মরণের পরপারের কথায় অবিশ্বাসীদের এই ভোগবাদী পরিবেশে মুসলিমদের অবস্থাও বিপর্যস্ত। তারপর আবার ঘরের টেকি কুমীর। মুর্তাদ্দ বুদ্ধিজীবীরা; যারা নিজেদের কুবুদ্ধিকে ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে জীবিকা ও অর্থ অর্জন করে তাদের লেখনি, বক্তৃতা ও ব্যবহারেও মুসলিম যুবক কুহকগ্রস্ত। এদের মাধ্যমেই মুসলিম সমাজ ও পরিবেশ অধিক ক্ষতিগ্রস্ত। বাইরের শত্রু যত ক্ষতি সাধন করতে না পারে, তার চেয়ে বহুগুণ বেশী পারে ঐ মীরজাফরেরা।

আর বাইরের শত্রুরা এদেরকে ব্যবহার করে, এদের বুদ্ধিকে ক্রয় করে নিয়ে কাঁটা দিয়ে কঁটা তোলার কাজ করিয়ে নেয়। তাদের শক্তিশালী প্রচারমাধ্যমে তাদেরকেই সমাজসেবী। বীর-বাহাদুররূপে চিত্রিত করে।

ভাইজান! যদিও এই শ্রেণীর মানুষদের নিকট থেকে গোড়া-রক্ষণশীল’ বলে অনেক গালি ও কটাক্ষ শোনা যায়, তবুও তুমি মনে মনে আল্লাহর আদেশ পালনে গর্ববোধ করো। আর তাদের ঐ কথায় কর্ণপাত না করে ভেবো, কুত্তা হুঁকতা রহেগা, আওর হাথী চলতা রহেগা।

মুসলিম আজ সুপরিকল্পিতরূপে হিংসা ও পরশ্রীকাতরতার শিকার। মুসলিমের অমূল্য ধন চরিত্র ও নৈতিকতা দেখে সারা বিশ্বের চোখ-টাটানি রয়েছে ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই। তাছাড়া এমনিতেই মানুষ এক অপরের ভালাই দেখতে পারে না। হাসলে বলে, লোকটা প্রগম্ভ। কাঁদলে বলে, ছিচকাদুনে। বেশী কথা না বললে বলে, গোমরামুখে। কথা বললে বলে, গপে। সহ্য করলে বলে, ভীরু। প্রতিশোধ নিলে বলে, অসহিষ, সন্ত্রাসী। ভালোর চেষ্টা থাকলেও মানুষ তাকে মন্দ আখ্যা দিতে দেরী করে না। দেখতে না পারলে চলন বাঁকা লাগে। চোখে। অবশ্য এর মুলে থাকে ভুল বুঝাবুঝি ও কুধারণা মাত্র।

ইসলামের প্রতি কিছু সাধারণ শিক্ষিত মানুষদের নাক-সিঁটকানির একটি কারণ এই যে, তারা মনে করেন, ইসলাম অন্যান্য ধর্মের মত একটি ধর্ম অথবা মতবাদ। অন্যান্য ধর্মের বিভিন্ন তথ্য যেমন বিজ্ঞানের সাথে সংঘর্ষ বাধিয়েছে এবং বিজ্ঞানের বৈজ্ঞানিক ও বাস্তব তথ্য প্রকাশ করে বহু বৈজ্ঞানিককে ধর্মযাজকদের হাতে নিগৃহীত হতে হয়েছে -যেমন হয়েছে। গ্যালিলিও প্রভৃতি বৈজ্ঞানিকের সাথে -তেমনি ইসলামেরও বহু তথ্য আছে যা অবৈজ্ঞানিক।

আসলে তারা কিন্তু নিছক ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে মধুকে মদ মনে করেছেন। তুলনা । করেছেন দুধকে আলকাতরার সাথে। তাদের চুন খেয়ে গাল তেঁতেছে, তাই দই দেখেও ভয়। পাচ্ছেন! অথচ তারা যদি নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আল্লাহর প্রতি ঈমান রেখে ইসলাম ও তার সংবিধান

