যে ইবাদত করার জন্য আল্লাহ বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন, সেই ইবাদতে আল্লাহকে একক ও অদ্বিতীয় জানা ও মানার নাম তওহীদ। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ
অর্থাৎ, আমার ইবাদতের জন্যই আমি মানুষ এবং জিনকে সৃষ্টি করেছি।(১) (সূরা যারিয়াত ৫৬ আয়াত) (অর্থাৎ আমি ওদেরকে কেবল এই জন্যই সৃষ্টি করেছি। যে, ওরা ইবাদতের যোগ্য হিসাবে আমাকেই একক বলে মানবে এবং দুআ ও প্রার্থনার স্থল হিসাবে আমাকেই অদ্বিতীয় স্বীকার করবে।)
কুরআন কারীম হতে সংগৃহীত তওহীদের প্রকরণ নিম্নরূপঃ
১৷ তওহীদুর রব্ব (প্রতিপালক বিষয়ে একত্ববাদ); আর তা হল এই কথার স্বীকার যে, আল্লাহই বিশ্বজাহানের স্রষ্টা ও প্রতিপালক। অবশ্য একথা কাফেরদলও স্বীকার করেছে; কিন্তু এ স্বীকারোক্তি তাদেরকে ইসলামে প্রবিষ্ট করেনি। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلَئِن سَأَلْتَهُم مَّنْ خَلَقَهُمْ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ
অর্থাৎ, যদি তুমি ওদেরকে জিজ্ঞাসা কর যে, কে ওদেরকে সৃষ্টি করেছে? তাহলে অবশ্যই ওরা বলবে, 'আল্লাহ।' (সূরা যুখরুফ ৮৭ আয়াত)
বর্তমান যুগে কমিউনিষ্টরা প্রতিপালক (আল্লাহর) অস্তিত্বকে অস্বীকার ও অবিশ্বাস করে, তাই তারা জাহেলিয়াতের কাফেরদের চেয়েও বড় কাফের।
২। তওহীদুল ইলাহ (উপাস্য বিষয়ে একত্ববাদ); আর তা হল সকল। প্রকার বিধিবদ্ধ ইবাদত -যেমন, দুআ ও প্রার্থনা, সাহায্য প্রার্থনা, তওয়াফ, যবেহ, নযর ইত্যাদিতে আল্লাহকে একক মান্য করা। এই প্রকার তওহীদকেই কাফের দল অস্বীকার করেছিল, এবং এই তওহীদ নিয়েই নুহ (আঃ) থেকে মুহাম্মাদ (সা.) পর্যন্ত সমস্ত রসূল ও তাদের উম্মতের মাঝে দ্বন্দ্ব ও বিবাদ ছিল। কুরআন কারীমের অধিকাংশ সূরাসমূহে এই তওহীদ এবং একমাত্র আল্লাহকেই (বিপদে-আপদে) ডাকা ও তাঁরই নিকট প্রার্থনা করার উপর মানুষকে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। যেমন সূরা ফাতেহায় আমরা পড়ে থাকি,
إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ
অর্থাৎ, আমরা কেবল তোমারই ইবাদত করি, তাই তোমাকেই কেবল আহবান করি এবং তুমি ব্যতীত আর কারো নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি না।
একমাত্র আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা, কুরআন দ্বারা মীমাংসা ও রাষ্ট্র পরিচালনা করা, শরীয়তের নিকটেই নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচারপ্রার্থী হওয়া, এ সব কিছু তওহীদুল ইলাহের শামীল। আর এর প্রত্যেকটাই আল্লাহর এই বাণীর আওতাভুক্ত যাতে তিনি বলেন,
إِنَّنِي أَنَا اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدْنِي
অর্থাৎ, নিশ্চয় আমি আল্লাহ, আমি ভিন্ন আর কোন (সত্য) উপাস্য নেই, সুতরাং তুমি আমারই উপাসনা কর। (সূরা ত্বহা ১৪ আয়াত)
