা জোর-জুলুম করে অপরের নিকট থেকে চাঁদা তুলে মহরমের পরবে ফুর্তিআমোদ করে থাকে। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষের গাড়ি থামিয়ে এমন চঁদাবাজি তথা ঐ অর্থ দ্বারা না হলেও ১০ই মহরমের দিন কোন প্রকার আনন্দ অথবা শোকপালন করা ইসলামী শরীয়ত-বহির্ভূত কর্ম। যেমন বিজাতীয় সহপাঠীদের চাঁদা তুলে কোন পূজা বা জন্ম-বার্ষিকী পালন করতে দেখে মুসলিম ছাত্রদেরও অনুরূপ নবী-দিবস পালন করা ইসলামী শরীয়ত-সম্মত নয়। প্রতিবেশীর সাথে পাল্লা দিয়ে এমন কাজ মুসলিমদের জন্য সত্যই লজ্জাকর।
বলাই বাহুল্য যে, ইসলাম হল খাটি একত্ববাদের ধর্ম। এ ধর্মে কোন প্রকার ব্যক্তিপূজা (মুর্তিপূজা, দুর্গাপূজা), শক্তিপূজা, অর্থপূজা এবং এক কথায় একমাত্র মহান আল্লাহর ইবাদত ও দাসত্ব ছাড়া অন্য কোন পূজার স্থান নেই। ইয়াহুদী ও খ্রীষ্টানরা আম্বিয়াগণের কবরসমূহকে মসজিদ (সিজদার জায়গা) বানিয়ে নিত। ইসলাম এ ব্যাপারেও তাদের অনুকরণ করতে নিষেধ করল। কবর ও মাজার পূজার বিরদ্ধে ইসলামের ঘোষণা এল, “তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিরা তাদের নবীগণের কবরসমূহকে মসজিদে পরিণত করেছে। সাবধান! খবরদার তোমরা কবরগুলোকে মসজিদে পরিণত করে নিও না। আমি এ করতে তোমাদেরকে নিষেধ করে যাচ্ছি।” (মুসলিম ৫৩২ নং) “আল্লাহ ইয়াহুদী জাতিকে ধ্বংস করুক; তারা তাদের আম্বিয়াগণের কবরসমূহকে মসজিদে পরিণত করেছে।” (বুখারী ৪৩৭ নং)।
“ওরা হল এমন জাতি; যারা তাদের কোন নেক বান্দার মৃত্যু হলে তার কবরের উপর মসজিদ তৈরী করেছে এবং তাতে তার ছবি বা মূর্তি স্থাপন করেছে। ওরাই হল আল্লাহর নিকট সবচাইতে নিকৃষ্টতম সৃষ্টি।” (বুখারী ৪২৬, মুসলিম ৫২৮ নং)। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, বর্তমান বিশ্বে অধিকাংশ মুসলিম বিজাতির অনুকরণে ঐ শ্রেণীর পূজায় লিপ্ত হয়ে পড়েছে এবং তওহীদের ধর্মে ইবাদত ও বন্দেগীতে অন্যকে আল্লাহর শরীক অথবা মাধ্যমরূপে পূজতে শুরু করেছে। যে গায়রুল্লাহর ইবাদত (পূজা) নির্মুল ও উচ্ছেদ করার জন্য এ ধরাধামে ইসলামের আবির্ভাব ছিল, সেই ইবাদত (পূজা)কেই অভীষ্ট লাভের অনন্য উপায় বলে বরণ করে নিল মুসলিম জাতির বহু কুলাঙ্গারদল! আল্লাহ এ জাতিকে সুমতি দিন। আমীন। ইয়াহুদী ও খ্রীষ্টানরা রোযা রাখে, কিন্তু সেহরী খায় না। ইসলাম তাদের অন্ধ অনুকরণ করে। সেহরী খাওয়া ত্যাগ করতে নিষেধ করল। (মুসলিম ১০৯৬ নং) রোযা রাখার পর ওরা ইফতার করে, কিন্তু বড় দেরী করে। ইসলাম তাদের অনুকরণ বর্জন করতে নির্দেশ দিয়ে সূর্য ডোবার। সাথে সাথে সত্বর ইফতার করতে মুসলিম জাতিকে উদ্বুদ্ধ করল। (আবু দাউদ ২৩৫৩, ইবনে মাজাহ ১৬৯৮ নং, হাকেম ১/৪৩১)
সূর্যপূজকরা সূর্যের উদয় ও অস্তের সময় তার পূজা করে থাকে। তাই ঐ সময়ে আল্লাহর উদ্দেশ্যেও নামায পড়াকে ইসলাম নিষিদ্ধ ঘোষণা করল। (মুসলিম ৮৩২নং) যাতে মুশরিকদের সাথে তওহীদবাদী মুসলিমদের কোন প্রকার সাদৃশ্যভাব না ফুটে ওঠে। বৈরাগ্যবাদ বিজাতীয় আচার। ইসলামে তা নিষিদ্ধ হল। (আবু দাউদ ৪৯০৪ নং)
‘বৈরাগ্য-সাধনে মুক্তি সে আমার নয়,
অসংখ্য বন্ধন মাঝে মহানন্দময়
লভিব মুক্তির স্বাদ----।
ইসলামের এ আদর্শ হল মানব-প্রকৃতির জন্য অতুলনীয়। সুতরাং মাছ-গোশু না খাওয়া, জুতো না পরা, গাড়ি না চড়া, ইত্যাদি বিজাতীয় আচরণ, ইসলামী আচরণ নয়।
ইসলামে দলাদলি ও ফিকাবন্দী নিষিদ্ধ কর্ম। কারণ, এ আচরণ ও নীতি হল মুশরিক ও কাফেরদের। তাদের সমাজেই আছে ভেদাভেদের নানা প্রাচীর। উঁচু-নীচু পার্থক্য করার মনগড়া নানা দোষগুণ। মহান আল্লাহ বলেন, “তোমরা তাদের মত হবে না, যারা তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন আসার পরও বিচ্ছিন্ন হয়ে (দলে দলে বিভক্ত হয়ে) পড়েছে এবং নিজেদের মাঝে মতান্তর সৃষ্টি করেছে।” (সরা আ-লি ইমরান ১০৫ আয়াত)।
