সাধারণতঃ লোকেরা নবী-রাসূলগণকে ধর্মনেতা হিসাবেই ভাবতে অভ্যস্ত। যারা দুনিয়াদারী থেকে সর্বদা দূরে থাকেন ও কেবল আল্লাহর যিকরে মশগূল থাকেন। আসলে ব্যাপারটি ঠিক তা নয়। বরং তাঁরা মানুষকে তার সার্বিক জীবনে শয়তানের দাসত্ব হ’তে মুক্ত করে আল্লাহর দাসত্বে ফিরিয়ে নিতে সর্বদা প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। বিভিন্ন যুগে নবী-রসূলগণ যে নির্যাতিত হয়েছেন, তা ছিল মূলতঃ তাদের আনীত ধর্ম বিশ্বাসের সাথে মানুষের মনগড়া ধারণা ও রীতি-নীতি সমূহের মধ্যে বিরোধ হওয়ার কারণেই। তবে হযরত মূসা (আঃ)-এর সঙ্গে ফেরাঊনের সংঘর্ষ ধর্মবিশ্বাসগত হওয়া ছাড়াও নির্যাতিত বনু ইস্রাঈলদের মুক্তির মত রাজনৈতিক বিষয়টিও জড়িত ছিল। কেননা বনু ইস্রাঈলকে ফেরাঊনের গোত্র ক্বিবতীরা দাস-দাসী হিসাবে ব্যবহার করত এবং তাদের উপরে অমানুষিক নির্যাতন চালাত। মূসা (আঃ) তাদেরকে ফেরাঊনের কবল থেকে মুক্ত করে তাদের আদি বাসস্থান শামে ফেরৎ নিতে চেয়েছিলেন। হযরত ঈসা (আঃ)-এর দাওয়াতের মধ্যে রাজনীতির নাম-গন্ধ না থাকলেও সমসাময়িক রাজা তাঁর জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে এবং ইহূদীদের চক্রান্তে তাঁকে হত্যা করার প্রয়াস চালান। কেননা ইহূদীরা হযরত ঈসা (আঃ)-কে নবী হিসাবে মানেনি। উপরন্তু তাওরাতের কিছু বিধান পরিবর্তন করায় তারা তাঁর ঘোর দুশমন ছিল। ফলে আল্লাহ ঈসা (আঃ)-কে আসমানে জীবিত উঠিয়ে নেন (আলে ইমরান ৩/৫৫; নিসা ৪/১৫৭)।
পক্ষান্তরে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) দুনিয়াতে প্রেরিত হয়েছিলেন মানবজাতির জন্য উসওয়ায়ে হাসানাহ বা ‘সর্বোত্তম নমুনা’ হিসাবে (আহযাব ৩৩/২১)। সেকারণ মানবজীবনে প্রয়োজনীয় সকল কল্যাণকর বিষয়ে সর্বোত্তম আদর্শ হিসাবে আল্লাহ তাঁকে প্রেরণ করেন। ফলে তিনি একাধারে ধর্মনেতা, রাজনৈতিক নেতা, সমাজনেতা, অর্থনৈতিক বিধানদাতা, সমরনেতা, বিচারপতি এবং বিচার বিভাগীয় নীতি ও দর্শনদাতা- এক কথায় বিশ্ব পরিচালনার সামগ্রিক পথপ্রদর্শক হিসাবে আল্লাহ তাঁকে প্রেরণ করেছিলেন এবং সেটা তিনি বাস্তবে দেখিয়ে গিয়েছিলেন। সেদিক দিয়ে বিচার করলে মুহাম্মাদ (ছাঃ) বিগত সকল নবী থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য, গুণাবলী ও বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।
একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তি নিয়মিত তাহাজ্জুদগোযার এবং নফল ছিয়াম ও ই‘তিকাফকারী রাসূলকে পাবেন শ্রেষ্ঠতম আধ্যাত্মিক নেতা হিসাবে। আগে-পিছে সব গোনাহ মাফ হওয়া সত্ত্বেও নৈশ ইবাদতে মগ্ন থাকা ও ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, أَفَلاَ أَكُوْنُ عَبْدًا شَكُوْرًا؟ ‘আমি কি একজন কৃতজ্ঞ বান্দা হব না’?