আল্লাহ তাআলা বলেন,
كِتَابٌ أَنزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِّيَدَّبَّرُوا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ
অর্থাৎ, আমি এ কল্যাণময় গ্রন্থ তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহ অনুধাবন করে এবং বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিগণ উপদেশ গ্রহণ করে। (সূরা স্বাদ ২৯ আয়াত)
সাহাবাগণ কুরআনের নির্দেশ পালন এবং তার নিষেধ বর্জন করার উপর প্রতিযোগিতা করেছেন। যার ফলে তারা ইহ-পরকালের জন্য পরমসুখী ও সৌভাগ্যবান ছিলেন। মুসলিমরা যখন কুরআনের নির্দেশাবলী ত্যাগ করে বসল এবং কেবল মওতাদের উদ্দেশ্যে, কবরের উপর এবং মৃত্যুর পর কয়েকদিন (আত্মীয়-স্বজনদের সাক্ষাতের কয়েকদিন) পাঠ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখল তখন তাদের মধ্যে লাঞ্ছনা ও বিচ্ছিন্নতা অবতীর্ণ হল। আল্লাহ তাআলার এই বাণী তাদের বাস্তব পরিস্থিতি বর্ণনা করে বলে,
وَقَالَ الرَّسُولُ يَا رَبِّ إِنَّ قَوْمِي اتَّخَذُوا هَٰذَا الْقُرْآنَ مَهْجُورًا
অর্থাৎ, এবং রসূল বলে, হে আমার প্রতিপালক! আমার সম্প্রদায় তো এ কুরআনকে পরিত্যাজ্য মনে করেছে।” (সূরা ফুরক্বান ৩০ আয়াত)
আল্লাহ কুরআন অবতীর্ণ করেছেন জীবিত মানুষদের জন্য, যাতে তারা। তাদের জীবনকে তার নির্দেশানুসারে পরিচালিত করে। সুতরাং কুরআন মৃত মানুষদের জন্য কোন উপকারী বস্তু নয়। যেহেতু তাদের আমল ও কর্ম তো বন্ধ হয়ে গেছে, তাই তারা তা পড়তে (ও শুনতেও) পারে না এবং সে অনুসারে কর্মও করতে পারে না। আর তাদের নিকট কুরআন পাঠের সওয়াবও পৌছে না। অবশ্য আপন ছেলের নিকট হতে সওয়াব তাদের নিকট পৌছে থাকে কারণ ছেলে বাপের স্বকর্ম (ও প্রতিপালনের) ফল। রসূল (সা.) বলেন, “মানুষ মারা গেলে তিনটি বিষয় ছাড়া তার আমল বন্ধ হয়ে যায়; সাদকাহ জারিয়াহ (ইষ্টাপুত কর্ম) তার ফলপ্রসু ইলম এবং সৎসন্তান যে তার জন্য দুআ করে।”
আল্লাহ তাআলা বলেন, (أَن لَّيْسَ لِلْإِنسَانِ إِلَّا مَا سَعَىٰ)। অর্থাৎ, এবং মানুষ তাই পায় যা সে নিজে করে। (সূরা নাজম ৩৯ আয়াত)
ইবনে কাসীর অত্র আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, “যেমন মানুষ অন্যের পাপ বহন করবে না তেমনি সে সেই পূণ্যও লাভ করবে না; যা সে নিজের জন্য স্বয়ং অর্জন করেনি। এই আয়াতে কারীমাহ থেকেই ইমাম শাফেয়ী উদ্ভাবন করেন