বিজাতীয় মানুষকে ঘৃণা করে নয়, বরং বাতিল থেকে হকের যে একটা পৃথক বৈশিষ্ট্য আছে তা প্রকাশের জন্য এবং মুসলিম বাতিলের সাথে কোন প্রকার আপোসে সম্মত নয়, তা জানিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই লেবাসে-পোশাকেও সে অন্যান্য জাতি থেকে ভিন্ন। পরিচ্ছদ-পরিধানেও মুসলিমের আছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। যেমন, মুসলিমের লেবাসে প্রকাশ পায় না কোন প্রকার অহংকার-অহমিকা, পাওয়া যায় না কোন বিজাতীয় গন্ধ, থাকে না কোন প্রকার দৃষ্টিকটুতা, অশ্লীলতা ও বেলেল্লাপনার ভাব। আর এ স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে চলা তার একান্ত কর্তব্য। একদা মহানবী (সা.) আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ)-কে দু’টি জাফরান রঙের কাপড় পরে থাকতে দেখে বললেন, “এ ধরনের কাপড় হল কাফেরদের। অতএব তুমি তা পরো না।” (মুসলিম আহমাদ ১১৬২)
এ থেকে বুঝা যায় যে, যে ধরনের লেবাস-পোশাক বিজাতির বিশেষ প্রতীক তা কোন। মুসলিম নর-নারী ব্যবহার করতে পারে না।
পুরুষের এক প্রকৃতি-সুন্দর রূপ হল তার চেহারায় দাড়ি। কুদরতের দেওয়া এই দাড়ি থাকলে মুসলিমকে দেখতে যেমন সুন্দর লাগে, তেমনি চাছা-ছিলার ঝামেলা থেকে রেহাই পায়। তাছাড়া বিশেষ করে গালে টোল পড়ার বয়সে টোলের ত্রুটি দাড়ি দিয়ে গোপন করা। যায়। এতে থুড়থুড়ে হলেও চেহারা বেশ শ্রদ্ধাপূর্ণ সুন্দর দেখায়। তবে শর্ত হল দাড়ি ছাড়ার সাথে মোছ ঘেঁটে ফেলতে হবে। নচেৎ সুন্দরের উপর অসুন্দর বেখাপ্পা দেখাবে। আর এমন চেহারা হবে মুসলিমের বৈশিষ্ট্য। প্রিয় নবী স. বলেন, “তোমরা মোছ হেঁটে ফেল এবং দাড়ি ছেড়ে দাও (কমপক্ষে এক মুঠো পরিমাণ)। আর একাজ করে তোমরা মুশরিকদের অন্যথাচরণ কর।” (বুখারী ৫৮৯৩, মুসলিম ২৫৯ নং) “মোছ ছেটে ও দাড়ি রেখে অগ্নিপূজকদের বৈপরীত্য কর।” (মুসলিম ২৬০ নং) “এবং ইয়াহুদী ও খ্রীষ্টানদের সাদৃশ্য অবলম্বন করো না।” (আহমাদ, সহীহুল জামে ১০৬৭ নং)
আর তা এই জন্য যে, ওরা কেউ আমাদের মত হতে চায় না, আমাদের কাছে আসা সত্যকে গ্রহণ করতে চায় না, তাই আমরা তাদের বাতিল চলনের বিরোধিতা করতে আদিষ্ট হয়েছি।
অনেক যুবকের অবস্থা উল্টা বুঝিল রাম। অর্থাৎ, তারা দাড়ি চেঁছে ফেলে মোছ লম্বা ছেড়ে মোছাল সেজে সেঁপে পাক দেয়। কারো বা টাঙ্গি মোছ! কারো বা হাফ-দাড়ি মোছ বা জুলফি-জোড়া মোছ। কারো বা দাড়ি-মোছ একেবারেই ছিলা! এরা সকলেই মহানবী ও ও তার অনুসারীদের বিরোধী। অনেকের দাড়ি আছে, তবে তা মহানবীর অনুকরণে নয়; বরং তা হয়তো লেনিন বা কার্লমার্কসের অনুকরণে, নচেৎ কোন প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব বা হিরোর অনুকরণে। যার দরুণ তাদের দাড়ি-মোছ ইসলামী ছাঁচ বা কাটিং মত নয়। ফ্যাশন মনে করে রাখে, এক সপ্তাহে ছাঁটে, পরের সপ্তাহে চাছে। কাউকে ছাঁটতে বা চাছতে নিষেধ করলে বুকের দিকে ইঙ্গিত করে বলে, “ঈমান তো এখানে!’ অর্থাৎ, দাড়িতে নয়। কিন্তু তার জানা নেই যে, ঈমানের মূল আছে অন্তরে, আর তার কান্ড ও শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন অঙ্গে ও কর্মে। সুতরাং দাড়ি রাখাও হল ঈমানের এক শাখা এবং তা ওয়াজেব।
পক্ষান্তরে আর এক শ্রেণীর লোক আছে, যারা মুসলিমকে ধোকা দেওয়ার উদ্দেশ্যে মেকি দাড়ি রাখে। এরা দুইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। চুল-দাড়ি পেকে সাদা হয়ে গেলে সাদাই রেখে দেওয়া বিজাতীয় আচরণ। তাই ইসলামের আদেশ হল, তা কালো ছাড়া অন্য কোন রঙ দ্বারা রঙিয়ে ফেল এবং বিজাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করো না। (বুখারী ৩৪৬২, মুসলিম ২১০৩ নং, আহমাদ, ত্বাবারানী, সহীহুল জামে’ ১০৬৭, ৪৮৮৭ নং)