৩৷ তওহীদুল আসমা-ই অসিফাত (আল্লাহর নাম ও গুণাবলী বিষয়ে একত্ববাদ); আর তা হল, কুরআন কারীম এবং সহীহ হাদীসে বর্ণিত সেই সমস্ত সিফাত বা গুণ, যার দ্বারা আল্লাহ নিজেকে গুণান্বিত করেছেন অথবা তার রসূল (সা.) তার জন্য বর্ণনা করেছেন তা বাস্তব ও প্রকৃত ভেবে, কোন প্রকারে তার অপব্যাখ্যা না করে, কোন উদাহরণ ও দৃষ্টান্ত কল্পনা না করে এবং তার প্রকৃতার্থ ‘জানি না’ বলে সে বিষয়ে আল্লাহকে ভারার্পণ না করে ঈমান ও প্রত্যয় রাখা। যেমন আল্লাহর আরশে আরোহণ, রাত্রির শেষ তৃতীয়াংশে পৃথিবীর আকাশে তাঁর অবতরণ, তার হস্ত, তার আগমন ইত্যাদি গুণ। আমরা এ সবের সেই রূপ ব্যাখ্যা করব যে রূপ সলফ কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে। যেমন তাবেয়ীন কর্তৃক তাঁর সমারূঢ় হওয়ার ব্যাখ্যা সহীহ বুখারীতে বর্ণিত; আর তা এই যে, তিনি সারা সৃষ্টির উর্ধে আরশের উপরে সমারূঢ়। যেমনঃ তার মহিমা ও মহত্বের উপযুক্ত (এবং তা কারো সদৃশ নয়)। আল্লাহ তাআলা বলেন,
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ ۖ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ
অর্থাৎ, তার সদৃশ কোন কিছুই নেই এবং তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। (সূরা শুরা ১১ আয়াত)
ক। তা'বীলঃ আয়াত ও সহীহ হাদীসের স্পষ্ট অর্থকে ভিন্ন কোন অসঙ্গত ও বাতিল অর্থে পরিবর্তন করাকে বলা হয়। যেমন, আল্লাহ আরশে সমারূঢ় আছেন। এর অর্থ এই করা যে, তিনি সার্বভৌম ক্ষমতা বা কর্তৃত্বের অধিকারী।”
খা। তা’ত্বীল (অর্থহীন, নিস্ক্রিয় বা বিরহিতকরণ): আল্লাহর গুণাবলীকে। অস্বীকার করা এবং তাঁকে (ঐ সমস্ত) গুণবিহীন ভাবাকে বলে। যেমন, আল্লাহর আকাশের উর্ধে অবস্থানকে কিছু ভ্রষ্ট ফির্কাহ অস্বীকার করে ও বলে, 'আল্লাহ সকল স্থানেই আছেন!’ (বা আল্লাহ মুমিনের হৃদয়ে আছেন।)
গ। তাকয়ীফ (কেমনত্ব বর্ণনা করা): আল্লাহর গুণাবলীর কেমনত্ব বর্ণনা করাকে বলে। যেমন বলা, তার রকমত্ব (হস্ত-পদ প্রভৃতি) এই রূপ।” সুতরাং আরশের উপর আল্লাহর আরোহণ করা তার কোন সৃষ্টির আরোহন করার মত নয় এবং তাঁর আরোহণ করার কেমনত্ব তিনি ব্যতীত আর কেউ জানে না।
ঘ। তামষীল (নমুনা বা দৃষ্টান্ত বর্ণনা করা): সৃষ্টির গুণাবলীর দ্বারা আল্লাহর গুণাবলীর দৃষ্টান্ত দেওয়া অথবা তার গুণাবলীকে সৃষ্টির গুণাবলীর সহিত তুলনা করা। সুতরাং এ বলা বৈধ নয় যে, আমাদের অবতরণ করার মত আল্লাহ আকাশের প্রতি অবতরণ করেন। অবতরণের হাদীসটিকে মুসলিম বর্ণনা করেছেন।
আল্লাহর গুণকে সৃষ্টির গুণের সদৃশ ভাবার কথা শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহর প্রতি আরোপ করা এক মিথ্যা অপবাদ। যেহেতু আমরা তার গ্রন্থাবলীতে একথার সত্যতার প্রমাণ পাইনি। বরং তিনি এই তাশবীহ ও তামষীলের (আল্লাহর গুণাবলী সৃষ্টির অনুরূপ হওয়ার কথা) খণ্ডন করেছেন এটাই আমরা পেয়েছি।
ঙ। তাফীয’ (ভারার্পণ করা): সলফগণ আল্লাহর গুণাবলীর কেমনত্ব বিষয়ের জ্ঞান তার প্রতি সমর্পণ করেন এবং ঐ গুণাবলীর অর্থ বিষয়ক জ্ঞান তাঁর প্রতি সমর্পণ করেন না (যেহেতু সে সবের অর্থ তাদের নিকট স্পষ্ট ও বিদিত এবং কেমনত্ব অবিদিত)। উদাহরণ স্বরূপ (استوى) ইসতিওয়া’ (আরোহণ করা) এর অর্থ কোন কিছুর ঊর্ধে অবস্থান বা আরোহণ করা যার কেমনত্ব আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানে না।