নবীদের কাহিনী নবী চরিত ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ১ টি
নবী পরিবারে উত্তম আচরণ (حسن السلوك فى بيت النبى صــ)

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, خَيْرُكُمْ خَيْرُكُمْ لأَهْلِهِ وَأَنَا خَيْرُكُمْ لأَهْلِى ‘তোমাদের মধ্যে সেই-ই উত্তম, যে তার পরিবারের নিকটে উত্তম। আর আমি আমার পরিবারের নিকটে তোমাদের চেয়ে উত্তম’।[1] এখানে পরিবার বলতে স্ত্রী বুঝানো হয়েছে।

‘সতীনের সংসার জাহান্নামের শামিল’ বলে একটা কথা সাধারণ্যে চালু আছে। কথাটি কমবেশী সত্য এবং বাস্তব। তবে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে নিবেদিতপ্রাণ পরিবারে তা কিভাবে শান্তির বাহনে পরিণত হয়, রাসূল-পরিবার ছিল তার অনন্য দৃষ্টান্ত। অন্য সকল ক্ষেত্রের ন্যায় পারিবারিক জীবনেও আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ছিলেন উম্মতের জন্য উত্তম আদর্শ। কিছু দৃষ্টান্তের মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত পরিসরে আমরা নিম্নে তা তুলে ধরার চেষ্টা পাব।-

১. স্ত্রীগণের সাথে সমান ব্যবহার (تسوية السلوك مع الزوجات) :

খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান সহ যাবতীয় আচার-আচরণে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাঁর সকল স্ত্রীর সঙ্গে সমান ব্যবহার করতেন। সাধারণতঃ আছর ছালাতের পর তিনি প্রত্যেক স্ত্রীর ঘরে গিয়ে তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় বিষয় সমূহ জেনে নিতেন।[2]

২. স্ত্রীদের পালা নির্ধারণ (القسم بين الزوجات) : তিনি স্ত্রীদের মধ্যে তাদের সম্মতিক্রমে সমভাবে পালা নির্ধারণ করতেন।[3] তিনি বলতেন, কারু নিকট দু’জন স্ত্রী থাকলে যদি তাদের মধ্যে সে ন্যায় বিচার না করে, তাহ’লে ক্বিয়ামতের দিন ঐ ব্যক্তি এক অঙ্গ পতিত অবস্থায় আগমন করবে’।[4]

৩. সফরকালে লটারি করণ (القرعة عند السفر) : কোন অভিযানে বা সফরে যাওয়ার সময় লটারীর মাধ্যমে স্ত্রী বাছাই করে একজনকে সাথে নিতেন।[5]

৪. স্ত্রীর বান্ধবীদের সাথে উত্তম আচরণ (المعاملة الحسنة مع صديقات الزوجات) : স্ত্রীগণের বান্ধবী ও আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সদ্ব্যবহার করতেন ও তাদের নিকট উপঢৌকনাদি প্রেরণ করতেন।[6]

৫. স্ত্রীদের কক্ষ পৃথককরণ (فصل غرفات الزوجات) : স্ত্রীগণের প্রত্যেকের কক্ষ পৃথক ছিল। যেগুলিকে আল্লাহ পাক ‘হুজুরাত’ (কক্ষ সমূহ) ‘বুয়ূত’ (ঘর সমূহ) ইত্যাদি নামে অভিহিত করেছেন (হুজুরাত ৪৯/৪; আহযাব ৩৩/৩৩)।

৬. অল্পে তুষ্ট থাকার নীতি অবলম্বন (اةخاذ مبدأ القناعة) : স্ত্রীগণের অধিকাংশ বড় বড় ঘরের মেয়ে হ’লেও রাসূল (ছাঃ)-এর শিক্ষাগুণে তাঁরা সবাই হয়ে উঠেছিলেন অল্পে তুষ্ট ও সহজ-সরল জীবন যাপনে অভ্যস্ত।