মহিলাদেরকে বেপর্দায় রাখা হল জাহেলী যুগের মানুষদের অনুকরণ। (সূরা আহযাব ৩৩ আয়াত) বরং বর্তমান বিশ্বের সমগ্র জাতির অন্ধ অনুকরণ হল মহিলাদের আব্রু ও পর্দাহীনতায় বেগানা পুরুষের সামনে যাওয়া। মাথায় পরচুলা ব্যবহার ইয়াহুদী মেয়েদের আচরণ। অতএব তা কোন মুসলিম নারী ব্যবহার করতে পারে না। (মুসলিম ২৭৪২ নং) কেউ এলে তার জন্য দাঁড়িয়ে সম্মান জানানো; যেমন, কোর্টে হাকীমদের জন্য, পার্লামেন্টে স্পীকার মন্ত্রীদের জন্য, স্কুল-কলেজে শিক্ষকদের জন্য অথবা কোন আলেম-বুযুর্গের জন্য উঠে দাঁড়িয়ে তা’যীম প্রকাশ করা বিজাতীয় আচরণ। কোন মুসলিমের জন্য তা বৈধ নয়। (মুসলিম ৪১৩, আবু দাউদ ৫২৩০ নং প্রমুখ) বৈধ নয় কোন মৃত বা তার আত্মার উদ্দেশ্যে কয়েক মিনিট দাড়িয়ে নীরবতা পালনের সাথে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন৷ কারণ, এ প্রথাও বিজাতির নিকট থেকে ধার করা প্রথা।
গুরুজনদেরকে সালাম দেওয়ার সময় অনেকে প্রণামের অনুকরণ করে তাদের পা ছুঁয়ে সে হাত কপালে ও বুকে ঠেকিয়ে সম্মান জানায়। এ ছাড়া এই সালামে অনুপ্রবেশ করেছে আরো অনেক কিছু বিজাতীয় কায়দা।
ইসলামে এক মুসলিম অপর মুসলিমকে সাক্ষাৎ করলে যে অভিবাদন আছে, তা অন্য কোন জাতির নেই। একই সঙ্গে অভিবাদন, দুআ ও কল্যাণ কামনা অন্য কোন শব্দ ও ভাষাতে নেই। সুপ্রভাত, শুভসন্ধা, নমস্কার আর যাই বলুন না কেন সালাম’-এর সমতুল কিছুই নয়। তবুও যেন এই অতুল শব্দগুচ্ছের অভিবাদনকে পরিহার করে মুসলিম পরিবেশেও ইংরেজী কায়দায় 'গুড মর্নিং’ গুড় এভেনিং' প্রভৃতি বলে পশ্চিমী ধারায় সালাম জানানো হয়, সৈনিক পর্যায়ে সেলুট করা হয় ঐ একই কায়দায়। মৃতব্যক্তিকেও শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করা হয় ঐ পশ্চিমী ছাঁচে। ইংরেজ কালচারের জয়-জয়কার যেন সর্বত্র। পোশাকেই বলুন, চাল-চলনেই বলুন, আর তাদের বুলি-বচনের কথাই বলুন, আমরা হাতে-কলমে প্রাত্যহিক কাজ-কর্মে এই প্রমাণই রাখছি যে, আমরা তোমাদের ছিলাম, তোমাদেরই আছি। এবং তোমাদের হয়েই থাকব।' (অপসংস্কৃতির বিভীষিকা ২৪পৃঃ)
মহানবী (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি আমাদেরকে ছেড়ে অন্যের অনুকরণ করে, সে ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়। তোমরা ইয়াহুদী ও খ্রীষ্টানদের সাদৃশ্য অবলম্বন (অনুকরণ) করো না। ইয়াহুদীদের সালাম হল আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করা এবং খ্রীষ্টানদের সালাম হল হাত দ্বারা ইশারা করা।” (তিরমিযী ২৮৪৮, সিলসিলাহ সহীহাহ ২১৯৪নং)*
বলা বাহুল্য যে, পোশাকে আমরা যা ব্যবহার করি, তা ওদেরই দেখে শেখা; যাতে বসে পেশাব করা যায় না, ইদ্দত যথার্থরূপে গোপন হয় না, গাটের নীচে ঝুলিয়ে না পরলে ফ্যাশন। জমে না। আর আমাদের স্ত্রী-কন্যা-বোনদেরকে যা পরিয়েছি তাও ঐ ‘ম্যাডাম’দের অনুকরণ। আলোকপ্রাপ্তা করার উদ্দেশ্যে যথা সম্ভব তাদের উন্মুক্ত হাঁটুতে, জাঙ্গে, বুকে, মাথায়, পিঠে ও নাভিতে সূর্যের আলো দিয়ে থাকি।
অনেকে বাড়িতে কুকুর পুষতে শুরু করেছে ওদের দেখাদেখি। বিবাহের পূর্বে কোর্টশীপ বা বর-কনের অবাধ মিলন ও হৃদয়ের আদান প্রদান, পয়গাম বা বাদানের সময় পয়গামের আংটি পরাবার প্রথা ইত্যাদিও ওদের নিকট থেকে অনুপ্রবেশ করেছে আমাদের সমাজে। নাম রাখাতেও অনুকরণ করা হচ্ছে বিদেশী কায়দার। অমুসলিমরা কোনদিন ভুল করেও নিজেদের ছেলে-মেয়েদের মুসলমানী নাম রাখে না। অথচ মুসলিমরা এ কাজ বড় গর্বের সাথে ফ্যাশন মনে করে পালন করে থাকে।
আর এ সবের মূল কারণ হল, আজকের মুসলিম হীনম্মন্যতার শিকার। মানসিক আগ্রাসনের শিকার হওয়ার ফলে বিজাতীয় সব কিছুকে লুফে নিতে প্রগতি ধরে নিয়েছে। সাধারণতঃ যে দুর্বল হয়, সে হয় প্রভাবশীল। আর সবল হয় প্রভাবশালী। মুসলমান মানসিক দুর্বলতার শিকার হয়ে নিজেকে প্রভাবশালী না করে প্রভাবশীল করে ফেলেছে।