কুরআন ও সহীহ হাদীস এবং উভয়ের সঠিক ব্যাখ্যা নিয়ে বিবেচনা-গবেষণা করতেন, তাহলে অন্ততঃপক্ষে তাদের সে ভুল ধারণা ও সন্দেহের মেঘ মনের আকাশ থেকে পরিষ্কার হয়ে যেত। আর ঊর্ধ্বপক্ষে তারা প্রমাণ করতে পারতেন যে, ইসলাম কোন বিকৃত ধর্ম বা মানব-রচিত মতবাদের নাম নয়। বরং ইসলাম হল মহান সৃষ্টিকর্তা মহাবৈজ্ঞানিক আল্লাহর তরফ থেকে সমগ্র মানবজাতির জন্য একটি অক্ষত জীবন-ব্যবস্থা। আর তার সাথে তাদের দুই দেখে সেই ভয় দূর হয়ে যেত; যে ভয় চুন খেয়ে গাল তাতার ফলে সৃষ্টি হয়েছিল।

বিশ্বপরিচালনা করার মত শক্তি কোন ধর্মের না থাকলেও ইসলামের আছে। যেহেতু ইসলাম হল সমগ্র মানবমণ্ডলীর জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন-বিধান। মানব-জীবনের সকল প্রকার সমস্যার পূর্ণ সমাধান এক ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্মে নেই। তাই তো খৃষ্টধর্মাবলম্বী হয়েও আমেরিকার এক গবেষক লেখক মাইকেল এইচ হার্ট’ তার 'দি হানড্রেড’ নামক প্রসিদ্ধ পুস্তকে মহানবী মুহাম্মাদ (সা.)-কে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানব বলে স্বীকার করেছেন এবং একশত মনীষীর মধ্যে তাকেই ঐ পুস্তকের প্রথমে স্থান দিয়েছেন। আর এর কারণ উল্লেখ করে বলেছেন যে, অন্যান্য মনীষী ছিলেন শুধু জাগতিক অথবা শুধু ধার্মিক নেতা। কিন্তু মুহাম্মাদ ই ছিলেন জাগতিক এবং ধার্মিক উভয় ক্ষেত্রের পুরোধা। (শ্রেষ্ঠ ১০০, ৪পৃঃ)

সুতরাং অন্য ধর্মের ব্যর্থতা দেখে অনুমান করে এ ধারণা এক প্রকার অজ্ঞতা যে, অন্য ধর্ম যা পারেনি, তা ইসলামও পারবে না। অথবা অন্যান্য ধর্মমতের অনুরূপ ইসলামও একটা ধর্মমত। বরং প্রকৃত বাস্তব এই যে, ইসলাম হল স্বয়ংসম্পূর্ণ, আত্মনির্ভরশীলতায় পরিপূর্ণ একটি শ্বাশত ও চিরন্তন ধর্ম।

বহু যুবকই ঐ শ্রেণীর হীনম্মন্যতার শিকার হয়ে পড়েছে। পরিবেশের বিষাক্ত ধুয়া নাকেমুখে লেগে তাদের শ্বাসরোধ করে ফেলেছে। এর একটি ছোট্ট উদাহরণ হল দাড়ি রাখার ব্যাপার। মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলা আমাদের সারা দেহে বিভিন্ন ধরনের লোম সৃষ্টি করেছেন। বান্দার কাছে আনুগত্যের পরীক্ষা নেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি কিছু লোম ছাঁটতে, কিছু চেঁছে ফেলতে, কিছু সৌন্দর্যের সাথে বহাল তবীয়ত ছেড়ে রাখতে আদেশ করেছেন; আর তা অবৈজ্ঞানিক নয়। কারণ আল্লাহ বিজ্ঞানময় সৃষ্টিকর্তা। “সৃষ্টি ও নির্দেশ কেবলমাত্র তাঁরই। বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহ মঙ্গলময়।” (সূরা আ'রাফ ৫৪ আয়াত) এবারে তার আদেশ। হল দাড়ি রাখা। যা পুরুষের প্রতীক, সকল মহামনীষীদের আদর্শ এবং মুসলিমের জন্য (কমপক্ষে এক মুষ্ঠি পরিমাণ) ওয়াজেব। কিন্তু পরিবেশের চাপে মুসলিম তা অস্বীকার করতে চায়। কেউ বুকের দিকে ইঙ্গিত করে বলে, 'ঈমান তো এখানে। অর্থাৎ, মুখে নয়, বুকে। আর তার মানেই হল, বুকে ঈমান রাখাই যথেষ্ট। কাজে পরিণত না করা বা আল্লাহ ও তদীয় রসুলের বিরুদ্ধাচরণ করা কোন প্রকার ক্ষতিকারক নয়! অথচ ঈমান হল, বুকে বিশ্বাস, মুখে স্বীকার এবং কর্মে পরিণত করার নাম।

