নবীদের কাহিনী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) - মাদানী জীবন ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ১ টি
ওহোদ যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য বিষয়সমূহ- ১১. রাসূল (ছাঃ)-এর দুঃখপূর্ণ দো‘আ (الدعاء الحزين للرسول صـ)

আনাস (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, দান্দান মুবারক শহীদ হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, كَيْفَ يُفْلِحُ قَوْمٌ شَجُّوا نَبِيَّهُمْ وَكَسَرُوا رَبَاعِيَتَهُ وَهُوَ يَدْعُوهُمْ إِلَى اللهِ ‘ঐ জাতি কিভাবে সফলকাম হবে, যারা তাদের নবীর মুখমণ্ডল আহত করেছে এবং তাঁর দাঁত ভেঙ্গে দিয়েছে। অথচ তিনি তাদেরকে আল্লাহর দিকে আহবান করছেন’।[1] ইবনু আববাস (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে যে, এ সময় তিনি বলেন,اشْتَدَّ غَضَبُ اللهِ عَلَى قَوْمٍ دَمَّوْا وَجْهَ رَسُولِهِ ‘আল্লাহর কঠিন গযব নাযিল হৌক ঐ জাতির উপরে যারা তাঁর রাসূলের চেহারাকে রক্তাক্ত করেছে’ (আহমাদ হা/২৬০৯, সনদ হাসান )

ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে যে, এ সময় তিনি বিগত এক নির্যাতিত নবীর বর্ণনা দিয়ে জাতির হেদায়াতের জন্য আল্লাহর নিকটে দো‘আ করে বলেন,رَبِّ اغْفِرْ لِقَوْمِى فَإِنَّهُمْ لاَ يَعْلَمُونَ ‘হে আমার পালনকর্তা! তুমি আমার কওমকে হেদায়াত কর। কেননা তারা (আমাকে) জানে না’।[2] আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে তিনি বলেন, إِنِّى لَمْ أُبْعَثْ لَعَّانًا وَإِنَّمَا بُعِثْتُ رَحْمَةً ‘আমি লা‘নতকারী হিসাবে প্রেরিত হইনি। বরং আমি প্রেরিত হয়েছি রহমত হিসাবে।[3]

একইরূপ কথা তিনি বলেন ঘাঁটিতে স্থিতি লাভের পর।[4] তখন নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়, لَيْسَ لَكَ مِنَ الأَمْرِ شَيْءٌ أَوْ يَتُوْبَ عَلَيْهِمْ أَوْ يُعَذَّبَهُمْ فَإِنَّهُمْ ظَالِمُوْنَ ‘আল্লাহ তাদের ক্ষমা করবেন অথবা শাস্তি দিবেন, সে বিষয়ে তোমার কিছুই করার নেই। কেননা তারা হ’ল যালেম’ (আলে ইমরান ৩/১২৮)।[5] এতে বুঝা যায় যে, যালেমদের শাস্তি দানের বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে আললাহর ইচ্ছাধীন। যখন চাইবেন তখন তিনি তাদের শাস্তি দিবেন। বান্দা কেবল দো‘আ করতে পারে। কবুল করার মালিক আল্লাহ।


[1]. মুসলিম হা/১৭৯১; মিশকাত হা/৫৮৪৯। প্রসিদ্ধ আছে যে, (১) আব্দুল্লাহ বিন ক্বামিআর তরবারির প্রচন্ড আঘাতে শিরস্ত্রাণের দু’টি কড়া রাসূল (ছাঃ)-এর চোখের নীচে হাঁড়ের মধ্যে ঢুকে যায়। যা বের করার জন্য হযরত আবুবকর (রাঃ) এগিয়ে গেলে আবু ওবায়দাহ ইবনুল জাররাহ (রাঃ) তাকে আল্লাহর দোহাই দেন ও নিজেই দাঁত দিয়ে কামড়ে ধীরে ধীরে টান দিয়ে একটা কড়া বের করে আনেন। এতে তাঁর উপরের সম্মুখ সারির একটি ‘ছানিয়া’ (ثَنِيَّةٌ) দাঁত ভেঙ্গে পড়ে যায়। দ্বিতীয়টির বেলায় আবুবকর (রাঃ) আবার এগিয়ে গেলেন। কিন্তু এবারেও তিনি আল্লাহর দোহাই দিয়ে তাঁকে সরিয়ে দেন ও নিজেই সেটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধীরে ধীরে টেনে বের করেন। এতে তার আরেকটি ‘ছানিয়া’ দাঁত ভেঙ্গে পড়ে যায়। এখান থেকে তাঁর লকব হয়ে যায় ‘দুই ছানিয়া দাঁত হারানো ব্যক্তি’ (سَاقِطُ الثَّنِيَتَيْنِ) হিসাবে’ (ইবনু হিশাম ২/৮০; যাদুল মা‘আদ ৩/১৮৩; আর-রাহীক্ব ২৭০ পৃঃ; ছহীহ ইবনু হিববান হা/৬৯৮০)। বর্ণনাটির সনদ মুনক্বাতি‘ বা যঈফ’ (মা শা-‘আ ১৪৩ পৃঃ)।