ইসলাম আসার পূর্বে জাহেলী যুগ ছিল অন্ধ মূর্খতার যুগ। ভ্রষ্টতার অন্ধকার ছিল ঘন কালো হয়ে মানুষের মনে ও সমাজে। সে যুগের সেই অসভ্যতার কৃষ্ট তমসাচ্ছন্ন বিভাবরী ভেদ করে সভ্যতার সূর্য উদিত করল ইসলাম। দুর হল মুখতা ও ভ্রষ্টতার অন্ধকার, অপসৃত হল মনের কালো। নিন্দিত হল জাহেলিয়াতের সকল কর্ম। সুতরাং সে সব কর্ম ও প্রথা কোন মুসলিম যে গ্রহণ করতে পারে না, তা বলাই বাহুল্য। জাহেলী প্রথা যেমন, মৃতব্যক্তির জন্য মাতম করে শোক পালন করা, মর্সিয়া গাওয়া, বংশ নিয়ে গর্ব করা, অপরের বংশে খোটা দেওয়া, রাশিচক্রে বিশ্বাস রাখা, (মুসলিম ৯৩৫ নং) নিজের দেশ, ভাষা, মযহাব, গোত্র, রঙ, বর্ণ প্রভৃতিতে অন্ধ-পক্ষপাতিত্ব করা ইত্যাদি।
সকল মুসলিম ভাই-ভাই। তাদের মাঝে ভেদাভেদের কোন প্রাচীর নেই। বর্ণ-বৈষম্যের অভিশাপ থেকে মুসলিম সমাজ সম্পূর্ণ মুক্ত। এ সমাজের সকলেই সমান অধিকারের দাবিদার। “সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ হল সেই ব্যক্তি, যে সব চেয়ে বেশী মুত্তাকী ও পরহেযগার।” (সূরা হুজুরাত ১৩ আয়াত) এমন কিছু আচরণ আছে যা মানুষের নয়, শয়তানের। মুসলিম শয়তানের অনুকরণ করে সে সব আচরণ করতে পারে না। যে শয়তান, তার সকল কর্ম শয়তানীতে ভর্তি। এমন কি আপাতঃদৃষ্টিতে যে কাজ মুসলিমের জন্য ভালো মনে হয় সে কাজ শয়তানের তরফ থেকে হলে জানতে হবে ঐ ভালোর মাঝে কোন কালো ভরে ফেলেছে, অপেক্ষাকৃত কোন বড় ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে।
অতএব শয়তানের শয়তানীতে অনুকরণ করা কোন মানুষের জন্য শোভনীয় হতে পারে না। বাম হাতে খাওয়া-পান করা এক শ্রেণীর মানুষের ফ্যাশন। ডান হাতে চা, বাম হাতে বিস্কুট, অথবা ডান হাতে পেন্সি বা জুস এবং বাম হাতে কেক ইত্যাদি খেয়ে তারা আধুনিকতা প্রদর্শন করে থাকে। অথচ পাশ্চাত্যের অনুকরণে এ আধুনিকতা ও ফ্যাশন হল আসলে শয়তানের। মহানবী বলেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ যেন তার বাম হাতে পানাহার না করে। কারণ, শয়তান তার বাম হাত দিয়ে পানাহার করে থাকে।” (মুসলিম ২০১৯, তিরমিযী, সহীহুল জামে ৭৫৭৯ নং)
অনেক যুবক অহংকার প্রদর্শন করে ঔদ্ধত্যের সাথে বলে, বাম হাতের দোষ কি? সে হাতে খেলে ক্ষতি কি? আর তারা হয়তো এ কথাও বলে, ডান হাত লাটসাহেব নাকি? সে হাত দিয়ে পায়খানা সাফ করলে ক্ষতি কি? কিন্তু ফলকথা হল এই যে, রুচি যখন বিকারগ্রস্ত হয়, তখন স্বাদ পার্থক্য করার মত ক্ষমতাও আর থাকে না এক শ্রেণীর রোগীর কাছে। অবশ্য এমন রোগীর সত্বর চিকিৎসা করা যে জরুরী, তা হয়তো বলা নিষ্প্রয়োজন। লেবাসে-পোশাকে, চলনে-বলনে, ভাবে-ভঙ্গিতে আচরণে-প্রসাধনে নারী-পুরুষের একে অন্যের অনুকরণ করা এক চারিত্রিক দোষ। দাড়ি-মোছ চেঁছে, চুল লম্বা রেখে, ছাপা লুঙ্গি-জামা পরে, গাঁটের নীচে মাটিতে পরিহিত কাপড় ঝুলিয়ে, পাউডার মেখে, হাতে বালা, গলায় সোনার হার ইত্যাদি পরে মহিলাদের অনুকরণ করে থাকে এক শ্রেণীর লারেলাপ্পা’ মার্কা যুবক।
পক্ষান্তরে চুল হেঁটে ছোট করে, পরিহিত কাপড় গাটের উপর, বরং হাঁটুর উপর তুলে, প্যান্ট-শার্ট পরে, অঙ্গ-ভঙ্গিতে পুরুষের মত গটগট করে চলে এক শ্রেণীর আধুনিকা ‘ম্যাডাম’-এর দল। যাদেরকে পিছন থেকে দেখলে কোন দর্শক সহজে ঠাওর করতে পারে, সামনে ওটা ছেলে চলল, না মেয়ে? প্রাকৃতিক নিয়মের নিয়ামক নারী-পুরুষের মাঝে বড় পার্থক্য রেখেছেন। যা অস্বীকার করলে এবং নারী-পুরুষকে সকল ময়দানে একাকার করে। দিলে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় সমাজে যে উচ্ছলতা ও অনৈতিকতা তথা অশান্তির ঝড় দেখা দেবে, তা বহু সমাজ-বিজ্ঞানী স্বীকার করেছেন।
