নবীদের কাহিনী ১১. হযরত ইউসুফ (আলাইহিস সালাম) ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ১ টি

সূরা ইউসুফের মোট ৯ (নয়)টি আয়াতের ব্যাখ্যায় বিদ্বানগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। আয়াতগুলি হ’ল যথাক্রমে ৪, ৬, ৮, ১৫, ২৪, ২৬, ২৮, ৪২ ও ৫২ আমরা এখানে সেগুলি সংক্ষেপে তুলে ধরব এবং গৃহীত ব্যাখ্যাটি পেশ করব।-

১. আয়াত সংখ্যা ৪ : (أَحَدَ عَشَرَ كَوْكَباً ) ‘এগারোটি নক্ষত্র’। জনৈক ইহুদীর প্রশ্নের উত্তরে রাসূলের বরাত দিয়ে উক্ত ১১টি নক্ষত্রের নাম সহ হাদীছ বর্ণনা করা হয়েছে।[38] যাদেরকে ইউসুফ আকাশে তাকে সিজদা করতে দেখেন। অথচ হাদীছটি ভিত্তিহীন।

এখানে গৃহীত ব্যাখ্যা হ’ল, ইউসুফের বাকী ১১ ভাই হ’লেন ১১টি নক্ষত্র এবং তাঁর পিতা-মাতা হ’লেন সূর্য ও চন্দ্র, যারা একত্রে ইউসুফকে সম্মানের সিজদা করেন। যা বর্ণিত হয়েছে সূরা ইউসুফ ১০০ নম্বর আয়াতে।

২. আয়াত সংখ্যা ৬ : (وَيُعَلِّمُكَ مِن تَأْوِيلِ الأَحَادِيثِ ) ‘এবং তোমাকে বাণী সমূহের নিগুঢ় তত্ত্ব শিক্ষা দেবেন’। এখানে একদল বিদ্বান বলেছেন, ‘বাণী সমূহের নিগুঢ় তত্ত্ব’ অর্থ আল্লাহর কিতাব ও নবীগণের সুন্নাত সমূহের অর্থ উপলব্ধি করা। এখানে গৃহীত ব্যাখ্যা হ’ল : স্বপ্ন ব্যাখ্যা দানের ক্ষমতা, যা বিশেষভাবে হযরত ইউসুফ (আঃ)-কে দেওয়া হয়েছিল। আল্লাহর বাণী সমূহ, যা তাঁর কিতাব সমূহে এবং নবীগণের সুন্নাত সমূহে বিধৃত হয়েছে, সেসবের ব্যাখ্যাও এর মধ্যে শামিল রয়েছে।

৩. আয়াত সংখ্যা ৮ : (إِنَّ أَبَانَا لَفِي ضَلاَلٍ مُّبِينٍ ) ‘নিশ্চয়ই আমাদের পিতা স্পষ্ট ভ্রান্তির মধ্যে রয়েছেন’। ইউসুফের বিমাতা দশ ভাই তাদের পিতা হযরত ইয়াকূব (আঃ)-কে একথা বলেছিল শিশুপুত্র ইউসুফ ও তার ছোট ভাই বেনিয়ামীনের প্রতি তাঁর স্নেহাধিক্যের অভিযোগ এনে। একই কথা তাঁকে পরিবারের অন্যেরা কিংবা প্রতিবেশীরাও বলেছিল, যখন ইউসুফের সাথে সাক্ষাতের পর তার ব্যবহৃত জামা নিয়ে ভাইদের কাফেলা কেন‘আনের উদ্দেশ্যে মিসর ত্যাগ করছিল। পিতা ইয়াকূব তখন বলেছিলেন, إِنِّي لَأَجِدُ رِيْحَ يُوْسُفَ ‘আমি ইউসুফের গন্ধ পাচ্ছি’ (ইউসুফ ৯৪)। জবাবে লোকেরা বলেছিল, تَاللهِ إِنَّكَ لَفِيْ ضَلاَلِكَ الْقَدِيْمِ ‘আল্লাহর কসম! আপনি তো সেই পুরানো ভ্রান্তিতেই পড়ে আছেন’ (ইউসুফ ৯৫)

