অধিকাংশ ‘ঈদে-মীলাদুন-নবী (সা.)’র অনুষ্ঠানে যা ঘটে থাকে তা গর্হিত, বিদআত, এবং শরীয়তের বিরুদ্ধাচরণ, এর অন্যথা নয়। পক্ষান্তরে এই ঈদে মীলাদ রসূল ধ্রু, তাঁর সাহাবাবৃন্দ, তাবেয়ীবর্গ, চার ইমামগণ এবং শ্রেষ্ঠতম (প্রারম্ভিক) শতাব্দীগুলির অন্য কেউই পালন করে যাননি। আর এর সপক্ষে কোন শরয়ী প্রমাণ ও নেই।
১। মীলাদ-উদ্যোক্তারা অধিকাংশ শির্কে আপতিত হয়ে থাকে। যেহেতু এতে তারা শির্কী নাত ও গজল আবৃত্তি করে থাকে। যেমন, হে আল্লাহর রসূল! মদদ ও সাহায্য হে আল্লাহর রসূল! আপনার উপরেই আমার ভরসা। হে আল্লাহর রসূ! আমাদের সঙ্কট দূর করুন,
সঙ্কট তো আপনাকে দেখলেই সরে পড়ে!! এ কথা যদি রসূল ধ্ৰু শুনতেন, তাহলে নিশ্চয় তিনি তা শির্কে আকবর বলে অভিহিত করতেন। যেহেতু সাহায্য, মদদ ও সঙ্কটমুক্ত করা একমাত্র আল্লাহর কাজ এবং ভরসাস্থলও একমাত্র তিনিই। আল্লাহ তাআলা বলেন,
أَمَّن يُجِيبُ الْمُضْطَرَّ إِذَا دَعَاهُ وَيَكْشِفُ السُّوءَ
অর্থাৎ, অথবা কে আর্তের আহবানে সাড়া দেয় যখন সে তাকে ডাকে এবং বিপদ-আপদ দূরীভূত করে? (এবং কে তোমাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করে? আল্লাহর সঙ্গে কোন উপাস্য আছে কি?) (সূরা নামল ৬২ আয়াত)
আল্লাহ তাঁর রসূলকে আদেশ করেন যে,
قُلْ إِنِّي لَا أَمْلِكُ لَكُمْ ضَرًّا وَلَا رَشَدًا
অর্থাৎ, বল, ‘আমি তোমাদের ইষ্ট-অনিষ্টের মালিক নই?' (সূরা জিন ২১ আয়াত)।
আর নবী (সা.) বলেন, “যখন (কিছু) চাইবে তখন আল্লাহরই নিকট চাও এবং যখন সাহায্য প্রার্থনা করবে তখন আল্লাহরই নিকট কর।” (তিরমিযী, আর তিনি হাদীসটিকে হাসান সহীহ বলেছেন।)
২। অধিকাংশ মীলাদে রসূল (সা.)-এর প্রশংসায় সীমালংঘন, অতিরঞ্জন ও বাড়াবাড়ি থাকে; অথচ নবী (সা.) তা নিষিদ্ধ করেছেন। তিনি বলেন, “তোমরা আমার প্রশংসায় অতিরঞ্জন করো না, যেমন খ্রিষ্টানরা মারয়্যাম পুত্র (ঈসার) করেছে। যেহেতু আমি তো একজন দাস মাত্র, অতএব তোমরা আমাকে আল্লাহর দাস ও তাঁর রসূল’ই বলো।” (বুখারী)
৩। উরস, মীলাদ প্রভৃতি অনুষ্ঠানে উল্লেখ করা হয় যে, আল্লাহ তাঁর নুর (জ্যোতি) হতে মুহাম্মাদকে সৃষ্টি করেছেন এবং তার (মুহাম্মদের) নূর হতে সকল বস্তু সৃষ্টি করেছেন। পরন্তু কুরআন তাদের এই কথাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। আল্লাহ বলেন,
قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ يُوحَىٰ إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَٰهُكُمْ إِلَٰهٌ وَاحِدٌ