যুগের ধর্ম এই
বারুদে-আগুনে একই করিলে জ্বালাইবে তোমাকেই।
শ্রেষ্ঠ সমাজ-বিজ্ঞানী নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেন, “আল্লাহ সেই পুরুষকে অভিশাপ করেন, যে নারীর পোশাক পরিধান করে এবং সেই নারীকে অভিশাপ করেন, যে পুরুষের পোশাক পরিধান করে।” (আবু দাউদ, হাকেম, সহীহুল জামে ৫০৯৫ নং) তিনি বলেন, “পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, মেড়া পুরুষ এবং পুরুষের বেশধারিণী মহিলা জান্নাতে যাবে না।” (নাসাঈ, বাযযার, হাকেম ১৭২, সহীহুল জামে’ ৩০৬৩ নং) তিনি নিজেও পরস্পরের বেশধারী নারী-পুরুষকে অভিশাপ করেছেন। (বুখারী ৫৮৮৫ নং, প্রমুখ) এবং আরো বলেছেন যে, “সে পুরুষ আমাদের দলভুক্ত নয়, যে কোন নারীর সাদৃশ্য অবলম্বন করে। অনুরূপ সে নারীও আমাদের দলভুক্ত নয়, যে কোন পুরুষের সাদৃশ্য অবলম্বন করে।” (আহমাদ, সহীহুল জামে ৫৪৩৩ নং)
আমাদের সমাজের যুবকদলের মনকে যে শ্রেণীর মানুষ অধিকরূপে জয় ও আকৃষ্ট করতে পেরেছে, তারা হল ফিল্মী দুনিয়ার তারকা নায়ক-নায়িকারা। কাল্পনিক কাহিনীর অভিনয়ের মাধ্যমে তারা অধিকাংশ তরুণ-তরুণীর হৃদয়-কোণে বাসা বেঁধে নিয়েছে। এরা তাদেরকে এত ভালোবাসে যে, তাদের ছবি দিয়ে নিজেদের ঘর সাজায়, প্রাইভেট এ্যালবামে রাখে, তাদের ছবি ও খবর প্রকাশক পত্র-পত্রিকা সংগ্রহ করে সাগ্রহে পড়ে মনে আমেজ নিয়ে থাকে। জীবনের প্রতি পদক্ষেপে তাদের অনুকরণ করার চেষ্টা করে। যৌন-জীবনে তো বটেই, এছাড়া সামাজিক জীবনেও তারা হয় এদের একমাত্র আদর্শ। তারা চলচ্চিত্র জগতের তারা, এদের মনের আকাশের তারা, এদের চোখেরও তারা। আর সেই তারা দেখেই রাতের আঁধারে পথ নির্ণয় করে। তাদেরই অনুগ্রহ ও অনুকরণে তৈরী হয় মস্তান যুবক-যুবতী।
এক শ্রেণীর যুবক নজরে পড়ে, যাদের শার্ট বা পাঞ্জাবীর বুকের বোতাম খোলা, ফুলহাতা জামার হাত গুটানো, হাতে বালা বা সূতো বাধা, মাথায় এক ঝাকা চুল। তাদের পরনের লুঙ্গি, পায়জামা বা প্যান্ট রাস্তায় ঝাড়ু মেরে যায়। পিছন থেকে দেখে মনে মনে প্রশ্ন জাগে, ওটা ছেলে না মেয়ে? সামনে না এলে হয়তো বুঝাও যায় না। এদেরকে নাকি মস্তান’ বলে। মস্তান। হল ফার্সী শব্দ; যার অর্থ পাগল। তাহলে এরা কি আসলে পাগল? হ্যা ফিল্মের দেওয়ানা ও হিরো-হিরোইনের প্রেমে পাগল। অথবা তারা অন্যান্যদেরকে পাগল ভাবে। তাদের ঐ হিরোহিরো ভাবের মন বলে, আমাদের বুকে পাটা আছে, তাই বুক খুলে চলি। আমরা কোন নিয়ম বা আদব-কায়দা মানি না, কাউকে আদৌ ভয় করি না। খোলা বুকই তার প্রমাণ। বাহুতে আছে। প্রবল শক্তি, তার প্রমাণ হল হাতে বাধা সুতো অথবা লোহার বালা। চিত্র-তারকাদেরকে তারা এত ভালোবাসে যে, মাথা থেকে পা পর্যন্ত তাদেরই অনুকরণে গঠিত। তাদের নামে চুলের কাট, শার্টের কাট, প্যান্টের কাট, প্রভৃতি বড়ই প্রচলিত এদের কাছে।
তাদের প্যান্টের নীচ অংশ হাই হীল জুতার নীচ পর্যন্ত গড়ায়, পথের ময়লা প্যান্টের কাপড়ে সাফ হয়। তারা চক্কর-মক্কর রংগীন কাপড়ে জামা তৈরী করে সার্কাসের রংবাজ সাজে। মহিলাদের ব্লাউজের কাপড় ওরা দখল করেছে বলে মহিলারা এক রংগা কাপড়ে সংক্ষিপ্ত ব্লাউজ তৈরী করে মনের দুঃখে পেট বের করে চলেন। সোনা মানিকরা বুক উদাম করে চলে, আর তাদের সম-মনা মহিলারা পেট বের করে চলেন। তাদের কেউ কেউ স্বদেশী গান পরিবেশনের স্টাইল ছেড়ে দিয়ে পশ্চিমা কায়দায় কোমর দুলিয়ে গান করে বেড়ায়। ওরা পুরুষ হয়ে কোমর দুলিয়ে যখন গান গায়, তখন নাচনেওয়ালীরাও শরমে মুখ লুকায়। আসলে তারা বহুরূপী, তাই বিশেষ কোন এক রূপে তাদের দেখা যায় না।