[1] একজন রাজনীতিক তার পথ খুঁজে পাবেন হোদায়বিয়ার সন্ধিতে ও মক্কা বিজয়ী রাসূল (ছাঃ)-এর কুশাগ্রবুদ্ধি ও দূরদর্শী রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মধ্যে। একজন অকুতোভয় সেনাপতি তার আদর্শ দেখতে পাবেন বদর-খন্দক-হোনায়েন বিজেতা সেনাপতি মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর সমর কুশলতার মধ্যে। একজন সমাজনেতা তার আদর্শ খুঁজে পাবেন মক্কা ও মদীনার কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ সংশোধনে দক্ষ সমাজনেতা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মধ্যে। একজন বিচারপতি তার আদর্শ খুঁজে পাবেন আল্লাহর দন্ডবিধিসমূহ বাস্তবায়নে দৃঢ়চিত্ত মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর নিরপেক্ষ বিচারের মধ্যে। যিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّمَا أَهْلَكَ الَّذِينَ قَبْلَكُمْ أَنَّهُمْ كَانُوا إِذَا سَرَقَ فِيهِمُ الشَّرِيفُ تَرَكُوهُ وَإِذَا سَرَقَ فِيهِمُ الضَّعِيفُ أَقَامُوا عَلَيْهِ الْحَدَّ وَايْمُ اللهِ لَوْ أَنَّ فَاطِمَةَ بِنْتَ مُحَمَّدٍ سَرَقَتْ لَقَطَعْتُ يَدَهَا ‘হে জনগণ! তোমাদের পূর্বেকার উম্মতেরা ধ্বংস হয়েছে এ কারণে যে, তাদের মধ্যে উঁচু শ্রেণীর কোন লোক চুরি করলে তারা তাকে ছেড়ে দিত এবং দুর্বল শ্রেণীর কেউ চুরি করলে তার উপরে দন্ডবিধি প্রয়োগ করত। আল্লাহর কসম! যদি মুহাম্মাদের কন্যা ফাতেমাও চুরি করে, আমি অবশ্যই তার হাত কেটে দেব’।[2]
এমনিভাবে মানবজীবনের সকল দিক ও বিভাগে একজন পূর্ণাঙ্গ আদর্শের মানুষ হিসাবে তাঁকে আমরা দেখতে পাই। অতএব জীবনের কোন একটি বা দু’টি বিভাগে রাসূল (ছাঃ)-কে আদর্শ মেনে অন্য বিভাগে অন্য কোন মানুষকে আদর্শ মানলে পূর্ণ মুমিন হওয়া যাবে না। পরকালে জান্নাতও আশা করা যাবে না। মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর জীবনচরিত তাই একজন কল্যাণকামী সমাজনেতার জন্য আদর্শ জীবনচরিত। যা যুগে যুগে মানবজাতিকে সত্য ও ন্যায়ের আলোকস্তম্ভ রূপে পথ দেখাবে। মযলূম মানবতাকে যালেমদের হাত থেকে মুক্তির দিশা দিবে।
মুহাম্মাদ (ছাঃ) অস্ত্র নিয়ে ময়দানে আসেননি। এসেছিলেন একটি অভ্রান্ত আদর্শ নিয়ে। যার মাধ্যমে তিনি মানুষের ভ্রান্ত আক্বীদা ও কপোল-কল্পিত ধারণা-বিশ্বাসে পরিবর্তন এনেছিলেন। আর তাতেই সৃষ্টি হয়েছিল সর্বাত্মক সমাজ বিপ্লব। দুনিয়াপূজারী মানুষকে তিনি আল্লাহ ও আখেরাতে দৃঢ় বিশ্বাসী করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাত বিশ্বাসের ভিত্তিতে তিনি সমাজের আমূল পরিবর্তনে সক্ষম হয়েছিলেন। আজও যদি সেই দৃঢ় বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা যায়, তাহ’লে আবারো সেই হারানো মানবতা ও হারানো ইসলামী খেলাফত ফিরে পাওয়া সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন একদল যিন্দাদিল নিবেদিত প্রাণ মুর্দে মুমিন। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন- আমীন!
[2]. মুসলিম হা/১৬৮৮; বুখারী হা/৬৭৮৭-৮৮; মিশকাত হা/৩৬১০ ‘দন্ড হ্রাসে সুফারিশ’ অনুচ্ছেদ।