এখানে ‘ভ্রান্তি’ (ضلل ) অর্থ ‘প্রকৃত বিষয় সম্পর্কে না জানা’। যেমন শেষনবী (ছাঃ) সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন, وَوَجَدَكَ ضَالاًّ فَهَدَى ‘তিনি তোমাকে পেয়েছিলেন পথহারা। অতঃপর তিনি পথ দেখিয়েছেন’ (আয-যোহা ৭)। অতএব গৃহীত ব্যাখ্যা হ’ল এই যে, এখানে ضلال বা ভ্রান্তি কথাটি আভিধানিক অর্থে এসেছে পারিভাষিক অর্থে নয়। কেননা পারিভাষিক অর্থে ضلال বা ভ্রষ্টতার অর্থ ضلال في الدين ‘ধর্মচ্যুত হওয়া’। নবীপুত্র হিসাবে ইউসুফের ভাইয়েরা তাদের পিতা নবী ইয়াকূবকে নিশ্চয়ই ধর্মচ্যুত কাফের বলেনি।

৪. আয়াত সংখ্যা ১৫ : (فَلَمَّا ذَهَبُوا بِهِ وَأَجْمَعُواْ أَن يَّجْعَلُوْهُ فِي غَيَابَةِ الْجُبِّ وَأَوْحَيْنَا إِلَيْهِ لَتُنَبِّئَنَّهُمْ بِأَمْرِهِمْ هَـذَا وَهُمْ لاَ يَشْعُرُوْنَ) ‘অতঃপর তারা যখন তাকে নিয়ে যাত্রা করল এবং অন্ধকূপে নিক্ষেপ করতে একমত হ’ল, তখন আমরা তাকে অহী (ইলহাম) করলাম যে, (এমন একটা দিন আসবে, যখন) অবশ্যই তুমি তাদেরকে তাদের এ কুকর্মের কথা অবহিত করবে। অথচ তারা তোমাকে চিনতে পারবে না’।

এখানে বিদ্বানগণ মতভেদ করেছেন ‘যখন তারা তাকে নিয়ে যাত্রা করল’-এর لَمَّا অর্থাৎ ‘যখন’-এর জওয়াব নিয়ে। অর্থাৎ কূপে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পূর্বে না পরে এই ইলহাম হয়েছিল। কোন কোন বিদ্বান বলেছেন, কূপে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর ভাইয়েরা যখন রক্ত মাখা জামা নিয়ে পিতার নিকটে এসে কৈফিয়ত পেশ করে (ইউসুফ ১৭), তখন ইউসুফকে সান্ত্বনা দিয়ে এ ইলহাম করা হয়।

এক্ষেত্রে গৃহীত ব্যাখ্যা হ’ল: (وَأَوْحَيْنَا إِلَيْهِ )-এর واو এসেছে (لَمَّا )-এর জওয়াব হিসাবে এবং তা বাক্যে صلة হয়েছে। ফলে ব্যাখ্যা দাঁড়াবে এই যে, কূয়ায় নিক্ষিপ্ত হওয়ার পূর্বেই এ ইলহাম করা হয়েছিল। আর এটি বাস্তবায়িত হয়েছিল বহু বৎসর পরে যখন ইউসুফের সঙ্গে তার ভাইদের সাক্ষাৎ হয়। অথচ তারা তাঁকে চিনতে পারেনি (ইউসুফ ৫৮)। ইউসুফ তার ভাইদের সেদিন বলেছিলেন, ‘তোমাদের কি জানা আছে যা তোমরা করেছিলে ইউসুফ ও তার ভাইয়ের সাথে? যখন তোমরা (পরিণাম সম্পর্কে) অজ্ঞ ছিলে’? ‘তারা বলল, তবে কি তুমিই ইউসুফ? তিনি বললেন, আমিই ইউসুফ, আর এ হ’ল আমার (সহোদর) ভাই। আল্লাহ আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন... (ইউসুফ ৮৯-৯০)

৫. আয়াত সংখ্যা ২৪ : (وَلَقَدْ هَمَّتْ بِهِ وَهَمَّ بِهَا لَوْلاَ أَن رَّآ بُرْهَانَ رَبِّهِ) ‘উক্ত মহিলা তার বিষয়ে কুচিন্তা করেছিল। আর সেও তার প্রতি কল্পনা করত, যদি না সে স্বীয় পালনকর্তার প্রমাণ অবলোকন করত..’।

এখানে প্রথম প্রশ্ন হ’লঃ ইউসুফ উক্ত মহিলার প্রতি কোনরূপ অন্যায় কল্পনা করেছিলেন কি-না। দ্বিতীয় প্রশ্ন হ’ল, তিনি যে আল্লাহর পক্ষ হ’তে ‘প্রমাণ’ (برهان ) অবলোকন করেছিলেন সেটা কি?

