আবু জাহল মক্কা থেকে রওয়ানার সময় দলবল নিয়ে কা‘বাগৃহের গেলাফ ধরে কেঁদে কেঁদে প্রার্থনা করেছিল, اللَّهُمَّ انْصُرْ أَقْرَانَا لِلضَّيْفِ وَأَوْصَلَنَا لِلرَّحِمِ وَأَفَكَّنَا لِلْعَانِيْ، إِنْ كَانَ مُحَمَّدٌ عَلَى حَقٍّ فَانْصُرْهُ وَاِنْ كُنَّا عَلَى حَقٍّ فَانْصُرْنَا، وَرُوِي اَنَّهُمْ قَالُوْا : اللهُمَّ انْصُرْ أَعْلَى الْجُنْدَيْنِ وَأَهْدَى الْفِئَتَيْنِ وَاَكْرَمَ الْحِزْبَيْنِ ‘হে আল্লাহ! তুমি সাহায্য কর আমাদের মধ্যেকার সর্বাধিক অতিথি আপ্যায়নকারী, সর্বাধিক আত্মীয়তা রক্ষাকারী ও বন্দী মুক্তি দানকারী দলকে’। ‘হে আল্লাহ! মুহাম্মাদ যদি সত্যের উপরে থাকে, তবে তুমি তাকে সাহায্য কর। আর যদি আমরা সত্যের উপর থাকি, তবে আমাদেরকে সাহায্য কর’। ‘হে আল্লাহ! তুমি সাহায্য কর আমাদের দু’দলের মধ্যকার সেরা সেনাদলকে, সেরা হেদায়াতপ্রাপ্ত ও সেরা সম্মানিত দলকে’।[1]
এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আবু জাহল আল্লাহকে সর্বশক্তিমান হিসাবে বিশ্বাস করত। যাকে ‘তওহীদে রুবূবিয়াত’ বলা হয়। এর ফলে কেউ মুসলমান হ’তে পারে না। কেননা মুসলিম হওয়ার জন্য ‘তওহীদে ইবাদত’-এর উপর ঈমান আনা যরূরী। যার মাধ্যমে মানুষ সার্বিক জীবনে আল্লাহর দাসত্ব করতে স্বীকৃত হয়। সেই সাথে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উপর ঈমান ও তাঁর আনীত শরী‘আতের বিধানসমূহ পালন করা অপরিহার্য।
অতঃপর রওয়ানা হওয়ার সময় তাদের মনে পড়ল বনু বকর গোত্রের কথা। যাদের সঙ্গে তাদের শত্রুতা ছিল। পথিমধ্যে তারা হামলা করতে পারে। ফলে মাক্কী বাহিনী দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে গেল। কিন্তু শয়তানী প্ররোচনায় গর্বোদ্ধত হয়ে তারা বেরিয়ে পড়ল। উক্ত প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, وَلاَ تَكُونُوا كَالَّذِينَ خَرَجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ بَطَرًا وَرِئَاءَ النَّاسِ وَيَصُدُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللهِ وَاللهُ بِمَا يَعْمَلُونَ مُحِيطٌ ‘আর তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা তাদের ঘর (মক্কা) থেকে বের হয়েছিল দর্পভরে ও লোক দেখিয়ে এবং যারা আল্লাহর পথ থেকে লোকদের বাধা দিত। অথচ আল্লাহ তাদের সকল কাজ পরিবেষ্টন করে আছেন’ (আনফাল ৮/৪৭)। এভাবে শয়তান মানুষের অন্তরে ধোঁকা সৃষ্টি করে। যাতে তার স্বাভাবিক বোধশক্তি লুপ্ত হয় এবং সে পথভ্রষ্ট হয়। যেমন বদরের যুদ্ধে শয়তানের ভূমিকা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, وَإِذْ زَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ أَعْمَالَهُمْ وَقَالَ لاَ غَالِبَ لَكُمُ الْيَوْمَ مِنَ النَّاسِ وَإِنِّي جَارٌ لَكُمْ فَلَمَّا تَرَاءَتِ الْفِئَتَانِ نَكَصَ عَلَى عَقِبَيْهِ وَقَالَ إِنِّي