(২) আরও প্রসিদ্ধ আছে যে, সূরা মুজাদালাহ ২২ আয়াতটি আবু ওবায়দাহ ইবনুল জাররাহ (রাঃ)-এর উপলক্ষ্যে নাযিল হয় (তাফসীর কুরতুবী, বায়হাক্বী সুনান)। যখন তিনি ওহোদের যুদ্ধে কিংবা বদরের যুদ্ধে তার পিতাকে হত্যা করেন। বর্ণনাটির সনদ মুনক্বাতি‘ বা যঈফ (মা শা-‘আ ১২৪ পৃঃ)।

জানা আবশ্যক যে, দু’জন ছাহাবী রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে তাদের স্ব স্ব পিতাকে হত্যা করার অনুমতি চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তাদেরকে অনুমতি দেননি। একজন হ’লেন মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই-এর পুত্র আব্দুল্লাহ এবং অন্যজন হলেন আবু ‘আমের আর-রাহেব-এর পুত্র হানযালা ‘গাসীলুল মালায়িকাহ’। উভয়কে তিনি তাদের স্ব স্ব পিতার সঙ্গে সদাচরণ করতে বলেন (ছহীহ ইবনু হিববান, সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩২২৩; আল-ইছাবাহ, হানাযালাহ, ক্রমিক ১৮৬৫; মা শা-‘আ ১২৬)। অনুরূপভাবে রাসূল (ছাঃ) কর্তৃক তাঁর স্ত্রীদের সাথে ঈলা-র ঘটনার সময় ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) তাঁর কন্যা হাফছাহকে হত্যা করার অনুমতি চেয়েছিলেন। কিন্তু রাসূল (ছাঃ) তাকে নিষেধ করেন (মুসলিম হা/১৪৭৯, ‘তালাক’ অধ্যায়)।

[2]. বুখারী হা/৩৪৭৭; মুসলিম হা/১৭৯২; মিশকাত হা/৫৩১৩।

[3]. মুসলিম হা/২৫৯৯; মিশকাত হা/৫৮১২।

[4]. ইবনু হিশাম ২/৮৬; বুখারী হা/৪০৭৩-৭৬।

[5]. মুসলিম হা/১৭৯১।

প্রসিদ্ধ আছে যে, আবু সাঈদ খুদরীর পিতা মালেক ইবনু সিনান রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ললাট হ’তে রক্ত চেটে খেয়ে ফেলেন। তখন তাকে নিজের রক্ত মুছতে বলা হ’লে তিনি বলেন, আল্লাহর কসম! আমি রক্ত মুছবো না। বলেই তিনি ময়দানে ছুটলেন ও যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এটা দেখে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ مَسَّ دَمِي دَمَهُ لَمْ تُصِبْهُ النَّارُ ‘আমার রক্ত যার রক্তকে স্পর্শ করেছে, তাকে জাহান্নাম স্পর্শ করবে না’ (ইবনু হিশাম ২/৮০)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, مَنْ أَرَادَ أَنْ يَنْظُرَ إلَى رَجُلٍ مِنْ أَهْلِ الْجَنّةِ فَلْيَنْظُرْ إلَى هَذَا ‘যে ব্যক্তি কোন জান্নাতী ব্যক্তিকে দেখতে চায়, সে যেন এ ব্যক্তিকে দেখে’ (যাদুল মা‘আদ ৩/১৮৮; আর-রাহীক্ব ২৭২ পৃঃ; আল-ইছাবাহ ক্রমিক সংখ্যা ৭৬৪১)। অতঃপর তিনি যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে গেলেন। বর্ণনাটির সনদ মুনক্বাতি‘ বা যঈফ (মা শা-‘আ ১৪০-৪২ পৃঃ)।