নবীদের কাহিনী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) - মাদানী জীবন ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ১ টি
মাদানী বাহিনীর বদরে উপস্থিতি (وصول الجيش المدنى فى بدر)

রাওহাতে অনুষ্ঠিত পরামর্শ সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ‘বদর’ অভিমুখে রওয়ানা হন। অতঃপর ‘ছাফরা’ টিলা সমূহ অতিক্রম করে বদর প্রান্তরের নিকটবর্তী স্থানে অবতরণ করেন। সেখান থেকে তিনি বাসবাস বিন আমর আল-জুহানী এবং ‘আদী বিন আবুয যাগবা আল-জুহানীকে বদরের খবরাখবর নেবার জন্য পাঠান’ (মুসলিম হা/১৯০১)

এরপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আলী, যুবায়ের ও সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছের নেতৃত্বে একটি গোয়েন্দা দল পাঠান শত্রুপক্ষের আরও তথ্যাদি সংগ্রহের জন্য। তারা গিয়ে দেখেন যে, দু’জন লোক বদরের ঝর্ণাধারা থেকে পানির মশক ভরছে। তাঁরা তাদের পাকড়াও করে নিয়ে এলেন। অতঃপর জিজ্ঞাসাবাদে ও সামান্য পিটুনী দেওয়ার পরে জানতে পারলেন যে, এরা আবু সুফিয়ানের লোক নয়। বরং তারা কুরায়েশ বাহিনীর লোক। কুরায়েশ বাহিনী উপত্যকার শেষপ্রান্তে টিলার অপর পার্শ্বে শিবির গেড়েছে। তাদের জন্য সে উটের পিঠে করে পানি বহন করে নিয়ে যাচ্ছে’।[1] তারপর ওদের নেতৃবর্গের নাম জিজ্ঞেস করলে তিনি আবু জাহল, উৎবা, শায়বা, উমাইয়া বিন খালাফ প্রমুখ মক্কার সেরা ব্যক্তিবর্গের নামগুলি জানতে পারেন। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘এইটি অমুকের নিহত হওয়ার স্থান, এইটি অমুকের নিহত হওয়ার স্থান’। রাবী আনাস (রাঃ) বলেন, ‘তাদের নিহতদের কেউই উক্ত ইশারার স্থান থেকে দূরে যেতে পারেনি’।[2] তবে তারা সঠিক সংখ্যা বলতে পারল না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, দৈনিক কয়টা উট যবহ করা হয়? তারা বলল, নয়টা অথবা দশটা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তাহ’লে ওদের সংখ্যা নয়শত অথবা হাযার-এর মধ্যে হবে। কেননা একটি উট ১০০ জনের বা তার কাছাকাছিদের জন্য।[3]

এরপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নির্দেশে মুসলিম বাহিনী দ্রুত গিয়ে এশার সময় বদরের উপরে দখল নিল, যা ছিল ঝর্ণাধারার পাশেই। অতঃপর আউস নেতা সা‘দ বিন মু‘আয (রাঃ)-এর প্রস্তাবক্রমে যুদ্ধক্ষেত্রের উত্তর-পূর্ব পার্শ্বে একটি উঁচু টিলার উপরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জন্য তাঁবুর (عَرِيْشٌ) ব্যবস্থা করা হ’ল। সেখানে তাঁর সাথে কেবল আবুবকর (রাঃ) রইলেন এবং পাহারায় রইলেন সা‘দ বিন মু‘আয-এর নেতৃত্বে একদল আনছার যুবক। সা‘দ সেখানে বিশেষ সওয়ারীও প্রস্ত্তত রাখলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বললেন, যদি আমরা যুদ্ধে পরাজিত হই, তাহ’লে আপনি এই সওয়ারীতে করে দ্রুত মদীনায় চলে যাবেন। কেননা فَقَدْ تَخَلَّفَ عَنْكَ أَقْوَامٌ، يَا نَبِيَّ اللهِ، مَا نَحْنُ بِأَشَدَّ لَكَ حُبًّا مِنْهُمْ ... يَمْنَعُكَ اللهُ بِهِمْ، يُنَاصِحُونَكَ وَيُجَاهِدُونَ مَعَكَ ‘সেখানে রয়েছে হে আল্লাহর নবী! আপনার জন্য আমাদের চাইতে অধিক জীবন উৎসর্গকারী একদল ভাই। আপনাকে ভালোবাসায় আমরা তাদের চাইতে অধিকতর অগ্রগামী নই। যারা যুদ্ধে কখনোই আপনার থেকে পিছনে থাকবে না। আল্লাহ তাদের মাধ্যমে আপনাকে হেফাযত করবেন। তারা আপনার শুভাকাংখী এবং তারা আপনার সঙ্গে থেকে জিহাদ করবে’। সা‘দের এ বীরত্বব্যঞ্জক কথায় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) অত্যন্ত প্রীত হ’লেন ও তার জন্য কল্যাণের দো‘আ করলেন(دَعَا لَهُ بِخَيْرٍ)।[4]

অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যুদ্ধ কৌশল অনুযায়ী সেনাদলকে বিন্যস্ত করেন এবং সুষ্ঠুভাবে শিবির সন্নিবেশ করেন।