بَرِيءٌ مِنْكُمْ إِنِّي أَرَى مَا لاَ تَرَوْنَ إِنِّي أَخَافُ اللهَ وَاللهُ شَدِيدُ الْعِقَابِ ‘আর যখন শয়তান (বদরের দিন) কাফেরদের নিকট তাদের কাজগুলিকে শোভনীয় করে দেখিয়েছিল এবং বলেছিল আজ লোকদের মধ্যে তোমাদের উপর বিজয়ী হবার মত কেউ নেই। আর আমি তোমাদের সাথে আছি। কিন্তু যখন দু’দল মুখোমুখী হ’ল, তখন সে পিছন ফিরে পালালো এবং বলল, আমি তোমাদের থেকে মুক্ত। আমি যা দেখেছি তোমরা তা দেখোনি। আমি আল্লাহকে ভয় করি। আর আল্লাহ কঠিন শাস্তিদাতা’ (আনফাল ৮/৪৮)।
শয়তানের দোসর মুনাফিকদের সম্পর্কেও আল্লাহ অনুরূপ বলেন,إِذْ يَقُولُ الْمُنَافِقُونَ وَالَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ غَرَّ هَؤُلاَءِ دِينُهُمْ وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ فَإِنَّ اللهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ ‘যেদিন মুনাফিকরা এবং যাদের অন্তরে রোগ ছিল, তারা বলেছিল, এদের দ্বীন এদেরকে (মুসলমানদেরকে) প্রতারিত করেছে (অর্থাৎ ধর্মান্ধ করেছে)। অথচ যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে (আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট)। কেননা আল্লাহ মহা পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’ (আনফাল ৮/৪৯)। অতঃপর মানুষের বিরুদ্ধে শয়তানের চিরন্তন রীতি সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
كَمَثَلِ الشَّيْطَانِ إِذْ قَالَ لِلْإِنْسَانِ اكْفُرْ فَلَمَّا كَفَرَ قَالَ إِنِّي بَرِيءٌ مِنْكَ إِنِّي أَخَافُ اللهَ رَبَّ الْعَالَمِينَ- فَكَانَ عَاقِبَتَهُمَا أَنَّهُمَا فِي النَّارِ خَالِدَيْنِ فِيهَا وَذَلِكَ جَزَاءُ الظَّالِمِينَ
‘(মুনাফিকরা) শয়তানের মত। যে মানুষকে কাফের হ’তে বলে। অতঃপর যখন সে কাফের হয়, তখন শয়তান বলে, আমি তোমার থেকে মুক্ত। আমি বিশ্বপালক আল্লাহকে ভয় করি’। ‘অতঃপর উভয়ের পরিণতি হয় এই যে, তারা জাহান্নামে যাবে এবং সেখানে চিরকাল বসবাস করবে। আর এটাই হ’ল যালেমদের শাস্তি’ (হাশর ৫৯/১৬-১৭)।[2] বস্ত্ততঃ আবু জাহল শয়তানের ধোঁকায় পড়েই রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে রওয়ানা হয়েছিল। অতঃপর কুরায়েশ বাহিনী যথারীতি দ্রুতবেগে এসে বদর উপত্যকার শেষপ্রান্তে টিলার অপর পার্শ্বে শিবির সন্নিবেশ করে।
[2]. প্রসিদ্ধ আছে যে, ইবলীস এ সময় বনু কিনানাহ গোত্রের নেতা সুরাক্বাহ বিন মালেক বিন জু‘শুম আল-মুদলিজীর রূপ ধারণ করে এসে বলল, ‘আমি তোমাদের বন্ধু’ (أَنَا لَكُمْ جَارٌ)। আমি তোমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিচ্ছি। এই আশ্বাস পাওয়ার পর কুরায়েশগণ মদীনা অভিমুখে খুব দ্রুতবেগে বদর প্রান্তরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যায় (আর-রাহীক্ব ২০৬ পৃঃ; ইবনু হিশাম ১/৬১২)। বর্ণনাটি ‘মুরসাল’ বা যঈফ (মা শা-‘আ ১০৮ পৃঃ)।