কেউ কেউ বলে, সে যুগে ব্লেড ছিল না, তাই লোকে দাড়ি রেখে নিত। অর্থাৎ, সে যুগে ব্লেড থাকলে তারাও দাড়ি রাখত না এবং এ যুগে ব্লেড আছে, তাই দাড়ি রাখাটা যুক্তিহীন। অবশ্য এ কথা বলা মূর্খামি বৈ কিছু নয়। যেমন বহু মূখ বলে থাকে, সে যুগে লোকেরা খেতে পেত না বলে রোযা রাখত। তাছাড়া উপবাস করতে হবে কেন?! অথচ জ্ঞানী মাত্রই

জানেন যে, দাড়ি রাখার সাথে সাথে কিছু লোম না রাখারও আদেশ দেওয়া হয়েছে। গুপ্তাঙ্গ ও তার চারিপাশের লোম চেঁছে পরিষ্কার করার জন্য ৪০ দিন সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। অতএব সে যুগেও যে চাঁছা-ছিলার ব্যবস্থা ছিল তা বলাই বাহুল্য।

এই পরিবেশগত কারণেই বহু মহিলা পুরুষের মুখে দাড়ি পছন্দ করে না। তাই তো অনেক স্বামী পছন্দ সত্ত্বেও শুধুমাত্র ‘মিসেস'কে খুশ করার জন্য মহানবী ৪ এর আদেশ লংঘন করে তার আনুগত্য বরণ করে নেয়।

অমুসলিম পরিবেশে বয়সে হাজার ছোট হলেও দাড়ি রাখলেই বয়োজ্যেষ্ঠদের নিকট থেকেও ‘চাচা’ ব্যঙ্গ শুনতে হয়। অনেকে বিশ্বকবির অনুকরণে আব্দুল মাঝির মত সকলকেই এক নজরে মুখে ছুঁচলো দাড়ি, কামানো গোঁফ এবং নেড়া মাথা থাকা অবস্থায় দেখতে পায়। তাই বহু মুসলিম যুবক শুধু কাফেরদের ঐ শ্রেণীর বিদ্রুপের কাছে পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে ইচ্ছা সত্ত্বেও আর দাড়ি রাখতে পারে না। অথবা রাখলেও ফ্যাশন মত কেটে-হেঁটে বাদ দিয়ে রাখে। আর ঐ একই কারণে অনেকে চাকরি পাওয়ার আগে পুরুষের পৌরুষ ও দাড়ি নষ্ট করে ফেলে।

অবশ্য অনেকে এর দায়ে লড়াইও করে থাকে। যেমন এক যুবক বাসের সীটে বসে আছে। সীট বলে রাখার জন্য বাপের বয়সের এক লোক তাকে ব্যঙ্গচ্ছলে জিজ্ঞাসা করল, 'ও চাচা! তুমি কোথায় নামবে?’ অমনি যুবক চকিত হয়ে বলে উঠল, 'ভাইপো! আমি অমুক বাসষ্ট্যান্ডে নামব। ভাবী কেমন আছে?’ বয়স্ক লোকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ভাবী কে?’ যুবকটি বলল, কেন? তোমার মা। তুমি না আমার ভাইপো?' লোকটি বলল, তুমি রাগছ কেন? দাড়িওয়ালা লোকদেরকে তো চাচা বলা হয়। যুবক বলল, 'তাহলে রবি ঠাকুর তোমার কোন চাচা ছিল? মুনি-সাধুরাও কি তোমার এক একটি চাচা?’ লোকটি স্তম্ভিত হয়ে ভুল স্বীকার করতে বাধ্য হল। হয়তো সে এ ভুল আর কোন দিন। করবে না।

এক সহপাঠী তার মুসলিম সহপাঠীকে বহুদিন পর সাক্ষাৎ হলে বলল, কিরে তুই এই বয়স থেকে দাড়ি ছেড়ে বুড়ো সাজলি কেন?’ মুসলিম যুবক উত্তর দিল, বুড়ো সাজার জন্য নয় রে, পুরুষ সাজার জন্য দাড়ি ছেড়েছি।' সেই সহপাঠীও সেদিন তওবা করেছিল। কিন্তু নরম জায়গায় বিড়ালের আঁচড় যে বড় সুবিধা।