যে, কুরআন পাঠের উৎসর্গীকৃত পুণ্য মৃতদের নিকট পৌছেনা। যেহেতু তা তাদের (মওতাদের নিজস্ব আমল বা উপার্জন নয়। এই জন্যই রসূল (সা.) তার উম্মতকে এ বিষয়ে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করেননি এবং স্পষ্টভাবে অথবা ইঙ্গিতেও কোন নির্দেশ দেননি। আর কোন সাহাবী হতেও এর বৈধতা বর্ণিত হয়নি। যদি তাতে কল্যাণ থাকত তাহলে নিশ্চয় তারাই সর্বাগ্রে তা করে যেতেন।
পক্ষান্তরে আল্লাহর সামীপ্যদাতা ইবাদতের ব্যাপারটা শরীয়তের স্পষ্ট উক্তির উপরই সীমাবদ্ধ। এতে নানা প্রকার কিয়াস (অনুমিতি) ও রায়ের চাকা অচল। অবশ্য দুআ ও সাদকাহ মৃতের নিকট পৌছনোর কথা সৰ্ববাদিসম্মত এবং এ বিষয়ে শরীয়তেরও স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে।”
১। মুর্দার নামে কুরআন খানীর’ প্রথা এত ব্যাপক প্রচলিত যে, কুরআন তেলাঅত মরণের নিদর্শন ও চিহ্ন হয়ে দাড়িয়েছে। সুতরাং বেতার-কেন্দ্র থেকে একটানা কুরআন পাঠ শুনতেই পাওয়া যায় না, আর যদি কোন দিন অবিরাম তেলাঅত শুনেন তাহলে জানবেন যে, কোন রাষ্ট্রনায়ক মারা গেছেন। যদি কোন বাড়ি হতে তেলাঅতের শব্দ শুনেন তাহলে জানবেন যে, ঐ বাড়িতে কারো মৃত্যুশোক পালিত হচ্ছে।
একদা এক রোগাগ্রস্ত শিশুর উপর (ঝাড়ার জন্য) জনৈক সাক্ষাৎকারী কুরআন পাঠ করতে লাগলে তার মা চিৎকার করে বলে উঠল, 'আমার ছেলে মারা তো যায়নি, আপনি ওর উপর করআন পড়েন কেন?!
এক মহিলা রেডিও থেকে সূরা ফাতিহা শুনে বলল, আমি সূরাটিকে পছন্দ করি না, কারণ তা আমার মৃত ভাইকে স্মরণ করিয়ে দেয়; যেহেতু ঐ সূরা তার। উপর পড়া হয়েছিল!’ (এ সবের কারণ হল, মানুষ মৃত্যু ও তার আনুষঙ্গিক বিষয়কে অপছন্দ করে।)
২। যে মৃতব্যক্তি তার জীবনকালে নামায ত্যাগ করেছে সে মৃত্যুর পর। কুরআন দ্বারা কিরূপে উপকৃত হতে পারে? অথচ কুরআন তাকে সর্বনাশ ও আযাবের শুভসংবাদ (?) দেয়,
فَوَيْلٌ لِّلْمُصَلِّينَ * الَّذِينَ هُمْ عَن صَلَاتِهِمْ سَاهُونَ
অর্থাৎ, সুতরাং দুর্ভোগ সেই নামাযীদের যারা তাদের নামায সম্বন্ধে উদাসীন। (সূরা মাউন ৪-৫ আয়াত)।
আর এ দুর্ভোগ তো তার, যে নামায ত্যাগ করে না, কিন্তু তা যথাসময় হতে ঢিলে করে (আদায় করে। তাহলে বেনামাযীর দুর্ভোগ কত তা অনুমেয়।)।
৩। “তোমরা তোমাদের মৃত (মরণােন্মুখ) ব্যক্তিদের উপর সূরা ইয়াসীন পাঠ কর।” এই হাদীসটিকে ইবনুল কাত্তান বিশৃঙ্খল, সাহাবীর উক্তি এবং অজ্ঞাতপরিচয় হওয়ার কারণে দুর্বল বলে চিহ্নিত করেছেন। দারাকুত্বনী বলেছেন, হাদীসটি বর্ণনা সূত্রের দিক হতে বিশৃঙ্খল ও মুল উক্তির দিক হতে অজ্ঞাতপরিচয় এবং অশুদ্ধ।