৭. দানশীলতায় অভ্যস্তকরণ (التعويد على السخاء) : অন্যের স্বার্থকে নিজের স্বার্থের উপরে স্থান দেওয়ার অনন্য গুণে গুণান্বিতা ছিলেন এই সকল মহিয়সী নারীগণ। সম্পদ পায়ে লুটালেও তাঁরা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করতেন না। দানশীলতায় তারা ছিলেন উদারহস্ত। উম্মুল মুমিনীন হযরত যয়নব বিনতে খুযায়মা (রাঃ) তো ‘উম্মুল মাসাকীন’ (মিসকীনদের মা) হিসাবে অভিহিত ছিলেন (মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১৫৩৫৭)। খায়বর বিজয়ের পর বিপুল গণীমত হস্তগত হয়। তখন রাসূল (ছাঃ)-এর প্রাপ্য অংশ হ’তে প্রত্যেক স্ত্রীর জন্য বছরে ৮০ অসাক্ব খেজুর এবং ২০ অসাক্ব যব বরাদ্দ করা হয়।[7] সেই সাথে একটি করে দুগ্ধবতী উষ্ট্রী প্রদান করা হয়। কিন্তু দেখা গেল যে, পবিত্রা স্ত্রীগণ যতটুকু না হ’লে নয়, ততটুকু রেখে বাকী সব দান করে দিয়েছেন।[8]

৮. স্ত্রীগণের মধ্যে পারস্পরিক সহমর্মিতা (التعاطف بين الزوجات) : সপত্নীগণের মধ্যে পরস্পরের ভালোবাসা ছিল গভীর ও নিঃস্বার্থ। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের প্রতি ছিলেন সহানুভূতিশীল ও দয়ার্দ্রচিত্ত। এরপরেও যদি কখনো কারু প্রতি কারু কোন রূঢ় আচরণ প্রকাশ পেত, তাহ’লে দ্রুত তা মিটিয়ে ফেলা হ’ত। যেমন (ক) একবার রাসূল (ছাঃ)-এর একমাত্র ইহূদীজাত স্ত্রী ছাফিয়াকে কুরায়শী স্ত্রী যয়নব বিনতে জাহ্শ ‘ইহূদী’ বলে সম্বোধন করেন, যার মধ্যে তাচ্ছিল্যের ভাব ছিল। এতে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এতই ক্ষুব্ধ হন যে, যয়নব তওবা করে অনুতপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তার গৃহে পা রাখেননি।[9] (খ) আরেকদিন রাসূল (ছাঃ) ঘরে এসে দেখেন যে, ছাফিয়া কাঁদছেন। কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন যে, হাফছা আমাকে ‘ইহূদীর মেয়ে’ বলেছেন। একথা শুনে রাসূল (ছাঃ) ছাফিয়াকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, বরং তুমি নিশ্চয়ই নবী (ইসহাকের) কন্যা। তোমার চাচা (ইসমাঈল) একজন নবী এবং তুমি একজন নবীর স্ত্রী। তাহ’লে কিসে তোমার উপরে সে গর্ব করছে? অতঃপর তিনি হাফছাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আল্লাহকে ভয় কর হে হাফছা’![10]

(গ) আয়েশা (রাঃ) বলেন, লোকেরা আয়েশার পালার দিন ঠিক রাখত। ঐদিন তারা রাসূল (ছাঃ)-কে খুশী করার জন্য নানাবিধ হাদিয়া পাঠাতো। স্ত্রীগণ দু’দলে বিভক্ত ছিলেন। সওদা, আয়েশা, হাফছা. ও ছাফিয়া এক দলে এবং উম্মে সালামাহ ও বাকীগণ আরেক দলে। শেষোক্ত দলের স্ত্রীগণের অনুরোধে উম্মে সালামাহ রাসূল (ছাঃ)-কে একদিন বললেন, আপনি লোকদের বলে দিন, তারা যেন আপনি যেদিন যে স্ত্রীর কাছে থাকেন, সেদিন সেখানে হাদিয়া পাঠায়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হে উম্মে সালামাহ! তুমি আমাকে আয়েশার ব্যাপারে কষ্ট দিয়ো না। উম্মে সালামা তওবা করলেন। পরে তারা উক্ত বিষয়ে ফাতেমাকে রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে পাঠালেন। সেখানেও রাসূল (ছাঃ) একই জবাব দিলেন এবং বললেন, ফাতেমা! আমি যা পসন্দ করি, তুমি কি তা পসন্দ করো না? তাহ’লে তুমি আয়েশাকে ভালোবাস।[11]

