রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পারস্য সম্রাট খসরু পারভেযের(أَبرَوِيزُ بنُ هُرمُزَ بنِ أَنوشِروَانَ) নিকটে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে পত্র প্রেরণ করেন, যিনি ছিলেন অর্ধেক প্রাচ্য দুনিয়ার অধিপতি এবং মজূসী বা যারদাশতী ধর্মের অনুসারী, যারা অগ্নিপূজক ছিলেন। পত্রবাহক ছিলেন আব্দুল্লাহ বিন হুযাফাহ সাহমী(عبد الله بن حُذافةَ السَّهمِيُّ)। পত্রটি ছিল নিম্নরূপ:
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ، مِنْ مُحَمَّدٍ رَسُوْلِ اللهِ إلَى كِسْرَى عَظِيمِ فَارِسَ سَلاَمٌ عَلَى مَنِ اتَّبَعَ الْهُدَى وَآمَنَ بِاَللهِ وَرَسُوْلِهِ وَشَهِدَ أَنْ لاَ إلَهَ إلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ وَأَنّ مُحَمّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ، أَدْعُوْكَ بِدِعَايَةِ اللهِ فَإِنِّيْ أَنَا رَسُوْلُ اللهِ إلَى النَّاسِ كَافّةً لِيُنْذِرَ مَنْ كَانَ حَيًّا وَيَحِقَّ الْقَوْلُ عَلَى الْكَافِرِيْنَ- أَسْلِمْ تَسْلَمْ فَإِنْ أَبَيْتَ فَعَلَيْكَ إثْمُ الْمَجُوْسِ-
‘শান্তি বর্ষিত হৌক ঐ ব্যক্তির উপরে যিনি হেদায়াতের অনুসরণ করেন এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল-এর উপরে ঈমান আনেন এবং সাক্ষ্য দেন যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনি এক, তাঁর কোন শরীক নেই। আমি আপনাকে আল্লাহর দিকে আহবান জানাচ্ছি। নিশ্চয়ই আমি আল্লাহর পক্ষ হ’তে সমগ্র মানব জাতির জন্য প্রেরিত রাসূল’। ‘যাতে তিনি জীবিতদের (জাহান্নামের) ভয় প্রদর্শন করেন এবং কাফিরদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়’ (ইয়াসীন ৩৬/৭০)। ইসলাম কবুল করুন, নিরাপদ থাকুন। যদি অস্বীকার করেন, তাহ’লে মজূসীদের পাপ আপনার উপরে বর্তাবে’ (আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ ৩৫৬ পৃঃ, সনদ হাসান)।
পত্রবাহক সাহমী (রাঃ) পত্রখানা (কিসরার গবর্ণর) বাহরায়নের শাসক মুনযির বিন সাওয়া-র(الْمُنذِر بن ساوَى) নিকটে হস্তান্তর করেন। অতঃপর যখন পত্রটি কিসরার নিকটে পাঠ করে শুনানো হয়, তখন তিনি পত্রটি ছিঁড়ে ফেলেন ও দম্ভভরে বলেন,عَبْدٌ حَقِيْرٌ مِنْ رَعِيَّتِيْ يَكْتُبُ اسْمَهُ قَبْلِيْ ‘আমার একজন নিকৃষ্ট প্রজা তার নাম লিখেছে আমার নামের পূর্বে’। এ খবর রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে পৌঁছলে তিনি বদদো‘আ করে বলেন,أَنْ يُمَزَّقُوا كُلَّ مُمَزَّقٍ ‘আল্লাহ তাদের সাম্রাজ্যকে ছিন্নভিন্ন করুন’![1] অন্য বর্ণনায় এসেছে,اللَّهُمَّ مَزِّقْ مُلْكَهُ ‘আল্লাহ তার সাম্রাজ্যকে ছিন্নভিন্ন করুন’।[2] পরবর্তীতে সেটাই হয়েছিল।
কিসরা তার অধীনস্থ ইয়ামনের গবর্ণর ‘বাযান’ (بَاذَان) এর কাছে লিখলেন, ‘হেজাযের এই ব্যক্তিটির নিকটে তুমি দু’জন শক্তিশালী লোক পাঠাও। যাতে তারা ঐ ব্যক্তিকে আমার কাছে ধরে নিয়ে আসে’। বাযান সে মোতাবেক দু’জন লোককে একটি পত্রসহ মদীনায় পাঠান, যাতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের সাথে কিসরার দরবারে চলে যান। তারা গিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে বেশ ধমকের সুরে কথা বলল। তিনি তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। তখন তারা ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) তাদেরকে বললেন, তোমরা কাল এসো। আমি তোমাদেরকে আমার কথা বলব। তারা পরের দিন এল। তখন তিনি তাদেরকে বললেন,أَبْلِغَا صَاحِبَكُمَا أَنَّ رَبِّي قَدْ قَتَلَ رَبَّهُ كِسْرَى فِي هَذِهِ اللَّيْلَةِ ‘তোমরা তোমাদের গবর্ণরের কাছে খবর পৌছে দাও যে, আমার প্রতিপালক তার প্রতিপালক কেসরাকে আজ রাতেই হত্যা করেছেন’ (ছহীহাহ হা/১৪২৯)।
