ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে বিশুদ্ধ তওহীদ বাস্তবায়িত হলে তাতে উৎকৃষ্টতম ফল লাভ হয়। এর কিছু ফল নিম্নরূপ :
১। আল্লাহ ছাড়া বিভিন্ন বস্তু, ব্যক্তি বা সৃষ্টির পদানতি ও দাসত্ব থেকে মানুষের মুক্তি'; যে সৃষ্টি কোন কিছু সৃজন করতে পারে না বরং তারা নিজেই সৃষ্ট; যারা নিজেদের মঙ্গলামঙ্গলের মালিক নয় এবং জীবন, মৃত্যু ও পুনরুত্থানের উপরেও কোন ক্ষমতা রাখে না। সুতরাং তওহীদ সুঠাম আকৃতিতে সৃষ্টিকর্তা প্রতিপালক ছাড়া অন্য সকল কিছুর দাসত্ব হতে মানুষকে স্বাধীনতা দান করে। বাতিল চিন্ত-ধারা ও কুসংস্কার হতে মস্তিষ্ক মুক্ত করে। পদানতি, হীনতা ও পরবশ্যতা হতে হৃদয়-মনকে অব্যাহতি দেয় এবং সর্বপ্রকার ফেরাউন, বাতিল প্রভু, গণকদল ও আল্লাহর বান্দাদের উপর খোদায়ী দাবীদারদের আধিপত্য। হতে মানব জীবনকে নিস্কৃতি দেয়। তাই তো মুশরিক (অংশীবাদী)দের দলপতিরা এবং জাহেলিয়াতের দুর্দম স্বেচ্ছাচারীরা সাধারণভাবে সকল আম্বিয়ার ও বিশেষভাবে শেষ রসূল (সা.) এর দাওয়াতের ঘোর বিরোধিতা করেছে এবং তা প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে। যেহেতু তারা জানত যে, ‘লা ইলাহার অর্থই হচ্ছে মানুষের মুক্তি, মিথ্যা সিংহাসন হতে পরাক্রমশালীদেরকে বিচ্যুতকরণ এবং মুমিনদের সেই ললাটসমুহ সুউন্নতকরণের এক সাধারণ ঘোষণা, যে ললাটসমূহ একমাত্র বিশ্বজাহানের মহান প্রতিপালক ছাড়া অন্য কিছুর নিকট অবনত হয় না।
২। ভারসাম্যপূর্ণ সুসমঞ্জস ব্যক্তিত্ব গঠন। তওহীদ সুসমঞ্জস ব্যক্তিত্ব-গঠনে। সহায়তা করে; যে ব্যক্তিত্বের গতিমুখ ও লক্ষ্য জীবনে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এবং যার উদ্দেশ্য ও গন্তব্যস্থলও একটাই। তাই তার একক উপাস্য ব্যতীত আর কোন উপাস্য নেই। নির্জনে ও প্রকাশ্যে সে যার অভিমুখী এবং সুখে ও দুখে যাকে সে আহবান করে থাকে। পক্ষান্তরে মুশরিক, যার অন্তরকে অসংখ্য উপাস্য ও মাবুদ বিভক্ত করে নিয়েছে। ফলে কখনো সে জীবিতের মুখাপেক্ষী হয় আবার কখনো মৃতের। এরই দিকে লক্ষ্য করে হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম বলেছিলেন,
يَا صَاحِبَيِ السِّجْنِ أَأَرْبَابٌ مُّتَفَرِّقُونَ خَيْرٌ أَمِ اللَّهُ الْوَاحِدُ الْقَهَّارُ
অর্থাৎ, হে কারা-সঙ্গীদ্বয়! ভিন্ন ভিন্ন একাধিক প্রতিপালক শ্রেয়, নাকি এক পরাক্রমশালী আল্লাহ? (সূরা ইউসুফ ৩৯ আয়াত)
সুতরাং মুমিন একই উপাস্যের উপাসনা করে। সে জানে যে, কি তাকে সন্তুষ্ট করে এবং কি অসন্তুষ্ট করে। তাই সে ঐ কর্মই করে, যাতে তিনি সন্তুষ্ট এবং এতে তার হৃদয় প্রশান্ত থাকে। আর মুশরিক বহু সংখ্যক মাবুদের ইবাদত করে; একজন তাকে ডানে নিয়ে যেতে চায় এবং অপরজন বামে। ফলে সে সবার মাঝে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত ও অস্বচ্ছন্দ হয়ে পড়ে, যার কোন স্থিরতা থাকে না।
