কুরআনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, এর কোন আয়াত কোন বিশেষ উপলক্ষ্যে নাযিল হ’লেও তার অর্থ হয় ব্যাপক ও সর্বযুগীয়। যাতে সকল যুগের সকল মানুষ এর দ্বারা উদ্বুদ্ধ ও উপকৃত হয়। যেমন (১) সূরা ‘আলাক্ব’-এর ৬ থেকে ১৯ আয়াত পর্যন্ত মক্কার মুশরিক নেতা আবু জাহ্ল সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। কিন্তু এর বক্তব্য সকল যুগের ইসলামদ্রোহী নেতাদের প্রতি প্রযোজ্য। অমনিভাবে (২) আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, সূরা আহক্বাফ ১৫ আয়াতটি হযরত আবুবকর (রাঃ) সম্পর্কে নাযিল হয়। যেখানে আল্লাহ বলেন, حَتَّى إِذَا بَلَغَ أَشُدَّهُ وَبَلَغَ أَرْبَعِيْنَ سَنَةً قَالَ رَبِّ أَوْزِعْنِيْ أَنْ أَشْكُرَ نِعْمَتَكَ الَّتِيْ أَنْعَمْتَ عَلَيَّ وَعَلَى وَالِدَيَّ وَأَنْ أَعْمَلَ صَالِحًا تَرْضَاهُ وَأَصْلِحْ لِيْ فِيْ ذُرِّيَّتِي إِنِّيْ تُبْتُ إِلَيْكَ وَإِنِّيْ مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ ‘... অবশেষে যখন সে পূর্ণ বয়স্ক হয় এবং চল্লিশ বছরে উপনীত হয় তখন সে বলে, হে আমার পালনকর্তা! তুমি আমাকে শক্তি দাও, যাতে আমি তোমার নে‘মতের শুকরিয়া আদায় করতে পারি, যা তুমি আমাকে ও আমার পিতামাতাকে দান করেছ এবং আমি তোমার পসন্দনীয় সৎকর্ম সমূহ করতে পারি। তুমি আমার জন্য আমার সন্তানদের মধ্যে কল্যাণ দান কর। আমি তোমার দিকে ফিরে গেলাম (তওবা করলাম) এবং আমি তোমার আজ্ঞাবহদের অন্যতম’ (কুরতুবী, তাফসীর সূরা আহক্বাফ ৪৬/১৫)।
এই দো‘আ কবুল করে আল্লাহ তাকে এমন তাওফীক দান করেন যে, তাঁর চার পুরুষ অর্থাৎ তিনি নিজে, তাঁর পিতা-মাতা, সন্তানাদি ও পৌত্রাদি ক্রমে সবাই মুসলমান হয়ে যান। ছাহাবায়ে কেরামের মধ্যে কেবল আবুবকর (রাঃ)-কেই আল্লাহ এই সৌভাগ্য দান করেন। কিন্তু আয়াতের উদ্দেশ্য হ’ল সকল মুসলমানকে এই নির্দেশনা দেওয়া যে, বয়স চল্লিশ বছর হয়ে গেলে তার মধ্যে পরকাল চিন্তা প্রবল হওয়া উচিত এবং বিগত গোনাহসমূহ হ’তে তওবা করা উচিত। আর সন্তান-সন্ততিকে দ্বীনদার ও সৎকর্মশীল করার জন্য সাধ্যমত চেষ্টার সাথে সাথে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করা উচিত। নির্দিষ্ট ও ব্যাপক অর্থবোধক এই দ্বৈত ভাবধারা কুরআনী ভাষা ও বর্ণনাভঙ্গির এক অনন্য দিক, যা অন্য কোন ধর্মগ্রন্থে নেই।
(২) কুরআনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হ’ল এর ‘মাছানী’ (مَثَانِي) নীতি। অর্থাৎ যেখানেই জান্নাতের সুসংবাদ। তার পরেই জাহান্নামের ভয় প্রদর্শন। যেমন আল্লাহ বলেন, أَمَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ فَلَهُمْ جَنَّاتُ الْمَأْوَى نُزُلًا بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ- وَأَمَّا الَّذِينَ فَسَقُوا فَمَأْوَاهُمُ النَّارُ كُلَّمَا أَرَادُوا أَنْ يَخْرُجُوا مِنْهَا أُعِيدُوا فِيهَا وَقِيلَ لَهُمْ ذُوقُوا عَذَابَ النَّارِ الَّذِي كُنْتُمْ بِهِ تُكَذِّبُونَ- ‘যারা ঈমান আনে ও সৎকর্মসমূহ সম্পাদন করে, তাদের জন্য তাদের কৃতকর্মের আপ্যায়ন স্বরূপ রয়েছে বসবাসের জান্নাত’। ‘আর যারা অবাধ্যতা করে, তাদের ঠিকানা হ’ল জাহান্নাম। যখনই তারা সেখান থেকে বের হ’তে চাইবে, তখনই তাদেরকে সেখানে ফিরিয়ে দেওয়া হবে এবং বলা হবে, জাহান্নামের যে শাস্তিকে তোমরা মিথ্যা বলতে, তার স্বাদ আস্বাদন করো’ (সাজদাহ ৩২/১৯-২০)। কুরআনের প্রায় প্রতি পৃষ্ঠায় এরূপ প্রমাণ মিলবে। যাতে পাঠকের মনে বারবার জান্নাত ও জাহান্নামের দোলা দেয়। যাতে তার মধ্যে জাহান্নাম থেকে বাঁচার আকুতি সৃষ্টি হয় ও জান্নাতের প্রতি আকাংখা প্রবল হয়। এভাবে সে প্রকাশ্য ও গোপন সকল পাপ থেকে ফিরে আসতে উদ্বুদ্ধ হয়।