আসলে মুসলিমদের উচ্চ ও দৃঢ় মনোবল নেই বলেই তাদেরকে নিয়ে লোকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে। তাদের ঐ পা-চাটা বহুরূপী মন-মানসিকতাই অন্যের নিকটে তাদের ওজন হাল্কা করে দিয়েছে। যে মুসলিমদের কথা ছিল, আল্লাহ ছাড়া আর কারো দাসত্ব করবে না, সেই মুসলিমরা আজ সৃষ্টির দাসে পরিণত হয়ে গেছে। অর্থ ও গদির লোভে নিজের স্বকীয়তা বর্জন করতে পর্যন্ত রাজী হয়েছে। হয়তো কোনদিন যদি এর জন্য খাসি হতে হয় তাও হবে!

পক্ষান্তরে রাজনৈতিক যে মর্যাদাতেই উন্নীত হোক না কেন, কোন শিখ তার ধর্মীয় প্রতীক পাগড়ী ও দাড়ি বর্জন করে না। তবুও কই, তাদেরকে কেউ চাচা” বলে না, বলতে পারে না। কারণ, তাদের আছে সুদৃঢ় মনোবল, সুউচ্চ আত্মমর্যাদা এবং ধর্মীয় প্রতীকের প্রতি পরম শ্রদ্ধা ও চরম গুরুত্ব। কিন্তু মুসলিম হীনম্মন্যতার শিকার। নিজেদের কাছে নিজেরাই নীচ,

হীন ও নিকৃষ্ট। অপরের কাছে নিজেদেরকে নেহাতই ছোট ও লাঞ্ছিত ভাবে। যে জাতি সর্বের সেরা ও সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী হয়ে আল্লাহ-প্রদত্ত খেলাফতের দায়িত্ব পালন করতে পৃথিবীতে এসেছিল, যে জাতি আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে নতি স্বীকার করতে জানত না, যে জাতির জন্য মহান প্রতিপালকের ঘোষণা ছিল, “তোমরা নিজেদেরকে হেয় মনে করো না। এবং চিন্তিত হয়ো না। তোমরাই হবে (পৃথিবীর) সর্বোপরি, যদি তোমরা মুমিন হও।” (সূরা আ-লি ইমরান ১৩৯ আয়াত) সেই জাতির অবস্থা এই যে, সে নিজের চোখে নিজেকে ছোট ও নীচ এবং অপরকে বড় ও সমুন্নত দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। আজ শুধু মনের ভিতর প্রশ্ন জাগে যে, কোথায় সে জাতি, ভিখারীর বেশে খলীফা যাদের শাসন করিল আধা জাহান’? কোথায় সে জাতি, যে জাতির শিক্ষা ছিল,

‘আল্লাহর কাছে কখনো চেয়ো না ক্ষুদ্র জিনিস কিছু,

আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে শির করিও না নিচু।

আজ মনে শুধু প্রশ্ন জাগে,

‘আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান কোথা সে মুসলমান,

কোথা সে আরিফ, অভেদ যাহার জীবনে-মৃত্যু-জ্ঞান?

যার মুখে শুনি’ তৌহিদের কালাম,

ভয়ে মৃত্যুও করিত সালাম।

যাহার দ্বীন রবে কাপিত দুনিয়া জি-পরি-ইনসান।

স্ত্রী-পুত্রে আল্লারে সঁপি’ জিহাদে যে নির্ভিক,

হেসে কুরবানী দিত প্রাণ যারা, আজ তারা মাগে ভিখ?

কোথা সে শিক্ষা আল্লাহ ছাড়া,

ত্রিভুবনে ভয় করিত না যারা।

আজাদ করিতে এসেছিল যারা সাথে লয়ে কুরআন।

আসলে আজকের মুসলিম মানসিক আগ্রাসন ও পরাজয়ের শিকার। তাই নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয় দিতেও লজ্জাবোধ করে! বাঘের বাচ্চা ছাগের পালে পড়ে নিজেকে ছাগ থেকেও ছোট ও হেয় মনে করে নিয়েছে। হিরার টুকরা মাটিতে পড়ে ধূলিধূসরিত হয়ে নিজের পরিচয় ভুলে গিয়ে নিজেকে মাটির ঢেলাই মনে করেছে। অথচ ‘মুসলিম’ বলে পরিচয় দিতে তার গর্ব হওয়া উচিত ছিল।