৯. যুহদ ও দুনিয়াত্যাগী জীবন (الزهد والتعبد فى العائلة) : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অত্যন্ত সরল-সহজ ও সাধাসিধা জীবন যাপন করতেন। তিনি স্বেচ্ছায় দরিদ্রতা অবলম্বন করেছিলেন। তিনি বলতেন, اللَّهُمَّ أَحْيِنِىْ مِسْكِيْنًا وَأَمِتْنِىْ مِسْكِيْنًا وَاحْشُرْنِىْ فِىْ زُمْرَةِ الْمَسَاكِيْنِ ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে মিসকীনী হালে বাঁচিয়ে রাখো ও মিসকীনী হালে মৃত্যু দান কর এবং আমাকে মিসকীনদের সাথে পুনরুত্থিত কর’।[12] তিনি বলতেন, اللَّهُمَّ ارْزُقْ آلَ مُحَمَّدٍ قُوتًا ‘হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদের পরিবারকে পরিমিত আহার দান কর। যা ক্ষুধা নিবৃত্ত করে’ (বুখারী হা/৬৪৬০)। অভাবে-অনটনে, দুঃখে-বেদনায়, সর্বাবস্থায় তিনি কঠিন ধৈর্য অবলম্বন করতেন। এমনকি ক্ষুধার যন্ত্রণা হ্রাস করার জন্য তিনি কখনো কখনো পেটে পাথর বেঁধে রাখতেন’ (ছহীহাহ হা/১৬১৫)। তিনদিন না খেয়ে পেটে পাথর বেঁধে সৈন্যদের সাথে অবর্ণনীয় কষ্টে খন্দক খোঁড়ার কাজে তিনি অংশ নিয়েছেন (বুখারী হা/৪১০১)। রাসূল (ছাঃ)-এর খাদেম হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, فَمَا أَعْلَمُ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَأَى رَغِيْفًا مُرَقَّقًا حَتَّى لَحِقَ بِاللهِ، وَلاَ رَأَى شَاةً سَمِيْطًا بِعَيْنِهِ قَطُّ ‘আমি জানি না, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়ার আগ পর্যন্ত কখনো কোন পাতলা নরম রুটি দেখেছেন কিংবা কোন আস্ত ভুনা বকরী দেখেছেন’।[13] আয়েশা ছিদ্দীকা (রাঃ) বলেন, মদীনায় আসার পর থেকে রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যু পর্যন্ত মুহাম্মাদের পরিবার কখনো তিনদিন একটানা রুটি খেতে পায়নি।[14] অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘পরপর দু’মাস অতিবাহিত হয়ে তৃতীয় মাসের চাঁদ উদিত হ’ত, অথচ নবীগৃহে কোন (চুলায়) আগুন জ্বলতো না’ (অর্থাৎ মাসভর চুলা জ্বলতো না)। ভগিনীপুত্র উরওয়া বিন যুবায়ের (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, খালাম্মা! مَا كَانَ يُعِيشُكُمْ ‘তাহ’লে কি খেয়ে আপনারা জীবন ধারণ করতেন? তিনি বলেন, الْأَسْوَدَانِ التَّمْرُ وَالْمَاءُ ‘দু’টি কালো বস্ত্ত দিয়ে- খেজুর ও পানি’।[15] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলতেন, قَدْ أَفْلَحَ مَنْ أَسْلَمَ وَرُزِقَ كَفَافًا وَقَنَّعَهُ اللهُ بِمَا آتَاهُ ‘ঐ ব্যক্তি সফলকাম, যে মুসলমান হ’ল। যে পরিমিত আহার পেল এবং তাকে আল্লাহ যা দিয়েছেন, তাতে সন্তুষ্ট থাকল’।[16]

