ইউসুফ যে এ ব্যাপারে শতভাগ নিষ্পাপ ছিলেন, সে বিষয়ে নিম্নোক্ত বিষয়গুলি দ্রষ্টব্য:
(১) ইউসুফ দৃঢ়ভাবে নিজের নির্দোষিতা ঘোষণা করেন। যেমন গৃহস্বামীর কাছে তিনি বলেন, هِيَ رَاوَدَتْنِيْ عَنْ نَفْسِيْ ‘উক্ত মহিলাই আমাকে প্ররোচিত করেছিল’ (ইউসুফ ২৬)। তার আগে তিনি মহিলার কুপ্রস্তাবের জওয়াবে বলেছিলেন, مَعَاذَ اللهِ إِنَّهُ رَبِّيْ أَحْسَنَ مَثْوَايَ إِنَّهُ لاَ يُفْلِحُ الظَّالِمُوْنَ ‘আল্লাহ আমাকে রক্ষা করুন! তিনি (অর্থাৎ গৃহস্বামী) আমার মনিব। তিনি আমার উত্তম বসবাসের ব্যবস্থা করেছেন। নিশ্চয়ই সীমা লংঘনকারীগণ সফলকাম হয় না’ (ইউসুফ ২৩)। নগরীর মহিলাদের সমাবেশে গৃহকত্রী যখন ইউসুফকে তার কুপ্রস্তাবে রাযী না হ’লে জেলে পাঠানোর হুমকি দেন, তখন ইউসুফ তার জওয়াবে বলেছিলেন, رَبِّ السِّجْنُ أَحَبُّ إِلَيَّ مِمَّا يَدْعُونَنِيْ إِلَيْهِ ‘হে আমার পালনকর্তা! এরা আমাকে যে কাজের দিকে আহবান জানাচ্ছে, তার চাইতে কারাগারই আমার নিকটে অধিক পসন্দনীয়’ (ইউসুফ ৩৩)। এখানে তিনি তাদের চক্রান্ত থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর আশ্রয় ভিক্ষা করেন।
(২) উক্ত মহিলা নিজেই ইউসুফের নির্দোষিতার সাক্ষ্য দেন। যেমন নগরীর মহিলাদের সমাবেশে তিনি বলেন, وَلَقَدْ رَاوَدتُّهُ عَنْ نَّفْسِهِ فَاسَتَعْصَمَ ‘আমি তাকে প্ররোচিত করেছিলাম, কিন্তু সে নিজেকে সংযত রেখেছিল’ (ইউসুফ ৩২)। পরবর্তীতে যখন ঘটনা পরিষ্কার হয়ে যায়, তখনও উক্ত মহিলা বলেন, الآنَ حَصْحَصَ الْحَقُّ أَنَا رَاوَدتُّهُ عَنْ نَّفْسِهِ وَإِنَّهُ لَمِنَ الصَّادِقِيْنَ ‘এখন সত্য প্রকাশিত হ’ল। আমিই তাকে ফুসলিয়েছিলাম এবং সে ছিল সত্যবাদী’ (ইউসুফ ৫১)।
(৩) তদন্তকালে নগরীর সকল মহিলা ইউসুফ সম্পর্কে সত্য সাক্ষ্য দেন। তারা বলেন, حَاشَ ِللهِ مَا عَلِمْنَا عَلَيْهِ مِنْ سُوْءٍ ‘আল্লাহ পবিত্র। আমরা ইউসুফ সম্পর্কে মন্দ কিছুই জানি না’ (ইউসুফ ৫১)।
(৪) গৃহকর্তা আযীযে মিছর তার নির্দোষিতার সাক্ষ্য দিয়ে বলেন, إِنَّهُ مِنْ كَيْدِكُنَّ إِنَّ كَيْدَكُنَّ عَظِيْمٌ ‘(হে স্ত্রী!) এটা তোমাদের ছলনা মাত্র। নিঃসন্দেহে তোমাদের ছলনা খুবই মারাত্মক’ (ইউসুফ ২৮)। ‘ইউসুফ! এ প্রসঙ্গ ছাড়। আর হে মহিলা! এ পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চিতভাবে তুমিই পাপাচারিনী’ (ঐ, ২৯)।
(৫) গৃহকর্তার উপদেষ্টা ও সাক্ষী একইভাবে সাক্ষ্য দেন ও বলেন, وَإِنْ كَانَ قَمِيْصُهُ قُدَّ مِنْ دُبُرٍ فَكَذَبَتْ وَهُوَ مِنَ الصَّادِقِيْنَ ‘যদি ইউসুফের জামা পিছন দিকে ছেঁড়া হয়, তবে মহিলা মিথ্যা বলেছে এবং ইউসুফ সত্যবাদী’ (ঐ, ২৭)।
(৬) আল্লাহ স্বয়ং ইউসুফের নির্দোষিতার সাক্ষ্য দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেন, كَذَلِكَ لِنَصْرِفَ عَنْهُ السُّوْءَ وَالْفَحْشَاءَ إِنَّهُ مِنْ عِبَادِنَا الْمُخْلَصِيْنَ ‘এভাবেই এটা এজন্য হয়েছে, যাতে আমরা তার থেকে যাবতীয় মন্দ ও নির্লজ্জ বিষয় সরিয়ে দেই। নিশ্চয়ই সে আমাদের মনোনীত বান্দাগণের অন্যতম’ (ঐ, ২৪)।