মহান আল্লাহ বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি মানুষকে আহ্বান করে, সৎকাজ করে এবং বলে, আমি একজন (আত্মসমর্পণকারী) মুসলিম’, সে ব্যক্তির কথা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট কথা। আর কার?” (সূরা ফুসসিলাত ৩৩ আয়াত)। কিন্তু যে শক্তিবলে সে নিজেকে মু'মিন’ ও ‘মুসলিম’ বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করবে, সে শক্তি ঈমান’ ও ‘ইসলাম’ যদি তার মন, কথা ও কাজে দুর্বল বা বিলীন থাকে তাহলে সে নিজেকে গোপন করবে না কেন? যে দেশের রচিত বিকৃত ইতিহাস তার চেহারাকে কালিমাময় করে ফেলেছে সে দেশে নিজ চেহারাকে ঢেকে রাখার চেষ্টা করবে না তো আর কি করবে? ইতিহাসের পর্দা তুলে কে তার আসল পরিচয় জেনে মনের মাঝে সে হারানো শক্তি ফিরিয়ে আনবে?

হে ভাই যুবক! পারবে না কি তুমি তোমার বদনামকে সুনামে পরিণত করতে? অবশ্যই পারবে। অতএব সে শক্তি আনয়ন কর, যে শক্তি ছাড়া তুমি হীন ও ক্ষীণ। যে শক্তি পরমাণু বোমা থেকেও অনেক শক্তিমান। অতঃপর যেখানেই থেকো, যে পরিবেশেই থেকো, মাথা উঁচু করে বলে, 'আমি মুসলিম। বুক ফুলিয়ে বলো, আমি মুসলিম। জোর গলায় বলো, আমি মুসলিম। গর্বের সাথে বলো, ‘আমি মুসলিম। মনের তৃপ্তির সাথে বলো, আমি মুসলিম। নির্ভয়ে বলো, আমি মুসলিম। নির্দ্বিধায় বলো, আমি মুসলিম। হিম্মতের সাথে বলো, 'আমি মুসলিম। মনের সকল সংকোচ কাটিয়ে বলো, আমি মুসলিম। জিহ্বার জড়তা কাটিয়ে বলো, আমি মুসলিম। আমি সেই সত্তার নিকট আত্মসমর্পণকারী, যিনি বিশ্বজাহানের সৃজনকর্তা ও দয়াময় পালনকর্তা।

কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, তুমি যদি কেবল নামসর্বস্ব মুসলিম হও, অন্তঃসারশূন্য মুসলিম হও অথবা ঈমানবিহীন মুনাফিক হও, তাহলে সে সৎসাহস, সে তৃপ্তি, সে গর্ব আসবে কোত্থেকে? পায়খানায় বসে তো আর মৌমাছির পরিচয় দেওয়া চলে না ভাই! বন্ধু আমার! এত লোক, এত সমাজ, এত ধর্ম ও জাতির মধ্যে একমাত্র তুমিই শ্রেষ্ঠ জাতি, সে কথা কোন সময়ের জন্য ভুলে বসো না। কুরআন সাক্ষ্য দেয়, “তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি; তোমরা মানবমন্ডলীর জন্য উদ্ভূত হয়েছ। তোমরা সৎকাজের আদেশ দেবে এবং মন্দকাজে বাধা দেবে। আর আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখবে।” (সূরা আ-লি ইমরান ১১০ আয়াত) “এভাবেই আমি তোমাদেরকে এক আদর্শ মধ্যপন্থী জাতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছি; যাতে তোমরা মানবজাতির জন্য সাক্ষীস্বরূপ হতে পার।” (সূরা বাক্বারাহ ১৪৩ আয়াত) আর মহানবী #$ বলেন, “ইসলাম চির উন্নত, অবনত নয়।” (দারকুনী বইহাকী, সহীহুল জামে’ ২৭৭৮ নং)