একবার আবু হুরায়রা (রাঃ) একদল লোকের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। যাদের সামনে একটা ভুনা বকরী ছিল। তারা তাঁকে খাওয়ার জন্য দাওয়াত দিলেন। কিন্তু তিনি অস্বীকার করে বললেন, خَرَجَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مِنَ الدُّنْيَا وَلَمْ يَشْبَعْ مِنَ الْخُبْزِ الشَّعِيرِ ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে গেছেন। অথচ কখনো একটি যবের রুটি দিয়েও পরিতৃপ্ত হননি’।[17] আনাস (রাঃ) বলেন, ‘রাসূল (ছাঃ)-এর পরিবারের নিকট কোন সন্ধ্যাতেই এক ছা‘ গম বা কোন খাদ্য দানা (&আগামীকালের জন্য) অবশিষ্ট থাকত না। অথচ তাঁর স্ত্রী ছিলেন নয় জন’ (অর্থাৎ যা পেতেন সবই দান করে দিতেন। জমা রাখতেন না)।[18] মৃত্যুর সময় রাসূল (ছাঃ)-এর লৌহবর্মটি এক ইহূদীর নিকটে ৩০ ছা‘ (৭৫ কেজি) যবের বিনিময়ে বন্ধক ছিল।[19] নবীজীবনের সর্বশেষ রাতেও স্ত্রী আয়েশাকে চেরাগ জ্বালাতে তার সতীনদের নিকট থেকে তৈল চেয়ে নিতে হয়েছিল।[20]

ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বলেন, ‘আমি একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে দেখলাম, তিনি একটা খেজুর পাতার চাটাইয়ের উপর শুয়ে আছেন। যাতে কোন ফরাশ বা চাদর নেই। তাঁর দেহে চাটাইয়ের দাগ বসে গিয়েছিল। তাঁর মাথার নীচে খেজুর গাছের ছোবড়া ভর্তি একটি চামড়ার বালিশ। তাঁর দেহে চাটাইয়ের দাগ দেখে আমি কাঁদতে লাগলাম। তিনি বললেন, তুমি কেন কাঁদছ? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! পারসিক ও রোমকরা কোন অবস্থায় আছে। আর আপনি কোন অবস্থায়? তখন তিনি বললেন, أَمَا تَرْضَى أَنْ تَكُونَ لَهُمُ الدُّنْيَا وَلَنَا الآخِرَةُ ‘তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, তাদের জন্য দুনিয়া এবং আমাদের জন্য আখেরাত? (বুখারী হা/৪৯১৩)। আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একটি চাটাইয়ের উপরে শুতেন। অতঃপর যখন দাঁড়াতেন, তখন তাঁর পার্শ্বদেশে ঐ চাটাইয়ের দাগ পড়ে যেত। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি আপনার জন্য একটি তোষক বানিয়ে দেব না? জবাবে তিনি বললেন, مَا لِى وَمَا لِلدُّنْيَا مَا أَنَا فِى الدُّنْيَا إِلاَّ كَرَاكِبٍ اسْتَظَلَّ تَحْتَ شَجَرَةٍ ثُمَّ رَاحَ وَتَرَكَهَا ‘আমার জন্য বা দুনিয়ার জন্য কি প্রয়োজন? দুনিয়াতে আমি একজন সওয়ারীর ন্যায়। যে একটি গাছের ছায়ায় বিশ্রাম করছে। অতঃপর রওয়ানা হবে এবং ঐ গাছটিকে ছেড়ে যাবে’ (তিরমিযী হা/২৩৭৭)। মূলতঃ এসবই ছিল তাঁর যুহ্দ বা দুনিয়াত্যাগী চরিত্রের অনন্য পরিচয়।

ইবাদত (التعبد): তিনি ফরয ছালাত ছাড়াও নফল ছালাতে গভীরভাবে নিমগ্ন হ’তেন। শেষ রাত্রিতে তাহাজ্জুদ ছালাত তাঁর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত ছিল (মুযযাম্মিল ৭৩/২-৩; ইসরা ১৭/৭৯)। দীর্ঘক্ষণ ছালাতে দাঁড়ানোর ফলে তাঁর দুই পা ফুলে যেত। তা দেখে তাঁকে বলা হ’ল, হে আল্লাহর রাসূল! غَفَرَ اللهُ لَكَ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ ‘আল্লাহ আপনার আগে-পিছের সকল গোনাহ মাফ করে দিয়েছেন। জবাবে তিনি বলতেন, أَفَلاَ أَكُونُ عَبْدًا شَكُورًا ‘আমি কি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হব না? (বুখারী হা/১১৩০)। এছাড়া যখনই তিনি কোন কষ্টে পড়তেন, তখনই নফল ছালাতে রত হ’তেন (আবুদাঊদ হা/১৩১৯)।