ঘটনা ছিল এই যে, সম্রাট পুত্র শীরাওয়াইহ (شِيرَوَيْه) পিতা খসরু পারভেযকে হত্যা করে রাতারাতি পারস্যের সিংহাসন দখল করে নেয়। ৭ম হিজরীর ১০ই জুমাদাল ঊলা মঙ্গলবারের (১৫ই সেপ্টেম্বর ৬২৮ খৃ. বৃহস্পতিবার) রাতে এ আকস্মিক ঘটনা ঘটে যায়। তখন লোক দু’টি বাযানের কাছে ফিরে আসে। অতঃপর বাযান এবং তার বংশধর যারা ইয়ামনে ছিল সবাই ইসলাম কবুল করল’।[3]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, পরদিন সকালে ঐ দু’জন লোক রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে এসে ঘটনা শুনে অবিশ্বাস ও বিস্ময়ভরে বলে উঠল, আমরা আপনার এই বাজে কথা সম্রাটের কাছে লিখে পাঠাব’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ। তবে তাকে একথা বলো যে,
وَقُولاَ لَهُ: إِنَّ دِينِي وَسُلْطَانِي سَيَبْلُغُ مَا بلغ كسْرَى وينتهى إِلَى الْخُفِّ وَالْحَافِرِ، وَقُولاَ لَهُ: إِنْ أَسْلَمْتَ أَعْطَيْتُكَ مَا تَحْتَ يَدَيْكَ وَمَلَّكْتُكَ عَلَى قَوْمِكَ مِنَ الْأَبْنَاءِ-
‘আমার দ্বীন ও শাসন ঐ পর্যন্ত পৌঁছবে, যে পর্যন্ত কিসরা পৌঁছেছেন এবং সেখানে গিয়ে শেষ হবে, যার পরে আর উট ও ঘোড়ার পা চলবে না’। তাকে একথাও বলো, ‘যদি তিনি মুসলমান হয়ে যান, তবে তার অধিকারে যা কিছু রয়েছে, সব তাকে দেওয়া হবে এবং তাকে তোমাদের জাতির জন্য বাদশাহ করে দেওয়া হবে’।[4]
লক্ষ্যণীয় বিষয় যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার পত্রেأَسْلِمْ تَسْلَمْ ‘ইসলাম কবুল করুন, নিরাপদ থাকুন’ কথাটি লিখেছিলেন, যা ছিল এক প্রকার ভবিষ্যদ্বাণী স্বরূপ। কিসরা সেটি প্রকাশ্যে অস্বীকার করেন ও পত্রটি ছিঁড়ে ফেলে চরম বেআদবী করেন। ফলে তার রাজনৈতিক নিরাপত্তা তার ছেলের মাধ্যমেই দ্রুত ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। পক্ষান্তরে একই কথা তিনি অন্য খ্রিষ্টান রাজা নাজাশীকে লিখলে তিনি ইসলাম কবুল করেন এবং তার রাজ্য নিরাপদ ও দৃঢ় হয়। অপর খ্রিষ্টান মিশরের রাজা মুক্বাউক্বিস ইসলাম কবুল না করলেও প্রত্যাখ্যান করেননি। বরং তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর পত্র ও পত্রবাহক দূতকে সম্মানিত করেন ও মদীনায় মূল্যবান উপঢৌকনাদি প্রেরণ করেন। ফলে তার রাজ্য নিরাপদ থাকে।
বলা বাহুল্য যে, রাসূল (ছাঃ)-এর প্রদত্ত উক্ত আগাম খবরে বাযান ও ইয়ামনে বসবাসরত পারসিকরা সবাই মুসলমান হয়ে যায় ও তাদের শাসিত এলাকার অধিকাংশ লোক ইসলাম কবুল করে (ইবনু হিশাম ১/৬৯)।
[2]. ইবনু সা‘দ ১/১৯৯; ছহীহাহ হা/১৪২৯। জীবনীকারগণের বর্ণনায় এসেছে, مَزَّقَ اللهُ مُلْكَهُ ‘আল্লাহ তার সাম্রাজ্যকে ছিন্নভিন্ন করুন’ (আল-বিদায়াহ ৬/১৯৪; যাদুল মা‘আদ ৩/৬০১)।
[3]. তাবাক্বাত ইবনু সা‘দ (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ ১৪১০/১৯৯০) ১/১৯৯ পৃঃ।
[4]. আল-বিদায়াহ ৪/২৭০; ফিক্বহুস সীরাহ পৃঃ ৩৬২, সনদ ‘মুরসাল’ বা যঈফ।