প্রথম প্রশ্নের জওয়াব হ’ল দ্বিবিধ: (১) অনিচ্ছাকৃতভাবে কল্পনা এসে থাকতে পারে। যা বেগানা নারী-পুরুষের মধ্যে হ’তে পারে। কিন্তু বুদ্বুদের ন্যায় উবে যাওয়া চকিতের এই কল্পনা কোন পাপের কারণ নয়। কেননা তিনি নিজেকে সংযত রেখেছিলেন এবং ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। ভবিষ্যৎ নবী হিসাবে যেটা তাঁর জন্য স্বাভাবিক ছিল। আল্লাহ বলেন, وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَى، فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَى- ‘যে ব্যক্তি তার প্রভুর সত্তাকে ভয় করে এবং নিজেকে প্রবৃত্তির তাড়না থেকে বিরত রাখে’, ‘নিশ্চয়ই জান্নাত তার ঠিকানা হবে’ (নাযে‘আত ৪০-৪১)। মুনাফিকদের কুপরামর্শে ওহোদের যুদ্ধ থেকে বনু হারেছাহ ও বনু সালামাহ পালিয়ে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু পালায়নি। যে বিষয়ে আল্লাহ বলেন, إِذْ هَمَّتْ طَّآئِفَتَانِ مِنْكُمْ أَن تَفْشَلاَ وَالله ُوَلِيُّهُمَا وَعَلَى اللهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُوْنَ ‘যখন তোমাদের দু’টি দল সাহস হারাবার উপক্রম করেছিল, অথচ আল্লাহ তাদের অভিভাবক ছিলেন, আর আল্লাহর উপরেই বিশ্বাসীদের ভরসা করা উচিত’ (আলে ইমরান ১২২)

এখানে একই هَمَّتْ (কল্পনা করছিল) ক্রিয়া ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ আল্লাহ তাদের ক্ষমা করেন এবং নিজেকে তাদের অভিভাবক বলে বরং তাদের প্রশংসা করেছেন। উল্লেখ্য যে, هَمٌّ বা কল্পনা দু’ধরনের হয়ে থাকে। এক- هم ثابت বা দৃঢ় কল্পনা, যা আযীয-পত্নী করেছিল ইউসুফের প্রতি। দুই- هم عارض অনিচ্ছাকৃত কল্পনা, যাতে কোন দৃঢ় সংকল্প থাকে না। ইউসুফের মধ্যে যদি এটা এসে থাকে বলে মনে করা হয়, তবে তাতে তিনি দোষী হবেন না। কেননা তিনি ঐ কল্পনার কথা মুখে বলেননি বা কাজে করেননি। বরং তার বিরুদ্ধে বলেছেন ও করেছেন।

দ্বিতীয় জওয়াব হ’ল এই যে, ইউসুফের মনে আদৌ কোন অন্যায় কল্পনা আসেনি। প্রমাণ মওজুদ থাকার কারণে এটা তাঁর চরিত্রে নিষিদ্ধ ছিল। মুফাসসির আবু হাইয়ান স্বীয় তাফসীর ‘বাহরুল মুহীত্বে’ একথা বলেন। তিনি বলেন, এমতাবস্থায় আয়াতটির বর্ণনা হবে, لولا أن رَّآ برهان ربه لهمَّ بها ‘যদি তিনি তার পালনকর্তার প্রমাণ না দেখতেন, তাহ’লে তার (অর্থাৎ উক্ত মহিলার) ব্যাপারে কল্পনা করতেন’। আলোচ্য আয়াতে لولا (যদি) শর্তের জওয়াব আগেই উল্লেখিত হয়েছে। অর্থাৎ বলা হয়েছে وَهَمَّ بِهَا لَوْلا أَن رَّآ بُرْهَانَ رَبِّهِ ‘আর সেও তার প্রতি কল্পনা করত, যদি না সে স্বীয় পালনকর্তার প্রমাণ অবলোকন করত’। আর সেই ‘বুরহান’ বা প্রমাণ ছিল আল্লাহ নির্ধারিত ‘নফসে লাউয়ামাহ’ অর্থাৎ শাণিত বিবেক, যা তাকে কঠোরভাবে বাধা দিয়েছিল।

আরবী সাহিত্যে ও কুরআনে এ ধরনের বাক্যের বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেমন জান্নাতীগণ বলবেন, وَمَا كُنَّا لِنَهْتَدِيَ لَوْلاَ أَنْ هَدَانَا اللهُ ‘আমরা কখনো সুপথ পেতাম না, যদি না আল্লাহ আমাদের পথ প্রদর্শন করতেন’ (আ‘রাফ ৪৩)। অর্থাৎ لولا أن هدانا اللهُ ما كنا لِنهتديَ ‘যদি আল্লাহ আমাদের হেদায়াত না করতেন, তাহ’লে আমরা হেদায়াত পেতাম না’।

[38]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ১/১৮৬।