তিনি নিয়মিত নফল ছিয়াম রাখতেন। যেমন প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার,[21] প্রতি চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ আইয়ামে বীযের নফল ছিয়াম (তিরমিযী হা/৭৬১), আরাফাহ ও আশূরার ছিয়াম (মুসলিম হা/১১৬২), শা‘বানের প্রায় পুরা মাস (মুসলিম হা/১১৫৬) এবং রামাযানের এক মাস ফরয ছিয়াম শেষে শাওয়ালের ৬টি নফল ছিয়াম (মুসলিম হা/১১৬৪)। তিনি বলতেন, مَنْ صَامَ يَوْمًا فِى سَبِيلِ اللهِ بَعَّدَ اللهُ وَجْهَهُ عَنِ النَّارِ سَبْعِينَ خَرِيفًا ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় একদিন ছিয়াম রাখে, আল্লাহ তার চেহারাকে জাহান্নামের আগুন থেকে ৭০ বছরের পথ দূরে রাখেন’।[22] তিনি বলতেন, তুমি ঘুমাও ও ইবাদত কর। নিশ্চয় তোমার উপর তোমার দেহের হক রয়েছে। চোখের হক রয়েছে। স্ত্রীর হক রয়েছে। সাক্ষাৎপ্রার্থীর হক রয়েছে। আর যে ব্যক্তি প্রতিদিন ছিয়াম রাখে, সেটি কোন ছিয়ামই নয়’। অর্থাৎ তার ছিয়াম কবুল হয় না।[23] এর মধ্যে সন্ন্যাসবাদের প্রতিবাদ রয়েছে। যা খ্রিষ্টানদের আবিষ্কার (হাদীদ ৫৭/২৭)।

উপরের বিস্তারিত আলোচনায় রাসূল (ছাঃ)-এর দুনিয়াত্যাগী চরিত্র এবং অতুলনীয় সংযম সাধনার পরিচয় পাওয়া যায়।

১০. পারিবারিক কিছু শিক্ষণীয় ঘটনাবলী (بعض الوقائع العائلية الاعةبارية) :

কঠিন সংযম ও কৃচ্ছতা সাধনের মধ্যে জীবন যাপন করেও পবিত্রা স্ত্রীগণ কখনো অসন্তুষ্টি ভাব প্রকাশ করতেন না। বরং সর্বদা মহান স্বামীর সাহচর্যে হাসিমুখে দাম্পত্য জীবন যাপন করতেন। তবে দু’একটি ঘটনা এমন ছিল যা রাসূল (ছাঃ)-এর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ছিল এবং তাতে তিনি দুঃখিত হয়েছিলেন। শরী‘আতী বিধান চালু করার লক্ষ্যে আল্লাহর বিশেষ ইচ্ছায় এরূপ ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। যার মধ্যে রয়েছে উম্মতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ। যেমন-

(১) ৫ম হিজরীতে খন্দক যুদ্ধের পর বনু কুরায়যার বিজয় এবং গণীমতের বিপুল মালামাল প্রাপ্তির ফলে মুসলমানদের মধ্যে স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে আসে। এ প্রেক্ষিতে পবিত্রা স্ত্রীগণ রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে তাদের ভরণ-পোষণের পরিমাণ বৃদ্ধির আবেদন জানান। এতে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মর্মাহত হন এবং তাদেরকে তালাক গ্রহণের এখতিয়ার প্রদান করেন। উক্ত মর্মে আয়াতে ‘তাখয়ীর’ (آية التخيير) নাযিল হয় (আহযাব ৩৩/২৮-২৯)।