রসূল (সা.) এবং তাঁর সাহাবা কর্তৃকও একথা প্রমাণিত নেই যে, তারা কোন মুর্দার উপর সূরা ইয়াসীন, ফাতেহা বা কুরআনের অন্য কোন সূরা পাঠ করেছেন। বরং মৃতব্যক্তির দাফনকার্য সমাধা করার পর রসূল পুঁই সাহাবাবৃন্দকে বলতেন, “তোমরা তোমাদের ভায়ের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তার জন্য প্রতিষ্ঠিত থাকার ক্ষমতা চাও। কারণ ওকে এক্ষনি প্রশ্ন করা হবে।” (সহীহ, আবু দাউদ প্রমুখ।
৪। দ্বীনের আহবায়ক জনৈক আলেম বলেন, ধিক তোমার প্রতি, হে মুসলিম! তোমার জীবন থাকতে তুমি কুরআনকে ত্যাগ করলে ও তার নির্দেশ অনুযায়ী কর্ম তো করলে না। অবশেষে যখন তোমার মৃত্যুর সময় হল, তখন লোকেরা তোমার উপর সূরা ইয়াসীন পাঠ করল - যাতে তোমার সহজে জীবন যায়। তাহলে কুরআন তোমার জীবনের জন্য অবতীর্ণ হয়েছে নাকি তোমার মরণের জন্য?!’
৫। কবরস্থানে প্রবেশের সময় সূরা ফাতেহা (বা অন্য সূরা) পড়তে হয় - এ কথা রসূল (সা.) সাহাবাকে শিখান নি, বরং তাদেরকে এই দুআ পড়তে শিখিয়েছেন,
السَّلامُ عَلَيكُمْ أَهْل الدِّيارِ مِنَ المُؤْمِنِينَ والمُسْلِمِينَ وَإِنَّا إِنْ شَاءَ اللَّهُ بِكُمْ لاَحِقُونَ أَسْأَلُ اللَّه لَنَا وَلَكُمُ العافِيَةَ
“আসসালামু আলাইকুম আহলাদ দিয়া-রি মিনাল মু'মিনীনা অল মুসলিমীন। অইন্না ইনশাআল্লাহু বিকুম লালা-হিকূন। আআলুল্লা-হা লানা আলাকুমুল আ-ফিয়াহ।”
অর্থাৎ, তোমাদের উপর শান্তি বর্ষণ হোক, হে কবরবাসী মুমিনগণ! আল্লাহ চাইলে আমরা তোমাদের সহিত মিলিত হব। আমি আমাদের এবং তোমাদের জন্য (আযাব হতে) নিরাপত্তা কামনা করি।” (মুসলিম)।
অতএব উক্ত হাদীস আমাদেরকে শিখায় যে, আমরা মৃতব্যক্তিগণের জন্যই দুআ করব, না তাদের নিকট আমরা দুআ করব এবং সাহায্য প্রার্থনা করব।
৬। কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে যাতে জীবিত মানুষদের উপর পঠিত হয়, যারা তা শ্রবণ করে (বুঝে) আমল করতে (বা নেকী অর্জন করতে) সক্ষম। আল্লাহ তাআলা বলেন,
لِّيُنذِرَ مَن كَانَ حَيًّا وَيَحِقَّ الْقَوْلُ عَلَى الْكَافِرِينَ
অর্থাৎ, (এ তো এক উপদেশ ও সুস্পষ্ট কুরআন;) যাতে (রসূল (সা.) দ্বারা) জীবিত ব্যক্তিকে সতর্ক করতে পারে এবং কাফেরদের বিরুদ্ধে শাস্তির কথা। সাব্যস্ত হয়। (সূরা ইয়াসীন ৭০ আয়াত)
কিন্তু মৃতরা তা শুনতেই পায় না এবং তারা এর দ্বারা আমল করবে তাও অসম্ভব। হে আল্লাহ! রসূল (সা.)-এর পদ্ধতি-অনুসারে আমাদেরকে কুরআন অনুযায়ী কর্ম করার প্রেরণা ও শক্তি দান কর। (আমীন)।