অর্থাৎ, বল, আমি তো তোমাদেরই মত একজন মানুষ; আমার প্রতি প্রত্যাদেশ (ওহী) হয় যে, তোমাদের উপাস্য একমাত্র উপাস্য। (সূরা কাহফ ১১০ আয়াত)
আবার একথা সর্বজনবিদিত যে, রসূল (সা.) অন্যান্য মানুষের মতই পিতামাতার ঔরস হতেই সৃষ্টি। কিন্তু তিনি ছিলেন আল্লাহর তরফ হতে ওহী দ্বারা মনোনীত ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মানুষ।
তদনুরূপ মীলাদে বলা হয় যে, আল্লাহ মুহাম্মাদের জন্যই জগৎ সৃষ্টি করেছেন।(এ বিষয়ে হাদীসগুলো জাল ও গড়া।) অথচ কুরআন এ কথাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। আল্লাহ বলেন,
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ
অর্থাৎ, আমি জিন ও মানুষকে একমাত্র আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি। (সূরা যারিয়াত ৫৬ আয়াত)
৪। খ্রিষ্টানরা খ্রিষ্টের জন্মোৎসব (মীলাদ) এবং তাদের পরিবারের প্রত্যেক ব্যক্তির জন্মদিন (বার্থডে’) পালন করে থাকে। মুসলিমরা এই বিদআত ওদের নিকট হতেই গ্রহণ করে নিয়েছে। তাই এরাও ওদের মত নবী (সা.)দিবস (ঈদে মীলাদুন নবী (সা.)) এবং পরিবারের সভ্যদের (বিশেষ করে শিশুদের) 'হ্যাপি বার্থ ডে’র অনুষ্ঠান উদ্যাপন করে। অথচ তাদের রসূল তাদেরকে সাবধান করে বলেন, “যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য অবলম্বন করে সে তাদেরই একজন।” (সহীহ আবু দাউদ)
৫৷ এই নবী (সা.)দিবস উপলক্ষে কৃত অনুষ্ঠানে বেশীর ভাগই নারী-পুরুষ ও যুবক-যুবতীর অবাধ মিলামিশা ঘটে থাকে; অথচ এ কাজকে ইসলাম অবৈধ। ঘোষণা করেছে।
৬। নবী দিবস উদ্যাপনের সাজ-সরঞ্জাম যেমন; রঙিন কাগজ, মোমবাতি প্রভৃতি আড়ম্বরে (সারা বিশ্বে) যে অর্থ খরচ করা হয় তা কয়েক মিলিয়নে গিয়ে পৌছে থাকে। অথচ পরে ঐ সব সাজ-সরঞ্জাম অনর্থক পানিতে ফেলে দেওয়া হয়। এতে লাভবান হয় তো শুধু কাফেররা; যারা তাদের দেশ হতে আমদানীকৃত ঐ সাজ-সরঞ্জামের মূল্য কুক্ষিগত করে। পক্ষান্তরে রসূল (সা.) অর্থ নষ্ট করতে নিষেধ করেছেন।
৭। এই উপলক্ষে মঞ্চাদি বানাতে ও সাজাতে লোকেরা যা সময় নষ্ট করে তাতে অনেকে নামাযও ত্যাগ করতে বাধ্য হয়; যেমন আমি লক্ষ্য করেছি।
৮ অভ্যাসগত ভাবে মীলাদের শেষে লোকেরা উঠে দাঁড়িয়ে যায় (কিয়াম করে)। কেননা, তাদের অনেকের বিশ্বাস যে, রসূল (সা.) মীলাদ অনুষ্ঠানে (এর শেষে?) উপস্থিত হন। অথচ এমন বিশ্বাস স্পষ্ট অলীক। কারণ আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمِن وَرَائِهِم بَرْزَخٌ إِلَىٰ يَوْمِ يُبْعَثُونَ