উক্ত আয়াত নাযিলের পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আয়েশাকে তার পিতা-মাতার সঙ্গে পরামর্শ করতে বললে তিনি বলে ওঠেন, فَفِى أَىِّ هَذَا أَسْتَأْمِرُ أَبَوَىَّ فَإِنِّى أُرِيدُ اللهَ وَرَسُولَهُ وَالدَّارَ الآخِرَةَ، قَالَتْ ثُمَّ فَعَلَ أَزْوَاجُ النَّبِىِّ- صلى الله عليه وسلم- مِثْلَ مَا فَعَلْتُ- ‘এজন্য পিতা-মাতার সাথে পরামর্শের কি আছে? আমি তো আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এবং আখেরাতকে কবুল করে নিয়েছি’। তিনি বলেন, অতঃপর অন্যান্য স্ত্রীগণ সকলেই আমার পথ অনুসরণ করলেন’।[24]

(২) একবার দু’জন স্ত্রীর উপর কোন কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে রাসূল (ছাঃ) কসম করেন যে, তাদের থেকে একমাস বিরত থাকবেন এবং তা যথারীতি কার্যকর হয়। যা ঈলা-র ঘটনা (قصة الإيلاء) নামে প্রসিদ্ধ।[25]

(৩) একবার মধু খাওয়ার ঘটনায় স্ত্রীদের কাউকে খুশী করার জন্য তা আর খাবেন না বলে কসম করেন। এভাবে হালালকে হারাম করায় আল্লাহপাক তাকে সতর্ক করে দিয়ে সূরা তাহরীম ১ম আয়াতটি (آية التحريم) নাযিল করেন।[26]

উপরোক্ত ঘটনাবলীতে পুণ্যবতী স্ত্রীগণের এই বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে যে, তারা সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায় পুণ্যবান স্বামীর একনিষ্ঠ অনুসারী হয়ে থাকেন। এর দ্বারা আরেকটি বিষয় প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মানুষ হিসাবে মানবীয় রাগ-অভিমান ও দুঃখ-বেদনার অধিকারী ছিলেন। স্বামী-স্ত্রীর প্রেমের সম্পর্ক এসবের মাধ্যমে ঝালাই হয়ে আরও দৃঢ়তর হয়। রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর পবিত্রা স্ত্রীগণের মধ্যকার এ ধরনের ঘটনা তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। ভবিষ্যতে কোন মুমিন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এরূপ ঘটনা ঘটলে তারা যেন রাসূল-পত্নীদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেন এবং সংসার ভেঙ্গে না দিয়ে আরও মযবুত করেন, সেদিকে পথপ্রদর্শনের জন্যই দৃষ্টান্ত হিসাবে আল্লাহর ইচ্ছায় উক্ত ঘটনা সমূহ সংঘটিত হয়।

বস্ত্ততঃ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর পুণ্যবতী স্ত্রীগণের মধ্যকার সম্পর্ক ছিল উন্নত আদর্শ চেতনার উপরে প্রতিষ্ঠিত। দুনিয়া ও আখেরাতে সর্বাবস্থায় তাঁরা নবীপত্নী হিসাবে বরিত।[27] তাই দুনিয়াবী ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য তাঁরা কখনোই আখেরাতের বৃহত্তর স্বার্থ বিকিয়ে দিতে পারেন না। দুনিয়াতে তাঁরা ছিলেন রাসূল (ছাঃ)-এর পারিবারিক জীবনের বিশ্বস্ততম সাক্ষী এবং তাদের মাধ্যমেই উম্মতে মুহাম্মাদী ইসলামের পারিবারিক ও অন্যান্য বিধানসমূহ জানতে পেরে ধন্য হয়েছে। এদিক দিয়ে বিবেচনা করলে তাঁরা কেবল নবীপত্নী ছিলেন না, বরং তারা ছিলেন উম্মতের শিক্ষিকা ও নক্ষত্রতুল্য দৃষ্টান্ত। নিঃসন্দেহে নবীর সঙ্গে নবীপত্নীগণের সম্পর্ক ও আচার-আচরণ ছিল অতীব মধুর এবং আখেরাতের চেতনায় উজ্জীবিত।