[1]. ইবনু হিশাম ১/৬১৬; যাদুল মা‘আদ ৩/১৫৬।

[2]. মুসলিম হা/১৭৭৯; আবুদাঊদ হা/২৬৮১।

[3]. আহমাদ হা/৯৪৮, সনদ ছহীহ; ইবনু হিশাম ১/৬১৬-১৭।

(১) প্রসিদ্ধ আছে যে, এ সময়ে রাসূল (ছাঃ) বলে ওঠে هَذِهِ مَكَّةُ قَدْ أَلْقَتْ إلَيْكُمْ أَفْلاَذَ كَبِدِهَا-‘এই যে মক্কা তার কলিজার টুকরাগুলোকে তোমাদের কাছে নিক্ষেপ করেছে’ বর্ণনাটির সনদ ‘মুরসাল’ (আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ ২২২ পৃঃ; মা শা-‘আ ১০৬ পৃঃ)।

(২) আরও প্রসিদ্ধ আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বদরে পৌঁছে শত্রুবাহিনীর তথ্য জানার জন্য পায়ে হেঁটে নিজেই রওয়ানা হন আবুবকর (রাঃ)-কে সাথে নিয়ে। সেখানে এক বৃদ্ধের সঙ্গে সাক্ষাৎ হ’লে তিনি তার কাছে উভয় বাহিনী সম্পর্কে জানতে চান। বৃদ্ধ তাদেরকে তারা কোন বাহিনীর লোক সেকথা জানানোর শর্তে তথ্য দিল যে, আমি রওয়ানা হবার যে সংবাদ পেয়েছি, তাতে মুহাম্মাদের বাহিনী আজকে অমুক স্থানে রয়েছে এবং কুরায়েশ বাহিনী অমুক স্থানে রয়েছে। বৃদ্ধের অনুমান সঠিক ছিল। এবার শর্তানুযায়ী রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জবাব দিলেন, نَحْنُ مِنْ مَاءٍ ‘আমরা একই পানি হ’তে’ (অর্থাৎ একই বংশের)। রাসূল (ছাঃ)-এর এই ইঙ্গিতপূর্ণ জবাবে বৃদ্ধ কিছুই বুঝতে না পেরে বিড় বিড় করতে করতে চলে গেল (ইবনু হিশাম ১/৬১৬; আর-রাহীক্ব ২১০ পৃঃ)। বর্ণনাটির সনদ মুনক্বাতি‘ (যঈফ), মা শা-‘আ ১০৫ পৃঃ।

[4]. ইবনু হিশাম ১/৬২০-২১; আর-রাহীক্ব ২১১-১২ পৃঃ; সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৬২।

প্রসিদ্ধ আছে যে, এ সময় সামরিক বিষয়ে দক্ষ ছাহাবী হুবাব ইবনুল মুনযির ইবনুল জামূহ (حُباب بن المنذر ابن الجموح) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! এখানে কি আল্লাহর নির্দেশক্রমে অবতরণ করলেন, না-কি যুদ্ধকৌশল হিসাবে? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, যুদ্ধকৌশল মনে করে’। তখন তিনি বললেন, ‘এটি উপযুক্ত স্থান নয়। কেননা এখান থেকে আগে বা পিছে যাবার কোন সুযোগ নেই’। অতএব আরো এগিয়ে কুরায়েশ শিবিরের নিকটবর্তী প্রস্রবণটি আমাদের দখলে নিতে হবে এবং সবগুলি ঝর্ণাস্রোত ঘুরিয়ে এক জায়গায় এনে পানি এক স্থানে সঞ্চয় করতে হবে। কুরায়েশরা টিলার মাথায় উচ্চভূমিতে অবস্থান করছে। যুদ্ধ শুরু হ’লে পানির প্রয়োজনে ওরা নীচে এসে আর পানি পাবে না। তখন পানির সঞ্চয়টি থাকবে আমাদের দখলে’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার পরামর্শ গ্রহণ করলেন এবং এগিয়ে গিয়ে কুরায়েশ বাহিনীর নিকটবর্তী পানির প্রস্রবণটি দখলে নিলেন। তারপর অন্যান্য সব ব্যবস্থা শেষ করলেন (ইবনু হিশাম ১/৬২০; আর-রাহীক্ব ২১১ পৃঃ; সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৬০)। হুবাবের পরামর্শদানের পর জিব্রীল অবতরণ করেন ও রাসূল (ছাঃ)-কে বলেন, আল্লাহ আপনাকে সালাম দিয়েছেন এবং বলেছেন যে, হুবাবের উক্ত রায় সঠিক’ (ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা আনফাল ৭ আয়াত)। উক্ত মর্মের বর্ণনাগুলির সনদ ‘মুনকার’ ও যঈফ (আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ ২২৪ পৃঃ; মা শা-‘আ ১১০ পৃঃ)। বরং ছহীহ হাদীছসমূহ দ্বারা এটাই প্রমাণিত যে, রাসূল (ছাঃ) তাঁর ছাহাবীগণের সাথে পরামর্শক্রমেই যুদ্ধকৌশল নির্ধারণ করেছিলেন। ‘অহি’ বহির্ভূত সকল বিষয়ে তিনি এভাবেই সিদ্ধান্ত নিতেন।