অনুকরণে সোনামানিকরা বানরকেও লজ্জা দিয়েছে। এ জন্য স্বদেশী বানরকুলকে আমেরিকা নিতে চাইলেও ওদের নিতে চায় না। মাথার পিছনের দিকে তারা চুল এতই লম্বা রাখতে শুরু করেছে, যে জন্য ওদের সম-মনা মহিলারা সোনা-মানিকদের উপর রাগ করে লম্বা চুল কেটে বব কাটিং চুল রাখতে শুরু করেছে। হাতের নখ লম্বা রেখে ওরা বাঘ-ভাল্লুক সাজতে চাচ্ছে। তাদের এ অবস্থা দেখে আমরা যেমন ভয় করি, তেমনি মানবজাতির একাংশের পশুজীবনে ফিরে যেতে দেখে মনে দুঃখও পাই। (অপসংস্কৃতির বিভীষিকা ২৯পৃঃ)। এদের নাদুস-নুদুস চেহারা ও ভাব-ভঙ্গিমা দেখে মনে হয়, ওরা যেন কোন আমীরজাদা।
অথচ অনেক ক্ষেত্রে এমনও হয় যে, বাহিরে কেঁাচার পত্তন, ভিতরে ছুঁচোর কিত্তন। যৌবনের উন্মাদনায় এরা ধরাকে সরাজ্ঞান করে। বেপরোয়া হয়ে বুক ফুলিয়ে চলে, বগলে রেডিও বা টেপ, গাড়িতে টেপ অথবা বাড়িতে টেপ, রেডিও বা টিভির শব্দে পার্শ্ববর্তী লোকদের ঘুম ও ইবাদত নষ্ট করে, জ্বালাতনে মন তিক্ত করে। বিড়ি-সিগারেট খায় বড় সাহেবী স্টাইলে। কাউকে কিছু বলতে গেলে মুখের উপরে ধুয়ো ছেড়ে লাল চোখে তাকিয়ে শাসিয়ে থাকে! মস্তানীবশে অনেকের উপর অন্যায় স্বেচ্ছাচারিতা চালায়। জোর-যুলুম করে নারীর সতীত্বনাশ, শ্লীলতাহানি, মানী-গুনীর অপমান, কারো জায়গা জবরদখল, চাঁদাবাজি অথবা সেলামী’ আদায় করে থাকে।
অথচ যুলুম হল কিয়ামতের দিনের অন্ধকার। মযলুমের হৃদয় থেকে বিষ-জ্বালায় যে আঃ বা ‘উঃ শব্দ বের হয়ে আসে, তা যে মস্তানের জন্য সর্বনাশ ডেকে আনে তা হয়তো অনেকেই জানে না। মহানবী বলেন, “তোমরা মযলুমের বন্দুআ থেকে সাবধান থেকোযদিও সে কাফের হয়। কারণ, ঐ দুআ ও আল্লাহর মাঝে কোন অন্তরাল থাকে না।” (সহীহুল জামে ২৬৮২ নং) অর্থাৎ, সেই বদুআ যালেমের হক্কে সত্বর লেগে যায়। হে মস্তান বন্ধু যে অহংকার তুমি আজ প্রদর্শন করছ, যে গর্বের সাথে মাটির বুকে চলাফেরা করছ, জানো কি, তা তোমার জন্য পরকালে কত বড় সর্বনাশ ডেকে আনবে? যে হৃদয়ে সরিষা-দানা পরিমাণ অহংকার থাকে, সে হৃদয়ের মানুষ বেহেশ্ব যেতে পারবে না। অহংকারবশে যে সত্য প্রত্যাখ্যান এবং মানুষকে ঘৃণা করে, তাকে সাজা ভুগতে হবে দোযখে। (আহমাদ, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, সহীহুল জামে ৭৬৭৪ নং)
যে মানুষ অহংকারবশে পরনের কাপড় গাটের নীচে ঝুলিয়ে পরে মাটিতে হেঁচড়ে নিয়ে বেড়ায়, আল্লাহ তাআলা কাল কিয়ামতের দিন সে মানুষের দিকে তাকিয়েও দেখবেন না, তার সহিত কথাও বলবেন না, তাকে গোনাহমুক্ত বা ক্ষমাও করবেন না। আর তার জন্য হবে কঠিন শাস্তি। (মুসলিম ১০৬নং, আসহাবে সুনান) হে বন্ধু! উপদেশ গ্রহণ কর,“(অহংকারবশে) মানুষের প্রতি বিমুখ হয়ো না, (কাউকে অবজ্ঞা করো না) এবং পৃথিবীতে গর্বভরে চলো না। কেন না, আল্লাহ গর্বিত অহংকারীকে পছন্দ করেন না।” (সূরা লুকমান ১৮ আয়াত)
হ্যা, তোমার মস্তানীর ফলে কিছু লোক হয়তো তোমাকে বাহাদুরী দেবে। কিছু লোক দেবে সম্মান। কিন্তু তা কি তাদের অন্তর থেকে? না কি তোমার অনিষ্টের ভয়ে? দুশমনকে উচু পিঁড়ে দেওয়ার মত লোক তোমাকেও সম্মান করে না কি? যদি তাই হয় তাহলে শোন, প্রিয় নবী (সা.) বলেন, “সবচেয়ে নিকৃষ্ট লোক তারা, যাদের অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য তাদের তোয়া করা হয়।” (আবু দাউদ, সহীহুল জামে’ ৭৯২৩ নং)
আর “আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক কঠোর-হৃদয় দাম্ভিককে ঘৃণা করেন, যে বাজারে হৈ-হাল্লা ও গলাবাজি করে বেড়ায়, যে রাত্রে মড়ার মত ঘুমায় এবং দিনে গাধার মত মেহনত করে, যে পার্থিব জ্ঞান রাখে, কিন্তু পরকাল বিষয়ে অজ্ঞ থাকে।” (বাইহাকী ১০/ ১৯৪, সহীহুল জামে’ ১৮৭৮ নং) “শ্রেষ্ঠ তো সেই ব্যক্তি, যে তার আখলাক-চরিত্রে শ্রেষ্ঠ।” (ইবনে মাজাহ হাকেম, সহীহুল জামে ১১২৮ নং) “শ্রেষ্ঠ মানুষ হল সেই ব্যক্তি, যে অপরের সাথে মিশতে পারে এবং অপরেও তার সাথে মিশতে পারে।” (সহীহুল জামে' ২৩১ নং) অতএব তুমি কি চাও না সেইরূপ শ্রেষ্ঠ মানুষ হতে?