[1]. তিরমিযী হা/৩৮৯৫; দারেমী হা/২২৬০; মিশকাত হা/৩২৫২।

[2]. বুখারী হা/৫২১৬; মুসলিম হা/১৪৭৪।

[3]. হাকেম হা/২৭৬০; আবুদাঊদ হা/২১৩৪-৩৫; ইরওয়া হা/২০১৮-২০; বুখারী হা/৫২১২; মুসলিম হা/১৪৬৩ (৪৭); তিরমিযী তুহফাসহ হা/১১৪০; মিশকাত হা/৩২২৯-৩০, ৩২৩৫ ‘বিবাহ’ অধ্যায় ‘পালা বণ্টন’ অনুচ্ছেদ।

[4]. (جَاءَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَشِقُّهُ سَاقِطٌ) তিরমিযী হা/১১৪১; ইবনু মাজাহ হা/১৯৬৯; মিশকাত হা/৩২৩৬।

[5]. বুখারী হা/২৫৯৩; মুসলিম হা/২৭৭০; মিশকাত হা/৩২৩২।

[6]. বুখারী হা/৩৮১৮; মুসলিম হা/২৪৩৫; মিশকাত হা/৬১৭৭।

[7]. মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/১৪৪৬৯; মুসলিম হা/১৫৫১ (২); আড়াই কেজিতে এক মাদানী ছা‘ এবং ৬০ ছা‘-তে এক অসাক্ব। যার পরিমাণ ১৫০ কেজি।

[8]. রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/১৪২।

[9]. আবুদাঊদ হা/৪৬০২; মিশকাত হা/৫০৪৯; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/২৮৩৫, সনদ হাসান।

[10]. তিরমিযী হা/৩৮৯৪; নাসাঈ হা/৩২৫২; মিশকাত হা/৬১৮৩, সনদ ছহীহ।

[11]. বুখারী হা/২৫৮১; মুসলিম হা/২৬০৩; মিশকাত হা/৬১৮০ ‘মর্যাদা সমূহ’ অধ্যায়-৩০, ‘নবীপত্নীগণের মর্যাদা’ অনুচ্ছেদ-১১।

[12]. তিরমিযী হা/২৩৫২; বায়হাক্বী-শু‘আবুল ঈমান হা/১৪৫৩; মিশকাত হা/৫২৪৪; ছহীহাহ হা/৩০৮।

[13]. বুখারী হা/৫৪২১; মিশকাত হা/৪১৭০ ‘খাদ্য সমূহ’ অধ্যায়।

[14]. বুখারী হা/৫৪১৬ ‘খাদ্য সমূহ’ অধ্যায়-৭০ অনুচ্ছেদ-২৩; মুসলিম হা/২৯৭০।

[15]. বুখারী হা/৬৪৫৯ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায় ‘রাসূল ও ছাহাবীদের জীবন যাপন কেমন ছিল’ অনুচ্ছেদ-১৭।

[16]. মুসলিম হা/১০৫৪; মিশকাত হা/৫১৬৫।

[17]. বুখারী হা/৫৪১৪; মিশকাত হা/৫২৩৮।

[18]. বুখারী হা/২০৬৯; মিশকাত হা/৫২৩৯।

[19]. বুখারী হা/২৯১৬; মিশকাত হা/২৮৮৫ ‘বন্ধক’ অনুচ্ছেদ।

[20]. ত্বাবারাণী কাবীর হা/৫৯৯০; ছহীহ আত-তারগীব হা/৯২৭।

[21]. তিরমিযী হা/৭৪৫; নাসাঈ হা/২৩৬৪; মিশকাত হা/২০৫৫।

[22]. বুখারী হা/২৮৪০; মিশকাত হা/২০৫৩।

[23]. বুখারী হা/১৯৭৫; মিশকাত হা/২০৫৪।

[24]. বুখারী হা/৪৭৮৫-৮৬; মুসলিম হা/১৪৭৫; মিশকাত হা/৩২৪৯; আহযাব ৩৩/২৮-২৯।

[25]. বুখারী হা/১৯১১; মুসলিম হা/১০৮৩, ১৪৭৯; মিশকাত হা/৩২৪৮; বাক্বারাহ ২/২২৬; তাহরীম ৬৬/৪।

[26]. তাহরীম ৬৬/১; বুখারী হা/৪৯১২।

[27]. আহযাব ৩৩/৩৩, ৫৩; যুখরুফ ৪৩/৭০ আয়াতের মর্মার্থ।