সুতরাং মুসলিম হেয় নয়, তুচ্ছ নয়, নয় অবজ্ঞার পুতুল। শত হালাকুর হালাকের মুখে শত শতবার ভেঙ্গে পড়েছি, তবুও আমি আমার স্বকীয়তা নিয়ে জীবিত আছি। কত ফেরআউনের কুটিল চক্রান্ত আমাকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছে, তবুও আমি মুসার অনুসরণ করে আজও টিকে আছি। কত ঝড়-ঝঞ্চার মুখে উড়ে-উড়ে আঘাত খেয়েছি, তবুও সেই ঘাত-প্রতিঘাতের প্রবল দ্বন্দ্বের মাঝে আমি বিলীন হয়ে যাইনি। শত বাতিলের তুফান এসে আমাকে বিনাশ করতে চেয়েছে, তবুও আমি সবকিছুকে উল্লংঘন করে পাহাড়ের মত অটল থেকেছি। আর এইভাবে বাতিলের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে এবং আঘাত খেতে খেতে আমি কিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত টিকে থাকব দুনিয়াতে। কেউ নিশ্চিহ্ন করতে পারবে না আমাকে।

কি দোষ আমার যে, সে দায়ে আমি অত্যাচারের নির্মম আঘাত সহ্য করব? কেন আমাকে গৃহহীন ও দেশছাড়া করার এত কুটিল চক্রান্ত? আমিও তো ঐ জালেমদের মতই একজন মানুষ। হয়তো আমার অপরাধ এই যে, আমি সত্যের আহ্বানে সাড়া দিয়েছি। আমি আমার ও সারা সৃষ্টির স্রষ্টারই কেবল ইবাদত করে থাকি। এ দোষেই কি আমি আমার মাতৃভূমি থেকে বহিস্কৃত হব?

এ পৃথিবীর আসল উত্তরাধিকারী হল মুসলমান। এ পৃথিবী সুসজ্জিত ও সুশোভিত আছে

শুধু মুসলিমদের জন্যই। মুসলমান ধ্বংস ও নিঃশেষ হলে পৃথিবী ধ্বংস ও নিঃশেষ হয়ে যাবে। যতদিন পৃথিবীতে একটিও মুসলিমও বেঁচে থাকবে ততদিন পৃথিবীও মহাপ্রলয়ের কবলিত হবে না। (মুসলিম, মিশকাত ৫৫১৬ নং)

তাওহীদ কী আমানত সীন মে হ্যায় হামারে

আসা নেই মিটানা নাম ও নিশা হামারা।

সুতরাং যারা মুসলিমদের ধ্বংস কামনা করে, যারা দুনিয়া থেকে মুসলিমদের নাম ও নিশানা মিটিয়ে দিতে চায়, যারা ইসলামকে মানবতার শত্রু মনে করে, সে হিংস্র মানুষেরা জানে না। যে, তারা সেই হিংসুক শিয়ালের মত, যে একদিন একটি কাককে গাছের মগডালে বসে থেকে মনের সুখে কা-কা করতে দেখে হিংসা-জ্বালায় ফেটে পড়ে বলেছিল, ঈশ্বর একটি আকাশ-তুলতুল তুফান দেয়, তাহলে শালার কাক কোথায় থাকে তাই দেখব! অথচ শিয়াল। মশায় নিজের কথাটা ভুলেই গেছে। সে এ কথাটা মনে ভেবেও দেখেনি যে, আকাশ-তুলতুল তুফানে গাছপালা ধংস হলে বা ডুবে গেলে কাক ধংস হওয়ার আগে সে নিজে ধংস হয়ে যাবে। গাছের মগডালে পানি পৌঁছনর আগেই তার গর্তের ভিতরে যে পানি থৈ-থৈ করবে সে কথা হিংসার বিষ-জ্বালায় ভাবতেও সযোগ পায়নি।

ভাই মুসলিম যুবক! তুমি যে পরিবেশেই থাক না কেন, নিজের মাথা উঁচু রেখো; তবে অহংকারী হয়ো না। তুমি তোমার ব্যবহার ও পরিবেশকে এমন নোংরা করে রেখো না, যাতে তা দেখে ইসলাম থেকে মানুষ দূরে সরে যায়, বা দূর থেকেই ইসলামের নাম শুনেই নাক সিটকায়। এ জগতে বহু মানুষ আছে, যারা ইসলামকে মনে-প্রাণে পছন্দ করে; কিন্তু ইসলামকে দ্বীনরূপে গ্রহণ করে না। এ শ্রেণীর মানুষের ইসলাম গ্রহণ না করার যে বিভিন্ন কারণ রয়েছে তার মধ্যে একটি কারণ হল, বহু মুসলিম পরিবেশের অবাঞ্ছিত নোংরা ব্যবহার এবং অনেক ফাসেক মুসলিমের বিভিন্ন অনাচার ও দুরাচার। মুসলিমদের দুরবস্থা দেখেই তারা ইসলাম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ হয় না। অনেকে অতি পিপাসায় পিপাসার্ত হয়ে দুর দুর থেকে কাজল-জলা দীঘির সন্ধান পেয়েও তার পানির উপর মড়া ভাসতে দেখে আর সে পানি পান করতে রুচিবোধ করে না। ইসলামে মুগ্ধ। হয়েও মুসলিমদের বেআমল পরিবেশ দেখে দূর থেকে দূরেই সরে যায়।