এক বন্ধু বলল, হুযুর! আমি মনে করি, আমরা অন্যায় করি না। অন্যায়ের প্রতিবাদ করি। জানেন না, লোহা দিয়ে লোহা কাটে? আমরা পড়ে থাকা ঋণ আদায় করে দিই, উপেক্ষিতা। নারীকে তার স্বামীর ঘরে বসিয়ে দিয়ে আসি; স্বামী তাকেই নিয়ে সংসার করতে বাধ্য হয়। জোর করে চাঁদা নিই ঠিকই, কিন্তু সেই টাকা দিয়ে অনেক গরীবদের খিদমত করি। বিধবাদের দেখাশোনা করি, গরীব মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিই। --- ইত্যাদি।
আমি বললাম, কিন্তু বন্ধু! পেশাব দিয়ে পায়খানা ধুয়ে লাভ কি? পায়খানার গন্ধ গেলেও পেশাবের দুর্গন্ধ ও নাপাকী তো আর কম নয়। উল্লেখিত ভালো কাজগুলোর জন্য যাকাত ও দান-খয়রাতের অর্থ আদায় করে ফান্ড তৈরী কর।
বলল, হুযুর। লোকে যাকাত দিলে ও দান-খয়রাত করলে কি আর আমাদেরকে মস্তানী করতে হত? সমাজই তো মস্তান তৈরী করে। পরিস্থিতির চাপে পড়েই অনেকে চোর-গুন্ডাবদমাশ হয়। বললাম, যা অন্যায় তা অন্যায়। কোনও সৎ উদ্দেশ্যে অন্যায় করা যেতে পারে না। যদিও বহু মস্তান অনুরূপ সৎ উদ্দেশ্য প্রকাশ করে অধিকাংশে নিজেদেরই প্রবৃত্তি-পূজা করে থাকে।
অতএব হে যৌবনমদে মত্ত মস্তান ভাই আমার। অসংযত চরিত্রকে সংযত করে মস্তানি ছাড়, যাতে পরে পস্তানি না হয়। উদ্ধৃঙ্খল চরিত্র ও দৈহিক বলের জোরে পাড়ায় পাড়ায় সরদারি করার নামে উপদ্রব ও যুলুম করে বেড়ায়ো না। কারণ, জেনে রেখো যে, মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর পাকড়াও বড় শক্ত। যখন ধরা খাবে, তখন জান ছুটানো দায় হয়ে পড়বে। একথা সুনিশ্চিত।
হে প্রাণচঞ্চল প্রাচী-র তরুণ, কর্মবীর!’ পরোপকারে ব্রতী হও, তবে নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে। কর্ম-বিমুখ হয়ে পরের ধনে পোদ্দারি বা সর্দারি করে নয়। হে ‘বগাহীন শৃঙ্খল-ছেড়া প্রিয় তরুণ! তুমি তোমার জীবনে শৃঙ্খলতা ফিরিয়ে এনে চেষ্টা কর, যাতে সমাজে খুন, ধর্ষণ, দুর্নীতি, অরাজকতা প্রভৃতির যুলুমবাজির সকল দরজা যেন চিরতরে রুদ্ধ হয়ে যায়। যেন বন্ধ হয়ে যায় দখলতন্ত্র বা লাঠি যার, মাটি তার’-এর নীতি। হে ‘অভয়-চিত্ত ভাবনা-মুক্ত’ যুবক বন্ধু আমার শান্তি ও শৃঙ্খলা কোথায় আছে জানো? শান্তি আছে সত্য বিশ্বাসে৷
শৃঙ্খলা আছে আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণে ও তার আনুগত্যে। শান্তির ধর্ম ইসলামের ছায়াতলে। দ্বীনের আশ্রয় নাও, তোমার সকল সমস্যার সমাধান সহজ হয়ে যাবে। সমাজের আকাশ থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় নেবে পাপ-ঝড়ে বয়ে আনা। অশান্তির বজ্ৰবাহী কালো মেঘ। অন্ধানুকরণের কথা ছাড়ার পূর্বে নায়িকাদের দেখাদেখি সাজা মস্তান যুবতীদের কথা আর বলে পারছি না। এ কথা বিদিত যে, ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা অধিক অনুকরণ-প্রিয়। একটা মডেল বা ফ্যাশন বাজারে নামলে তা ধরার জন্য ধৈর্য হারিয়ে ফেলে মেয়েরা।
বিশেষ করে আধুনিকারা অনুকরণ করে তথাকথিত প্রগতিবাদিনীদের; অর্থাৎ, যাদের নৈতিকতার গতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে তাদের। অনুকরণ করে যৌন-স্বাধীনতাকামীদের; অর্থাৎ, যারা উপচীয়মান যৌবনকে কেবল এক জনের অধীন করে রাখে না তাদের। তাই তো এমন যুবতীর কেশবিন্যাস সাধনার মত সাধনা কাটের অথবা বাবরের মত বাবরী কাটের। মালবিকার ন্যায় সিঁথিতে সিন্দুর, বিন্দিয়ার ন্যায় কপালে টিপ, কানে লম্বা বা রথের চাকার মত বড় দুল, কোন অভিনেত্রীর মত কপালের ভ্রু চিকন করে চাঁছা, এ ছাড়া চোখের জন্য, চোখের পাতার জন্য, গালের জন্য, ঠোটের জন্য পৃথক পৃথক ‘মেকআপ তো আছেই। পরনে আছে ইউ’ বা ‘ভি’ কাটিং-এর নকশা করা খাটো ব্লাউজ। পাতলা শাড়ির কেঁাচার থাক গোজা আছে নাভির নীচে। বুকের আঁচল খানাও বেশ থাক করে সুবিন্যস্তরূপে লম্বালম্বি বাম কাঁধে চাপানো আছে; যাতে সাইড থেকে বুকে-পেটে-পিঠে হাওয়া ও আলো পায় এবং ব্লাউজের ‘কাম’ দেখিয়ে চেংড়া’দের মনে কাম সৃষ্টি করা যায়। অথবা পরিধানে আছে আধুনিক কাটিং-এর শেলোয়ার-কামিস। ওড়না খানা ‘ফর শো’ বুকে থাকানো আছে।
আর এর চাইতে বেশী আলোকপ্রাপ্তা হলে উপর দিকে থাকে আধুনিক টাইট-ফিট অর্ধ বুক খোলা গেঞ্জি অথবা ব্লাউজ এবং নীচের দিকে চোস্ত প্যান্ট অথবা সংকীর্ণ স্কার্ট; যা হাঁটু অবধি খোলা। তার পরেও পিছন দিক হতে ইঞ্চি তিনেক কাটা! পক্ষান্তরে আরো অত্যাধুনিকা হলে পরে সিন্থিয়ার মত বগল-কাটা ব্লাউজ অথবা গেঞ্জি। হাতের আঙ্গুলগুলোতে আছে হ্যালেনের মত লম্বা-লম্বা নখ, তার উপর পুরু নখ-পালিশ। পায়ে আছে উচু পেনসিল-হিল জুতো।
এরপর চুলে আছে শ্যাম্পুর সুগন্ধ, গালে আছে ক্রিমের সুবাস, গলায় ও বুকে আছে পাওডারের সুঘ্রাণ, আর লেবাসে তো পারফিউম স্প্রে করা আছেই। অতঃপর কাধে একটি ভ্যানিটি ব্যাগ ঝুলিয়ে বাড়ির খাঁচা থেকে যখন বের হয়, তখন কি জানি কোন কাজে যায়, নাকি কারো বাসরে?