(৭) এমনকি অভিশপ্ত ইবলীসও প্রকারান্তরে ইউসুফের নির্দোষিতার সাক্ষ্য দিয়েছে। যেমন সে অভিশপ্ত হওয়ার পর আল্লাহ্কে বলেছিল, لَأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِيْنَ، إِلاَّ عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِيْنَ- ‘আমি অবশ্যই তাদের (বনু আদমের) সবাইকে পথভ্রষ্ট করব’। ‘তবে তাদের মধ্য হ’তে তোমার মনোনীত বান্দাগণ ব্যতীত (হিজর ৩৯-৪০; ছোয়াদ ৮২)। এখানে একই শব্দ ব্যবহার করে আল্লাহ ইউসুফকে তাঁর ‘মনোনীত বান্দাগণের অন্যতম’ (ইউসুফ ২৪) বলে ঘোষণা করেছেন।
অত্র ২৪ আয়াতে বর্ণিত (السُّوءَ وَالْفَحْشَاء) ‘মন্দ ও নির্লজ্জ বিষয়সমূহ’ অর্থ কি? এ বিষয়ে বিদ্বানগণ বলেন, মুখের বা হাতের দ্বারা স্পর্শ করার পাপ এবং প্রকৃত যেনার পাপ। অর্থাৎ উভয় প্রকার পাপ থেকে আল্লাহ ইউসুফকে ফিরিয়ে নেন।
নিকৃষ্ট মনের অধিকারী ইহুদীরা ও তাদের অনুসারীরা, যারা ইউসুফের চরিত্রে কালিমা লেপন করে নানাবিধ কল্পনার ফানুস উড়িয়ে শত শত পৃষ্ঠা মসীলিপ্ত করেছে, তাদের উদ্দেশ্যে ইমাম রাযী (রহঃ) বলেন, ‘যেসব মূর্খরা ইউসুফের চরিত্রে কলংক লেপনের চেষ্টা করে, তারা যদি আল্লাহর দ্বীনের অনুসারী হবার দাবীদার হয়, তাহ’লে তারা এ ব্যাপারে আল্লাহর সাক্ষ্য কবুল করুক। অথবা যদি তারা শয়তানের তাবেদার হয়, তবে ইবলীসের সাক্ষ্য কবুল করুক’। আসল কথা এই যে, ইবলীস এখন এদের শিষ্যে পরিণত হয়েছে।
এক্ষণে আয়াতের গৃহীত ব্যাখ্যা দু’টির সারমর্ম হ’ল (১) আল্লাহর পক্ষ হ’তে প্রমাণ মওজুদ থাকার কারণে ইউসুফের অন্তরে আদৌ বাজে কল্পনার উদয় হয়নি (২) প্রমাণ দেখার কারণে কল্পনার বুদ্বুদ সাথে সাথে মিলে যায় এবং তিনি আল্লাহর আশ্রয় কামনা করেন ও দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান।
এক্ষণে প্রশ্ন হ’ল: ঐ ‘বুরহান’ বা প্রমাণটি কি ছিল, যা তিনি দেখেছিলেন? এ বিষয়ে ইবনু আববাস, আলী, ইকরিমা, মুজাহিদ, সুদ্দী, সাঈদ ইবনু জুবায়ের, ইবনু সীরীন, ক্বাতাদাহ, হাসান বাছরী, যুহরী, আওযাঈ, কা‘ব আল-আহবার, ওহাব বিন মুনাবিবহ এবং অন্যান্য প্রসিদ্ধ বিদ্বান মন্ডলীর নামে এমন সব উদ্ভট ও নোংরা কাল্পনিক চিত্রসমূহ তাফসীরের কেতাব সমূহে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, যা পড়তেও ঘৃণাবোধ হয় ও লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। শুরু থেকে এ যাবত কালের কোন তাফসীরের কেতাবই সম্ভবতঃ এইসব ভিত্তিহীন ও কাল্পনিক গল্প থেকে মুক্ত নয়। উক্ত মুফাসসিরগণের তাক্বওয়া ও বিদ্যাবত্তার প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেও বলতে বাধ্য হব যে, ইউসুফের প্রতি সুধারণা রাখা সত্ত্বেও তাঁরা প্রাচীন কালের ইহুদী যিন্দীক্বদের বানোয়াট কাহিনী সমূহের কিছু কিছু স্ব স্ব কিতাবে স্থান দিয়ে দুধের মধ্যে বিষ মিশ্রিত করেছেন। যা এ যুগের নাস্তিক ও যিন্দীক্বদের জন্য নবীগণের নিষ্পাপত্বের বিরুদ্ধে প্রচারের মোক্ষম হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে তা ধর্মভীরু মানুষের ধর্মচ্যুতির কারণ হয়েছে। সাথে সাথে এগুলি কিছু পেট পূজারী কাহিনীকারের রসালো গল্পের খোরাক হয়েছে। তাফসীরের নামে যা শুনে মানুষ ক্রমেই ইসলাম থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। অতএব ঈমানদারগণ সাবধান!!