অবশ্য এ শ্রেণীর মানুষেরা যে জ্ঞানী মানুষ তা নয়। হীরের টুকরা যদি কারো দোষে কর্দমাক্ত হয় এবং তাতে কাদা দেখে যে হীরে কুড়িয়ে নেয় না সে জ্ঞানী হয় কি করে? ‘ছুঁচোর গলায় চন্দ্রহার’ দেখে কেউ সে হার বরণ করতে নারাজ হলে সে জ্ঞানী নয়। যে হক দেখে ব্যক্তি। চেনে না; বরং ব্যক্তির মুখ দেখে হক চিনতে চায়, তাকে কেউ জ্ঞানী বলতে পারে না। জ্ঞানী। হল সেই ব্যক্তি, যে কাদা পরিষ্কার করে হীরের টুকরা কুড়িয়ে নেয় এবং ছুঁচোর কারণে চন্দ্রহারের কদর কম মনে করে না। সেই হল জ্ঞানী, যে হক দেখে পরিবেশের বিচার করে; পরিবেশ দেখে হকের বিচার নয়।

মদীনা ইউনিভার্সিটির এক প্রফেসর আমার ওস্তায ডক্টর যিয়াউর রহমান আযমী সাহেব যখন ইসলাম গ্রহণ করেন, তখন তার কর্তৃপক্ষ ও আপনজনেরা তাতে প্রতিবাদ জানিয়ে নানা প্রলোভন ও প্রচেষ্টার বলে স্বধর্মে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল। কিন্তু তবুও তিনি হক থেকে এতটুকু বিচলিত হননি। তাকে বলা হয়েছিল, 'ধর্ম পরিবর্তন করার ইচ্ছা যদি তোমার একান্তই ছিল, তাহলে ইসলাম কেন? ইয়াহুদী বা খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করলেই তো পারতো।

আজ সারা বিশ্বে তাকিয়ে দেখ, ইয়াহুদী ও খৃষ্টানরা জ্ঞান-বিজ্ঞান ও অর্থ-সম্পদের দিক থেকে কত উন্নত ও সমৃদ্ধ। আর মুসলিমদের অবস্থা তো অধঃপতনের অতল তলে। তাদের ব্যবহার ও পরিবেশ দেখেও কি তাদের ধর্মেই দীক্ষিত হতে উদ্বুদ্ধ হলে?

আমার ওস্তায় বলেন, এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েও আমি সকলের সামনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলেছিলাম, আমি আসলে মুসলমান ও তাদের পরিবেশ দেখে ইসলাম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ হইনি। আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি কেবল ইসলামের সৌন্দর্য দেখেই। যত ধর্ম পৃথিবীতে ছিল বা আছে তার কিছু আল্লাহর তরফ থেকে হলেও তার শেষ ও মনোনীত ধর্ম হল ইসলাম। বিজ্ঞানের যুগে এই ছোট্ট গ্রামের মত পৃথিবীতে একটা ধর্মই যথেষ্ট। তাছাড়া অন্যান্য ধর্মে ভেজাল ও বিকৃতি অনুপ্রবেশ করে তার আসলত্ব বিলীন করে ফেলেছে এবং সকল ধর্মের ধর্মগ্রন্থেই এই সর্বশেষ ধর্মের অনুসরণ করার আদেশ রয়েছে। এই সকল সত্যকে উপলব্ধি করেই জ্ঞানী-গুণীরা ইসলাম গ্রহণ করেন। এবারে সে সত্য ধর্মের অনুসারীরা যদি তার সঠিক অনুসরণ না করে চলে, তাতে সত্যের কি আসে-যায়? সত্য যা তা অম্লান আছে, তা বরণ করে নিজেকে সত্যের অনুসারী করার অধিকারী তো প্রত্যেক মানুষের আছে।