অর্থাৎ, ওদের (পরলোকগত ব্যক্তিদের) সম্মুখে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত বারযাখ থাকবে। (সূরা মু'মিনুন ১০০ আয়াত) (বারযাখ, অর্থাৎ ইহকাল ও পরকালের মাঝে এক যবনিকা।)। আনাস বিন মালেক (রাঃ) বলেন, “ওঁদের (সাহাবাদের) নিকট রসূল (সা.) প্রক্ট অপেক্ষা অন্য কেউ অধিক প্রিয় (ও শ্রদ্ধেয়) ছিল না। ওঁরা যখন তাঁকে দেখতেন তখন তার জন্য উঠে দাঁড়াতেন না। কারণ এতে তাঁর অপছন্দনীয়তার কথা তারা জানতেন।” (সহীহ আহমদ ও তিরমিযী)।
৯৷ ওদের অনেকে বলে থাকে, 'আমরা মীলাদে রসূল (সা.)-এর জীবনচরিত আলোচনা করি। কিন্তু বাস্তবে ওরা এমন সব করে ও বলে যা তার বাণী ও চরিতের পরিপন্থী। পক্ষান্তরেআসলনবী (সা.)র প্রেমিক তো সেই ব্যক্তিইযে বৎসরান্তে একবার নয়, বরং প্রত্যহ তার জীবন-চরিত আলোচনা ও পাঠ করে। পরন্তু রবিউল আওয়াল; যে মাসে (এবং অনেকের মতে, যে দিনে) তাঁর জন্ম। ঠিক সেই মাসেই (ও সেই দিনেই) তাঁর মৃত্যু। সুতরাং তাতে শোক-পালনের চেয়ে আনন্দ প্রকাশ নিশ্চয় উত্তম নয়।
১০৷ অধিকাংশ মীলাদভক্তরা ঐ তারীখে অর্ধরাত্রি (বরং তারও অধিক) পর্যন্ত জাগরণ করে থাকে ফলে কমপক্ষে ফজরের নামায জামাআতে না পড়ে নষ্টই করে ফেলে অথবা তাদের নামাযই ছুটে যায়।
১১। ঈদে মীলাদ বহু সংখ্যক লোক উদযাপন করে থাকলেও (সত্য নিরূপণে) সংখ্যাধিক্য বিবেচ্য নয়। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَإِن تُطِعْ أَكْثَرَ مَن فِي الْأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَن سَبِيلِ اللَّهِ
অর্থাৎ, আর যদি তুমি দুনিয়ার অধিকাংশ লোকের কথামত চল, তবে তারা তোমাকে আল্লাহর পথ হতে বিচ্যুত করে ফেলবে। (সূরা আনআম ১১৬ আয়াত)।
হুযাইফা বলেন, প্রত্যেক বিদআতই ভ্রষ্টতা, যদিও সকল লোকে তা সৎকর্ম। বলে ধারণা (বা আমল) করে থাকে।
১২। হাসান বাসরী বলেন, অতীতে অল্প সংখ্যক মানুষই আহলে সুন্নাহ ছিল এবং ভবিষ্যতেও তারা অপই থাকবে। যারা বিলাসিতায় বিলাসীদের সঙ্গী হয় না এবং বিদআতে বিদআতীদের সাথী হয় না। তাদের প্রতিপালকের সহিত সাক্ষাৎ-কাল পর্যন্ত তারা নিজস্ব নীতি (সুন্নাহর) উপর ধৈর্য ধারণ করে। অতএব এরকমই তোমরাও হও।
১৩৷ শাম (সিরিয়া)তে সর্বপ্রথম ঈদে মীলাদ (নবী (সা.)দিবস) আবিষ্কার করেন শাহ মুযাফফর ঠিক হিজরী সপ্তম শতাব্দীর গোড়ার দিকে। মিসরে সর্বপ্রথম চালু করে ফাতেমীরা; যাদের প্রসঙ্গে ইবনে কাসীর বলেন, 'তারা ছিল কাফের, ফাসেক ও পাপাচারী।”