পক্ষান্তরে বিভিন্ন বাহারের অঙ্গসজ্জা করে আবেদনময়ী মস্তানা চলন ও অঙ্গভঙ্গি চুম্বকের আকর্ষণে পুরুষের দৃষ্টি ও মন লোহা যে আকৃষ্ট হবে, তা বলাই বাহুল্য। ফুল বর্ষণ হবে যৌনদৃষ্টি ও কুমন্তব্যের। অবশ্য এমন প্রসাধিকার এটাই তো আকাঙ্খা, এটাই তো লাভ। প্রগতির ঘোড়ায় চড়ে এরা চায় ভাব দেখিয়ে লাভ করতে যৌন আবেদন থাকে এদের চেহারা ও চরিত্রে, চলনে ও বলনে, আচরণ ও চাহনিতে, পোশাকে ও প্রসাধনে, ভাবে ও ভঙ্গিতে। এখানেই ঘায়েল হয়ে যায় বহু যুবক অথবা ঘায়েল হয় বহু এমন প্রসাধিকা আধুনিকারা। শুরু হয় প্রেম অথবা ঘটে যায় ধর্ষণ ও বলাৎকার।
আলোকপ্রাপ্তা যুবতীদের ছ্যাবলা পোশাক ও চাঞ্চল্য-ভরা আকর্ষণময় চলন নজরে পড়লে প্রিয় নবী (সা.) এর এক নবুয়ত-বাণী মনে পড়ে যায়; তিনি বলেন, “যদি তোমার লজ্জা না থাকে, তাহলে যা মন তাই করতে পার।” (আহমাদ, বুখারী, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, সহীহুল জামে’ ২২৩০ নং) অর্থাৎ, কেবল নির্লজ্জরাই এমন বেহায়ামী প্রদর্শন করতে পারে। এ ক্ষেত্রে এমন নারীদের জন্য আরো কয়েকটি মহাবাণী উল্লেখ করে এ প্রসঙ্গের ইতি টানব। মহানবী ও বলেন, 'প্রত্যেক চক্ষুই ব্যভিচার করে থাকে। আর মহিলা যদি (কোন প্রকার) সুগন্ধ ব্যবহার করে কোন (পুরুষদের) মজলিসের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে, তবে সে বেশ্যা মেয়ে।” (আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ প্রমুখ, সহীহুল জামে’ ৪৫৪০ নং)
তিনি বলেন, “দুই শ্রেণীর মানুষ দোযখবাসী হবে, যাদেরকে এখনো আমি দেখিনি। এদের মধ্যে দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ হল, সেই মহিলা দল; যারা কাপড় পরা সত্ত্বেও যেন উলঙ্গ থাকবে, এরা (পরপুরুষকে নিজেদের প্রতি) আকৃষ্ট করবে এবং নিজেরাও (তাদের প্রতি) আকৃষ্ট হবে। (চুলের খোপার কারণে) তাদের মাথা হবে হিলে যাওয়া উটের কুঁজের মত। তারা বেহেশু প্রবেশ করবে না এবং তার সুগন্ধ পর্যন্তও পাবে না; অথচ তার সুগন্ধ বহু বহু দূরবর্তী স্থান থেকে পাওয়া যাবে।” (মুসলিম ২ ১২৮ নং) তিনি বলেন, “তোমাদের সবচাইতে জঘন্যতম নারী হল তারা, যারা বেপর্দা, যারা অহংকারের সাথে অন্যের অনুকরণে নিজেদের অঙ্গসজ্জা ও বহুরূপ প্রদর্শন করে থাকে। ওরাই হল কল্পট নারী। এদের মধ্যে কিঞ্চিৎই কেউ বেহেস্তে যেতে পারবে।” (বাইহাকী ৭/৮২, সিলসিলাহ সহীহাহ ১৮৪৯ নং)
আর বন্য-সুন্দরী বাঘিনীদের উদ্দেশ্যে বলি যে, লম্বা নখ রাখা মানব-প্রকৃতির বিরোধী কর্ম। প্রিয় নবী (সা.) বলেন, “পাঁচটি কর্ম হল মানব প্রকৃতির স্বভাবসুলভ কর্ম; খতনা করা, লজ্জাস্থানের লোম চেঁছে ফেলা, মোছ ঘেঁটে ফেলা, নখ কেটে ফেলা এবং বগলের লোম দূর কর।” (বুখারী, মুসলিম, প্রভৃতি, সহীহুল জামে’ ৩২৫০ নং)
“আল্লাহর রসূল (সা.) মোছ ছাটা, নখ কাটা, বগলের লোম তুলে ফেলা এবং গুপ্তাঙ্গের লোম চেঁছে ফেলার ব্যাপারে সময় নির্ধারিত করেছেন; যাতে ৪০ দিনের বেশী সময় তা রেখে না দেওয়া হয়।” (আহমাদ ১২২, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ)।
আর পরিবারের মুরব্বী ও বাড়ির গুরুজন তথা অভিভাবকদেরকে মহানবী (সা.) এর এক মহাবাণী স্মরণ করিয়ে দিই। তিনি বলেন, “অবশ্যই আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক দায়িত্বশীল ব্যক্তির নিকট থেকে তার দায়িত্ব বিষয়ে (কিয়ামতে) কৈফিয়ত নেবেন; সে কি তা যথার্থ পালন করেছে, নাকি অবহেলা করে দায়িত্বে দেওয়া জিনিসকে নষ্ট করেছে? এমন কি পুরুষকে তার পরিবারের সকল সদস্যের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন।” (নাসাঈ, ইবনে হিব্বান, সহীহুল জামে' ১৭৭৪নং)