৩। তওহীদ নিরাপত্তার উৎস। যেহেতু তওহীদ তওহীদবাদীর হৃদয়কে নিরাপত্তা ও শান্তিতে পরিপূর্ণ করে দেয়। তাই সে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকেও ভয় করে না। রুজী-রুটি, নিজের আত্মা ও আত্মীয়-পরিজনের উপর ভয়ের সমস্ত ছিদ্রপথ সে বন্ধ করে থাকে। মানুষ, জিন, মৃত্যু ইত্যাদি হতে ভয় এবং আরো অন্যান্য সকল ভয় হতে সে নির্ভয় থাকে। কারণ তওহীদবাদী মুমিন একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কাউকেও ভয় করে না। তাই আপনি তাকে দেখবেন যে, মানুষ যখন ভীত-সন্ত্রস্ত তখন সে অকুতোভয় এবং সকলে যখন উদ্বিগ্ন ও অস্থির তখন সে প্রশান্ত ও স্থিরচিত্ত।
এই অর্থের প্রতিই কুরআন করীমে ইঙ্গিত করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
الَّذِينَ آمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُم بِظُلْمٍ أُولَٰئِكَ لَهُمُ الْأَمْنُ وَهُم مُّهْتَدُونَ
অর্থাৎ, যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানকে অন্যায় (শিক) দ্বারা কলুষিত করেনি তাদের জন্যই তো রয়েছে নিরাপত্তা এবং তারাই সুপথপ্রাপ্ত। (সূরা আনআম ৮২ আয়াত)
অবশ্য এই নির্বিঘ্নতা চিত্তের অভ্যন্তর হতে নিঃসৃত ও অনুভূত হয়, প্রহরীর প্রহরা হতে নয়। আর এটা হল ইহলৌকিক নিরাপত্তা। পরন্তু পারলৌকিক নিরাপত্তা তো সর্ববৃহৎ ও চিরস্থায়ী। কারণ তারা কেবল আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ ও বিশুদ্ধ-চিত্ত এবং তারা তাদের তওহীদকে শির্কের কলুষ দ্বারা সংমিশ্রিত করেনি। যেহেতু শির্ক করা বড় যুম্ন।
৪। তওহীদ আত্মিক শক্তির উৎপত্তিস্থল। যেহেতু তওহীদ তওহীদবাদীকে দুর্দান্ত আধ্যাত্মিক ও সামাজিক বল দান করে। কারণ তার আত্মা-মন আল্লাহর সকাশে আশা, আস্থা, ভরসা, তার লিখিত ভাগ্যের উপর সন্তুষ্টি, তাঁর তরফ হতে আগত বিপদের উপর ধৈর্য, তার সৃষ্টি হতে অমুখাপেক্ষিতা দ্বারা পরিব্যাপ্ত। তাই সে পর্বতের ন্যায় সুদৃঢ় অটল। পরন্তু যখন তার উপর কোন বিপদ আসে তখন সে স্বীয় প্রভুর নিকট তা হতে উদ্ধার চায়। আর কোন মৃতের নিকট বিপদ মুক্তি চায় না। যেহেতু তার আদর্শ বচন হল, নবী (সা.) ঐক-এর এই বাণী “যখন তুমি কিছু চাইবে তখন আল্লাহরই নিকট চাও এবং সাহায্য। প্রার্থনা করলে আল্লাহরই নিকট কর।” (তিরমিযী, তিনি বলেন, হাসান সহীহ) এবং আল্লাহ তাআলার এই বাণী,
وَإِن يَمْسَسْكَ اللَّهُ بِضُرٍّ فَلَا كَاشِفَ لَهُ إِلَّا هُوَ
অর্থাৎ, আর আল্লাহ যদি তোমাকে বিপদে ফেলেন তাহলে তিনি ছাড়া তা মোচনকারী আর কেউ নেই। (সূরা আনআম ১৭ আয়াত)
৫। তওহীদ ভ্রাতৃত্ব এবং সাম্যের মূল ভিত্তি। যেহেতু তওহীদ তওহীদবাদীদেরকে একথার অনুমতি দেয় না যে, তারা আল্লাহকে ছেড়ে একে অপরকে নিজেরদের প্রভু বানিয়ে নিক। কারণ উপাস্যত্বের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ এবং সমগ্রমানবকুল ও তার শীর্ষস্থানে মুহাম্মদ ও তাঁর রসূল (সা.) এবং নির্বাচিত ও মনোনীত নবী (সা.) ও তাঁর দাস। (ডক্টর ইউসূফ আল-কারযাবীর গ্রন্থ ‘হাকীকাতুত তাওহীদ’ হতে কিছু রদবদলের সহিত সংগৃহীত)